শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ১০:২৬

শিশুদের জন্যে চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের অর্ধশতকব্যাপী দাতব্য চিকিৎসাসেবা

উজ্জ্বল হোসাইন
শিশুদের জন্যে চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের অর্ধশতকব্যাপী দাতব্য চিকিৎসাসেবা

চাঁদপুর জেলা তার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মানবিক কর্মকাণ্ডের জন্যে সুপরিচিত। এক সময়ে চাঁদপুরকে রোটারীর শহর বলা হতো। নানা সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে মানুষের কল্যাণে অসংখ্য কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এ জেলায়। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো : চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের দাতব্য চিকিৎসা কার্যক্রম। প্রায় অর্ধশতক ধরে তারা চাঁদপুর শহর ও শহরসংলগ্ন এলাকার শিশুদের জন্যে নীরবে, নিরলসভাবে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছে।

প্রায় ৫০ বছর আগে চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ডা. নুরুর রহমানের হাত ধরে ক্লাবের এ উদ্যোগ শুরু হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিলো নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের স্বল্প খরচে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা। কারণ চিকিৎসার খরচ সাধারণ মানুষের জন্যে সব সময়ই এক বড়ো বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে গ্রামের অসহায় পরিবারগুলো তাদের শিশুদের চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেক সময় অর্থাভাবে দিশেহারা হয়ে পড়ে। এ বাস্তবতা উপলব্ধি করেই রোটারী ক্লাবের সদস্যরা এই মহৎ কর্মসূচি হাতে নেন।

প্রতি শুক্রবার দুপুর ২টা থেকে বিকেল পর্যন্ত চাঁদপুর শহরের কবি নজরুল সড়কস্থ রোটারী ভবনে এই দাতব্য চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের অন্যান্য সেবামূলক কাজের পাশাপাশি এখানে ০ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের মাত্র ৩০ টাকা ফি দিয়ে ক্লাবের অভিজ্ঞ চিকিৎসকগণ সেবা প্রদান করেন। অর্থাৎ সাধারণ হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যেখানে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যেতে কয়েকশ’ টাকা খরচ হয়, সেখানে দরিদ্র পরিবারগুলো মাত্র ৩০ টাকায় সেবা পাচ্ছে।

সবচেয়ে বড়ো বিষয় হলো, এখানে চিকিৎসা নেয়ার পর শিশু রোগীদের বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়া হয়। অনেক সময় অ্যান্টিবায়োটিক, স্যালাইন বা শিশুর সাধারণ চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধগুলোও রোগীদের হাতে তুলে দেয়া হয়। ফলে দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্যে এটি আশীর্বাদস্বরূপ।

প্রতি শুক্রবার এখানে গড়ে শতাধিক শিশু চিকিৎসাসেবা নেয়। অনেক সময় রোগীর সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। শিশুদের নানা রোগ যেমন সর্দি-কাশি, জ্বর, ডায়রিয়া, পেটব্যথা, নিউমোনিয়া, চর্মরোগসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে অভিভাবকরা আসেন। অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সঠিক পরামর্শ ও ফ্রি ওষুধে শিশুরা সুস্থ হয়ে উঠে।

গত কয়েক বছর এ উদ্যোগের সাথে যুক্ত আছেন চাঁদপুরের স্বনামধন্য চিকিৎসক, অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন রোটা. ডা. এমজি ফারুক ভূঁইয়া এবং রোটা. ডা. এসএম সহিদ উল্লাহসহ আরো অনেকে। তাঁরা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এই চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৯০-১০০ জন রোগী দেখেন। তাঁদের এই মানবিক কর্মকাণ্ড চাঁদপুরবাসীর কাছে বিশেষভাবে প্রশংসিত হচ্ছে।

চিকিৎসাসেবা নিতে আসা অনেক অভিভাবক বলেন, সরকারি হাসপাতালের ভিড় এবং প্রাইভেট ক্লিনিকের ব্যয়বহুল চিকিৎসার কারণে তারা সমস্যায় থাকেন। এখানে এসে স্বল্প খরচে ওষুধসহ সেবা পাওয়ায় তারা স্বস্তি পান। অনেকেই জানান, অন্য কোথাও গেলে শুধু ডাক্তার দেখাতেই ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার ওষুধ কিনতে হয়। অথচ রোটারী ক্লাবের দাতব্য চিকিৎসালয়ে তারা নামমাত্র খরচে সন্তানের চিকিৎসা করাতে পারছেন।

এ উদ্যোগ শুধু চিকিৎসাসেবাই নয় বরং সামাজিক দায়বদ্ধতার দৃষ্টান্ত। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এতে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। বিশেষ করে নবীন প্রজন্মের কাছে এই বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে যে, সামর্থ্য থাকলে সমাজের জন্যে কাজ করতে হবে। রোটার‌্যাক্ট ক্লাবের অনেক তরুণ সদস্য রোটারী ক্লাবের এই কার্যক্রমে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুক্ত হচ্ছেন। তারা রোগীদের লাইন ম্যানেজ করা, ওষুধ বিতরণ, রেজিস্ট্রেশনসহ নানা কাজে সহায়তা করছেন।

চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের অর্ধশতকের এই কার্যক্রম নিঃসন্দেহে মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যেখানে চিকিৎসা খাতে দিন দিন বাণিজ্যিকতার প্রবণতা বাড়ছে, সেখানে এমন একটি কার্যক্রম মানুষকে ভরসা দেয়। রোটারীর চিকিৎসকরা দেখিয়ে দিচ্ছেন, অর্থই সব নয়, মানবসেবাই প্রকৃত চিকিৎসকের মূল দায়িত্ব।

রোটারী ক্লাবের বর্তমান সভাপতি রোটা. মো. মোস্তফা ফুল মিয়া ও সচিব রোটা. নাজিমুল ইসলাম এমিল জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে এই সেবার পরিধি আরও বাড়ানো হবে। এছাড়া দরিদ্র পরিবারের শিশুদের টিকা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পুষ্টি বিষয়ক পরামর্শ দেয়ার উদ্যোগও নেয়া হতে পারে। চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের সদস্যদের এই দীর্ঘ ৫০ বছরের দাতব্য চিকিৎসা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে, ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। সমাজের অসহায় মানুষদের জন্যে এটি আশার আলো হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের জন্যে এই উদ্যোগ সত্যিই ব্যতিক্রমী। মানবিক চিকিৎসক ডা. এমজি ফারুক ভূঁইয়ার আত্মনিবেদন এবং ডা. এস এম সহিদ উল্লাহর অকুণ্ঠ সহযোগিতা সহ অন্য রোটারিয়ানদের নিরলস সেবা এবং রোটারী ক্লাবের নীরব অবদান চাঁদপুরবাসীর কাছে অমূল্য হয়ে থাকবে।

আমরা প্রত্যাশা করি, দেশের অন্যান্য স্থানে এমন দাতব্য চিকিৎসা কার্যক্রম আরও ছড়িয়ে পড়ুক। মানবিক ডাক্তার এবং মানবিক সংগঠনগুলোই পারে সমাজকে সুস্থ ও সুন্দর পথে এগিয়ে নিতে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়