সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০

যে কাপে কাঁপে পৃথিবী
অনলাইন ডেস্ক

আরব উপদ্বীপের একটি ছোট দেশ কাতারে আগামী বিশে নভেম্বর থেকে শুরু হতে যাচ্ছে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপ ফুটবল। পাঁচটি শহরের আটটি মাঠে বত্রিশটি দলের ফুটবল বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই। কাতারের গ্রীষ্মকালীন অতি উত্তপ্ত আবহাওয়াকে এড়িয়ে, শরতোত্তর প্রাক্ শীতের আরামদায়ক আবহাওয়ায় এই প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবলের কোন আসর বসতে যাচ্ছে এবং কাতার এর আয়োজক। আয়োজকের লড়াইয়ে কাতার পেছনে ফেলেছে জাপান, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকার মতো দেশগুলোকে। কাতারের এই আয়োজক হয়ে ওঠাকে কেন্দ্র করে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। শেষমেষ কাতারই বিজয়ী হয়েছে। বিশ্বকাপের আয়োজক হয়েছে বলে কাতারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অজস্র প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। এমনও বলা হচ্ছে, বিশ্বকাপ আয়োজনকে কেন্দ্র করে কাতারে এ পর্যন্ত চার হাজারের মতো শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে। তবুও কাতার এগিয়ে গেছে তার লক্ষ্য পূরণে।

ছাব্বিশ লাখ হতে কিছু বেশি জনসংখ্যা নিয়ে কাতার পৃথিবীর বুকে বর্তমানে অন্যতম ধনী ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হলেও বিংশ শতকের মধ্য ভাগেও এটি ছিল এক দরিদ্র ও অনুন্নত দেশ। স্বাধীনতা অর্জনের সালের দিক থেকে কাতারের সাথে বাংলাদেশের বেশ মিল রয়েছে। কাতার স্বাধীনতা ঘোষণা করে ঊনিশশো একাত্তর সালের পয়লা সেপ্টেম্বর এবং ইংরেজরা তাদের স্বাধীনতা দিয়ে যায় তেসরা সেপ্টেম্বর। তেলের খনি আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে কাতার বিশ্ব ধনীদের খাতায় নাম লিখিয়েছে। কাতারের মোট জনসংখ্যার মাত্র চৌদ্দভাগ কাতারী আর বাকি শতকরা ছিয়াশি ভাগ বিদেশি। এদের মধ্যে অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। কাতারে নারীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র কুড়ি ভাগ। শাসন ব্যবস্থার ধরনে কাতার একটি আমিরাত রাষ্ট্র । অর্থাৎ সুলতান বা রাজা নয়, আমিরই এখানে যুগপৎ সরকার ও রাষ্ট্র প্রধান।

কথা ছিলো কাতার বিশ্বকাপ থেকেই অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যার সম্প্রসারণ হবে। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত হয়, দুহাজার ছাব্বিশ সালের বিশ্বকাপ থেকেই দলের সংখ্যা বাড়িয়ে আটচল্লিশে উন্নীত করা হবে। যদিও কুড়ি তারিখের আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে কাতার বিশ্বকাপের শুভ উদ্বোধন হবে, কিন্তু খেলা মাঠে গড়াবে একুশ তারিখ স্বাগতিক কাতার ও ইকুয়েডরের মধ্যকার প্রারম্ভিক ম্যাচ দিয়ে। পেন্টাজয়ী সেলেসাওরা এবার হেক্সা জয়ের মিশনে মাঠে নামছে। সবার হিসাব-কিতাবে সেলেসাওরাই ফেভারিট। তবে সেলেসাওদের কান্ডারি নেইমারের দৃষ্টিতে এবার ফেভারিটদের তালিকায় আছে জার্মানি, আর্জেন্টিনা আর ইংল্যান্ডের মতো দলও। ম্যারাডোনার উত্তরসূরি লিওনেল মেসির এটা শেষ বিশ্বকাপ। হয়তো বা নেইমারের জন্যেও। মেসি কি আদৌ তার বদনাম ঘুচাতে পারবে কি না তা নিয়ে উদ্গ্রীব হয়ে আছে সারা ফুটবল বিশ্ব।

কাতার বিশ্বকাপ শুধু আয়োজনের সময়কাল দিয়ে নয়, আরো একটা বিষয়ে ইতিহাস হতে যাচ্ছে। এই প্রথম কোন বিশ্বকাপে পুরুষ রেফারিদের পাশাপাশি পুরুষদের ইভেন্টে তিনজন নারী রেফারি খেলা পরিচালনা করবেন। এই তিনজন নারী রেফারির সহকারী হিসেবেও থাকছেন আরো তিনজন নারী। বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম তিনজন নারী রেফারি হচ্ছেন ফ্রান্সের স্তেফানি ফ্রাপার্ত, রুয়ান্ডার সালিমা মুকানসাঙ্গা এবং জাপানের ইয়োশিমি ইয়ামাশিতা। আয়োজক হিসেবে কাতার কোন ছাড় পায়নি এ বিশ্বকাপে। তাদেরকেও এএফসির সিদ্ধান্তে খেলতে হয়েছে বাছাই পর্বে। তারা তাদের গ্রুপে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ান হয়েই মূল পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। কাতার বিশ্বকাপে কাতার ছাড়াও জাপান, ইরান, সৌদি আরব রয়েছে এশিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে।

বিশ্বকাপে আপাতত দুটো গ্রুপকেই গ্রুপ অব ডেথ বলে মনে করা হচ্ছে। একটি হলো গ্রুপ ‘বি’ আর অন্যটি গ্রুপ ‘জি’। গ্রুপ ‘বি’ মূলত রাজনৈতিক কারণে আলোচনায় এসেছে। এতে আছে ইংল্যান্ড, ইরান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েলস্ জাতীয় দল। ইরানের সাথে আমেরিকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং ইংল্যান্ডের সাথে সহোদর ভাই ওয়েলস্-এর দ্বৈরথ নিয়ে গ্রুপ বি আলোচনায় এসেছে টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই। কিন্তু খেলার বিচারে গ্রুপ জি-এর গুরুত্ব বেশি থাকবে বলেই মনে হয়। গ্রুপ জি-তে আছে টুর্নামেন্ট ফেভারিট ব্রাজিল, সুইজারল্যান্ড, সার্বিয়া এবং ক্যামেরুন। ব্রাজিল কেবল শিল্পিত ফুটবলই খেলে না, তাদের ফুটবলাররা পৃথিবীর সর্বত্র দাপিয়ে বেড়ায় সকল লীগে। কাজেই সবার খেলার ধরন ও শক্তি তাদের নখ দর্পণে। অবশ্য যতবারই ব্রাজিল হট ফেভারিট হিসেবে মাঠে নেমেছে তার বেশিরভাগ সময়েই তারা বিফল হয়েছে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে ব্রাজিলের স্পেন বিশ্বকাপের দলটিই ছিল সবচেয়ে সেরা যারা কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিতে হয়। অথচ ওই দলের জিকো, সক্রেটিস, ফ্যালকাওরা সবাই বিশ্বসেরা তারকা। শুধু নামে নয়, খেলার শিল্প ও দক্ষতাতেও তারা মন জয় করেছিল বিশ্বের। তুলনামূলক ঊনিশশো নব্বইয়ের দুর্বল দলকে কারেকা তার একক নৈপুণ্য দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ফাইনালে। তাই বিশ্বকাপে কখন কী হয়ে যায় তা বলা যায় না। বিশ্বকাপ যতটা না মাঠের খেলা, তার চেয়ে বেশি স্নায়ুর সংযম। গ্রুপ ‘জি’-এর অন্য তিনটি দল কেউ কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলার নয়। গত বিশ্বকাপে সার্বিয়া যে খেলা দেখিয়েছে তাতে পৃথিবী এখনও বুঁদ হয়ে আছে। সার্বিয়ানদের পেছনে তাদের প্রধানমন্ত্রী মেলিন্দা যেভাবে সুন্দর হাসি নিয়ে মাঠে প্রেরণা হয়ে ছিলেন, এবারও তাদের সেই শক্তি ও সৌন্দর্যের প্রদর্শনী হবে বলে আশা রাখি। তাদের বড় সুবিধা হলো সব খেলোয়াড়ই লম্বা গড়নের। ফলে বাতাসে বলের দখলে তারা এগিয়ে থাকবেই। পক্ষান্তরে সুইজারল্যান্ডের খেলোয়াড়েরা গতি দিয়ে প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করতে পারে। তাদের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে পেরে ওঠা কষ্টের। আফ্রিকান সিংহ ক্যামেরুনকে দর্শক এখনো মনে রেখেছে ওমাম বিয়িক এবং রজার মিলার জন্যে। বর্ষীয়ান রজার মিলা খেলোয়াড়ি দক্ষতার পাশাপাশি নৃত্যভঙ্গিমায় যে বিনোদন দিতেন তা এখনও মনে গেঁথে আছে অনেকের। ঊনিশশো বিরাশির বিশ্বকাপে উদ্বোধনী খেলায় ওমাম বিয়িকের দেয়া গোলে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা ধরাশায়ী হওয়ার স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বলে। সেই থেকে ক্যামেরুনের পতাকাও বিশ্বকাপ এলে দখল করে নেয় বাংলাদেশের আকাশ। আর্জেন্টাইন মেসির ওপর এবার দায়িত্ব অনেক বেশি। কেননা, প্রয়াত কিংবদন্তি ডিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনাকে উৎসর্গ করতে হলে এবার তার কাপ নিয়ে ঘরে যেতেই হবে। এবার যদি ব্যর্থ হয়, তবে কে বলতে পারে, মেসির নাম হয়তো কালের আবর্তনে মুছে যাবে বিশ্বকাপের ইতিহাস থেকে।

বিশ্বকাপ ফুটবল এক মহা প্রপঞ্চ পৃথিবীর বুকে। ছয়টা কনফেডারেশনের দুইশ এগারটা দল থেকে বাছাই করে নিয়ে মাত্র বত্রিশটা দলের চূড়ান্ত পর্ব পৃথিবীর বুকে এক মহাযজ্ঞ বটে। এই মহারণে কার কপালে জয়ের তিলক আঁকে সময় তা জানার জন্যে আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। কাতারের জাতীয় দিবস আঠার ডিসেম্বরেই মহা ফাইনালের বল গড়াবে মাঠে। কারও স্বপ্ন ভেঙে যাবে চুরমার হয়ে আর কারও স্বপ্ন হয়তো নতুন করে নির্মিত হবে আশার বালুচরে। কুড়ি তারিখ হতে আগামী ঊনত্রিশ দিন ধরে চায়ের কাপে ঝড় উঠবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু সেসব কাপে কাঁপে না পৃথিবী। পৃথিবী কেঁপে ওঠে একটা কাপেই। সে কাপে থাকে পৃথিবীর সাতশ’ কোটি মানুষের আবেগের নির্যাস। সেই কাপের কাঁপের চাপে ব্যস্ত থাকে দুনিয়ার তাবৎ মিডিয়া।

করোনা পরবর্তী বিশ্বে বিশ্বকাপ ফুটবলই মানুষের বিজয়ের সবচেয়ে বড় উৎসব। দিকে দিকে এই মহা যজ্ঞের বিজয় বারতা ধ্বনিত হোক। চর্মগোলকের শিল্পে আনন্দিত হয়ে উঠুক আমাদের ধরিত্রী ভূ-গোলক। জয়তু ফুটবল।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়