প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
অনুমানের অনুশোচনা
ভাবছিলাম অন্য কথা। ওই লোকটা এভাবে তাকিয়ে থাকে কেন? প্রতিদিনই বিস্কুট রঙের বাসার ছাদে তাকে দেখি। ভোরে যখন ছাদে ইয়োগা করি, তখন সে থাকে। বিকেলে পায়চারী করার সময়ও দেখি। আবার রাতে আমার জানালা দিয়ে তাকালেও দেখি সে আমারই দিকে তাকিয়ে। কী একটা অস্বস্তি যে অনুভব করি!
আমি একজন মধ্যবয়সী নারী। এই বয়সে কেউ যদি এমন করে পিছু লেগে থাকে তো কেমন লাগে? যদিও লোকটা বিরক্তিকর কোনো ইঙ্গিত করে না। তবু খুব একটা ভালো লাগে না আমার। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে। কয়েক দিন পরে তাদের বিয়েশাদি দিতে হবে। আর এই বয়সে কেউ যদি হ্যাংলার মতো তাদের মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে! এ কথা বাচ্চারা জানতে পারলে কী ভাববে? আশপাশের মানুষই–বা কী মনে করবে? নাহ্! আর না! এর একটা বিহিত করতেই হবে। দারোয়ানকে দিয়ে খবর লাগাব। আর কত দিন সহ্য করা যায়?
ইন্টারকমটা হাতে নিলাম। ডায়াল করতেই জব্বর রিসিভার তুলল,
-আসসালামু আলাইকুম।
-জব্বর?
-জে ম্যাডাম।
-আজকে বিকেলে সাড়ে পাঁচটার দিকে ছাদে এসো তো!
-জে ম্যাডাম।
জব্বর অনেক পুরোনো কেয়ারটেকার। এই এলাকাতেই আছে পঁচিশ বছর। আশপাশের সবকিছু তার নখদর্পণে। মনে মনে ভাবলাম, বিকেলে জব্বর এলে, আগে তাকে ওই লোকটিকে দেখাব। এরপর তার কাছে লোকটির সম্পর্কে জানতে চাইব। যদি না চেনে, তবে ওই বিল্ডিংয়ে পাঠাব। ওই লোকের নাড়িনক্ষত্র বের করব। তবেই আমি ছাড়ব।
ঠিক সাড়ে পাঁচটায় ছাদে যাই। একটু পরেই জব্বর এসে সালাম জানাল। ওই লোকটির দিকে তর্জনী দেখিয়ে জানতে চাইলাম,
-বিস্কুট রঙের বিল্ডিংটা দেখছ?
-জে ম্যাডাম। ওই তো, ওই ডা।
-হুম, ছাদের ওপরে একজন ভদ্রলোককে দেখছ?
-জে ম্যাডাম। ওই বুইড়া ব্যাডা ডা তো?
-ওহো! বুইড়া ব্যাটা আবার কী কথা? ভদ্রলোক বলো।
-ছরি ম্যাডাম। ভদ্দরলোক।
-হুম। তাকে চেনো?
-না তো ম্যাডাম!
-তুমি বলে এই এলাকার সবাইকে চেনো? তাহলে ওই লোকটিকে চিনতে পারছ না কেন?
-ম্যাডাম, হইতে পারে; ওই ব্যাডাৃছরি, ছরি ম্যাডাম! ওই ভদ্দরলোক এইখানে ব্যাড়াইতে আইছে।
-তা কী করে হয়? তাকে তো দেড়-দুই মাস হলো দেখছি!
-অ! তাই নাকি? আইচ্ছা। ওহন কন, আমারে কী করতে হইব?
-ওই লোকের খোঁজ নিয়ে আসবে। সে কী কাজ করে? কেন সে ছাদে বসে এই দিকে তাকিয়ে থাকে? কেন সে রাতে জানালা দিয়ে বাসার দিকে তাকিয়ে থাকে? এই সব জিজ্ঞেস করবা।
-কার দিকে তাকাই থাহে ম্যাডাম? মৌ আফার দিকে?
-তোমার এত কিছু জানার দরকার নাই। তুমি দেখছ না, সে এখনো তাকিয়ে আছে?
-জে ম্যাডাম। তাই তো! অহনও তাকায় আছে! খবিশ ব্যাডা। ছোক্ষু গালাই দিমু। ছরিৃছরিৃভদ্দরলোক!
-তুমি একটু বেশি কথা বলো! এখন কি আর কোনো ডিউটি আছে তোমার?
-না ম্যাডাম। নাই।
-তাহলে এখনই গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে আসো। আশপাশের কারও সঙ্গে কথা বলবে না। সরাসরি ওই বিল্ডিংয়ে যাবে। বিস্তারিত নিয়ে আমাকে এসে জানাবে। মনে থাকবে?
-মনে আবার থাকব না, মাইনে? আমি এই গেলাম আর এই আইলাম।
-আচ্ছা যাও।
আধঘণ্টা পরে ছাদ থেকে বাসায় ফিরে এলাম। জব্বর মিঞা এখনো আসছে না কেন? এই বিষয়টা নিয়ে বাচ্চাদের সামনে কথা বলতে চাইছি না। তাই মনেপ্রাণে চাইছি জব্বর মিঞা তাড়াতাড়ি ফিরুক। মাগরিবের পরে কলবেল বেজে উঠল। জব্বর এসেছে ভেবে ভীষণ উৎকণ্ঠায় দরজা খুললাম। নাহ! বাচ্চাদের বাবা, মানে আমার স্বামী ফয়সাল এসেছে। আমি যেন একটু হতাশ হলাম। আমার চেহারা দেখে সে অনুমান করতে পারল। জিজ্ঞেস করল,
-মিলি, কী হলো? কিছু নিয়ে চিন্তা করছ?
-আরে, জব্বরকে সেই বিকেলে পাঠিয়েছি ওই বিস্কুট রঙের বাসায়। কিন্তু দেখো, এখনো আসার নাম নাই।
-নিচেও তো দেখলাম না তাকে! ইন্টারকম করো।
-তুমি করো।
-আচ্ছা।
-আমি তোমার নাশতা গরম করি।
টেবিলে নাশতা রেডি করতে করতেই জব্বর এসে হাজির। ফয়সালকে দেখে সে ইতস্ততবোধ করছে। সেটা বুঝতে পেরে আমি বললাম,
-বলো জব্বর, কী খবর নিয়ে এসেছ?
জব্বর মিঞা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,
-ছ্যার!
-তোমার স্যার জানেন। অসুবিধা নাই বলো।
-ম্যাডাম, ওই ভদ্দরলোকটা আন্দা। ছোক্ষে দেখে না। ওই বাড়ির সাহেবের ছোড বাই।
-আহা! ইশ্! তাই নাকি? ছিঃ ছিঃ কেমন হলো তাহলে ব্যাপারটা! এই শুনেছ? ওই লোকটা নাকি অন্ধ! (আমি চিৎকার করে ফয়সালকে বললাম)।
-সে দেড়-দুই মাস হইল আন্দা হইছে। নিজেই গাড়ি চালাইতে ছিল। দুইডা বাস পাল্লাপাল্লি করতে যাইয়া হ্যাগো গাড়িতে লাগাইছে। হের বউ আর শাশুড়ি মইরা গেছে লগে লগে। মাইয়াডার কিছ্ছু হই নাই। তয় ভদ্দরলোকের ছোক্ষে কাছ ঢুইক্কা গিয়া আন্দা হইয়া গেছে। আহারে! কী সুন্দর তার চেহারাখান! আমারে বসাইয়া সে নিজেই কতা কইল। এতকাল বিদ্যেশে আছিল তো! তাই তার স্বভাবচরিত্রও ভালো। আমারে সোফায় বসায়ছে। গল্প করতে করতে নামাজের সময় হইয়া গেলে, আমি আর হেই মিল্লা জামাত করলাম। তারপরে জুড়াজুড়ি কইরা একলগে নাশতা করাইল। ফেরেশতার মতো মানুষ! আল্লায় তার লগে কেমুনডা করল ক্যান? খুবই কষ্ট লাগছে কতাগুলান শুইনা।
-হুম, আমারও ভীষণ খারাপ লাগছে। এতক্ষণে ফয়সাল ফ্রেশ হয়ে এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। জব্বারের কথা সে কতটুকু শুনেছে কে জানে? তবু সে বলল,
-দূর থেকে আসলে কিছুই বোঝা যায় না। তাই ওপর থেকে দেখে কারও সম্পর্কে ধারণা করা ঠিক নয়। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘নেভার জাজ আ বুক বাই ইটস কাভার’।