শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৪  |   ২৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা গণফোরামের কর্মী সমাবেশ
  •   নিষেধাজ্ঞার প্রথম দিনে ফরিদগঞ্জে অবাধে ইলিশ বিক্রি
  •   পিকনিকে যাওয়া শিক্ষার্থীর মরদেহ মেঘনায় ভেসে উঠলো দুদিন পর
  •   নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি না করার শপথ করিয়েছেন এমএ হান্নান
  •   বিকেলে ইলিশ জব্দ ও জরিমানা

প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

অবচেতন ধূসরতা

খশরু আহসান
অবচেতন ধূসরতা

‘বাকের ভাই। আপনার চোখ ভীষণ লাল দেখাচ্ছে। সকালের রক্তিম সূর্যের মতো। আপনি ঘুমাননি কাল রাতে?’ মুনা নরম সুরে জিজ্ঞেস করল। তার কোনো কথা নরমভাবে বলার অর্থ হলো, ‘বাকের ভাই, আপনি আমার কিছু কঠিন কথা শোনার জন্য প্রস্তুতি নিন।’

বাকের ভাই বললেন, ‘হুম।’

‘বাকের ভাই, আপনি দয়া করে হুম বলবেন না। আপনার অনেক কাজের মতো এটিও আমি অত্যন্ত অপছন্দ করি।’

‘আচ্ছা।’

‘বাকের ভাই, আমি কিন্তু উঠে চলে যাব। হুম কিংবা আচ্ছা কোনোটাই আমি পছন্দ করি না। কথা বলবেন কমপক্ষে তিন শব্দে। এক শব্দে কোনো কথা হতে পারে না। এক শব্দে কথা বলার অর্থ হলো, এড়িয়ে যাওয়া। এমন এককথায় কথার উত্তর দেওয়াটা অভদ্রতার মধ্যে পড়ে।’

মুনা একটু থামে। মুনার থেমে যাওয়াকে বাকের ভাই ভয় পান। মেয়েটা রাগ করলেও ঠোঁটের কোনায় হাসি লেগে থাকে। বাকের ভাই এই লেগে থাকা হাসির নাম দিয়েছেন স্নিগ্ধতা। স্নিগ্ধতা বাকের ভাইয়ের বরাবরই পছন্দ। নারীর চেহারায় স্নিগ্ধতা আর কবিতার ছন্দের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মুনা লতার মতো কোমল। স্পর্শ করলেই চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো কোমল। পৃথিবীতে স্পর্শ অনুভব করা নারীর সংখ্যা প্রতিনিয়তই কমে যাচ্ছে বলে বাকের ভাই মোড়ের দোকানে বসে মাঝেমধ্যেই দুশ্চিন্তা করেন।

বদির সঙ্গে এ নিয়ে অনেক আলাপ হয়েছে। ছেলেটার মাথা মোটা। একটা স্টুপিড। এলোমেলো উত্তর দেয় বলে বাকের ভাই এ বিষয়ে কথা বলাই বাদ দিয়েছেন।

একবার বাকের ভাই বললেন, ‘আচ্ছা বদি, পৃথিবীতে যদি কোমলমতি নারীর সংখ্যা কমে যায়, তাহলে ইফেক্ট অব আফটার কী হতে পারে বলতে পারিস?’ বদি কিছুক্ষণ মাথা চুলকে বলল, ‘বাকের ভাই, গট ইট। পানি তখন লোহার মতো শক্ত হবে। আর লোহা পানির মতো। পানি ভেবে নদীতে ঝাঁপ দিলেই কেল্লা ফতে। পঙ্গু হাসপাতালের ঠিকানাটা তখন খুব প্রয়োজন হবে।’

বাকের ভাই ধমক দিলেন। ‘বদি শোন, এত দিন ভাবতাম, তুই একটা গর্ধভ। এখন দেখছি, না। তুই মহা গর্ধভ। মোর স্টুপিড। আমার চোখের সামনে থেকে যা।’ বদি চলে গেল। যাওয়ার আগে বলল, ‘বাকের ভাই, আরেক কাপ চা দিতে বলব?’

বাকের ভাই ভাবছেন, এই মুহূর্তে আমার সামনে এমন এক কোমলমতি মেয়ে বসে আছে, যার চোখের জল গড়িয়ে পড়া দেখতেও সুন্দর। এমন স্নিগ্ধ একটি মেয়ের অভিমানেও কবিতার ছন্দ রচনা করা যায়। ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে’ গানটা বেজে উঠলেই বাকের ভাইয়ের মুনার কথা মনে পড়ে। ভাতের প্লেটে এই মুহূর্তে ঠিক কতগুলো ভাত আছে, দেখতে দেখতে বাকের ভাই বললেন, ‘মুনা, আমার শরীরটা ভালো নেই। কয়েক দিন হলো ক্রমাগত মাথা ধরে আছে। চিনচিন করে ব্যথা করে। চোখ জ্বলছে। খুব সম্ভবত জ্বরের আগমন হবে।’

মুনা চোখ তুলে তাকাল। বাকের ভাই লক্ষ করলেন, মুনার চোখ তুলে তাকানো আর তাকিয়ে থাকা মোনালিসার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। লেওনার্দো দা ভিঞ্চির জন্ম তখন না হয়ে এখন হওয়া উচিত ছিল। যে মেয়ের তাকানোর ধরন এমন সুন্দর হতে পারে, সে মেয়ের হাসিতে মুগ্ধ না হতে পারাটা একধরনের ব্যর্থতা। বাকের ভাইকে অবাক করে দিয়ে মুনা কিঞ্চিৎ হেসে বলল, ‘বাকের ভাই। মানুষকে বোঝার অদ্ভুত ক্ষমতা আমার আছে কি না জানি না। তবে আপনাকে বোঝার এক বিশেষ ক্ষমতা আমার আছে। আপনি কিছুক্ষণ পরপরই কপালের ভাঁজে দুই আঙুল দিচ্ছিলেন। আমি খেয়াল করেছি, আপনার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। বাকের ভাই, শুনুন। আপনার কষ্ট পাওয়া দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি বরং আপনাকে বাসায় এগিয়ে দিয়ে আসি।’

বাকের ভাই হাসলেন। মুনা অবাক হয়ে ভাবছে, এমন পরিস্থিতিতে মানুষের হাসি কীভাবে আসে! বাকের ভাই বললেন, ‘মুনা। আমার মাথাটা প্রচণ্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে, সে কথা সত্য। তবে এই মুহূর্তে আমার মাথায় কোনো ব্যথা নেই। এমন একটি কারণে নেই, যেটা বলা নিষেধ।’

‘কেন নিষেধ, জানতে পারি?’

‘অবশ্যই পারো, মুনা। এই পৃথিবীতে সব কথাকে প্রকাশ করে দিতে নেই। মানুষের সব কথা প্রকাশ পেলে প্রকৃতিতে কথার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। প্রকৃতি ভারী হয়ে আসবে। তখন দেখা যাবে, স্নিগ্ধ কথারা ঝগড়া করছে। কথারা ঝগড়া করলে বড় বিপদ মুনা।’

‘বাকের ভাই, কথা বলতে বলতে আপনি ঢলে পড়ছেন। আপনার এখনই বাসায় যাওয়া প্রয়োজন। আমি রিকশা ডাকছি।’

‘প্রয়োজন নেই মুনা।’

‘আপনি এমন অদ্ভুত মানুষ কেন বাকের ভাই? কী প্রয়োজন শুনি?’

‘প্রয়োজনের কথা প্রিয়জনকে বলতে ভয় হয়।’

‘বাকের ভাই, বলুন।’

‘একটু এ পাশে আসবে মুনা?’

মুনা বাকের ভাইয়ের পাশে বসল। কপালে হাত দিয়ে দেখল, বাকের ভাইয়ের সারা গা আগুনের মতো গরম। মুনা চমকে উঠল, ‘বাকের ভাই, এ কী? আপনার গায়ে ভীষণ জ্বর। বাকের ভাই, চলুন, আপনাকে এই মুহূর্তে ওষুধ খেতে হবে।’

‘না মুনা, আমি ওষুধ খাই না। জ্বর আমার প্রিয় অসুখ। জ্বর হলে আমার চোখ জোড়া কেমন অন্ধকার হয়ে আসে। খুলে রাখার প্রচণ্ড চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। চোখ দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে, পৃথিবীর শেষ আলোটুকু যখন আমার চোখে, আমি তখন তোমাকে দেখি। চোখ বন্ধ হওয়ার পরের পুরোটা সময় তুমি থাকো।’

মুনা কথা বলছে না। বাকের ভাই মুনার কাঁধে মাথা রেখেছেন। এই মুহূর্তে বাকের ভাইয়ের কথাগুলো জ্বরের ঘোরে বলা কথা ভেবে মুনা আজীবনের জন্য ভুল করে বসল। বাকের ভাই একটুখানি চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করলেন। পারলেন না। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বললেন, ‘মুনা। জ্বরের সবচেয়ে ভালো ওষুধ কী, জানো?’

‘কী?’

‘স্পর্শ।’ বাকের ভাই হাসলেন। অতি কষ্টের হাসি। তারপর বললেন, ‘মুনা, তুমি আমাকে একটু স্পর্শ করবে? তোমার ডান হাত দিয়ে আমার কপালের ঠিক মধ্যে?’

আশপাশের মানুষজন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে বাকের ভাইয়ের দিকে। কার সঙ্গে কথা বলে মানুষটা? লোকটাকে ভীষণ চেনা চেনা লাগছে। আনুমানিক তিন দশক আগে ঠিক একই রকম দেখতে এমন একজন এই ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াত। গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড গরমেও মানুষটা ওভারকোট পরত। মানুষ তাকিয়ে আছে। উশকোখুশকো অগোছালো চুলের এই মানুষটা ঠিক কে!

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়