বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে তথ্যের সুরক্ষা
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

১৯৬০ থেকে ৮০’র দশকে কম্পিউটারে তথ্য সংরক্ষণের বিপ্লবের মাঝে গ্লোবাল নেটওয়ার্কিংয়ের ব্যাপক উন্নতি ঘটে এবং ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে সকল কম্পিউটার হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার থাকে সার্ভিস দাতার তত্ত্বাবধানে। ক্রেতা বা ব্যবহারকারী শুধু ছোট ও কম খরচের একটি ডিভাইসের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সহযোগিতায় ভার্চুয়ালি সার্ভিসদাতার মূল কম্পিউটার বা সার্ভারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে প্রয়োজনীয় কম্পিউটিং কাজ সম্পাদন করে থাকে। কাজ শেষে সকল তথ্য আবার ওই সার্ভারে জমা রাখতে পারে মূল কম্পিউটার বা সার্ভারে।

যেহেতু ক্রেতা বা ব্যবহারকারী থেকে অনেক দূরে থাকে, ফলে সার্ভিসদাতার অবকাঠামো, রিসোর্সসমূহ এবং সব প্রক্রিয়া ক্রেতা বা ব্যবহারকারীর কাছে অনেকটা অদৃশ্যমান মনে হয়। ফলে ক্রেতা বা ব্যবহারকারীর কাছে এসব সার্ভিস অনেকটা মেঘ (Cloud) কিংবা কল্পনার কোনো রাজ্য থেকে পাওয়ার মতো মনে হয়। নেটওয়ার্ক ডায়াগ্রাম আঁকার সময়ে ক্রেতা ও সার্ভারের মাঝের ইন্টারনেটের অংশটিকে অনেক আগে থেকেই মেঘের (Cloud) ছবি দিয়ে বোঝানো হতো। আবার সিস্টেম ডায়াগ্রামে জটিল সাংগঠনিক কোনো বিষয় সম্পর্কে ধারণার জন্য ক্লাউড বা মেঘের মতো প্রতীক ব্যবহার করা হয়। সে থেকেই অদৃশ্য বা ভাসমান এই প্রযুক্তিটির নামকরণ হয়েছে ক্লাউড কম্পিউটিং।

বোঝা যাচ্ছে, এটি কোনো নির্দিষ্ট একক টেকনোলজি নয়, অনেক টেকনোলজিকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা একটা ব্যবসায়িক মডেল বা বিশেষ পরিষেবা। এই মডেলে ব্যবহারকারী বা ক্রেতার চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে বেশ কিছু চলমান প্রযুক্তির সমন্বয়ে বিভিন্ন রিসোর্স এবং সার্ভিস বিশেষভাবে বাজারজাত করা হয় বা ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।

ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের এই উন্নত পরিষেবা কিছু কম্পিউটারের গ্রিড সিস্টেমের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেকনোলজি (NIST) দ্বারা সংজ্ঞায়িত ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের নিম্নলিখিত ৪টি প্রধান পরিষেবার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এগুলো হলো- ১. ব্রড এক্সেস নেটওয়ার্ক : যে কোনো জায়গা থেকে অনায়াসে সার্ভিস পাওয়া যাবে। ২. অন ডিমান্ড সেলফ সার্ভিস- যখন দরকার কাস্টমার মুহূর্তের মধ্যেই প্রয়োজনীয় রিসোর্স যোগ করে নিতে পারবে। ৩. রিসোর্স পুলিং- যখন দরকার তখন রিসোর্স নেওয়া আবার ছেড়ে দেওয়া যাবে, যেটা অনেক সাশ্রয়ী। ৪. মিটারড সার্ভিস- ঠিক যতটুক ব্যবহার ততটুকুরই বিল দেওয়া যাবে।

এই পরিষেবাগুলো নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এবং গ্রাহকদের ডেটা সর্বদা নিরাপদ এবং সুরক্ষিত রাখার জন্য ক্লাউড প্রোভাইডাররা সার্ভারগুলোকে সর্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখে এবং নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করে থাকে- ১. ডেটা এনক্রিপশন (Encryption) করা, একাধিক স্তরের নিরাপত্তা দেওয়া এবং উচ্চ প্রাপ্যতা (High availability) ও স্থায়িত্বের (Durability) জন্য একাধিক সার্ভারে কপি (Replicate) করা, ২. ত্রুটি ও সহনশীলতার (Redundancy এবং Fault tolerance) জন্য বিভিন্ন ডেটা সেন্টারে ভার্চুয়ালাইজেশন স্তর এবং সফ্টওয়্যার চালানো, ৩. লোড বা ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়লে অটো-স্কেলিং আউট এবং লোড কমে গেলে অটো-স্কেলিং ডাউন করা, ৪. যখন একটি সার্ভারে সমস্যা হয়, তখন অন্য একটিতে স্থানান্তরিত (Migrate) করা, ৫. শুধু যে পরিমাণ সেবা ও রিসোর্স ব্যবহার করা হবে সে পরিমাণ বিল গণনা করা, ৬. প্রকৃত ডেটা সেন্টার পরিচালনা এবং সুরক্ষিত করা ইত্যাদি।

বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির এই সহজ ও নিরাপদ মাধ্যম ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে শত শত আইটি ফার্ম। ছোট্ট একটি শপ থেকে শুরু করে বহুজাতিক কোম্পানি, প্রায় সবখানেই এখন তথ্য সংরক্ষণ করা হয় ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের সাহায্যে। মূলত প্রযুক্তিবিদরা বহু আগে থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন কি ভাবে সমস্ত তথ্যকে এক করে তা মানুষের সেবায় পৌঁছানো যায়। এরই ধারাবাহিতায় ক্লাউড কম্পিউটিং এখন প্রযুক্তি দুনিয়ায় বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। তবে প্রযুক্তির বাজারে সত্যিকারের ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের আবির্ভাব ঘটেছে অ্যামাজনের হাত ধরে।

পরবর্তীতে ২০১০ সালে মাইক্রোসফট ধরনের পরিষেবা এবং আরও পরে গুগল তাদের গুগল কম্পিউটার ইঞ্জিন প্রযুক্তি বাজারে নিয়ে আসে। এই সময়ে আরও কিছু প্রতিষ্ঠান খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভার্চুয়াল মেশিনের মাধ্যমে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের সেবা নিয়ে হাজির হয়েছিল। যদিও বর্তমান সময়ে অ্যামাজন, গুগল ও মাইক্রোসফটই প্রতিযোগিতায় টিকে রয়েছে। কারণ, মানুষের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো সেবার মান বাড়াতে পারেনি।

অন্যদিকে, উল্লিখিত তিনটি প্রতিষ্ঠান সেবার মান বাড়িয়ে একে অপরকে ছাড়িয়ে যেতে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা করে যাচ্ছে। ওরাকল, আইবিএম এবং আলিবাবা এই প্রতিযোগিতায় কয়েক বছর ভালো অবস্থানে থাকলেও এখন তারা ব্যবসা প্রায় গুটিয়ে নিয়েছে। ভার্চুয়াল যন্ত্রগুলো ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মূল উপাদান হিসেবে দিনে দিনে আরও গ্রাহকসুবিধা বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। এই সুবিধাসমূহের মধ্যে রয়েছে নেটওয়ার্ক, সুরক্ষা ব্যবস্থা, ফাংশন, অ্যাপ্লিকেশন, মেমোরি ইঞ্জিন, বিভিন্ন স্টোরেজ, ডাটাবেস, বিগ ডাটা ইত্যাদি। সময়ের পরিক্রমায় ক্লাউড কম্পিউটিং পদ্ধতি ভার্চুয়াল কম্পিউটার থেকে যেমন একাধিক ভার্চুয়াল যন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছে, তেমনি শুরুর সময়ের তুলনায় বর্তমানে আরও বেশি সুবিধা ও নিরাপত্তা উপভোগ করতে পারছেন ব্যবহারকারীরা। আর এটিই ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মূল বিপ্লব।

গুগল ড্রাইভের ব্যবহার ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের বাস্তব উদাহরণ। তথ্য সরবরাহ এবং সুরক্ষার জন্য অনলাইন ভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল রিসোর্স যেমন- ডেটা, প্রোগ্রাম, স্টোরেজ, সার্ভার, নেটওয়ার্ক ও অন্যান্য ডিজিটাল সেবা চাহিবামাত্র ও চাহিদা অনুযায়ী ব্যবহার করার সুযোগ প্রদানে/ভাড়া দেওয়া ইত্যাদি কারণে ক্লাউড কম্পিউটিং এখন খুবই জনপ্রিয়। গুগলের তথ্যমতে, ২০২০ সালে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ হবে প্রায় ২২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১৮ সালে ছিল ১৬০ বিলিয়ন। এছাড়াও ২০২৪ সালের মধ্যে বেশিরভাগ উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠান ক্লাউডের সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

২০২৫ সালে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের ব্যবহার বর্তমানের চেয়েও পাঁচগুণ বেড়ে যাবে বলে ধারণা গুগলের। তথ্যের একাধিক স্তরের নিরাপত্তা, সহজলভ্য, দ্রুত ও কম খরচ ইত্যাদি বিবেচনায় ক্লাউড কম্পিউটিংকে আজ ডিজিটাল রূপান্তরের চাবিকাঠি বললেও ভুল হয় না। ব্যবহারকারীকে অফিসলেস, পেপারলেস এবং সর্বোপরি ডিভাইসলেস সুবিধার আওতায় এনে গোটা বিশ্বকে স্মার্ট নেটওয়ার্কের আওতায় আনাই ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের প্রধান উদ্দেশ্য। ব্যবসায়িক সুবিধা এবং কর্মসংস্থানের বিপুল সম্ভাবনার ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে ক্লাউড কম্পিউটিং।

ধারণা করা হচ্ছে, ক্লাউড কম্পিউটিং সিস্টেম আগামী ১০/১৫ বছরের মধ্যে এক অসীম যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করবে এবং মানুষ তখন রাউটার, ব্যক্তিগত নেটওয়ার্ক এসব নিয়ে আর কথাই বলবে না। এমনকি ছোট ছোট কোম্পানিগুলো তাদের কোম্পানির ওয়ার্কস্টেশনের জন্য আলাদাভাবে কোনো কম্পিউটার, রাইটার, টাওয়ার, সার্ভার এসব কেনার পরিবর্তে শুধু মাউস, মনিটর, কীবোর্ডকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য থিনা ক্লায়েন্ট প্রযুক্তি বেছে নেবে।

লেখক : অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়