বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ১৯ জুন ২০২৩, ০০:০০

শারীরিক অসুস্থতা ও মানসিক স্বাস্থ্য
ডাঃ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

দেহ আর মন মিলেই মানুষ। এর একটি অসুস্থ হলে মানুষ স্বাভাবিক থাকতে পারে না। বর্তমানে শারীরিক চিকিৎসার ব্যাপ্তি বাড়লেও মানসিক চিকিৎসায় বিশ্বজুড়েই রয়ে গেছে সঙ্কট। অথচ মানসিক রোগ বসে থাকেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে ৩০ কোটির বেশি মানুষ বিষণ্ণতায় ভোগে। যার প্রভাব পড়ছে স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতায়। বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও মডেল সার্ভের তথ্যমতে, দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের ১৯ শতাংশ এবং শিশু-কিশোরদের ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে।

‘মানসিক অসুস্থতা’ কথাটি শুনলে বাংলাদেশের মানুষ বিচিত্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। কেউ ঘৃণায় মুখ বাঁকায়, কেউ অবজ্ঞায় নাক সিটকায়, আবার কেউবা বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য ছুড়ে দেয়। মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের প্রতি এ দেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি রীতিমতো অমানবিক, নিষ্ঠুর ও আঁতকে ওঠার মতো। এখানে মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের ‘পাগল’ মনে করা হয়।

কিন্তু মানসিকভাবে অসুস্থতা কোনওভাবেই পাগলামি নয়। আর অসুস্থতার ওপর কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো সময় যেকোনো রোগে আক্রান্ত হতে পারে। মানসিক রোগ জ্বর, সর্দি, যক্ষা, টাইফয়েড বা ক্যান্সারের মতোই একটি রোগ। সমস্যা হলো- এ দেশের মানুষ মানসিক রোগকে কোনো রোগ বলে মনেই করে না। তাই মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের প্রতি সহমর্মিতা দেখানোর তাগিদও বোধ করে না।

করোনাকালে দেশে আত্মহত্যাসহ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা অনেক বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করে। ১৪ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ আত্মহত্যা। বেশির ভাগ ব্যক্তিই আত্মহত্যার সময় কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে আট লাখ লোক আত্মহত্যা করে। মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬। মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের মাধ্যমে আত্মহত্যার এ হার কমিয়ে আনা সম্ভব বলেও মত ডব্লিউএইচওর।

দেশে প্রতি বছর কত মানুষ আত্মহত্যা করে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। সরকারের এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০২০ সালে ১১ হাজারের মতো মানুষ আত্মহত্যা করেছে। করোনাকালে এ সংখ্যা আরো বেড়েছে। আর ২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, করোনাকালে গেল এক বছরে পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, আর্থিক সঙ্কটসহ বিভিন্ন কারণে সারা দেশে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ নারী-পুরুষ। স্থানীয় গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার প্রতি লাখে ছয় থেকে ১০ জন, যা উন্নত দেশের কাছাকাছি। দেশের মোট স্বাস্থ্য বাজেটের দশমিক ৫০ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রয়েছে। আবার এ খাতে দক্ষ জনবলেরও স্বল্পতা আছে। তবে গত কয়েক বছরে এ খাতের উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি আগের চেয়ে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, পাবনা ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালের প্রচেষ্টায় দেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অগ্রগতি হয়েছে। পাবনা মানসিক হাসপাতালকে বিশ্বমানের ইনস্টিটিউট হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যবিদদের ভাষ্যমতে, মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে এখন মানুষের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। বিষয়টিকে সঠিক গন্তব্যের দিকে নিতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। হতাশার দিক চিহ্নিত করে তারা বলেন, দেশের কত মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে, তার সঠিক তথ্য নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সরকারের নজরদারি অতীতের চেয়ে বেড়েছে।

মানসিক রোগের বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে আলোচনা করা যাক।

দুশ্চিন্তারোগের অনুভূতি : সবসময় মাথায় চিন্তা ঘোরে বিশেষত অসুখ বা অসুখের চিকিৎসা সংক্রান্ত চিন্তা সবচেয়ে খারাপ যা পরিণতি হতে পারে, মনে হয় যে সেটিই ঘটবে। যেমন, মনে হতে পারে যে, অসুখটার খুব বাড়াবাড়ি হবে, বা মারা যেতে পারি; বুক ধড়ফড় করা; মাংসপেশিতে ব্যথা বা টানটান ভাব ও রিল্যাক্স করতে না পারা; ঘামা ; ঘন ঘন শ্বাস নেয়া; মাথা ঘোরা; গ্যাস অম্বল হওয়া ইত্যাদি।

বিষণ্নতার অনুভূতি : সবসময় বিষণ্ণ বোধ করা, জীবনে কোনো কিছুতেই উৎসাহ না থাকা; কোনো কিছু উপভোগ করতে না পারা, ছোটখাটো ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিতে না পারা; বেশি ক্লান্ত লাগা, অস্বস্তি বা অস্থিরতা বোধ করা; ক্ষুধা না হওয়া এবং ওজন কমা (কিছু ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা হয়, খিদে আর ওজন দুটোই বাড়ে); ঘুম না আসা আর সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যাওয়া; সহবাসে অনীহা; আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং নিজেকে অপদার্থ, অক্ষম ভাবা অন্যের সঙ্গ বর্জন করা; মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া; সামগ্রিক হতাশা; আত্মহত্যার কথা মনে হওয়া ইত্যাদি।

মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার উপায়: মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার প্রথম উপায় হলো নিজের যত্ন নিতে হবে। অবদমিত আবেগ প্রকাশের ফলে মানসিক চাপ ও জটিলতা কমে যায়। নিজের জন্য কিছুটা সময় আলাদা রাখতে হয় নিজের মনের কথা শুনতে হয়। বই পড়া এবং গান শোনাও দরকার। দুশ্চিন্তা দূর করতে অতীত ও ভবিষ্যৎ ভুলে বর্তমান দেখার চেষ্টা করা উচিত। তাছাড়া গতানুগতিক ডিসিপ্লিন্ড জীবনে না থেকে একটু নিজের মতো সময় কাটানো দরকার।

বিভিন্ন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সুষম ও পুষ্টিকর খাবার কেবল আমাদের শরীর নয় এমনকি মনও ভালো রাখে। অন্য দিকে অস্বাস্থ্যকর খাবার বিষণ্ণতার জন্য মারাত্মকভাবে দায়ী। ভিটামিন বি টুয়েলভ, ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার আমাদের মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনগুলোকে চাঙ্গা রাখতে সাহায্য করে। এ ছাড়া তাজা ফলমূল ও শাকসবজি বড় ভূমিকা রাখে। আমাদের মানসিক শাস্তি পুষ্টিকর খাবার নিয়মিত খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, ফলে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য আমাদের ঠিক থাকে।

শরীর সুস্থ রাখতে যেমন পর্যাপ্ত ঘুমের বিকল্প নেই। তেমনি মন সুস্থ রাখতেও ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। কারণ পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠে। ফলে ক্লান্তি বোধ হয়। কমে যায় কর্মস্পৃহা। ঘুম শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলো সারিয়ে তোলে। মন চাঙ্গা করে। তাই মানসিক স্বাস্থ্য সুস্থ রাখতে আমাদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম খুব বেশি জরুরি। এরপর নিয়মিত ব্যায়াম। মানুষের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে শারীরিক ব্যায়াম খুবই জরুরি। স্ট্রেস ও বিষণ্ণতা কাটাতে ভীষণ কাজে লাগে। ব্যায়ামের ফলে শরীরের ক্লান্তি ও মানসিক চাপ হ্রাস পায়। তাই মন চাঙ্গা রাখতে এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি।

দ্রুত ওজন কমানোর উপায়: শখের কাজ করা। নিয়মিত অভ্যাসের একটু বাইরে গিয়ে যেসব বিষয়ে কাজ করলে মন ভালো থাকে ওই ধরনের কাজ করা। যেমন অনেকের ছবি আঁকতে ভালো লাগে, বাগান করতে ভালো লাগে, রান্না করতে ভালো লাগে, যখন মন খারাপ থাকবে তখন এ ধরনের কাজগুলো করা উচিত। এতে মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায়।

নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখা উচিত: মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো প্রিয়জনের সাথে সময় কাটানো। প্রিয়জনের সাথে সময় কাটালে মানসিক হতাশা অনেকাংশে কেটে যায়। পরিবারের সাথে মন খুলে মেলামেশা করলে, মন খুলে কথা বললে, আলিঙ্গন করলে, মানসিক হতাশা অনেকাংশে কমে মানসিক সুস্থতা লাভ করা যায়। এ ছাড়াও অন্য একটি উপায় রয়েছে যার মধ্য দিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য ভালো রাখা যায়, সেটি হলো নিজের মনের যত গোপন কথা অর্থাৎ যে সব বিষয় নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হচ্ছেন, কাছের কোনো মানুষের সাথে কথাগুলো শেয়ার করা। এতে করে নিজের মন অনেক হালকা হয়ে যায় এবং মানসিক সুস্থতা ফিরে পাওয়া যায়। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে আত্মহত্যার এ হার কমিয়ে আনা সম্ভবমানসিক রোগ নিয়ে অজ্ঞতা, অসচেতনতা আর কুসংস্কারের ফলে মানসিক রোগ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্বই স্বীকার করতে চান না অনেকে। গায়েবি আওয়াজ শোনা, ভ্রান্ত কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস, অহেতুক সন্দেহ, আচার-আচরণ বা কথাবার্তার অস্বাভাবিক পরিবর্তন, কনভার্সন ডিসঅর্ডার (যা হিস্টিরিয়া বা মূর্ছারোগ নামেই বেশি পরিচিত)-এর উপসর্গগুলোকে জিন-ভূতের আছর, জাদুটোনা-তাবিজ-আলগা বাতাসের প্রভাব বলে বিশ্বাস করেন অনেকে। আত্মীয়স্বজন এসব সমস্যায় আক্রান্ত হলে তারা চিকিৎসাও করান তেলপড়া, পানিপড়া, তাবিজ, ঝাড়-ফুঁক, ‘শিকল থেরাপি’ ইত্যাদির মাধ্যমে। অনেকের কাছে মানসিক রোগের উপসর্গগুলো বয়সের দোষ, বিয়ের জন্য টালবাহানা, ঢং বা ভং ধরা। চিকিৎসার ব্যাপারে এদের বিশ্বাস, ‘মাইরের ওপর ওষুধ নাই’। কখনো কখনো শারীরিক উপসর্গ যে মানসিক রোগের কারণে হতে পারে- তাও অনেকে মানতে চান না। ফলে, মানসিক সমস্যার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে শারীরিক উপসর্গ নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকেন তারা। এত সব কুসংস্কার ও অজ্ঞতার বেড়াজাল ডিঙিয়ে যারা মানসিক রোগ চিকিৎসার আওতায় আসেন, তাদেরও বড় একটি অংশ ওষুধ নিয়ে নানান বিভ্রান্তিতে সঠিক চিকিৎসা করান না। পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে মানসিক রোগ চিকিৎসার আধুনিক ওষুধ আবিষ্কৃত হয়। এর পর সময়ের গতির সাথে মানসিক রোগ চিকিৎসারও অগ্রগতি সাধিত হয়, আবিষ্কৃত হয় নতুন নতুন ওষুধ, সেসব ওষুধের সফল প্রয়োগ মানসিক রোগ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমাদের দেশে মানসিক রোগের ওষুধ সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো বিদ্যমান।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়