প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
(পূর্ব প্রকাশিতের পর ॥ ২য় পর্ব)
রফিক মিয়া অন্যের বাড়িতে রাখালের কাজ করে। চরমেশা অথবা সাহেববাজারের অবারিত চর, ধানক্ষেতের আইলে আইলে গরু চরানো ব্যতীত চাষবাসের কাজে খাঁ বাড়ির অবস্থাপন্ন রাজ্জাক খানের সংসারে তার স্ত্রীর রসুইঘরে ফাই ফরমায়েশ খেটে বালক বেলাটি অতিক্রম করে এসে, সে এখন ঝড়-তুফানের মধ্যে সহসা বিবাহযোগ্য হয়ে উঠেছিলো। পিতৃহীন সংসারে রফিকের দিনকানা মা একগাদা পুত্র নিয়ে হিমশিম অবস্থা, তার কোনও ‘কইন্যা’ নাই-এই দুঃখে প্রায়ই ট্যারা-কানা চোখে কাঁদেন। রফিক মিয়ার অন্য ভাইরাও, পরের সংসারে কামকাজ করে। বাপ নাই, বড়ো ভাই পিতার সমতুল্য-শুক্কুর মিয়া, রফিকদের নিজ গাঁও দশানির বিখ্যাত গাছি। সে তাল, নারিকেল, সুপারি, কাঁটাওয়ালা খেজুর গাছের লম্বা-উঁচু শিখরে চড়ে অনায়াসে পুরনো পাতা কেটে পরিষ্কার করে। কৃষিকাজের ফাঁকে এটাই তার শখের পেশা। শুক্কুর যখন লুঙ্গিটি গোঁচ দিয়ে কালো কুঁচকুঁচে থুতনিতে ক’গাছি ছাগল-দাঁড়ি, মুখে চুনের দাগ, ঠোঁট দিয়ে চেপে, ধারালো দা নিয়ে তরতরিয়ে তালগাছের চূড়ায় প্রায় হেঁটে উঠে যায়, সে এক দেখবার মতো দৃশ্য। লোকেরা বলে, শুক্কুর নাকি পা উল্টা করেও অর্থাৎ পা উপরের দিকে দিয়ে গিরগিটি কিংবা কাঠঠোকরার মতোই গাছ বেয়ে উঠতে পারে। শুক্কুরের ভেলকিবাজীর এই কিংবদন্তী অনেকেই নিজ দেখে নাই। শুনেছে। তবে আশা করেছে কোনও একদিন সেই অসম্ভব বৃক্ষারোহণ দেখে একটুখানি বিস্ময়ে বলবে, ‘বড়োই আচানক! কী তাজ্জুক কারবার!’
ক্লান্তি, ক্ষুধা ও খেয়াঘাটে এতোক্ষণ অপেক্ষার অজানা আশঙ্কায় বিপর্যস্ত শুক্কুর বললো, ‘ও রণজিৎ, হেমা কি মরছে রে?’
‘কী জানি শুক্কুর ভাই, আমার ত ভালা লাগতেছে না। অহন পালকি নিয়া করি কি কন ত?’ এটুকু বলে চারিদিকে একটু চেয়ে নিয়ে, গামছায় মুখটা মুছে পুনরায় রণজিৎ বলে, ‘দেখছেননি শুক্কুর ভাই, দুনিয়াডা কীরম ঝিম মাইরা আছে? নদীডার কচুরিগুলিও য্যান দম আটকাইয়া মইরা রইছে।’
এ সময় গুমট, থমকে থাকা বাতাসেরও একটা দহন টের পাওয়া যায়, নাক চোখ পোড়ায়, তাতে পঁচা লাশের গন্ধে খেয়াঘাটের পাড়ে, বটতলাটি থেকে থেকে অসহনীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু গন্ধের সূত্রটি চিহ্নিত করা যায় নাই। কয়েকটি কাক ও শকুন কচুরির জটিল স্তূপের ওপর দিয়ে বার কয়েক চক্কর দিয়েছে, আবার উড়ে গিয়ে কোন গাছের ডালে বসেছে খেয়াল করে নাই কেহ। যাত্রীগণ নিজেদের সাধ্যমতো নাকে কাপড় চেপে ভেবেছে, কোথায় কার সর্বনাশ হয়েছে কে জানে!
এতোক্ষণ চুপচাপ থেকে নিজের ভেতর একটা ভয়-ডর অনুভবে একটু নড়ে বসলো রণজিৎ-এর সঙ্গী অহিদুল বাছাড়। অহিদুলই পালকির মালিক। বাপ-দাদার স্কন্ধের ভারÑচারকোণা ‘পালকি’ এখন তার নিজের কাঁধে। জোড় পালকি আছে, কিন্তু মানুষ আছে আতঙ্কের মইধ্যে। ডাক পড়ে না। জোড় পালকির দিন শেষ। যারা বিয়া করতে যায়, সেই জামাই বাড়ির লোকেরা এখন এক পালকি ভাড়া কইরা কইন্যা তুইল্যা আনে। আকালের উপর আকাল। জীবনই বাঁচে না, তার আবার বিয়া-ই কি পালকি-ই কি! এইভাবে কয়দিন যাইবো কে জানে। দ্যাশ কি স্বাধীন অইবো?-এইসব চিন্তায় অহিদুল বাছাড় দিন দুপুরে চোখে ‘জুনি’ দেখে। তারপর চোখ বন্ধ করেই বলে, ‘কিয়ের পঁচা গন্ধ রে? বোটকা গন্ধে ত ‘মনুরা’ উল্টাইয়া নাড়িভূড়ি প্যাঁচ লাইগা যাইতেছে আমার! ও-য়া-ক থুঃ!’
ও-য়া-ক কইরা একদলা থুতু ফেলে অহিদুল। গলা খাঁকারি দেয়ার পর, জিহ্বাটা কেমন তিতকুটি তিতকুটি লাগে তার। মনে হয় পিত্তগলা পানি বার হয়ে মুখ বিকৃত, পেট মোচড়ায়।
শুক্কুর বসেছিলো প্রাচীন বটগাছটির নেমে আসা ঝুরির ফাঁকে। সেখানে কিছু ঝরা হলদে পাতা শুয়ে আছে। তাদের শরীরে পাখিদের চুনা হাগার শুকনো দাগ। শুক্কুরেরও দিনকাল ভাল না। গাছির কামে ভয়াবহ ভাটা। মানুষেরই জান বাঁচে না, তা-ও আবার গাছের ছাল-বাকলের ‘ক্ষৌর’ কর্ম! সে তার ছাগইল্যা দাড়িতে আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে বলল, ‘অহন উপায় কি, হেমা ত আইতেছে না। পালকি নিয়া কি সাঁতার কাডমু?’
অন্যান্য যারা পালকির সঙ্গে যাত্রী, তারা হেমাঙ্গ মাঝির আক্কেল দেইখ্যা বিরক্ত। ফলে তারা নিজ নিজ আক্কেল অনুসন্ধানে এখন গুড়ুম। এমনিতে সকলে আতঙ্কের মধ্যে আছেÑকখন জানি কি হয় কি হয়!
পালকিতে ঢুলুঢুলু আতুরি সকলের কথাই শুনেছে। কখনও বা চকিতে, চুরি করে, কেউ দেখে নাই-ঘোমটা তুলে বাইরের পৃথিবীটাও দেখে নিয়েছিলো। সবই কেমন জানি অচেনা অচেনা লেগেছে-এইরকম পৃথিবী সে আগে দেখে নাই।
তার বড়চাচা খুবই রাগী লোক। দশ গেরামের মানুষ জানে তার বদমেজাজের কথা, তবে মনটা বড়োই নরম। বিবাহে ‘কবুল’ কইতে দেরি করায় চোখ লাল জবাফুলের লাহান কইরা ধমকাইছেন, ‘তোরা দ্যাশের অবস্তা জানছ না! ঘোমটার তলে বইয়া কি ঘুমাইতাছোস নাকি, হ্যাঁ? শয়তানি কায়কারবার যতো! তরাতরি কর..অনেক দূরের পথ..এক্ষুণি পালকি ছাড়তে অইবো।’
আতুরির কোনও দোষ ছিলো না। তার বয়স্ক ভাবি-ভাউজরা মশকরা কইরা শিখাইয়া দিছিলো, ‘ওই ছেমড়ি, বকশিস না দিলে কিন্তুক কবুল কইবি না, বুঝলি?’ সে কিছু বলে নাই। সোঁতা-মেথি-হলুদ বাটার রঙ-মাখা হাতের নখ খুটতে খুটতে চিন্তা করেছিলো-তরাতরি কবুল কওয়া একটা লাজ।
চাচার ধমক খেয়ে কবুল বলার পর, মুরব্বিরা বউ-জামাই দু’জনকে সোন্দর লাল-নীল-কউচ্চা রঙের খোপ খোপ খাঁজকাটা চিনির গেলাসে শরবত দিছিলো।
পালকি ছাড়ার আগে, পায়ে ধরে কদমবুসি করার সময় বড়চাচা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন, ‘ভালা থাইক্য গো মা, বংশের ইজ্জত রাইখ্য।’ তারপর মোনাজাতের মতো হাত জোড় করে স্বগতঃ বললেন, ‘ও মা’বুদ তুমি হেফাজত কইরো।’
আতুরি শুনেছে, জামাই মিয়া কালা, মুখে বসন্তের ‘খাইট’-পুরনো শিলপাটার মতো খোপ খোপ! সে ঘোমটায় নত। ফলে ভেবেছে, না জানি কেমন ভূত!
(চলবে)
[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]