প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
নির্বাচনের হাতিয়ার হোক প্রযুক্তি
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

বিগত একযুগের বেশি সময় বিভিন্ন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহৃত হলেও এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ব্যালট পেপারে। ইভিএম নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক থাকলেও এর ব্যবহার ক্রমেই বেড়েছিল বিগত নির্বাচনগুলোতে। কিন্তু এটিকে মেনিপুলেট করে প্রার্থীর পক্ষে ফল দেওয়া যায়- এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এবারের নির্বাচনে ইভিএম ছাড়া করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনের হাতে এখনো যে পরিমাণ সচল ইভিএম আছে, তা দিয়ে অন্তত ৩০-৫০টি আসনে নির্বাচন করা সম্ভব ছিল।
যা হোক, ইভিএম কিংবা ব্যালট পেপার, যেভাবেই নির্বাচন হোক না কেন, বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনেই কারচুপি হয়নি- এমন অভিযোগ থেকে রেহাই পায়নি কখনো। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং, সূক্ষ্ম কারচুপি, সাম্প্রদায়িক উস্কানি, অদৃশ্যশক্তি, কালো টাকার ছড়াছড়ি, ভয় দেখিয়ে ভোটকেন্দ্র দখল করা, এজেন্টকে ঢুকতে না দেওয়া, নির্দিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে সিল মারা, দিনের ভোট আগের রাতে দেওয়া, লেভেল প্লেইং ফিল্ড না থাকা ইত্যাদি নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে বিগত দিনের নির্বাচনগুলো।
যদিও এসব অভিযোগ অনেকটাই রাজনৈতিক এবং নির্বাচনে হারজিতের কৌশল হিসেবে মনে করেন বিশেষজ্ঞগণ। প্রকৃতপক্ষে, এসব অভিযোগ থেকে সম্পূর্ণ রেহাই পাওয়া যায়, যদি নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়াটি সফটওয়্যার এবং প্রযুক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রযুক্তি এবং সফটওয়্যারকে তার নিজের মতো চলতে দিতে হবে।
গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনটি প্রচলিত ব্যালট পেপারে হলেও এর আনুষঙ্গিক কাজের সঙ্গে অনেক প্রযুক্তি সফলভাবে কাজ করেছে। এগুলোর মধ্যে প্রধান দুটি হলো- নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সফটওয়্যার ‘স্মার্ট ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট বিডি’ এবং ‘অনলাইন নমিনেশন সাবমিশন সিস্টেম (ওএনএসএস)’ অ্যাপ।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক মনোনয়ন ফরম কেনার জন্য ‘স্মার্ট নোমিনেশন অ্যাপ’ এবং অপরাধী শনাক্তকরণে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব কর্তৃক উদ্ভাবিত ‘ওআইভিএস’ ডিভাইস খুবই কার্যকর ছিল। ওআইভিএস ডিভাইসের মাধ্যমে আঙুলের ছাপেই বেরিয়ে এসেছে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটারদের নাম-ঠিকানা ও ভোটকেন্দ্র। ফলে, জালভোট দিতে আসা ব্যক্তি কিংবা ভোট কেন্দ্রের সামনে সন্দেহভাজনদের ঘোরাঘুরি শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে সহজে।
অপরাধ দমন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতেও ডিভাইস খুবই কার্যকর। দীর্ঘদিন ছদ্মবেশে আত্মগোপনে থাকা অপরাধীদের আঙুলের ছাপ নিয়ে তাদের অপরাধ শনাক্ত করা যায়। ডিভাইসটি চালুর পর বিভিন্ন হত্যা মামলার আসামি, দুর্র্ধষ সন্ত্রাসীসহ গুরুতর অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে র্যাব। মোবাইল ফোন সদৃশ ডিভাইসটি ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে যেকোনো স্থান থেকে পরিচালনা করা যায়। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি ও অপরাধী শনাক্তের ক্ষেত্রেও ডিভাইসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
এতে কোনো ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জন্ম তারিখ বা ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে নিমিষেই জানা সম্ভব হচ্ছে ওই লোকের ব্যক্তিগত তথ্যসহ হত্যাকাণ্ডের শিকার কিংবা হত্যাকাণ্ডে জড়িত বা অপরাধমূলক কোনো কাজের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা, কারাভোগ কিংবা কোনো সাজা হয়েছে কিনা ইত্যাদি। এর মাধ্যমে শুধু অপরাধী শনাক্তই নয়, বিভিন্ন অজ্ঞাত পরিচয় মৃত ব্যক্তি ও মানসিক প্রতিবন্ধীর পরিচয়ও শনাক্ত করা হচ্ছে এবং তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
‘স্মার্ট নোমিনেশন অ্যাপ’ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একটি যুগান্তরকারী মাইলফলক। গুগল প্লে-স্টোর অথবা আইওএস অ্যাপ-স্টোর থেকে এবং ওয়েবসাইট থেকে অ্যাপটি ডাউনলোড করে প্রার্থীরা তাদের নোমিনেশন ফর্ম জমা দিয়েছে খুবই উৎসবমুখর পরিবেশে। নির্বাচনকালীন সময়ে মিছিল-মিটিং ও ঢাকঢোল বাজিয়ে জনদুর্ভোগ কমাতে আওয়ামী লীগের এই উদ্যোগকে সকলে প্রশংসা করেছে।
এদিকে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ‘স্মার্ট ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট বিডি’ অ্যাপসের মাধ্যমে একজন ভোটার ঘরে বসেই তার ভোটার নম্বর, ভোটার এলাকা, নির্বাচনী আসন, ভোটকেন্দ্রের নাম, ভোটকেন্দ্রের ছবি, ভোটকেন্দ্রের ভৌগোলিক অবস্থান ম্যাপসহ দেখতে পেয়েছেন। এ অ্যাপের মাধ্যমে বিভাগওয়ারি আসনগুলোর তথ্য, যেমন- মোট ভোটার, মোট আসন, আসনের প্রার্থী, প্রার্থীদের বিস্তারিত তথ্য (হলফনামা, আয়কর সম্পর্কিত তথ্য, নির্বাচনী ব্যয় ও ব্যক্তিগত সম্পদের বিবরণী) ইত্যাদি জানা গেছে।
অ্যাপসটির মাধ্যমে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর তথ্য এবং সমসাময়িক তথ্যাবলি ‘নোটিশ’ আকারে প্রদর্শিত হওয়ার ব্যবস্থা আছে। এবারের নির্বাচনে অ্যাপসটির সাহায্যে প্রতি ২ ঘণ্টা অন্তর চলমান ভোটিং কার্যক্রমের তথ্য জানা গেছে। এ অ্যাপের ফলে তৃণমূল পর্যন্ত তথ্যের অবাধ প্রবাহ থাকার কারণে প্রার্থীরাও তাদের কর্মকাণ্ড এবং সর্বোপরি ভোটার, প্রার্থী, জনগণ এ তিনের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে একধাপ এগিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক করায় ভূমিকা রেখেছে।
ভবিষ্যতে সংসদ নির্বাচন ছাড়াও স্থানীয় সরকারের যেকোনো নির্বাচনে মনোনয়ন জমাসহ নির্বাচনীসেবা সহজ হবে এ অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে। সর্বোপরি প্রযুক্তিনির্ভর এ ভোট ব্যবস্থাপনার ফলে নির্বাচনের ক্ষেত্রেও দেশ স্মার্ট বাংলাদেশের যুগে প্রবেশ করেছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লক চেন ও অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা যেতে পারে।
গত কয়েক বছরে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে, তার শতভাগ প্রভাব পড়েছে এবারের সংসদ নির্বাচনে। তাই প্রার্থীদের ভোটের প্রচারণায় এবার গুরুত্ব পেয়েছিল ডিজিটাল মাধ্যম। বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানি এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে চালিয়েছেন নির্বাচনী প্রচার। মোবাইল ফোনে সালাম বিনিময়, দোয়া ও আশীর্বাদ চেয়ে খুদে বার্তা এবং নির্বাচিত হলে নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা জানাতে পেরেছেন প্রযুক্তির সহায়তায়।
অনেকে সরকারের নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরেও ভোট চেয়েছেন। এসব তথ্য ফেসবুক বুস্টিং করে অল্প খরচে নিমেষেই ছড়িয়ে দিয়েছেন পুরো এলাকাজুড়ে। যা হয়তো সমাবেশ করে জানাতে সময় লাগত দিনের পর দিন। আর খরচের বিষয় তো ছিলই। পাশাপাশি প্রচারের জন্য আরও ছিল ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, নিজস্ব ও দলীয় ওয়েবসাইট এবং ই-মেইল। এক্ষেত্রে ফেসবুককে দেখা গেছে ভিন্ন মাত্রায়।
নির্বাচনী প্রচারণায় গুজব, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও ক্ষতিকর কন্টেন্ট যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে লক্ষ্যে ফেসবুকের স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান মেটাপ্ল্যাটফর্মস ইনকর্পোরেটেড নিয়েছিল নানা প্রতিরোধমুখী পদক্ষেপ। সেজন্য মেটা আয়ও করেছে বেশ। মেটা জানিয়েছে, ভোটের জন্য সংক্ষিপ্ত আবেদন এবং রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন বাবদ প্রচারের শেষ সাত দিনে তারা বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪৫ হাজার মার্কিন ডলার আয় করেছে, যা প্রায় ৫০ লাখ টাকার সমান।
বরাবরের মতো সন্দেহভাজক এবং কেন্দ্রীয়ভাবে বিভিন্নস্থানে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটরিং করে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও তৎপর ছিল ইসি। একইভাবে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের প্রাপ্ত ভোটগণনা করে অ্যাপসের মাধ্যমে ইসির দপ্তরে পাঠাতে সময়ক্ষেপণ করেনি সংশ্লিষ্ট প্রিসাইডিং অফিসার।
ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং এর ব্যবহার যেভাবে মানুষের হাতের নাগালে চলে আসছে, তাতে আগামী নির্বাচনগুলোতে এর ব্যবহার, ব্যাপকতা এবং উপযোগিতা আরও বাড়বে- তাতে কোন সন্দেহ নেই। স্পষ্টত, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ডিজিটাল প্রযুক্তি যেভাবে সহায়তা করেছে, তা হিসাব করলে দেখা যাবে যে, প্রায় ৫০ শতাংশ নির্বাচনী কাজে প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছে।
আরেকটু উদ্যোগ নিয়ে আগামী নির্বাচনে বাকি ৫০ শতাংশ প্রয়োগ করে স্মার্ট ইলেকশন পদ্ধতি প্রবর্তন করার বিষয়ে ভাবতে হবে এখনই। অনেক দেশেই ব্যালট পেপারের পাশাপাশি অনলাইনে নির্বাচন হয়ে থাকে। আমাদের দেশেও ব্যালটের পাশাপাশি অনলাইন বা ইভিএম দিয়ে নির্বাচন আশা করতে পারি। হয়তো আন্দোলন হবে, সমালোচনা হবে, এমনটি মাথায় নিয়েই এগোতে হবে। এমনটি হলে অদূর ভবিষ্যতে বিদেশে থাকা বাঙালিরাও ভোটে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় শতভাগ প্রযুক্তির সহায়তা কার্যকর হলে মিছিল-মিটিং, ব্যানার-পোস্টার, মাইকিং, গণসমাবেশ, শোডাউন ইত্যাদি বন্ধ হবে। কালো টাকার ব্যবহার কমে আসবে। আচরণবিধিও কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করা যাবে। সর্বোপরি সকলের জন্য লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড কার্যকর হবে। তাই প্রযুক্তিই হোক আগামী নির্বাচনের প্রধান অবলম্বন।
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক ও তথ্য প্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।