প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
করোনাকালীন দিনলিপি
তানভীর পাটওয়ারী
৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ চীনে ধরা পড়ে একটি অপরিচিত ভাইরাসের সংক্রমণ। পরে গবেষণা করে জানা যায় এটি করোনা শ্রেণিভুক্ত একটি ভাইরাসের আক্রমণের কারণে হয়েছে। যেহেতু ২০১৯ সালে এটি ধরা পড়ে তাই এর নাম দেয়া হয় ‘কোভিড-১৯’। এটি বিশ্বে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ছোঁয়াচে ভাইরাসজনিত রোগ। খুব অল্প সময়ে এটি চীনের উহান থেকে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। যার ধারাবাহিকতায় ৮ মার্চ ২০২০ সালে ধরা পড়ে বাংলাদেশে ২ জন ইতালীয় প্রবাসী এবং তাদের একজন পারিবারিক সদস্যের শরীরে। আর ১৭ মার্চ প্রথম কোনো রোগীর মৃত্যু হলে বাংলাদেশ সরকার সকল সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বন্ধ ঘোষণা করে সারাদেশের ‘লকডাউন’ জারি করে।
আমি ২০১৯ সালে এসএসসি শিক্ষার্থী ছিলাম। আমাদের পরীক্ষা শুরু হয় ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ আর শেষ হয় ৩ মার্চ। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর কিছুদিন বাড়িতে রেস্ট নিয়ে যখন কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবো আর এই ছুটিতে কী কী করবো তা ভাবছি। ঠিক এমন সময়েই আসলো এক ভয়াবহ খবর। বাংলাদেশও এখন ভয়াবহ মরণব্যাধি করোনা থেকে মুক্ত নয়! তারপর পরিচিত হলাম একটি নতুন শব্দের সাথে ‘লকডাউন’। সারাদেশে সরকার লকডাউন জারি করেছে। মনে হলো, দেশে যেনো এক ভয়াবহ যুদ্ধ আসন্ন, তাই সবাইকে পূর্ব প্রস্তুতির কথা বলা হচ্ছে! ভয়েই বুক খালি হয়ে গেলো। বাতিল হলো আমার সব পরিকল্পনা! সবাই তখন গৃহবন্দী কোনো এক অদৃশ্য শত্রুর ভয়ে! আমার তখন খুব খারাপ অবস্থা একেতো মন খারাপ তার ওপর আবার নিজেরসহ পরিবার এমন কি আত্মীয়স্বজনের জীবনের ভয়।
প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও ধীরে ধীরে আমার কাছে সবকিছু মানানসই লাগলো। আমাদের একান্নবর্তী পরিবার। পরিবারের সবাই তখন একে অপরকে অনেক সময় দিচ্ছে। তাই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমার মধ্যে একটা চাপা আনন্দ কাজ করতে লাগলো। তখন সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রথম কাজ ছিলো ঘরের সবাই মিলে নামাজ পড়া নারীরা আলাদা আর পুরুষরা আলাদা বেশ মজার সময় ছিলো সেটা। তারপর বাড়ির কিছু ছোট কাজ করার পর আসতো আমার সকালের খাবারের ডাক। ডাক পেয়েই গিয়ে দেখতাম সবাই আমার আগেই মাদুর পেতে বসে আছে। আর সবার মুখেই খাবার। আমিও তখন তড়িঘড়ি করে বসে পড়তাম সবার সাথে। তারপর যে যার ঠিকানায় চলে যেতো। আমি তখন বসতাম পত্রিকা নিয়ে। তারপর বাড়ির সমবয়সী এবং ছোটদের সাথে সারাদিন সময় কাটাতাম। কিন্তু বাড়িতে আবদ্ধ থেকেত আর মন ভালো থাকে না। তাই ধীরে ধীরে আমার মধ্যে একটা হতাশা আর জড়তা কাজ করতে লাগলো।
কিন্তু কোথাও বের হওয়া বা কারো সাথে দেখা করার কোনো উপায় নেই। সারাদিন আর সময়ও কাটে না। তাই সময় কাটানোর জন্য বেছে নিলাম বই পড়ার অভ্যাস। আগেও হালকা কিছু বই পড়তাম। কিন্তু করোনাকালীন এই সময়ে হাতে অনেক সময় পেলাম। যা কাজে লাগালাম বই পড়াতে। আমি তখন থেকে এখন পর্যন্ত রুটিন করে নিয়েছি। সকালে নাস্তা করার পর থেকে ১১টা ৩০ পর্যন্ত বই পড়ি। তারপর গোসল এবং হাতের ছোটখাটো কাজগুলো করে জোহরের নামাজ পড়ি। নামাজ পড়ে সবার সাথে দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমোতে যাই। ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে বের হই। তারপর আসরের নামাজ পরে বাড়িতে চলে আসি। আগে আসরের নামাজ পড়ে বন্ধুদের সাথে খেলতে যেতাম কিন্তু করোনার কারণে তা-ও বাদ দিতে হয়েছে। বিকেলটা এখন ঘরেই কাটে। তাই বিকেল বেলাতেই কলেজের বই নিয়ে বসি। নিজে নিজে কলেজের সিলেবাস শেষ করার চেষ্টা করি। আসরের নামাজের পর থেকে মাগরিবের নামাজের আজান পর্যন্ত কলেজের বই পড়ি। তারপর নামাজে যাই। নামাজ থেকে এসে সবার সাথে কিছু হালকা খাবার খাই। তারপর আবার পড়তে বসি। এবার পড়ি এশার নামাজের আজান পর্যন্ত। তারপর নামাজে যাই। নামাজ থেকে এসেই রাতের খাবার খাওয়ার অভ্যাস। কারণ একান্নবর্তী পরিবারে অনেক সদস্য রাত জাগতে পারে না। রাতের খাবার খেয়ে একটু রেস্টে থাকি। তারপর আবার কলেজের বই নিয়ে বসে পড়ি এবারে একেবারে রাত ১১টা বা ১২টা পর্যন্ত। আমার নিজের মোবাইল নেই। তাই আমার দিনলিপিতে মোবাইলের কোনো উল্লেখও নেই। গত প্রায় দেড় বছর এমন করেই আমার দিন কেটেছে।
* পাঠক ফোরাম বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা