প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
(পূর্ব প্রকাশিতের পর ॥ শেষ পর্ব)
ডাকাতিয়া নদীতে এ রকম ভেসে ওঠা লাশ আরও দেখেছে হেমাঙ্গ মাঝি। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলেও জৈবিক প্রয়োজনে হেমাঙ্গ মাঝি মানুষ, গরু-ছাগল, বোচকা-বুচকি পারাপার না করে পারে নাই। নদী ও নৌকাই তার নিয়তি।
শুক্কুর বললো, ‘ও হেমা তরাতরি কর ত। এরা সবে ডরাইতাছে।’
সকলে নাকে সাধ্যমতো কাপড় চেপে স্থির করে কিসের গন্ধ এতোক্ষণ তাদের অন্তরাত্মাটি টেনে-হিঁচড়ে বার করে আনছিলো। শকুন ও কাকেরা মিছেমিছি ওড়াউড়ি করে নাই।
নৌকাটি যখন নদীটির মাঝখানটা অতিক্রম করেছে, পাতাল থেকে ভেসে ওঠা লাশটি কোনো মায়ের সন্তান, অথবা কারো বউ, কার জননীÑএই থমথমে ভাবনায় সকলেই নিজ নিজ অন্তরে সকরুণ হয়ে উঠেছে। মৃত্যুকে বড়োই ভয়, পুতলিও হৃদয়ঙ্গম করে কূল পায় নাই ‘আয়াতুল্লা রাজাকার’ মানে কি, সে তার ক্ষুদ্র কল্পনায় ভেবেছে ওটা একটা ‘কচ্ছপ’ জাতীয় কিছু! তবে ওয়াপদার রাস্তার আড়ালের কারণে এতোক্ষণ দেখা যায় নাইÑসত্যই কচ্ছপের খোল মাথায় পরা অনেকগুলো লোক বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়েÑএখন দৃশ্যমান। এরাই সেই জীবন্ত আজরাইল যাদের ভয়ে জনপদের মানুষ নিজেদের চৌদ্দ পুরুষের ঘর-বাড়ি-ভিটে-মাটি-লেন-দেন ফেলে রেখে এখন উদ্দশ্যহীন গন্তব্য খুঁজে দৌড়াচ্ছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। সারাদেশ যেনো এক বিস্তস্ত আঁন্ধাইরা কবর।
এমন সময় মেঘহীন চৈত মাসের খরখর আকাশে ঠাটা পড়ার ভয়ানক আওয়াজে জীবিত সকল প্রাণীর শ্রবণেন্দ্রীয় চৌচির হয়ে যায়। গুলি করতে করতে একদল মিলিটারি হনহনিয়ে এই দিকেই, নদীর দিকে আসতেছে। পেছনে, হেমার বাড়ির অদূরে, মুন্সি বাড়িটা হঠাৎ দাউ দাউ আগুনে ঝলসে উঠতে দেখে সকলেই হতবাক।
মুন্সি বাড়ির ছেরাজুলÑছেরা মুন্সির নিরীহ মুখখানি মনে পড়ে শক্কুরের। মানুষের ঘরে জলসার মিলাদ ও মোনাজাত পরিচালনা করে, হাতে কয়েকটি টাকা, পাঞ্জাবির পকেটে মিঠাই-বাতাসা নিয়ে জীবন কেটেছে, তারই বাড়িটি জ্বলছে। কিন্তু ছেরা মুন্সির কথা ভাবার সময় এখন কই?
বাছাড়ি অহিদ, রণজিৎ, শুক্কুর, মুজা হঠাৎ বেকুপ তাহারা কি করবে জীবিতকালে থেকে মরণের এই অভিজ্ঞতা কখনও ভাবেনি কেউ এই মহূর্তে জীবনের অসীম বাসনা তো এই বউটির পালকি কই রাখবে, কোথায় লুকাবে, পারলে মাটির সাত হাত নিচে লুকায় এইরকম ভাবনার ভেতর হতচকিত, এরই মধ্যে কয়েকজন, ডাকতিয়া নাম নদীটির বুকের উপর থমকে থাকা কচুরির তলে ঝাঁপ দেয়। তার আগেই দীর্ঘদেহী অচেনা লোকগুলোর হাতের মেশিন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বেরিয়ে আসে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লুটিয়ে পড়ে লগি নিয়ে সংগ্রামরত জন্টু মাঝি হেমাঙ্গ দাস। ঝাঁৎ করে আসা কয়েকটি গুলি হেমার মাথার খুলিটি উড়িয়ে নিয়ে গেলে হৃদপি- বার-হওয়া-ভয়ে একটু আগে যারা কচুরির তলে, শুধুমাত্র নাকের ছিদ্র দুটি বার করে রেখে সমস্ত শরীরটি পাতালে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলো, তাদের মধ্যে মুজা পাগলাকে আর দেখা গেলো না। সম্ভবত সে গুলি খেয়ে তলিয়ে গেছে মুহূর্তে। অথবা নদীর তলদেশের ‘বাইছা’ শ্যাওলা তারে টান দিয়ে নিয়ে গেছে।
পালকির ভেতর বালিকা বউটি, ক্ষুদ্র জীবনে ঠাটা পড়ার শব্দ শুনেছে। কিন্তু এই শব্দ আসমানের ঠাটা পড়া শব্দ না। লা ই লা হা ইল্লালাহু পুনঃপুনঃ উচ্চারণর্পূবক আতুরি পালকির ভেতর থেকে ঘোমটা তুলে মুখটি বার করেছে কি করে নাইÑসে দেখলো মাঝিটি ছিটকে পড়েছে নৌকার গলুইয়ের উপর। ছোট বোনটিকে বুকে আগলে সে কোনও কিছু ভাবারও সময় পায় নাই। তখন, এরই মধ্যে পুরুষেরা নদীতে ঝাঁপ দেয়ার পূর্বক্ষণে, নাকফুলে হাত দিয়ে বোধগম্যহীন ফেনানো একটা গোঙানির শব্দ তুলেছিলো, আতুরি হয়তো ভেবেছিলোÑএকরত্তি সন্নÑমেয়েদের সধবার চিহ্ন।
নৌকাটি কাৎ হয়ে ঢুলে ওঠার পূর্বক্ষণে সবুজ-লাল ঘুড়ি-কাগজের নকশায় সাজানো চারপেয়ে নিরীহ পালকিটি ঝাঁঝরা হয়ে যায়। ভয় পেয়ে উড্ডীন, পলায়নরত কাকের দল থেকে, পক্ষীজীবনে তাহারা এই রকম শব্দের সঙ্গে কখনও পরিচিত ছিলো না ঝুপ করে একটা কাক নিঃসাড় ডানাঝ’রে পড়ে নৌকাটির পাটাতনে, থুবড়ে-পড়া পালকির ক্ষুদ্র দুয়ারের পাশেই।
তখন হেমাঙ্গের চিরসাথী, কিছুকাল আগেই কচি গাবের কষে যতেœর প্রলেপ দেয়া খেয়া নৌকাটির আত্মা জেগে ওঠে। সহসা কিংকর্তব্যবিমূঢ় নৌকাটি, দ্রুততম সময়ের ভেতর একটি পালকি, তার ভেতর এক স্বপ্নকিশোরী বধূ, লাল মোজা পরা জামাই রফিক মিয়া, পাগলা মুজা, গাছের জাদুকর শুক্কুর গাছি, দুই বাছাড় রণজিৎ-অহিদুল্লা, অবুঝ বালিকা পুতলি, মহূর্তকাল পূর্বে ভেসে ওঠা গলিত নারীর শাড়িতে জরির ঝিলিক আর কয়েকটি শকুনের আনাগোনা দেখে ভেবেছে মানব জীবন বড়ই ঠুনকো, তবে তাহাদের বিস্ময়কর আবেগময় ভাষাটি মহাকালের এক যাদু-মায়া! নৌকাটি আরো ভেবেছে, তাহার জন্মের পর থেকে লোকস্রোতের সেইসব ভাষা-গল্প সহসা ঝাঁঝরা করে দিলো কে? এরা আর কথা-সংলাপ করছে না কেনো? কিন্তু নৌকাটির আত্মা এখন হতবিহ্বল।
এ সময় কয়েক খ- কালো-ধূসর মেঘ কোথা থেকে ভেসে এলে ক্ষণকালের জন্যে আকাশের সূর্যটি হঠাৎ কানা হয়ে যায়। ফলে এপার-ওপার জনপদের মাঝখানে বহমান একটি নদীÑডাকাতিয়াÑঅন্ধ জগতে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে না পেয়ে ¯্রােতহীন এক মহাস্থবির সেখানে কালের সকল চিহ্ন অবলুপ্ত।
গুলি থামার পর, কচুরির জমাট থেকে বেরিয়ে এসেছিলো রফিক। তার লাল মোজা তখনও পায়ে ঝুলে আছে, পানি ঢুকে ঢোল। টেনে টেনে নিজের অচেনা পা দুটি নৌকায় তুলতে পেরেছিলো সে। নদী ও নৌকার মতোই, রফিক মিয়া অনন্তকালের কোনও শব্দ শোনে নাই।
অনেক অপেক্ষার পর রণজিৎ বাছাড়ও, মস্তকে কচুরির নুড়ি নিয়ে, ভৌতিক বেরিয়ে আসে। নৌকায় হতবম্ব জামাইটিকে আবিস্কার করতে পেরে, রণজিৎ বাছাড়ের মনে পড়ে, কচুরির ভেতর থেকে নাক বার করে রেখে, জীবনের তীব্র আকাক্সক্ষায় শুধুমাত্র আকাশের ভগবানকে ভেবেছিলো সে। সে আশা করেছিলো অহিদুল ভাইছাব কচুরির তল থেকে এক্ষণি ভুস করে উঠে আসবেন। সেহেতু দৃষ্টিতে একধরনের অব্যক্ত তৃষ্ণা মন্দিরের ঘণ্টার মতো বেজে ওঠে।
একসময়, সত্যই, গুলি থেমেছিলো। কতক্ষণ পর থামে, কর্ণকুহরে স্তব্ধতা ঝিম মেরে থাকার কারণে, স্মরণে আনতে পারে না রফিক মিয়াÑকতো যুগ সে পানিতে নাক ভাসিয়ে বেঁচে ছিলোÑজানে না। কচুরির ভেতর ডুব দিয়ে, নাকের ডগাটি ভাসিয়ে রাখার এই কৌশল, সব গাঁয়েরই, বিশেষত মিলিটারি আইতাছে মাছিবাহিত এই সংবাদের আনাগোনা এমনকি গন্ধ পেলেও, যুবকেরা কাউকে কিছু না বলে, শেখ সাব-এর ভাষণের পর থেকেই, সূক্ষ্মতার সঙ্গে করে এসেছে।
কিন্তু ‘বাইল্যা’ পাখির ধান খাওয়ার মতো ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির সমুখে এখন, সামান্য আগে, কচুরিপানার ভাসমান গুহা সকলকে রক্ষা করে নাই।
ততোক্ষণে রফিক মিয়ার শরীরটি ঠা-া-হিম হয়ে কাঁপতে শুরিু করেছে। সে বস্তুত ইহজগতে নাই।
শুক্কুর গাছি আর মুজারও খবর নাই। নৌকার ওপর পড়ে আছে ছিন্নভিন্ন পালকি, হেমাঙ্গের মুহীন বীভৎস দেহ। পালকির ভেতর থেকে বেরিয়ে রয়েছে একটি লাল শাড়ি পরা নতুন বউ। বউটির পাশে তারই ছোটো বোনটি। মুহূর্তের কালবৈশাখে নিশ্চিহ্ন জনপদ-চরাচর যেনো নৌকাটির পাটাতনে এসে এক নতুন বিমূর্ত স্থাপত্য।
রফিকের মনে হয়েছে, এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনাটিই বাল্যকাল থেকে শুনে আসা, মাথার ঘিলুর ভেতর অঙ্কিত সেই ‘কেয়ামত।’ সুতরাং সে আর তার পরিচিত পৃথিবীতে নাই। সে কোনও দিনও খাঁ বাড়িতে রাখালের কাজ করে নাই। হেমা মাঝির নায়ে কখনও পার হয় নাই। বিবাহের সাধে পায়ে লাল মোজাও পরে নাই। অলৌকিক জগতের এক ঘোরতর আঁন্ধার সুড়ঙ্গে তলিয়ে থেকে শরীরের একমাত্র অঙ্গÑ‘নাক’Ñব্যতীত আর কিছুই মনে নাই তার।
কচুরির তল থেকে, ভাসানো নাকের দু পাশের দুই চক্ষু মাঝে মাঝে আসমানের রহস্য দেখার প্রয়োজনে একটুখানি মিটিমিটি খুলেছিলো রফিক, ভেবেছিলো, আজরাইল বুঝি এবার এসেই গেলো। সে যে অন্যদের মতোই পালকি ফেলে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিজেকে একটা কাপুরুষ, হিজড়াসম তুলনা করারও সময় পায় নাই এতো দ্রুত ঘটনা ঘটতে শুরু করলে জীবন বাঁচানোই চিন্তায় এসেছিলো। কিন্তু জ্ঞান ফেরার পর, এখন, মনুষ্যসুলভ পাপের ভারে শরীরটা পাতালের দিকে যেনো কেউ টান মেরে নিয়ে যাচ্ছিলো। পালকিতে তারই নতুন বউ আর পুতলি ছিলো, তাদেরকে রেখে নিজের এভাবে বেঁচে ওঠা কবিরাহ গুনাহÑএই চিন্তাও রফিককে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলো।
অতি কষ্টে নিজেকে কচুরির জলকাদার ভেতর থেকে টেনে তোলার পর, নৌকায় বসা বিহ্বল, রফিকের অন্তরে কে যেনো বলে ওঠে সে ছাড়া জগতে আর কেহ নাই। বাবা আদমের মতো সাড়ে তিনশ’ বছর একাকিত্ব ভোগ করছে সে। তবে চক্ষু স্থির হয়ে এলে দেখে তীরে ওঠার চেষ্টায়Ñরণজিৎ বাছাড়।
মিলিটারিরা চলে যাওয়ার পর, সারা গ্রাম হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।
পালকিটি পড়েছিলো নৌকায়। আতুরির শরীরে পেঁচানো বিবাহের লাল টাঙ্গাইল শাড়িটি তখনও, রক্তে আরো রঙিন। গলুই থেকে ছিটকে হেমাঙ্গ মাঝির শরীরটা পানিতে ঝুলছিলো, শুধু বেকায়দা একটি ঠ্যাং নৌকার পাটাতনের পাশ দিয়ে আটকে রয়েছে। বোনের সঙ্গে তার শ্বশুরবাড়ি যাবে বলে বায়না ধরেছিলো যে পুতলি, তার হাতে কয়েকগাছা কাঁচের চুড়ি। হাতের তালুতে গোল করে আঁকা মেহেদীর রঙ। আতরবানুর গায়ে হলুদে নিজেও সেজেছিলো পুতলি। কিন্তু এখন দুই বোন পরস্পরকে ধরে আছে প্রাণ সেখানে নিথর।
গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া আতুরির শরীরের একমাত্র চিহ্নÑসন্নের নাকফুল সামান্য ঝিলিক মেরে সমাগত মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, পালকিতে চড়ে আতুরি শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলো।
বিধ্বস্ত পালকিটি নৌকার পাটাতনে পরস্পর আত্মার মিলনে চুপ। নৌকায় চড়ে বসে আছে লাল মোজা পরা জামাইটি, রফিক মিয়া। তখন তিন ভুবনের মাঝে ঘুরছিলো হেমাঙ্গ মাঝির খেয়া নৌকাটি। (সমাপ্ত)