প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
বত্রিশ দলের মহারণে কাতার হয়ে উঠেছে ইতিহাসের পৌরাণিক কুরুক্ষেত্রের সত্যিকার প্রতিচ্ছবি। নাদুস-নুদুস লা’য়িবের কোমল মাস্কটটি কাতারের স্টেডিয়ামজুড়ে যে আহ্বান ছড়িয়ে দিয়েছে, তার আলোড়ন ঘুম কেড়ে নিয়েছে সাত-সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরের লোনাজলে প্রতিনিয়ত সিক্ত হওয়া বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষের। কেউ কেউ নিজের জমি বিক্রি করে তৈরি করেছে পাঁচ মাইল দীর্ঘ প্রিয় দলের পতাকা। আর কেউ নিজের লুঙ্গি হতে শুরু করে চুল পর্যন্ত সবকিছুতেই নিজের পছন্দের দলের পতাকার রঙে রাঙিয়ে তুলেছে। একই ঘরে স্বামী আর্জেন্টিনার পতাকার আদলে মশারী আনার কারণে গৃহকর্ত্রী রান্নায় হলুদের ব্যবহার দিয়েছে বাড়িয়ে। আসলে বাঙালি উন্মাদনাপ্রবণ জাতি। বিশ্বকাপ এলে সমর্থকদের উন্মাদনার হুঁশ থাকে না।
বত্রিশ দলের মহারণ এখন ষোল দলের টিকে থাকার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। এ মুহূর্তে হল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ব্রাজিল ও ক্রোয়েশিয়া ষোল দলের লড়াইয়ে বিজয়ী হয়ে আট দলের ক্ষুদ্র তালিকায় নাম লিখিয়েছে। এবারের বিশ্বকাপে ইতালি ও চিলির অভাব খুব বেশি অনুভূত হচ্ছে। পাশাপাশি ইউরোপের শক্তিশালী জার্মানকে প্রথম পর্বেই ঘরে ফেরার টিকেট ধরিয়ে দিয়েছে তুলনামূলক কম শক্তির দলগুলো। যতটুকু খেলা এগিয়েছে তাতে এমবাপের ফ্রান্সকে তথা লা ব্লুজদের শিরোপার কঠিন দাবিদার বলে মনে হচ্ছে। বর্তমানে রাজার দেশ ইংল্যান্ডও নিজেদের শিরোপার দাবিদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। লা লিগার স্পেন, জোগো বনিতোর সেলেসাও এবং মেসি-মুগ্ধ আর্জেন্টিনাও এই শিরোপাকে ছেড়ে কথা বলবে না।
ফিফা র্যাংকিংয়ে দ্বিতীয় দল বেলজিয়াম এবার হতাশ করে প্রথম পর্বে শুধু বাতিলই হয়নি, খেলার সৌন্দর্যও নষ্ট করেছে। তাদেরকে শীর্ষ দল ধরে যে গ্রুপটা করা হলো তা হয়ে গেছে দুর্বল গ্রুপ। পোল্যান্ড টিমটাকে নিয়েও একই কথা প্রযোজ্য। এই দলটা দ্বিতীয় পর্বে আসার যোগ্য দলই ছিলো না। কিন্তু গণিতের হিসেব মিলিয়ে খেলা দিয়ে না হলেও অঙ্কের কারণে তারা দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে এসেছে। কিন্তু তাদের দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলা সবাইকে হতাশ করেছে। মহাদেশ হিসেবে এবার এশিয়া এবং আফ্রিকার দলগুলো চমক দেখিয়েছে। নিজেদের প্রথম খেলায় এশিয়ার সৌদি আরব আর্জেন্টিনাকে ধরাশায়ী করে হৈচৈ ফেলে দিলেও পরের খেলাগুলোতে তা ধরে রাখতে পারেনি। এশিয়ার ফুটবল পরাশক্তি দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে দ্বিতীয় রাউন্ডে এসেছে। দল হিসেবে জাপানের খেলা অনেককেই মুগ্ধ করেছে। দ্বিতীয় রাউন্ডে কোরিয়া মুখোমুখি হয়েছে ব্রাজিলের। আফ্রিকান দলগুলের মধ্যে সেনেগাল, মরক্কো বেশ ভালো খেলছে।
তারকা খেলোয়াড়দের কথা বললে নাম চলে আসে মেসি, নেইমার, রোনালদো ও এমবাপের। নেইমার আহত হয়ে দ্বিতীয় খেলার পর ৬ ডিসেম্বর মাঠে নেমেছেন। মেসির ওপর পুরো পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষার চাপ তৈরি হয়েছে। এবারে শিরোপা জিততে না পারলে মেসি কালের ধুলোয় হারিয়ে যাবেন নিঃসন্দেহে। সেই তুলনায় ফ্রান্সের এমবাপে বেশ উজ্জ্বল। পর্তুগালের রোনালদো যে অস্তগামী সূর্য তা বেশ বোঝা গেছে। ইংল্যান্ডের সাকা, ব্রাজিলের রিচার্লিসন ভবিষ্যতের তারকা হিসেবে নিজেদের নাম লিখিয়ে ফেলেছেন ইতোমধ্যেই। খেলা পরিচালনার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তির ব্যবহার কিছু কিছু বিতর্ক তৈরি করেছে। বিশেষত, ভূমিতে উভয়ের পায়ের অবস্থান সমান হলেও কেবল কাঁধের ক্ষীণ অংশ প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে ছাপিয়ে যাওয়ায় ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারী (ঠঅজ) অফসাইড বিবেচনা করে গোলটাকে বাতিল করে দেয়াটা অযৌক্তিক বলে মনে হয়েছে। খেলা পরিচালনায় কোনো কোনো রেফারী কিছুটা পক্ষপাতের শিকার বলে মনে হয়েছে। সেই তুলনায় নারী রেফারীরা বেশ ভালো করেছেন।
কর্তৃপক্ষ এমনভাবে ফিক্শ্চার করেছেন যাতে ইউরোপ ও ল্যাটিনের মধ্যে ফাইনাল হয়। সবকিছু ঠিকঠাক মতো চললে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সেমিফাইনাল এবার আর এড়ানো যাবে না বলে মনে হচ্ছে।