প্রকাশ : ০৫ জুন ২০২৩, ০০:০০
এক ব্যক্তি গরমের কারণে ২ দিনে ১০ প্যাকেট খাবার স্যালাইন (সঠিক নিয়মে অর্থাৎ ১ প্যাকেট আধা লিটার পানিতে) খেয়েছেন। এখন তিনি অস্বস্তি বোধ করছেন। কিছু হলেই বিশেষ করে গরমে স্যালাইন খাওয়া প্রচলিত একটি বিষয় হয়ে গেছে দেশে।
ব্যাপারটি ভয়াবহ। কারণ প্রথমত খাবার স্যালাইন কোনো কোমল পানীয় না যে, ভালো লাগলে বা না লাগলেও খেয়ে ফেলবেন। পানিশূন্যতা বিশেষ করে ডায়রিয়াজনিত পানিশূন্যতায় দেহ থেকে বেরিয়ে যাওয়া লবণ ও পানির অভাব দ্রুত পূরণে চিকিৎসা হিসেবে ওরস্যালাইনের জন্ম, যা বাঁচিয়েছে কোটি মানুষের প্রাণ। কিন্তু এই প্রাণ রক্ষাকারী স্যালাইন যদি আপনি কারণে-অকারণে অপরিমিতভাবে খান, তাহলে তা শরীরের উপকার না করে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।
একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের জন্য দৈনিক খাবারে লবণ গ্রহণের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যকর মাত্রা হলো ৬ গ্রাম (২.৪ গ্রাম সোডিয়াম) বা আধা চামচের কম। এক প্যাকেট ওরস্যালাইনে থাকে ১.৩ গ্রাম সোডিয়াম। কেউ দুই দিনে ১০ প্যাকেট অর্থাৎ দিনে ৬.৫ গ্রাম সোডিয়াম খেলে দৈনিক সর্বোচ্চ মাত্রার প্রায় ৩ গুণ বেশি হবে। এর বাইরে আমরা যে নিয়মিত খাবার খাই, তাতে প্রচুর পরিমাণে লবণ থাকে। এমনকি নলকূপ বা ডিপ টিউবওয়েলের পানিতেও কিছু মাত্রায় লবণ থাকে উপকূল এলাকায়। ২০১৭ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ গড়ে দৈনিক ১৭ গ্রাম পর্যন্ত লবণ গ্রহণ করেন, যা স্বাস্থ্যকর সর্বোচ্চ মাত্রার তিন গুণ।
এর বাইরেও স্যালাইন, ডাবের পানি, এনার্জি ড্রিংক, সফট ড্রিংক, লবণ মাখানো ফলসহ আরও নানাবিধ উপায়ে কত পরিমাণ লবণ যে আমরা খাচ্ছি। কারণে-অকারণে স্যালাইন বা অন্য উপায়ে অতিরিক্ত লবণ খেলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে শরীরে।
লবণের সঙ্গে অতিরিক্ত সোডিয়াম আমাদের শরীরে ঢুকে রক্তে ও কোষের বাইরে থাকা তরলের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেবে। যার কারণে কোষ থেকে পানি বেরিয়ে আসবে, এতে একদিকে কোষের কর্মক্ষমতা কমে যাবে অন্যদিকে কোষ থেকে পানি রক্তে চলে আসায় রক্তচাপ বাড়বে, এমনকি মস্তিষ্কের বিভিন্ন স্থানে পানি জমে খিঁচুনি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। এটি একটি ভয়াবহ বিপজ্জনক অবস্থা।
এত বললাম শুধু সোডিয়ামের কথা। এর চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করতে পারে পটাশিয়াম। মানবদেহে দৈনিক পটাশিয়াম গ্রহণের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যকর মাত্রা ৩.৫ গ্রাম। এক প্যাকেট খাবার স্যালাইনে থাকে ০.৭৫ গ্রাম। অর্থাৎ ৪-৫ প্যাকেট স্যালাইন খেলেই সর্বোচ্চ মাত্রা অতিক্রম করবে। ডাবের পানিতে এর চেয়ে বেশি পটাশিয়াম থাকে। আধা লিটার ডাবের পানিতে প্রায় ০.৯ গ্রাম পটাশিয়াম থাকে। কেউ প্রয়োজনের বেশি পটাশিয়াম গ্রহণ করলে হাইপারক্যালেমিয়া তৈরি হতে পারে। যার ফলাফল কিডনি ফেইলিওর, হার্ট অ্যাটাক ও মৃত্যু।
সুতরাং গরমে ঘেমে গেলেই বা দু-একবার পাতলা পায়খানা বা বমি হলেই খাবার স্যালাইন বা ডাবের পানি ঘন ঘন খাবেন না। শুধু পানিশূন্যতার লক্ষণ দেখা দিলে খেতে পারেন চিকিৎসকের পরামর্শ মতো। পানিশূন্যতার লক্ষণ হলো প্রচণ্ড পিপাসা পাওয়া, জিহ্বা আঙুল দিয়ে স্পর্শ করলে ভেজা অনুভূতি না পাওয়া, প্রস্রাব ঘন হলুদ বর্ণের এবং অল্প পরিমাণে হওয়া, মুখ, ঠোঁট, চোখ শুকিয়ে যাওয়া, মাথা ঘোরানো, প্রচণ্ড শারীরিক দুর্বলতা ইত্যাদি। শুধু ঘাম হওয়ার কারণে এ ধরনের লক্ষণ ছাড়াই খাবার স্যালাইন খাওয়া উপকারী নয় বরং ক্ষতিকর হতে পারে।
এ ছাড়া অতিরিক্ত লবণে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির প্রথমেই থাকবে উচ্চ রক্তচাপ। সেখান থেকে উচ্চ রক্তচাপজনিত অন্যান্য শারীরিক জটিলতা, যেমন কিডনি ও হার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, হাইপারটেন্সিভ রেটিনোপ্যাথি (দৃষ্টিশক্তির সমস্যা) এবং স্ট্রোক হতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর প্রায় ৬৮ শতাংশই এ ধরনের অসংক্রামক রোগজনিত কারণে হয়, যার মাঝে ২০ শতাংশই আবার উচ্চ রক্তচাপজনিত কারণ। সুতরাং দৈনিক খাদ্যতালিকায় লবণের পরিমাণ যাচাই করুন। কোন কোন উপায়ে প্রতিদিন মাত্রাতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করছেন তালিকা করুন। ভাত-তরকারির সঙ্গে থাকা লবণ হঠাৎ করে কমিয়ে ফেলা অনেকের ক্ষেত্রেই সম্ভব নয় কিন্তু অন্যান্য উৎস যেমন বিভিন্ন কোমল পানীয়, নাস্তা, চিপস, লবণ মাখানো ফল, সস, ভাজাপোড়া, খাবার স্যালাইন ইত্যাদি উৎস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।