প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:০৬
প্রশ্বাস কষ্ট বা ডিজনিয়া
নিঃশ্বাস ও প্রশ্বাসের যুগপৎ সার্থকতা হলো জীবন। জীবন হচ্ছে দমের খেলা। দম ফুরালে জীবনও ফুরায়। আমরা প্রশ্বাস নিই আর নিঃশ্বাস ছাড়ি। প্রশ্বাস বায়ুতে থাকে অক্সিজেনের আধিক্য আর নিঃশ্বাস বায়ুতে থাকে কার্বন ডাই-অক্সাইডের আধিক্য। স্বাভাবিক প্রশ্বাসে ব্যক্তির কোন কষ্ট হয় না বা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু শরীরে যখন বিভিন্ন রোগ ও উপসর্গ দেখা দেয় তখন প্রশ্বাস গ্রহণের স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়। পরিণামে ব্যক্তি কষ্ট অনুভব করে এবং মৃত্যুর ঝুঁকি তৈরি হয়। প্রশ্বাসে কষ্ট হলে তাই আমাদের জন্যে তা সতর্কতার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
ডিজনিয়া কী :
প্রশ্বাসে কষ্ট যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা ডিজনিয়া বলি তা হলো ব্যথা বা অস্বস্তির কারণে ব্যক্তির প্রশ্বাস একটা সীমার পরে অগভীর হওয়া। এই অগভীর প্রশ্বাসের মূল কারণ শ্বাস নিতে গেলে একটা নির্দিষ্ট মাত্রার পর ধারালো অস্ত্রে কেটে যাওয়ার মতো ব্যথা বোধ হওয়া বা অস্বস্তি বোধ হওয়া, যে কারণে ব্যক্তি সচেতনভাবে ঐ মাত্রা বা সীমার পরে আর প্রশ্বাসকে গভীর করে না। অগভীর প্রশ্বাসের কারণে ব্যক্তি ঘন ঘন প্রশ্বাস গ্রহণ করতে হয় এবং এতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন হতে ভুক্তভোগী বঞ্চিত হয়।
ডিজনিয়ার কারণ :
ডিজনিয়ার মূল কারণ তিন ধরনের।
প্রথমত: হৃদপিণ্ড ও রক্ত সংবহনতন্ত্রের দুর্বলতা এবং অ্যানিমিয়া বা রক্ত স্বল্পতা।
দ্বিতীয়ত: শ্বাসতন্ত্রের দুর্বলতা এবং
তৃতীয়ত: মানসিক চাপ বা মানসিক দুর্বলতা।
হৃদপিণ্ডের যদি অসামর্থ বা ফেইলিওর তৈরি হয় তবে ডিজনিয়া দেখা দেয়। মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশান বা অক্সিজেন স্বল্পতাহেতু হৃদপিণ্ডের মাংশপেশি স্তরের পঁচে যাওয়া, কনজেস্টিভ কার্ডিয়াক ফেইলিওর বা হৃদপিণ্ডের অসামর্থজনিত কারণে অতিরিক্ত তরল সঞ্চয়ন ও তদ্জনিত কারণে বুক জ্যাম হয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে মানুষ ডিজনিয়ায় আক্রান্ত হয়।
শ্বাসতন্ত্রে জীবাণু সংক্রমণ বা নিউমোনিয়া, ইন্টারস্টিশিয়াল লাং ডিজিজ, অ্যাজমা, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারী ডিজিজ বা দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসতন্ত্রের অবরোধজনিত বিঘ্নতা ইত্যাদি কারণে ডিজনিয়া দেখা দেয়।
মানসিকভাবে কেউ যদি অতি উদ্বেগে ভোগে, কেউ মাত্রাতিরিক্ত ভীতিপ্রবণ হলে কিংবা অতিমাত্রায় আবেগী হয়ে উঠলেও তার ডিজনিয়া বা প্রশ্বাস গ্রহণে অতি সচেতনতামূলক অগভীরতা তৈরী হয়।
ডিজনিয়ার লক্ষণ :
ডিজনিয়া বা প্রশ্বাসের কষ্টে ভোগা রোগীদের ঘন ঘন শ্বাস নিতে হয়। গায়ে ঘাম হয়। নখের পাতগুলো নীলচে বা নীলাভ হয়ে যায়। জিভের অগ্রভাগ, কানের লতিও নীলচে বর্ণ ধারণ করে। অর্থাৎ তাদের রক্তে কার্বন ডাই-অক্সাইড বাড়তি হয়। প্রশ্বাস ধরে রাখা কষ্টকর হয় ও প্রশ্বাসে শব্দ হয়। খুব দ্রুত ও অগভীর প্রশ্বাস নিতে হয় এবং হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পায়। প্রশ্বাসকালিন শোঁ শোঁ আওয়াজ হয়, বুকে ব্যথা অনুভব হয়। ত্বক শীতল বা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে কিংবা অল্প পথ হাঁটতে ক্লান্তি বোধ হয়। এক পর্যায়ে বসে থাকলেও ক্লান্তি তৈরি হয় এবং বুকে চাপ চাপ লাগে।
ডিজনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির পরীক্ষণ :
* বুকের এক্সরে
* ফুসফুসের সিটি স্ক্যান
* ইসিজি
* রক্তের সিবিসি বা সম্পূর্ণ ব্লাড কাউন্ট
* রক্তে চর্বির মান নিরূপণ
ডিজনিয়ার চিকিৎসা :
যে কোন ধরনের ডিজনিয়ায় অক্সিজেন থেরাপি আবশ্যক। মিনিটে তিন লিটার হারে অক্সিজেন থেরাপি ক্ষেত্র বিশেষে প্রযোজ্য।
ডিজনিয়ার মূল কারণ অনুসন্ধান করে তার সঠিক চিকিৎসা করা উচিৎ। অ্যানিমিয়া বা রক্ত স্বল্পতাজনিত ডিজনিয়ায় রক্তবর্ধক বা আয়রনের ঘাটতি সংশোধনকারী চিকিৎসা প্রদান জরুরি। পাশাপাশি বাংলাদেশে আয়রন ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতার মূল কারণ নির্মূলে নিয়মিত বিরতিতে কৃমিনাশক ঔষধ সেবন করা জরুরি। রক্তক্ষরণের কোন যৌক্তিক কারণ থাকলে তা অপনোদন করা দরকার।
হৃদপিণ্ডের ফেইলিওর বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশানে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতেই হবে। ফুসফুসের জীবাণু সংক্রমণ প্রতিকারে উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক যেমন : ক্ল্যাভুলোনিক অ্যাসিডের অগমেন্টেশনে তৈরি করা অ্যামক্সিসিলিন বা দ্বিতীয় প্রজন্মের সেফালোস্পোরিন ব্যবহার করা যেতে পারে।
মানসিক চাপ ও বিকলনজনিত ডিজনিয়া মোকাবেলায় মনকে প্রফুল্ল রাখতে হবে। দুশ্চিন্তা দূরে রেখে জীবন চলা জরুরি। প্রতিদিন হাল্কা শরীর চর্চা ডিজনিয়া মোকাবেলায় কার্যকর। অতিরিক্ত উদ্বেগ অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
ডিজনিয়া প্রতিরোধ :
* নিয়মিত হাল্কা শরীর চর্চা
* ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন
* দেহের অতিরিক্ত ওজন হ্রাস
* ধোঁয়া-ধূলিবালি এড়িয়ে চলা
* পর্যাপ্ত বিশ্রাম গ্রহণ।
ডিজনিয়া বা প্রশ্বাসে বাধা মূলত কোন রোগ নয় বরং রোগের উপসর্গ যা আমাদের অন্তর্নিহিত সত্যকে জানিয়ে দেয়। এতে মূল রোগ নিরূপণ ও চিকিৎসা সহজ হয়ে আসে।