প্রকাশ : ০৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
শিরোনামটা কিংবদন্তি ফুটবলার পেলেকে নিয়ে বানানো সিনেমা ‘পেলে, বার্থ অব অ্যা লিজেন্ড’ সিনেমার বাংলা অনুবাদ। গত ২৯ ডিসেম্বর কোটি কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন বিশ্ব ফুটবলের রাজা বলে খ্যাত কালো মানিক পেলে (১৯৪০-২০২২)। আজকের গল্পটা ফুটবল সম্রাট এদসোঁ আরাঁচ দু নাসিমেঁতু (জন্মনাম) ওরফে পেলের।
পেলের বয়স তখন মাত্র নয় বছর। ১৯৫০ বিশ্বকাপে ফাইনালে উরুগুয়ের কাছে হেরে ঘরের মাঠে শিরোপা হাতছাড়ার বেদনায় পুড়ে ছারখার হয় গোটা ব্রাজিল। সেই হৃদয়বিদারক হারে আশ্চর্য-স্তব্ধ হয়েছিল ব্রাজিল; যাকে মারাকানজো (মারাকানা বিপর্যয়) হিসেবে অভিহিত করা হয়।
২০১৪ সালে ফিফাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মারাকানা বিপর্যয় নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করেছিলেন পেলে। বাবাকে কাঁদতে দেখার সেই দৃশ্য তার ভেতর তৈরি করেছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। তিনি বলেন, সেই পরাজয়ের কারণে প্রথম আমি আমার বাবাকে কাঁদতে দেখেছিলাম। আমার মনে আছে, তাকে বলেছিলাম : ‘কেঁদো না বাবা, আমি তোমার জন্য বিশ্বকাপ জিতব।’
ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি অবশ্য এটাও স্বীকার করেছিলেন যে, বাবাকে আসলে তিনি সান্ত¡না দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টাই অল্প বয়সে করেছিলেন। কারণ বাবাকে কাঁদতে দেখার মুহূর্তে কী বলবেন বালক পেলে তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
ফুটবল ঈশ্বর অবশ্য নয় বছরের সেই বালকের মুখ থেকে বের হওয়া কথাটাকেই যেন নিয়তির লিখন বানিয়ে ছাড়লেন। আট বছর পর ১৯৫৮ ব্রাজিল বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ডাক পেলেন কালো মানিক খ্যাত ফুটবলার। অথচ তিনি নিজে ধারণাও করেননি এতো অল্প বয়সে বিশ্বকাপ খেলবেন। ৬ গোল করে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হবেন। একটি জাতিকে প্রথম শিরোপা জয়ের উদযাপনে হাসাবেন।
একটি তথ্যচিত্রে পেলে নিজেই বলেছিলেন সেই দিনটির কথা, যেদিন বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাওয়ার খবর প্রথম শোনেন। তথ্যচিত্রের বরাত দিয়ে দ্য সান তাদের প্রকাশিত এক খবরে জানায়, সেদিন পেলের বাবা রেডিওতে দল ঘোষণার খবর শুনছিলেন। হঠাৎ তার কানে ছেলের নাম আসে। তিনি কিছুটা অবাক হন। কিছুক্ষণ বাদে প্রতিবেশীরা উল্লাস করতে করতে বাড়ি চলে আসেন। সবকিছু শুনে বাবার মতো পেলেও মনে করেন, হয়তো ভুল করে তার নামটি ঘোষিত হয়েছে! সন্ধ্যা হওয়ার আগেই অবশ্য পেলের ভুল ভেঙ্গে যায়। তিনি নিশ্চিত হয়ে যান, বিশ্বকাপ তাকে ডাকছে।
পেলে তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, আমার পরিবারকে নিয়েই প্রথম চিন্তাটা হচ্ছিল এমন-তারা কি জানতো যে আমরা চ্যাম্পিয়ন? আমি আমার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু টেলিফোন ছিল না। আমি বারবার বলতে থাকলাম, ‘আমাকে আমার বাবার সাথে বলতে হবে, আমাকে আমার বাবার সাথে বলতে হবে।’
দেশে ফিরে যাওয়ার পরে বাবার সঙ্গে দেখা হওয়ার মুহূর্তকে স্মরণ করে পেলে আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘আমি আমার বাবাকে আবারও কাঁদতে দেখেছিলাম, তবে এবার আনন্দে।’
দীর্ঘ ৮২ বছরের জীবনে এই কিংবদন্তির রয়েছে এমন অনেক গল্প। ব্রাজিলিয়ান ক্লাব সান্তোসের হয়ে একবার নাইজেরিয়াতে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলতে গিয়েছিলেন পেলে। শুধু পেলে কে দেখার জন্য নাকি ৪৮ ঘন্টার জন্য থেমে গিয়েছিলো নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধ। ফ্রি স্টাইল মাস্টার ফুটবলার রোনালদিনহো থেকে আজকের মেসি, রোনালদো, নেইমার, ইব্রাহিমোভিচ কিংবা হালান্ড, এমবাপ্পেরা যে চোখ ধাঁধাঁনো ড্রিবলিং, বাইসাইকেল কিক, ভলি, নাটমেগ সহ নানান ধরনের স্কিলে আমাদের মুগ্ধ করেছে বা করছে সবই নাকি সবার আগে পেলে করেছেন। পেলের জীবন সংক্রান্ত কিছু তথ্য ফুটবলপ্রেমী হিসেবে জিজ্ঞেস করতেই পারেন।
পেলে ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের ত্রেস কোরাচয়, মিনাস জেরাইসে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দন্দিনহো এবং মাতার নাম সেলেস্তে আরাস। তার পিতাও একজন ফুটবলার ছিলেন ও ফ্লুমিনেস ফুটবল ক্লাবে খেলতেন। পেলে দুই ভাই-বোনের মধ্যে বড় ছিলেন এবং মার্কিন উদ্ভাবক টমাস এডিসনের নামানুসারে তার নাম রাখা হয়েছিল। তার পিতামাতা এডিসন (ঊফরংড়হ) থেকে সরিয়ে তাকে "এদসোঁ" (ঊফংড়হ) বলে ডাকার সিদ্ধান্ত নেন, তবে বিভিন্ন সনদপত্রে ভুল করে তার নামের বানান 'ঊফরংড়হ' লিখতে দেখা যায়। পরিবারে তার ডাকনাম ছিল 'জিকো'। বিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি 'পেলে' ডাকনামটি পান। এটি দাবি করা হয় যে, পেলে নিজেই তার ডাকনামটি দিয়েছিলেন, তার কাছে তার পছন্দের ডাকনাম চাওয়া হলে তিনি স্থানীয় ভাস্কো দা গামার গোলরক্ষক বিলের (ইরষল্ক) নাম উচ্চারণ করেন, তবে তিনি ভুলভাবে উচ্চারণ করেন, পরে পেলে অভিযোগ জানালেও বিদ্যালয়ে তার ডাকনাম পেলে রয়ে যায়। পেলে তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, যে নামটির অর্থ কী তা নিয়ে তার এবং তার পুরানো বন্ধুদের তখন কোনও ধারণা ছিল না। নামটি 'বিলে' থেকে উদ্ভূত হয়েছে, এবং হিব্রু ভাষার এটির অর্থ অলৌকিক।
পেলে সাও পাওলো রাজ্যের বাউরুতে দারিদ্রের মাঝে বেড়ে ওঠেন। চাকর হিসেবে তিনি চায়ের দোকানে কাজ করে বাড়তি অর্থ উপার্জন করতেন। তাঁর বাবা তাঁকে ফুটবল খেলা শেখান, তবে তার একটি ফুটবল কেনার সামর্থ্য ছিল না। ফলে তিনি মোজার ভিতর সংবাদপত্র, দড়ি বা আঙ্গুর ঢুকিয়ে বল বানিয়ে খেলতেন। পেলে তার যৌবনে বেশ কয়েকটি অপেশাদার দলের হয়ে খেলেছেন, যার মধ্যে রয়েছে সেট ডি সেতেমব্রো, ক্যান্টো দো রিও, সাও পাওলিনহো এবং আমিরিকুইনহা। পেলে দুটি সাও পাওলো রাজ্য যুব চ্যাম্পিয়নশিপে বাউরু অ্যাথলেটিক ক্লাব জুনিয়রের নেতৃত্ব দেন (তাদের প্রশিক্ষক ছিলেন ওয়ালডেমার ডি ব্রিটো)। পেলে তার মধ্য-কৈশোরে রেডিয়াম নামক একটি ইনডোর ফুটবল দলের হয়ে খেলেন। সেই সময় বাউরুতে ইনডোর ফুটবল সবেমাত্র জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তিনি এই অঞ্চলের প্রথম ফুটসাল (ইনডোর ফুটবল) প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। পেলে এবং তার দল প্রথম চ্যাম্পিয়নশিপ এবং আরও বেশ কয়েকটি প্রতিযোগিতা জিতে।
পেলের মতে, ফুটসাল (ইনডোর ফুটবল) কঠিন চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করেছিল। তিনি বলেন, এটি ঘাসের ওপর ফুটবল খেলার চেয়ে অনেক দ্রুত ছিল এবং পিচে প্রত্যেকেই একে অপরের কাছাকাছি থাকায় খেলোয়াড়দের দ্রুত চিন্তা করতে হতো। পেলে ক্রীড়ায় আরও ভাল ভাবে চিন্তা করতে সহায়তা করার জন্য ফুটসালকে কৃতিত্ব দেন। উপরন্তু, ফুটসালের কারণে তিনি ১৪ বছর বয়সে প্রাপ্তবয়স্কদের সাথে খেলতে পেরেছিলেন। তিনি যে টুর্নামেন্টগুলোতে অংশ নিয়েছিলেন তার মধ্যে একটি টুর্নামেন্টে, প্রথমে তাকে খেলার জন্য খুব কম বয়সী বলে ভাবা হয়েছিল, তবে পেলে শেষ পর্যন্ত ১৪ বা ১৫টি গোল করে শীর্ষ গোলদাতা হিসেবে উক্ত টুর্নামেন্ট শেষ করেন। পেলে বলেন, "এটি আমাকে অনেক আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল", "আমি তখন জানতাম যে যাই ঘটুক না কেন ভয় পেয়ো না"।
১৯৫৬ সালে পেশাদার ক্লাব সান্তোস এফসিতে খেলার জন্য ডি ব্রিটো পেলেকে সাও পাওলোর কাছে অবস্থিত শিল্প ও বন্দর শহর সান্তোসে নিয়ে যান। তিনি পেলেকে দেখিয়ে সান্তোসের পরিচালকদের বলেন যে, এই ১৫ বছর বয়সী ছেলে একদিন ‘বিশ্বের সেরা ফুটবল খেলোয়াড়' হবে। পেলে এস্তাদিও ভিলা বেলমিরোতে ট্রায়ালের সময় সান্তোসের কোচ লুলাকে মুগ্ধ করেন। ১৯৫৬ সালের জুনে পেলে সান্তোস ক্লাবে খেলতে ক্লাবটির সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। সেই সময় স্থানীয় গণমাধ্যমে পেলেকে ভবিষ্যতের সুপারস্টার আখ্যা দিয়ে বেশ প্রচার করা হয়। ১৯৫৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর করিন্থিয়ান্স দে সান্তো আন্দ্রে'র বিপক্ষে ১৫ বছর বয়সে পেলের অভিষেক ঘটে এবং ৭-১ ব্যবধানের জয়ে তিনি আকর্ষণীয় পারফরম্যান্স করেন। এই ম্যাচেই পেলে তার দীর্ঘ ও প্রফুল্ল কর্মজীবনের প্রথম গোলটি করেন।
পেলে ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই মারাকানা স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন। ২-১ ব্যবধানে হারা সেই ম্যাচে ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে ব্রাজিলের পক্ষে প্রথম গোল করে পেলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার স্থান দখল করেন।
১৯৫৮ ফিফা বিশ্বকাপ
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে পেলে তার প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচ খেলেন। ১৯৫৮ সালের ফিফা বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডের সেই ম্যাচটা ছিল প্রতিযোগিতার তৃতীয় খেলা। সেই বিশ্বকাপের সর্বকনিষ্ঠ (এবং তখন পর্যন্ত যেকোন বিশ্বকাপ খেলায় সর্বকনিষ্ঠ) খেলোয়াড় পেলের সতীর্থ ছিলেন গ্যারিঞ্চা, যিতো এবং ভাভা। ওয়েলসের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে করা গোলটি ছিল প্রতিযোগিতায় পেলের প্রথম এবং সেই ম্যাচের একমাত্র গোল, যার সাহায্যে ব্রাজিল সেমিফাইনালে উত্তীর্ণ হয়। ম্যাচের সময় পেলের বয়স ছিল ১৭ বছর ২৩৯ দিন, বিশ্বকাপের গোলদাতাদের মধ্যে সবচেয়ে কম।
১৯৬৬ ফিফা বিশ্বকাপ
১৯৬৬ সালের ফিফা বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্যায়ের ১ম খেলায় বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে জয়ী হলেও হাঙ্গেরীর বিরুদ্ধে ২য় খেলায় ব্রাজিল হেরে যায়। এর পূর্বে বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে জয়ী হলেও তিনি গুরুতর আঘাত পান। তারপরও কোচ ভিসেন্তে ফিওলা সকলকে আশ্চর্যান্বিত করে গ্রুপের শেষ খেলায় পর্তুগালের বিপক্ষে পেলেকে মাঠে নামান। তিনি পুরো রক্ষণভাগ পরিবর্তন করে ফেলেন। এমনকি গোলরক্ষকও বাদ পড়েননি। আক্রমণভাগে তিনি জায়ারজিনহো এবং পরিবর্তিত দু'জন খেলোয়াড়কে দেন। মধ্যমাঠে তিনি প্রথম খেলার ন্যায় সাজান। যদিও তিনি জানতেন যে, পেলে তখনো তার মারাত্মক জখমকে কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
১৯৭০ ফিফা বিশ্বকাপ
১৯৭০ সালের আগের বিশ্বকাপের ব্যর্থতা মুছে ফেলে আবারও শিরোপা জিতে নেয় ব্রাজিল। টানা চারটি টুর্নামেন্টের তিনটিরই ট্রফি ওঠে তাদেরই হাতে। পেলে খেলেন তার চতুর্থ বিশ্বকাপের শেষটি। প্রতিটা ম্যাচে গোল করেন জেয়ারজিনহো। ফাইনালে ইতালিকে ৪-১ গোলে গুঁড়িয়ে দেয় ‘ক্যাপ্টেন’ কার্লোস আলবার্তো। দল তিনবার শিরোপা জেতায় জুলে রিমে ট্রফিটা একেবারেই দিয়ে দেওয়া হয় ব্রাজিলকে। সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন পেলে। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপের পর নিজেকে সর্বকালের সেরা ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে প্রমাণ করেন পেলে।
পেলের কিছু রেকর্ড
ফিফার ‘সর্বকালের সেরা’, ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির ‘বিংশ শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ’ হয়েছিলেন পেলে। ফুটবলের মানদণ্ড হিসেবে অনেকেই তাঁকে বিবেচনা করে থাকেন।
বিশ্বকাপজয়ী সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হওয়া থেকে শুরু করে সেলেসাওদের হয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশিসংখ্যক আন্তর্জাতিক গোল করাসহ বেশ কিছু দুর্দান্ত উচ্চতা অর্জন করেন পেলে। এই কিংবদন্তির একাধিক রেকর্ড এখনো কেউ ভাঙ্গতে পারেননি।
চলুন এক নজরে দেখে নেয়া যাক ফুটবল সম্রাটের সকল রেকর্ড।
* মাত্র ১৬ বছর নয় মাস বয়সে ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই আর্জেন্টিনার বিপক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নামেন। ব্রাজিল সেই খেলায় ২-১ গোলে জিতেছিল। অভিষেক ম্যাচেই ব্রাজিলের প্রথম গোলটি তিনিই করেছিলেন। সবচেয়ে কম বয়সে সেলেসাওদের জার্সিতে গোল করার সেই রেকর্ড এখনো কেউ ভাঙ্গতে পারেননি।
* ১৯৫৮ বিশ্বকাপে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে তার বিশ্বকাপ অভিষেক হয়। ড্রিবলিং আর গতি দেখিয়ে ঠিকই কোচের মন জয় করেন।
* নক আউট পর্বের খেলায় ওয়েলসের বিপক্ষে পেলের করা ম্যাচের একমাত্র গোলেই সেমি-ফাইনালে পৌঁছায় ব্রাজিল। এটাই ছিল তাঁর প্রথম বিশ্বকাপ গোল। ১৯ জুন হওয়া সেই ম্যাচে পেলের গোলটি এখনো বিশেষ এক কারণে স্মরণীয় হয়ে আছে। ১৭ বছর ২৩৯ দিন বয়সে তিনি গোলটি করেছিলেন। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে গোল করার এই রেকর্ড ৬৪ বছর ধরে আজও অক্ষত রয়েছে।
* ১৯৫৮ বিশ্বকাপে সেমি-ফাইনালে প্রতিপক্ষ হিসেবে শক্তিশালী ফ্রান্সকে পায় সেলেসাওরা। এদিন যেন গোটা বিশ্ববাসীকেই অবাক করে দেন পেলে। তার হ্যাটট্রিকে ফ্রান্সকে ৫-২ গোলে হারিয়ে ফাইনালে উঠে ব্রাজিল। সুইডেনকে ৫-২ গোলে হারিয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। বালকবীর পেলে ফাইনালে জোড়া গোল করেছিলেন। ওই আসরে করেন মোট ৬ গোল।
* পেলে একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে সর্বাধিক তিনবার (১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭০) বিশ্বকাপ জয় করেছেন।
* ফিফার অফিসিয়াল ওয়েবসাইট অনুযায়ী, পেলে ১,৩৬৩টি ম্যাচ খেলে ১,২৮১টি গোল করেছেন, কিন্তু এর ভেতর কয়েকটি অনানুষ্ঠানিক ম্যাচ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সান্তোস এবং নিউইয়র্ক কসমসের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ ছিল। এদিকে, গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস বলছে, পেলে ১,৩৬৩ ম্যাচে ১,২৮৯টি গোল করেছেন।
* দ্য রেক স্পোর্ট সকার স্ট্যাটিস্টিকস ফাউন্ডেশন (আরএসএসএসএফ) জানিয়েছে, শুধুমাত্র প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচের ওপর ভিত্তি করে ৮৩১ ম্যাচে পেলের অফিসিয়াল গোলের সংখ্যা ৭৬৭। তবে অনানুষ্ঠানিক ম্যাচগুলো হিসাবে আনলে ১,৩৭৫ ম্যাচে তার মোট গোল ১,২৮৪টি।
* স্বদেশি ক্লাব সান্তোসের হয়ে ৬৫৯টি অফিসিয়াল ম্যাচে ৬৪৩ গোল করেছিলেন।
* জাতীয় দলের হয়ে ৯২ ম্যাচে সর্বাধিক ৭৭ গোল তার। ৬০ বছর ধরে তিনি এককভাবে ব্রাজিলের সর্বাধিক গোলদাতা ছিলেন। চলতি বছর কাতার বিশ্বকাপে তার রেকর্ড স্পর্শ করেছেন নেইমার। বিশ্বকাপে পেলের গোল রয়েছে এক ডজন।
* ১৯৭১ সালে সাও পাওলোতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিনি জাতীয় দলের হয়ে শেষ গোলটি করেছিলেন। ম্যাচটি ১-১ গোলে ড্র হয়।
* ১৯৭৭ সালে অবসর নেয়ার পরও সাবেক এই দুটবলার সারাবিশ্বে এখনও সবচেয়ে পরিচিত ও সম্মানিত ব্যক্তিদের একজন।
* পেলে তার পুরো ফুটবল ক্যারিয়ারে তাঁর হাতে মাত্র একবারই অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরেছিলেন। ক্লাব ও দেশের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করার জন্য তাকে যখনই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, সেটা তিনি সবসময় প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু এই ঘটনার ব্যতিক্রম হয় পেলের ৫০ বছর বয়সে। সেটা ছিল ১৯৯০ সালের, জাতীয় ফুটবল থেকে তার অবসর নেয়ার ১৯ বছর পরে! সেবার ব্রাজিলের সাথে বাকি বিশ্বের একটি প্রীতি ম্যাচ হয়েছিল মিলানে। তাতে অংশ নিয়েছিলেন পেলে। তার ৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই ম্যাচের আয়োজন করা হয়। প্রথমার্ধের ৪৫ মিনিট তিনি মাঠে ছিলেন।
২০২২ সাল খুব বেশি করে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ, মানবতার প্রশ্নে ইউরোপের চির ভ-ামিপূর্ণ রূপ, বিশ্ব অর্থনীতির মন্দাবস্থা, চীন-তাইওয়ান দ্বন্দ্ব এবং যুক্তরাষ্ট্রের চিরচেনা লম্বা নাক, ইমরান খানের ক্ষমতা চ্যুতি, বাংলাদেশের পদ্মাসেতু এবং মেট্রোরেল, কাতার বিশ্বকাপ ও মেসির বিশ্বকাপ জয় এবং অবশেষে ফুটবল সম্রাট পেলের চলে যাওয়া। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের খেলোয়াড়, তবুও ফুটবলের একজন ছোটখাটো ভক্ত হিসেবে মনে করি, বিশ্বফুটবলের রাজপুত্র যদি ম্যারাডোনা হন, ফুটবল রাজ্যের রাজা হলেন পেলে। পেলে ইউরোপের লীগে কখনো খেলেননি। হয়তো তখনকার উগ্র বর্ণবাদ বাধা হয়েছিলো। কে জানে? স্পষ্ট কোনো তথ্য আমার জানা নেই। তবে অতি আধুনিক যুগের রোনালদিনহোও নাকি কালো হওয়ার কারণে রিয়াল মাদ্রিদে খেলতে পারেননি। ফুটবল ভক্তদের ধারণা, সেই যুগের ভয়ানক বর্ণবাদও হয়তো পেলেকে সেরা হওয়ার পরও ইউরোপে খেলতে দেয়নি। যাই হোক, পেলে সেরা, সেরাদের সেরা, এটা মানতে অন্তত কোনো বাধা নেই। তবে মৌসুমী ভক্তদের কথা আলাদা। ফুটবল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এবং নান্দনিক খেলা, আর পেলে সেই নান্দনিকতার জনক। সেকালের পেলে একালের স্ট্রিট বালক রোনালদিনহো কিংবা রোড ক্লিনার থেকে সিআর সেভেন হওয়া রোনালদোদের অনুপ্রেরণা।
বিঃ দ্রঃ লেখক নিজে একজন আর্জেন্টিনার ভক্ত হয়েও এটা স্বীকার করেছেন।
লেখক : হাসান মাহাদি, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
ইমেইল : [email protected]। মোবাইল ফোন : ০১৫১৮৭৮৮৪৫৫