প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৪, ০০:০০
কঠিন সময়ের মুখোমুখি গণমাধ্যম এবং চাঁদপুর কণ্ঠ
আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। তারিখটি ২০০২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরের ২৩। আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের হিসেবে চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, এদিন আপনার স্ত্রী মা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাস্তবতাহেতু সেদিন স্ত্রীর আশপাশে আমার থাকার কথা। বিকেল আনুমানিক চারটা। খবর এলো : গুপ্টি (পূর্ব) ইউনিয়নের ডুমরিয়া গ্রামে আগুনে দগ্ধ হয়ে একজন বৃদ্ধা মায়ের মৃত্যু হয়েছে। ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ডুমরিয়া গ্রামের পথের দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। দ্রুত তথ্য ও চিত্র সংগ্রহ করে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে অফিসে সংবাদ প্রেরণ করতে হবে। আমার ব্যক্তিগত মোটরবাইক ছিলো না। নানানজনকে সাধ্যি করছি তার মোটরবাইকে চড়িয়ে আমাকে নিয়ে ডুমরিয়া যেতে। অবশেষে একজন রাজি হলেন। ততোক্ষণে বেলা প্রায় পাঁচটা। তথ্য সংগ্রহ ও চিত্রধারণ করে ফিরে আসা ও সংবাদ প্রেরণ। এমন নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রিয় পাঠকের সঙ্গে বিনিসুতোর মালায় বাঁধা পড়েছিলাম। এক অদম্য নেশায় পেয়ে বসেছিলো। প্রিয় দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে স্ত্রীর মা হওয়ার এ গল্পের অবতারণার কারণ তো আছেই।
গণমাধ্যম তথা কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের সূচনার বিষয়টি একজন মায়ের গর্ভ ধারণকালীন আনন্দ-বেদনা ও প্রসবকালীন ভূমিকম্পের সাথে তুলনা করা অপ্রাসঙ্গিক নয়। ফলে আমাদের দেশ তথা ভারতবর্ষের গণমাধ্যম, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ৩০ বছরের ইতিহাসের বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে তার বর্ণনা উপস্থাপন করা দুরূহ। তবুও কিঞ্চিৎ চেষ্টা করবো।
গণমাধ্যমে কাজের সুবাদে পাঠকমহল থেকে যতোদূর বুঝতে পেরেছি, চাঁদপুর জেলার যারা দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছেন তারা চাঁদপুর জেলার খবর জানতে চান। এজন্যে পাঠক ইন্টারনেটে প্রথমেই দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ খোঁজেন। সেখানে চাঞ্চল্যকর সংবাদ দেখলে বিশদ জানার জন্যে কল দেন। আমি নেট ওপেন করে খবর পড়ে ও ঘটনা সংশ্লিষ্ট এলাকায় খবর নিয়ে বিস্তারিত জানাই। বুঝতে পারছি, জেলার সংবাদ জানতে পাঠকের কাছে চাঁদপুর কণ্ঠের সেতু তৈরি হয়েছে।
ট্যাবলয়েড থেকে বড়ো পাতা, সাপ্তাহিক থেকে দৈনিক, ওয়েব দুনিয়ায় চাঁদপুর কণ্ঠের প্রবেশ- এসব সিদ্ধান্ত চাঁদপুর কণ্ঠকে ধাপে ধাপে পাঠকপ্রিয়তা অর্জনে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে আরো যেসব দূরদর্শী ও পরিণামদর্শী পদক্ষেপ আমি লক্ষ্য করেছি, সেগুলো হচ্ছে : শিক্ষক, শিক্ষার্থী, রাজনীতিক, বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবন-জীবিকা ও প্রাতিষ্ঠানিক ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিক রিপোর্ট ও ফিচার প্রকাশ করা। জেলাব্যাপী ওইসব ফিচার যাদের নিয়ে ছাপা হয়েছে তারা চাঁদপুর কণ্ঠের সঙ্গে বিনিসুতোর মালায় বাঁধা পড়েছেন। সে বন্ধন চাঁদপুর কণ্ঠকে পাঠকের শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে। ‘বিতর্ক মঞ্চ’র পদক্ষেপ চাঁদপুর কণ্ঠের ব্যাপ্তি ও ভিত্তি আরো মজবুত করেছে। এর মাধ্যমে জেলার শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, অভিভাবক, রাজনীতিক, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী ও সংশ্লিষ্ট এলাকার অধিবাসীকে চাঁদপুর কণ্ঠের বাহু বন্ধনে নিয়ে গেছে চুম্বকের মতো। এ ব্যাপারে আমি ব্যক্তিগতভাবে চাঁদপুরের কৃতী সন্তান সাব্বির আজমের নাম স্মরণ করবো। বিতর্ক আন্দোলনের গোড়াতে তার মেধা ও শ্রম, লক্ষ্যে পৌঁছার পরিকল্পনা ও অদম্য বাসনা অনস্বীকার্য।
চাঁদপুর কণ্ঠ আমার সন্তানসম নয়। সে যোগ্যতা আমি অর্জন করতে পারিনি। আমার মাকে আমি শ্রদ্ধা করি। এ শ্রদ্ধায় কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু মা আমাকে গর্ভে ধারণ ও প্রসব করে কী রকম কষ্ট ও আনন্দ লাভ করেছিলেন তা ছোটবেলায় বুঝিনি। বরং মায়ের শাসন-বারণ শুনে শুনে কান ঝালাপালা হতো। মা আমাকে গর্ভে ধারণ করার অনুভূতি বুঝেছি আমি যেদিন বাবা হলাম। দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ আমার মায়ের মতো। স্বভাবতই সর্বজনাব ইকবাল-বিন-বাশার, কাজী শাহাদাত, শহীদ পাটোয়ারী, মির্জা জাকির পিতৃতুল্য। তাঁদের অকৃত্রিম স্নেহধন্য হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। চাঁদপুর কণ্ঠের সঙ্গে আমি প্রায় চার বছর যুক্ত ছিলাম। কীভাবে যুক্ত হয়েছি তা বলতে চাই। তার আগে একটু পেছনে যেতে হবে।
নানা দিক থেকে পৃথিবী আধুনিক হয়েছে। প্রায় শেষ তিন দশকে পৃথিবীব্যাপী বেশ কিছু বিপ্লব ঘটেছে। গণমাধ্যম তার অন্যতম অংশ। আজ এ নিবন্ধের একমাত্র উপলক্ষ দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ পত্রিকাটির জন্ম তিন দশক সম্পন্ন করছে। পত্রিকার জন্ম হয়েছে হাতুড়ি বাটালের যুগে। এখন সে স্থান দখল করেছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। চাঁদপুর জেলায় চাঁদপুর কণ্ঠ একটি ইতিহাস, মাইলফলক, বিকন, জেলার গণমাধ্যমের বিপ্লবের পথপ্রদর্শক। কিন্তু সন্তানের প্রসব বেদনা যেমন মা ছাড়া অন্য কেউ বুঝে না, তেমনই দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের গর্ভধারণ, যত্ন-আত্তি, লালন-পালন, প্রতি ক্ষণে ক্ষণে তার বেড়ে উঠতে কত হোঁচট, শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ঘাত-প্রতিঘাতের ক্ষতচিহ্ন তা শুধুই তার জন্মদাত্রী মা, তারপর বাবা ও দুজনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই জানে। সকল ঘাত-প্রতিঘাত ম্লান হয়ে যায় যখন ‘দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ’ পাঠকের হৃদয়ে ধারণ করে। চাঁদপুর কণ্ঠের যাত্রাপথের পরতে পরতে রয়েছে নানা পত্র-পল্লব। যেখানে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ, নারী-পুরুষ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, শ্রমিক, কৃষকসহ নানা শ্রেণি-পেশার নাগরিকের জীবনের সুখ-দুঃখ রেকর্ড হয়েছে, যা আগামী দিনে এক একটি দলিল হয়ে থাকবে।
চাঁদপুর কণ্ঠের অসাধারণ একটি পদক্ষেপ লক্ষণীয়। তা হচ্ছে প্রকাশিত সংবাদের ওপর সম্পাদকীয় প্রকাশ। এর মাধ্যমে জেলার বহু সমস্যা সমাধানে বিশেষ করে প্রশাসনকে উদ্বুদ্ধ করতে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই পত্রিকার প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত ভাইকে।
একটু পেছনে যাওয়া বাঞ্ছনীয়। এমন একটি সময় ছিলো, যখন পাঠক পত্রিকার জন্যে অপেক্ষা করতেন। কেউ হকারকে ডেকে দৈনন্দিন কেনাকাটার সঙ্গে পত্রিকা কিনতেন। তখন যাতায়াত ব্যবস্থা ছিলো অত্যন্ত নাজুক। সত্তরের দশক। ঢাকা থেকে জাতীয় পত্রিকা ফরিদগঞ্জে আসতো কখনো তিনদিন পর। চাঁদপুর জেলা সদরসহ অন্য থানাগুলোতেও প্রায় তথৈবচ। তবুও পাঠক পত্রিকা পড়তে সচেষ্ট ছিলেন। পাতা উল্টেপাল্টে দেখতেন দেশের কোথায় কী ঘটেছে। কেউ রাজনীতির খবর পড়তেন। এক শ্রেণির পাঠক ছিলেন যারা সম্পাদকীয় ও কলাম পড়তেন। ইংরেজি দৈনিক অবজারভারের পাঠক ছিলো উল্লেখযোগ্য হারে। আশির দশকের গোড়ার দিকে কাউকে ইংরেজি দৈনিক পড়তে দেখলে তার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যেতো। এখন উপজেলায় ইংরেজি দৈনিক চোখে পড়ে না!
তখন সংবাদ শোনার জন্যে মানুষ ‘রেডিও’র ওপর যারপরনাই নির্ভরশীল ছিলেন। সন্ধ্যায় ও রাতে কিছু দোকান ও বাড়িঘরে মানুষ ভিড় জমাতেন। বিশেষ করে ভয়েস অব আমেরিকা (ভোয়া) ও বিবিসি বাংলা থেকে বাংলা ভাষায় প্রচারিত সংবাদ শুনতেন নিয়ম করে। সংবাদ জানা ও শোনার প্রতি মানুষের আগ্রহ ও বিশ্বাস ছিলো নিখাদ। খবরের গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। নিজের দেশ থেকে সঠিক সংবাদ শুনতে না পেয়ে বা অধিক নির্ভরতার জন্যে তারা ওইসব সংবাদমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময়কালে নানা বিধিনিষেধের মধ্যেও গণমাধ্যম নানা কলাকৌশল ব্যবহার করে পাঠকের সামনে সংবাদ উপস্থাপনে বদ্ধপরিকর থেকেছে, প্রকাশ করেছে বা করতে পেরেছে।
কালের পরিক্রমায় সেই ব্রিটিশ ভারত সময়কালের মতো গণমাধ্যম এখন কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়েছে। এক ধরনের বন্ধ্যাত্বকাল অতিক্রম করছে। গণমাধ্যম হাউজের সংখ্যা বাড়লেও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রকাশনার ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়েছে। একদিকে পাঠক চাহিদা পূরণ করা, অপরদিকে ভার্চুয়াল জগতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রিন্ট মিডিয়া বাঁচিয়ে রাখা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। কমেছে পত্রিকার সার্কুলেশন ও বিজ্ঞাপন থেকে আয়। একইভাবে কমেছে পাঠকের চাহিদা মতো সংবাদ প্রকাশ। তাই গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িতদের কাছে এ বিষয়টি ভেবে দেখা সময়ের দাবি হয়ে আছে।
বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন পত্রিকা ভিয়েনাভিত্তিক দৈনিক সংবাদপত্র ‘উইনার জাইটং’। ২০২৩ সালের ৩০ জুন এটির মুদ্রণ বন্ধ হয়ে গেছে। পত্রিকাটির প্রথম সংস্করণের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিলো, ‘কোনো কথার ফুলঝুরি বা কাব্যিকতা নয়, আমরা সংবাদের সরল বিবরণ দিতে চাই’। পত্রিকার শেষ সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘এটা হলো মানসম্পন্ন সাংবাদিকতার জন্যে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়... এখন অনেক অনেক প্ল্যাটফর্ম, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোকে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে চারদিকে ভুয়া খবর, বিড়ালের ভিডিও আর ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সঙ্গে পাল্লা দিতে হচ্ছে’।
১৭০৩ সালের আগস্টে শুরু হওয়া পত্রিকা প্রকাশনার প্রায় ৩২০ বছর পর ‘উইনার জাইটং’ কেনো বন্ধ হয়ে গেলো? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আরো অনেকটা জায়গা জুড়ে যাবে। একেবারেই সংক্ষেপে জানিয়ে রাখতে চাই, সরকারের বিশেষ একটি আইনের ফাঁদে পড়ে পত্রিকাটি বন্ধ হয়েছে। এপ্রিল মাসে অস্ট্রিয়ার জোট সরকারের আইনে কোম্পানিগুলোকে তাদের কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বিজ্ঞাপন আকারে সংবাদপত্রের মুদ্রিত সংস্করণে প্রকাশ করার আইনি বাধ্যবাধকতা রহিত করা হয়েছে। এটিই ছিলো পত্রিকাগুলোর আয়ের একটি বড় অংশ। এই আইন পরিবর্তনের ফলে পত্রিকাটির প্রকাশকের ১ কোটি ৯৬ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি আয় কমে গেছে।
পত্রিকার ওপর নানান খড়গ, কালাকানুন আরোপ করা নতুন কিছু নয়। আবার এর মানে এই নয় যে, বিশ্বের সব দেশে যখন তখন পত্রিকার ওপর খড়গ চালানো এবং পত্রিকা বন্ধ করা হয়। বরং একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, উদারনৈতিক-বিজ্ঞানভিত্তিক জনগোষ্ঠী, উন্নত ও শক্তিশালী রাষ্ট্র কাঠামো টিকিয়ে রাখতে সংবাদপত্রের ওপর কোনোরূপ সেন্সর আরোপ না করে সম্পূর্ণভাবে সেটিকে টিকিয়ে রাখতে হয় রাষ্ট্র তথা সরকারকে। জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে’ বলা হয়েছে : ‘প্রত্যেকের মতামত ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে, এই অধিকারে হস্তক্ষেপ ছাড়াই মতামত রাখা এবং কোনো গণমাধ্যমের মাধ্যমে তথ্য ও ধারণাগুলো অনুসন্ধান গ্রহণ করা, গ্রহণ এবং গ্রহণের স্বাধীনতার সীমানা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত’।
বাস্তবতা এই যে, ব্রিটিশ ভারতে সংবাদপত্রের সূচনা হয়েছে ১৭৮০ সালে হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’কে দিয়ে। ব্রিটিশ রাজের অধীনে সংবাদপত্রসমূহকে যেতে হয়েছিলো বিভিন্ন আইনকানুনের মধ্য দিয়ে। এসবের চাপে অনেক সংবাদপত্র হারিয়ে বা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রিয় পাঠক, সংবাদপত্র হারিয়ে যাওয়ার এই অগণতান্ত্রিকতা এখনো চলমান। আমরা ব্রিটিশ থেকে ভৌগোলিক অর্থে স্বাধীন হয়েছি, কিন্তু নাগরিকগণ ন্যায়ের ভিত্তিতে প্রাপ্ত হবে এমন সর্বক্ষেত্রে স্বাধীন হয়েছি কিনা এ প্রশ্ন দিন দিন জোরালো হয়ে উঠেছে। ১৭৯৯ সালে ব্রিটিশ ভারতে লর্ড ওয়েলেসলি একটি আইন প্রণয়ন করেন। এ আইনের উদ্দেশ্য ছিলো ফরাসিরা যেনো কোনো প্রকার প্রকাশনার সাথে যুক্ত হতে না পারে। ইংরেজরা তাদের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে সব রকম ব্যবস্থা নিয়েছিলো। ‘সেন্সরশিপ অব প্রেস অ্যাক্ট’-এর মূল লক্ষ্য ছিলো ফরাসিরা যাতে এমন কোনো সংবাদপত্র প্রকাশ না করে যেটি ইংরেজ শাসনের জন্যে হুমকি হয়।
প্রিয় পাঠক, সংবাদপত্রের ওপর ব্রিটিশদের আরোপিত কালাকানুন এখনো বহাল আছে। খোদ চাঁদপুর থেকে প্রকাশিত ক’টি পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। সারা দেশের হিসেব তো আরো লম্বা। শুরুতে প্রশ্ন তুলেছিলাম, ‘দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ’ সংবাদ প্রকাশে সরলতা বজায় রাখতে পারছে কি না। উত্তর কী হবে পাঠক ও আমরা জানি। আমরা গণমাধ্যমের দার্শনিকের কাছ থেকে শিখেছি, ‘ক্ষমতাবানরা যা কিছু লুকিয়ে রাখতে চায় সেগুলো সংবাদ। অন্যসব বিজ্ঞাপন’। চাঁদপুর কণ্ঠ বর্তমানে কতোটুকু সংবাদ ছাপছে, কতোটুকু বিজ্ঞাপন- এ প্রশ্ন আমি ব্যক্তিগতভাবে সম্পাদকীয় বিভাগের কাছে রাখতে চাই। একই সঙ্গে পাঠকের বিবেকের ওপর প্রশ্ন তুলে দিচ্ছি, ‘যদি চাঁদপুর কণ্ঠ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংবাদ প্রকাশ করতে না পারে, এর দায় কি শুধুই চাঁদপুর কণ্ঠের, নাকি এ দায় অন্য কোথাও বিস্তৃত’?
দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি এক বিশেষ পরিস্থিতিতে। তার আগে চাঁদপুর থেকে প্রকাশিত অপর একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের গোড়াতে যুক্ত হই। প্রায় ৬ বছর পর একজন মাঠ পর্যায়ের কর্মীর আচরণ আমাকে প্রচণ্ড ব্যথিত করে। আমি সম্পাদকীয় পর্ষদে জানাই। তারা বিচারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিচার হয়নি। মনে কষ্ট নিয়ে স্থানীয় দৈনিক থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিই। প্রায় তিন বছর পার হয়। চাঁদপুর কণ্ঠের রিপোর্টার বন্ধু এম. কে. মানিক পাঠানের সঙ্গে চাঁদপুর কণ্ঠ অফিসে প্রায়শ যেতাম। একদিন তৎকালীন বার্তা সম্পাদক শহীদ পাটোয়ারী কুশল বিনিময় করছিলেন। এর এক ফাঁকে জানতে পারেন, আমি ওই দৈনিকে রিপোর্টিং করছি না। চা-বিস্কুট পরিবেশন করে তিনি কিছুক্ষণ পর উঠে প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাতের কক্ষে প্রবেশ করেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে আমাকে বললেন, আপনি চাঁদপুর কণ্ঠে রিপোর্ট পাঠাবেন কি না? আমি ভাবছিলাম। বন্ধু মানিক পাঠান বললো, এটা তো ভালো প্রস্তাব, চুপ করে আছিস্ কেনো? তখন শহীদ ভাই আমাকে নিয়ে শাহাদাত ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিলেন। শাহাদাত ভাই বললেন, রিপোর্ট পাঠান। এভাবেই চাঁদপুর কণ্ঠের সঙ্গে চারটি বছর পার করতে পেরেছি। যে রিপোর্ট লিড হওয়ার সুযোগ আছে, এমন বেশ কিছু রিপোর্ট প্রথম লিড হয়েছিলো। চাঁদপুর কণ্ঠ সাপ্তাহিক থেকে দৈনিক পর্যন্ত বেশ ক’জন সাংবাদিক জন্ম দিয়েছে। যারা এখন চাঁদপুর ও ঢাকার পত্রিকা হাউজে ও মাঠে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। আমি পড়ে আছি নিজ উপজেলায়। হয়তো এর চেয়ে উপরে ওঠার যোগ্যতা আমি অর্জন করতে পারিনি। তবে আমার স্ত্রী আমার সঙ্গে ৩২টি বছর পার করেছেন। এখন আমার দু সন্তান। প্রতিদিন তাদের ভরণপোষণ জোগাতে হিমশিম খেতে হয়। এরপরও প্রিয় গণমাধ্যম ছাড়িনি। এর সঙ্গে যে আমার জীবন জড়িয়ে গেছে। এ আমার জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে।
যে কথাটি না বললেই নয়। তা হচ্ছে, আশির দশকের গোড়ার দিকে ফরিদগঞ্জে পত্রিকা আসতো পাশর্^বর্তী রায়পুর উপজেলা সদর থেকে। কাঁচা রাস্তা, প্রচুর খানাখন্দকে ভরপুর। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিতে ভিজে পলিথিন গায়ে ও পত্রিকায় মুড়িয়ে কঠিন এ কাজটি যিনি করতেন তার নাম মোঃ ইসমাইল। তিনি এখনো ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদরে পত্রিকা বিলির কাজ করে চলেছেন। বয়সের ভারে ও শারীরিক অসুস্থতায় তিনি এখন অনেকটা বার্ধক্যের দিকে। ইসমাইল ভাইয়ের সুস্থতা ও দীর্ঘ জীবন কামনা করছি।
দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের জন্মদাতা ও কলাকুশলীগণ প্রকৃতির নিয়মে যে কোনো দিন পৃথিবী ত্যাগ করবেন। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ডাক ছাড়াও তাদের কারো বয়স এখন জবুথবু পর্যায়ে। কে কখন চলে যাবেন কেউ জানে না। কিন্তু থেকে যাবে তাদের কর্মণ্ডস্মৃতি। ৩০ বছর পূর্তিতে ও বর্তমান বাস্তবতায় অকুণ্ঠচিত্তে বলতে চাই, পৃথিবী যতোদিন থাকবে চাঁদপুর কণ্ঠ ততোদিন থাকবে। দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ দীর্ঘজীবী হোক।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী। বর্তমানে দৈনিক মানবজমিন ও দৈনিক চাঁদপুর দর্পণে কর্মরত। প্রতিষ্ঠাতা : ফরিদগঞ্জ পোস্ট।