প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
সারা বিশ্বে বিজ্ঞানভিত্তিক যতো বিস্ময়কর আবিষ্কার হয়েছে তাদের অন্যতম কম্পিউটার আবিষ্কার। এটি একটি প্রোগ্রাম বা সফটওয়্যার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বৈদ্যুতিক যন্ত্র, যা ক্রমান্বয়ে স্বয়ংক্রিয় ও বাধাহীনভাবে উচ্চ গতিতে নির্ধারিত ডাটা গ্রহণ করে। প্রয়োজনীয় অ্যালগরিদম এবং কমান্ড (ইনস্ট্রাকশন) অনুযায়ী গাণিতিক ও যৌক্তিক ক্রিয়াকলাপ সম্পাদন করে এবং সে অনুযায়ী ফলাফল প্রদর্শন করে। কম্পিউটার শব্দটি লাতিন ‘কম্পিউটারে’ থেকে আগত, এর অর্থ গণনা বা গণনাকারী যন্ত্র। শুরুতে অ্যানালগ ও ডিজিটাল কম্পিউটার এবং পরে হাইব্রিড তথা ক্লোন কম্পিউটার মানুষের হাতে আসে। ডিজিটাল ও অ্যানালগ শব্দ দুটি দ্বারা কম্পিউটারের দুই ধরনের কাজের ধারা বোঝায়। অ্যানালগ কম্পিউটার ডাটাকে বৈদ্যুতিক ভোল্টে পরিণত করে, আর ডিজিটাল কম্পিউটার সংখ্যাকে বৈদ্যুতিক রিদম বা ছন্দে পরিবর্তন করে। আর এই অ্যানালগ ও ডিজিটাল কম্পিউটারের কার্যক্রম ও বৈশিষ্ট্যগুলোর সমন্বয়ে গঠিত হলো হাইব্রিড কম্পিউটার। আছে সুপারকম্পিউটারও, যার গতি আরো বেশি। এসব কম্পিউটারকে পেছনে ফেলে হাজার হাজার গুণ গতিসম্পন্ন কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি হচ্ছে, যা ২০২৯ সালে বাণিজ্যিকভাবে আসবে বিশ্ববাজারে। আসবে সুপারফাস্ট কোয়ান্টাম কম্পিউটার, যা নিয়ন্ত্রণ করবে ভবিষ্যতের কোয়ান্টামজগৎ।
ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারে পলিনমিয়াল (বহুপদী সংখ্যামালা), ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশন আর জটিল ও যৌগিক সংখ্যার মৌলিক উৎপাদক সমাধান করতে চাইলে অনেক সময় লাগে। কারণ ক্রিপ্টোগ্রাফির অনেক প্রটোকল আছে, যা সাধারণ কম্পিউটার দ্বারা প্রাইম ফ্যাক্টরাইজেশন বা লিনিয়ার সার্চের কমপ্লিক্সিটি স্কয়ার রুট, রাসায়নিক বিক্রিয়া, সিমুলেশন ইত্যাদি খুব দ্রুত করতে পারে না। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার কোয়ান্টাম মেকানিকসের বিভিন্ন ধর্ম, যেমনÑএনট্যাঙ্গলমেন্ট, টেলিপোর্টেশন, সুপারপজিশন ইত্যাদি ব্যবহার করে খুব দ্রুত বিশ্লেষণ করতে পারে। এই কম্পিউটারটি মানুষের আন্দাজ ও অনুভূতি, ইচ্ছা ও অনিচ্ছার সংকেত, দেখা, শোনা, গন্ধ, স্বাদ ও স্পর্শের অনুভূতি সহজে বুঝতে পারবে, এমনকি আচরণ ও অনুধাবন করবে মানুষের মতো। ট্র্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের ভাষ্য, ট্রান্সক্রিপ্টর নামের জৈব ট্রানজিস্টরটি ডিএনএর মধ্যকার এনজাইমের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ফলে ক্যান্সার বা এইডসের মতো মারণব্যাধির পথ দেখাতেও সাহায্য করবে এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার। আমাদের এই মহাবিশ্বকে বাঁচানোর জন্যে বৈশ্বিক উষ্ণতার সমস্যার প্রকৃতি বোঝা এবং কার্বন ধরে রাখা যাবে কি না তা-ও জানতে পারবো এই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমে। মানবসভ্যতার জন্যে কল্যাণকর অথচ এখনো বিজ্ঞানীদের ভাবনায় আসেনি এমন অনেক কিছুই সংযুক্ত হবে আগামী দিনের এই কম্পিউটারে। যেমনটি মানুষ একদিন স্বপ্নেও ভাবেনি টাচস্ক্রিনের কথা, যা এখন মানুষের হাতে হাতে।
সাধারণ বা ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার বাইনারি সংখ্যা (০, ১) দিয়ে তথ্য সংরক্ষণ ও পরিচালনা করে। মূলত সার্কিটে নির্দিষ্ট মাত্রার ভোল্টেজের উপস্থিতি হলো ১ (অন), অনুপস্থিতি হলো ০ (অফ)। এই ০, ১ হলো ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারে তথ্যের একক, যাকে বলা হয় ‘বিট’। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার তথ্য সংরক্ষণ ও পরিচালনা করে ‘কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল ফেনোমেনা’ বা ‘কোয়ান্টাম যান্ত্রিক ঘটনা’র ওপর ভিত্তি করে। এটি হচ্ছে বাইনারি (০, ১) সংখ্যার মিশ্রণ (স্পিন) পদ্ধতি, যাকে বলা হয় সুপারপজিশন (উপরিপাতন)। এই বিটকে বলা হয় ‘কিউবিট’। তাহলে এই মিশ্রণ কিভাবে ঘটে? সেটা অনেকটা কোয়ান্টামতত্ত্বে বর্ণিত পদার্থের কণা ও তরঙ্গ ধর্মের মতো। কোয়ান্টাম দুনিয়ায় একই কণা একই সঙ্গে একাধিক জায়গায় থাকতে পারে এবং তরঙ্গ ও কণাধর্মী আচরণের মধ্যে তার বিচরণও সক্রিয়। আর এটিই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মূল শক্তি, যা ০ ও ১-এর সহাবস্থানের মাধ্যমে একসঙ্গে বহু তথ্য সংরক্ষণে সক্ষম। এটি এর গতি ও শক্তিকে দ্বিগুণ বা বহুগুণ নয়, বাড়ায় জ্যামিতিক হারে। যেমনÑদুই কিউবিটে যদি চারটি সংখ্যা সংরক্ষণ করা যায়, তাহলে তিন কিউবিটে যাবে আটটি, আর চার কিউবিট পারবে ১৬টি সংখ্যা। ফলে তথ্য আদান-প্রদান ও বিশ্লেষণ হবে দ্রুতগতিতে এবং তাতে সময় অনেক কম লাগবে। গুগলের সিকামোর প্রসেসর সাড়ে তিন মিনিট সময়ে এমন এক হিসাব সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে, যা প্রচলিত সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটারের করতে ১০ হাজার বছর লাগতো। গুগলের এআই কোয়ান্টামের গবেষকরা জানান, এক পরীক্ষায় কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রসেসর জটিল একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান বের করেছে ২০০ সেকেন্ডে। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে দ্রুতগতির সুপারকম্পিউটারে সমাধানটি বের করতে সময় লাগতো ১০ হাজার বছর।
গবেষণায় প্রতীয়মান যে প্রতিদিন আমরা ২.৫ হেক্সাবাইট তথ্য উৎপাদন করছি, যা ৫০ লাখ ল্যাপটপে থাকা কনটেন্টের সমান। আবার প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যন্ত্র থেকেও প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে ডাটা। এতো বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণের চাহিদা অনুযায়ী কম্পিউটারের প্রসেসরে ট্রানজিস্টরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এই ধারা বজায় রাখতে হলে আরো বেশি ট্রানজিস্টর দিতে হবে, ফলে ট্রানজিস্টরকে আরো ছোট করতে হবে। এভাবে প্রতিনিয়ত ট্রানজিস্টর ছোট করতে করতে অ্যাটমিক পর্যায়ে চলে যাবে। আর তখন আগের মতো ‘অন’, ‘অফ’ করে তথ্য সংরক্ষণ ও পরিচালনা করা যাবে না। ফলে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণুর মধ্যে বিদ্যুৎ ইচ্ছামতো থামিয়ে রাখা বা প্রবাহিত করানো যাবে না। এই পরিস্থিতিতে কোয়ান্টাম কম্পিউটার তার সুপারপজিশনের মাধ্যমে (অনবরত ‘অফ’-‘অন’-এর মিশ্রণ পদ্ধতি) বিশাল এই তথ্যভা-ার বিশ্লেষণ করবে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে, যা এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত কম্পিউটারের মাধ্যমে সম্ভব ছিলো না। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, স্বাস্থ্যসেবা, অর্থনীতি, এনক্রিপশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডাটা এবং শক্তিক্ষেত্রের মতো শিল্প বিকাশ তথা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সাফল্য আসবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের হাত ধরেই।
এককথায় পুরো কম্পিউটার-প্রযুক্তি বদলে দেবে এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার। এই কম্পিউটার ব্যবহারের ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান হবে আরো উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তিময়। তবে নতুন এই কম্পিউটারের যেমন অনেক ভালো দিক রয়েছে, তেমনি খারাপ দিকও আছে। এই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের অসদ্ব্যবহারের কারণে মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকবে না। সন্ত্রাসীদের হাতে এই কম্পিউটার পড়লে এতো দিনের ব্যবহৃত পুরো ইন্টারনেটব্যবস্থা নষ্ট করে দিতে পারবে কয়েক সেকেন্ডে। কোটি কোটি মানুষের তথ্য চলে যাবে সন্ত্রাসীদের দখলে। হ্যাকড হয়ে যাবে সব সরকারি তথ্য। ইন্টারনেটভিত্তিক আর্থিক লেনদেনে (ই-কমার্স, ই-পেমেন্ট) দেখা দেবে বিপর্যয়। নটিংহাম ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটির কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বিশেষজ্ঞ কলিন উইলমট বলেন, যে পক্ষ সবার আগে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মালিক হবে, সেই পক্ষই এই অসীম ক্ষমতার অধিকারী হবে। অতএব, যে রাষ্ট্র বা কোম্পানি সবার আগে এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হতে পারবে, সেই দেশই পরে সারা বিশ্বে অর্থনীতি ও প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব দেবে। তবে প্রথম এই কম্পিউটার যদি কোনো অসৎ ব্যক্তির হাতে পড়ে তাহলে এর রক্ষা নেই। প্রযুক্তিপ্রেমী তথা সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা একটাই, যেনো কাক্সিক্ষত এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার মানুষ ও প্রকৃতির কল্যাণের কাজে ব্যবহৃত হয়।
ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।