শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬  |   ২৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   দিনমজুরকে জবাই করে হত্যা, ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন
  •   অবশেষে চাঁসক সহকারী অধ্যাপক কামরুল হাছানকে বদলি
  •   নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে সড়কের ওপর ভবন নির্মাণের অভিযোগ
  •   বাবা মায়ের উপর ছেলেদের নৃশংসতা ।। বৃদ্ধ বাবার থানায় অভিযোগ
  •   ফিরে এলেন আগের খতিব, নামাজের আগে নাটকীয়তা বায়তুল মোকাররমে

প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

নিষিদ্ধ অধিকার

হিমু চন্দ্র শীল
নিষিদ্ধ অধিকার

মুখন্দ দাস দোকান থেকে পরোটা আর ডালভাজি কিনে তা পলিথিনে নিলে বড় ছেলে হুট করে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, আমরা কি দোকানে বসে অন্য সবার মতো খেতে পারি না?’ ছেলের মুখে এমন কথা শুনে মুখন্দ দাস ঈষৎ হেসে বললেন, ‘হোটেলের চেয়ারে বসি খেতে গেলি এর জন্যি আলাদা টেহ্যা দেওন লাগবে। ওই টেহ্যা তো আমার কাছে নেই। তাই ওইহানে বসি খাই না।’ ছেলে তবু অবুঝ মনে বলে, ‘আমাদের ক্লাসের শ্যামচরণ, লক্ষ্মী ঠাকুর, ওরা যে প্রতিদিন তাদের বাবার সঙ্গে হোটেলের চেয়ারে বসে মজা করে খায়। ওদের বুঝি অঢেল টাকা!’

‘হ, ওনাদের ম্যালা টেহ্যা। তুইও পড়িলেইক্কা যেদিন বড় হইবি, ম্যালা টেহ্যা কামাইবার পারবি, সেদিন তুইও ওইহানে বইয়া শুধু পরোটা না, মাছ-মাংস দিয়া ভাতও খাইতি পারবি।’ ধমকের সুরে বলেন মুখন্দ দাস।

এমন কথা শুনে একেবারে চুপ হয়ে গেল বছর দশেকের ছেলে গৌরাঙ্গ। দ্বিতীয়বার আর কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না। তবু নানা জল্পনাকল্পনা তার মনে উঁকি দিতে লাগল। ছেলেকে ধমক দিয়ে কথা বলায় মুখন্দ দাসের মনও বিষাদে ভরে উঠল। কিন্তু বাস্তবতার কাছে হার মেনে পরক্ষণে সব নিয়তির দোষ বলে মেনে নিলেন।

মুখন্দ দাস স্থানীয় সিটি করপোরেশনের অধীনে বাসাবাড়ির আবর্জনা সংগ্রহের কাজ করেন। রাস্তাঘাট ঝাড়ু দেওয়া, ডাস্টবিনের আবর্জনা সংগ্রহ করে তা নির্দিষ্ট স্থানে রেখে আসাই নিত্যদিনের কাজ। তাঁর বাবাও সিটি করপোরেশনের কর্মী ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর বংশপরম্পরায় মুখন্দ দাস চাকরিটি পান। অবশ্য এর জন্য তাঁকে অনেক দেনদরবার করতে হয়েছে।

সেবক কলোনির আশপাশে যে কয়টি পাড়া আছে, সেখানে সব উঁচু জাতের মানুষের বসবাস। তাদের চোখে সেবক কলোনির মানুষগুলো কিছুই না। পূজা–পার্বণের সময় তাই সব দায়দায়িত্বের ভার থাকে ওই সমাজের ওপর। অবশ্য এসবের বিরুদ্ধে অনেকে কথাও বলেছেন। চেষ্টা করেছেন এসব রীতি ভেঙে নতুন দিনের সূচনা করার। কিন্তু দিনশেষে ফলাফল শূন্য।

মুখন্দ দাসের বড় ভাইয়ের ছেলে সুজেয় দাস সেবক কলোনি থেকে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। তিনিও এর বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে বাড়িছাড়া হন বছর দুয়েক হতে চলল। তাই এ বিষয়ে কেউ আর কোনো দিন সাহস করেননি কিছু বলার।

গৌরাঙ্গ স্থানীয় এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। লেখাপড়ায় অসম্ভব মেধাবী। সেবক কলোনির কোনো বাড়িতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পড়ার প্রয়োজন হলে তার ডাক পড়ে। গৌরাঙ্গ সযতনে পড়ে তা শুনিয়ে দেয় গৃহস্থকে। মাঝেমধ্যে মানুষ খুশি হয়ে এর বিনিময়ে হাতে পাঁচ টাকার একটা পুরোনো নোট গুঁজে দেয়। লোকে মুখন্দ দাসকে বলে, তাঁর ছেলে মিষ্টভাষী। স্কুলে পড়াশোনায় অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে থাকার কারণে মহল্লার অনেকে গৌরাঙ্গকে নিয়ে টিটকারি করতেও দুইবার ভাবে না। যে কয়েকজন মহাজন প্রকৃতির লোক আছেন, তাঁরা ইতিমধ্যে তাঁদের সন্তানদের নিষেধ করে দিয়েছেন এই বলে, স্কুলের বেঞ্চে মুখন্দ দাসের ছেলে তাঁদের ছেলেমেয়েদের পাশে বসতে পারবে না। শ্রেণিশিক্ষকেরা এর প্রতিবাদ জানান। কিন্তু স্কুল কমিটির মৌনতায় তা বেশি দিন স্থায়িত্ব হয়নি।

শীতের সকাল। কুয়াশা পুরোপুরি জেঁকে বসেছে। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে স্কুল-কলেজ ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। পাড়া-মহল্লার ছেলেমেয়েদের হাতে অফুরন্ত সময়। অনেকে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায় মগ্ন। আবার কেউ ঘুরে বেড়ানোর উদ্দেশে বেরিয়েছে। এদিকে গৌরাঙ্গ বায়না ধরেছে, এবার শীতের ছুটি মামার বাড়িতে কাটাবে। ছেলের আবদার রাখার জন্য মুখন্দ দাস শীতের এক সকালে দুই ছেলে আর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে।

মহল্লার আশপাশে যে কয়টি রুটি-পরোটার দোকান আছে, সবখানে মানুষের ভিড়। আশপাশের ছোট-বড় সবাই এসে রুটি-পরোটায় তৃপ্তি খুঁজছে। বয়োজ্যেষ্ঠরা ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে করছেন খোশগল্প। যে আলাপ-আলোচনায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে পাশের বাড়ির ছোট মুরগির ছানাটিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সকালবেলা ঘরে খাওয়ার মতো তেমন কিছু ছিল না বলে মুখন্দ দাসের স্ত্রী ও ছেলেরা কিছুই মুখে দিতে পারেনি। যাত্রাপথে ছেলে বায়না ধরেছে চায়ের দোকানে বসে পরোটা আর ডালভাজি খাওয়ার। পথিমধ্যে বেশ কয়েকটি চায়ের দোকানে অনেক ইতিউতি করলেন মুখন্দ দাস। দেখলেন সমাজের বড়বাবুরা সেখানে বসে আরাম করছেন। তাই আর সাহস করলেন না তাঁদের পাশে বসে ছেলের আবদার পূরণ করার।

কিঞ্চিৎ দ্বিধান্বিত হয়ে রমেশের দোকান থেকে গুনে গুনে চারজনের জন্য চারটি পরোটা নিলেন মুখন্দ দাস, সঙ্গে দুটো ডালভাজি। মুখন্দ দাসের কাছ থেকে রমেশ টাকাটা নিল একটু দূর থেকে। তাও কায়দা করে। যদি হাতের ছোঁয়া লাগে, এতে তার জাত যাবে—এই ভয়ে! এলাকার মানুষেরা সেবক কলোনির জন্য একটা অলিখিত নিয়ম করে রেখেছে। এই কলোনির কেউ মহল্লার চায়ের দোকানে বসে কিছু খেতে পারবে না। যদি একান্ত খেতেই হয় তাহলে তা পলিথিনে নিয়ে বাইরে কোথাও বসে খেতে হবে। লোকমুখে শোনা যায়, এই প্রথা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আর কেউ যদি এর ব্যত্যয় করে, তাহলে তাকে সমাজচ্যুত করা হয়। সমাজচ্যুতির ভয়ে এর বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলার সাহসও করে না কোনো দিন। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ প্রথা সেবক কলোনির মানুষগুলোও নিরুপায় হয়ে দিনের পর দিন নীরবে সহ্য করে চলেছে।

শীতের কুয়াশা হালকা হতে শুরু করেছে। পূর্ব দিগন্তে সূর্যটা উঠবে বলে লাল আভা ছড়িয়েছে। কুয়াশার লুকোচুরি ভেঙে মাঝেমধ্যে সেই লাল আভা দেখা দিয়ে আবারও কুয়াশার অতলে নিমেষে হারিয়ে যাচ্ছে। পরোটা আর ডালভাজির পুঁটলিটা হাতে নিয়ে মুখন্দ দাস চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে একবার দেখে নিলেন। ইতস্তত বোধ না করে সদর্পে হেঁটে গিয়ে স্ত্রী আর বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে বসলেন চায়ের দোকানের পাশঘেঁষা পিটালিগাছের তলায়। স্ত্রী-পুত্র মিলে তৃপ্তি ভরে খেলেন। ঢেকুর তুলতে তুলতে নীরবে রওনা দিলেন গন্তব্যের উদ্দেশে। পথিমধ্যে কোনো জলাধার মিললে সেখান থেকে পানি পানের ইচ্ছা। আশপাশের চায়ের দোকানে থাকা চকচকে গ্লাস আর পানির পাত্রগুলো থেকে মুখন্দ দাসদের পানি পানের অধিকার, সে তো বহুকাল আগে থেকেই নিষিদ্ধ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়