মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মিশরে ঈদে মিলাদুন্নবীর ঐতিহ্য ‘আরুসাত-আল-মোলিদ’ : জন্মদিনের পুতুল
  •   'বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ অপরিহার্য'
  •   চাঁদপুরের ২৪তম পুলিশ সুপার মুহম্মদ আব্দুর রকিব
  •   ফরিদগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে শোভাযাত্রা
  •   ওয়াইফাই সংযোগ দিতে গিয়ে প্রাণ গেল যুবকের

প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

টো টো কোম্পানি

সবুজ ওয়াহিদ

‘ও নদী রে...।’

নদীর পাড়ে পৌঁছেই হেঁড়ে গলায় গান ধরে সুজন। যে নদীর উদ্দেশে তার এই আকুল জিজ্ঞাসা, সেটা আসলে নদী নয়, নদ। নদের নাম ভৈরব। ভৈরবের সেই রমরমা দিন আর নেই এখন। নানা-দাদা তো বটেই, মামা-চাচাদের মুখেও শুনেছি, তাঁরা নাকি এই নদে কুমির দেখেছেন। এমনকি দু-চারজন চাপাবাজ ধরনের পাড়াপড়শি ও মামা-চাচা গোত্রীয়দের কাছে কুমিরের সঙ্গে তাঁদের লড়াইয়ের বর্ণনাও শুনেছি দু-চারজনের ছোটবেলায়। অনেক দিন ভৈরব নিয়ে কোনো হইচই ছিল না; জল তার বয়ে যাচ্ছিল। আলোড়নহীনভাবে। ইদানীং শোনা যাচ্ছে, এখানে নাকি কী এক আজব প্রাণীর আগমন ঘটেছে। সেই প্রাণীর নাকি বিরাট শরীর, বড় বড় রক্তবর্ণ চোখ, লেজের দিকে মাথা, আবার মাথার দিকে লেজ ইত্যাদি ইত্যাদি।

তো বিকেল হলেই সেই আজব প্রাণী দেখতে অনেক মানুষ ভৈরবপাড়ে ভিড় জমায়। আমাদের (আমি, অয়ন ও সুজন) আগমনের হেতু অবশ্য ভিন্ন। ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি আর অ্যানিমেল প্ল্যানেট চ্যানেল প্রচুর দেখার অভিজ্ঞতার সুবাদে আমরা নিশ্চিত করেই জানি প্রাণীটা বড় আকারের শুশুক ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা এসেছি জমায়েতকারিণীদের মধ্যকার সুন্দরীদের দেখতে এবং টাংকি মারতে। সেই উদ্দেশ্যে নদের কাছে সুজনের প্রশ্ন দ্রুত থামিয়ে দিয়ে এদিক-ওদিক নজর চালালাম। নদের পাড়ে অবস্থানরতাদের মধ্যকার কোনো সুন্দরীর সঙ্গে চোখাচোখি ঘটানোই উদ্দেশ্য। কোনো সুন্দরীর চোখে চোখ পড়ল না। তবে দৃষ্টি গিয়ে পড়ল রায়হান ভাইয়ের ওপর। রায়হান ভাই কেমন জানি উদাস হয়ে বসে আছেন সামান্য দূরের শিমুলগাছটাকে ঘিরে তৈরি করা বেদিতে। তাঁর আশপাশে আর কাউকে দেখলাম না।

রায়হান ভাই আমাদের পাড়াতো বড় ভাইস্থানীয় বন্ধু। কয়েক বছর ধরে পাড়ায় যেকোনো সামাজিক, অর্ধসামাজিক ও কখনো কখনো অসামাজিক কাজে আমাদের মানে টো টো কোম্পানির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তিনি। এখন তাঁর জায়গায় আমরা স্থলাভিষিক্ত হব। কারণ, রায়হান ভাই আগামীকাল একটা নতুন চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন।

আমরা এগিয়ে গেলাম রায়হান ভাইয়ের দিকে। কুশল বিনিময়ের পর তাঁর এই উদাসীন ভাবের কারণ জানতে চেয়ে তাঁকে ঘিরে বসে পড়লাম আমরা তিনজন। বয়সে তিনি বড় হলেও আমাদের সঙ্গে একদম বন্ধুর মতো আচরণ করেন। আর তাই খোলাখুলিই বলতে শুরু করলেন রায়হান ভাই,

‘তোরা তো জানিস, কাল নতুন চাকরিতে জয়েন করব। এত দিনের পুরোনো চাকরিতে আজই আমার শেষ দিন। এত দিনের চাকরি মানে বুঝলি না? এই টো টো কোম্পানির চাকরি আরকি। তোরা এখন যেটা করছিস, এই চাকরির চেয়ে নতুনটাতে বেতন আর সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি। টো টো কোম্পানি আমাকে বেতন দেয়নি এটা ঠিক, কিন্তু একজনকে ঠিকই মিলিয়ে দিয়েছিল। সে আমার স্বপ্নের রাজকন্যা।’ এ পর্যন্ত শুনে আমরা তিনজন মুখ–চাওয়াচাওয়ি শুরু করলাম। রায়হান ভাইয়েরও যে এসব ব্যাপার আছে, সেটা আমরা কেউই জানতাম না। রায়হান ভাই আমাদের মুখভঙ্গি দেখতে পাননি। তিনি বলে চলেছেন,

‘টো টো কোম্পানিতে চাকরির সৌজন্যে আমাকে অনেক ঘুরে বেড়াতে হতো। ....না, দেশ-বিদেশে না, এই শহরের অলিগলিতে। চুপ করে শোন। কয়েক বছর আগের কথা। তখন আমি কলেজে পড়ি। তোরা তখনো এলাকায় আসিসনি।’ এটা বলে আমার আর অয়নের দিকে ইঙ্গিত করলেন রায়হান ভাই। সুজন তখন বেশ ছোট। এরপর আবার পুরোনো কথার খেই ধরলেন রায়হান ভাই, ‘কোম্পানিতে ধাপে ধাপে আমার পদোন্নতি ঘটছিল। ২০ ফেব্রুয়ারির কর্মক্লান্ত দিন শেষে রাত এল। পরদিন মহান ২১ ফেব্রুয়ারি। শহীদ মিনারে ফুল দিতে হবে। কিন্তু দিতে হবে বললেই তো আর দেওয়া যায় না, তার আগে ফুল চুরির একটা ব্যাপার থেকে যায়। আমাদের পাড়ায় সবচেয়ে সুন্দর ফুলের বাগান আছে কিবরিয়া সাহেবের বাড়িতে, দেখেছিস তো তোরা। রাতের বেলা ফুল চুরির এক দুর্দান্ত মিশন নিয়ে ঢুকে পড়লাম ওই বাগানে। হামাগুড়ি দিয়ে বাগানের মধ্যে একটু একটু করে এগোই আর পছন্দসই ফুল ছিঁড়ে হাতের ব্যাগে রাখি। বেশ কিছু সময় ধরে পেছনে একটা অস্পষ্ট আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। পেছনে তাকিয়ে কিছু না দেখলে ভয় পেতে পারি ভেবে আর পেছনে তাকাইনি। কিন্তু আওয়াজটা একটু জোরে হতেই পেছনে না তাকিয়ে পারলাম না। তাকিয়েই তো আমার হতভম্ব অবস্থা। দেখি পেখম আপু দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছেন। চিন্তা কর অবস্থা!’

আমাদের চিন্তা করার সুযোগ না দিয়ে নিজেই সেই অবস্থা কল্পনা করে হাসতে লাগলেন রায়হান ভাই। আমরাও বাদামওয়ালাকে ডাক দিয়ে রায়হান ভাইকে এই মগ্নতার সুযোগে ভাঙিয়ে নিয়ে তাঁর সঙ্গে হাসিতে যোগ দিলাম। হাসাহাসি কমলে রায়হান ভাইও বাদামে ভাগ বসিয়ে আবার বলতে লাগলেন, ‘তোরা হয়তো জানিস না। কিবরিয়া আঙ্কেলের দুই মেয়ে। ময়ূর আপু আর পেখম আপু। ময়ূর আপু বড়, স্বামীর সঙ্গে কানাডায় থাকেন। পেখম আপু ছোট। ছোট হলেও আমার বছর তিনেকের বড়। তো যা বলছিলাম, আপু তো হাসছেন। এদিকে আমার অবস্থা হালুয়া টাইট। এ আমি কী দেখছি! আপুকে তো আগেও অনেকবার দেখেছি। কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি! মনে হচ্ছে যেন ফুলবাগানে ফুলেদের রানি আমার সামনে দাঁড়িয়ে চাঁদের আলোয় হাসছেন। আপুর কথায় আমার ঘোর কাটল।

“কী ব্যাপার রায়হান, এই সময় বাগানে?” প্রশ্ন করলেন পেখম আপু। আমি চট করে ফুলের ব্যাগটা লুকানোর চেষ্টা করে বললাম, “না, মানে এই, ইয়ে, অনেক দিন হামাগুড়ি দেওয়া হয় না তো, তাই একটু চেষ্টা করে দেখছিলাম আরকি!”’

রায়হান ভাইয়ের কথা শুনে তো আমরা তিনজন হাসতে হাসতে কাত।

আমরা থামলে রায়হান ভাই আবার বলতে লাগলেন, ‘তোদের মতো পেখম আপুও জোরে জোরে হেসে উঠেছিলেন। হাসতে হাসতেই বলেছিলেন, “ও, আচ্ছা। আর হামাগুড়ি দেওয়ার পথে যেসব ফুল বাধা দিচ্ছিল, ওগুলো ছিঁড়ে ব্যাগে ভরছিলে, তা–ই না?”

“না, মানে, ইয়ে, মানে, হ্যাঁ।” আমি বললাম।

“ফুলগুলো কি কাল শহীদ মিনারে দেবে?” আবার প্রশ্ন করলেন আপু।

“জি।”

“একবার কি চিন্তা করেছ, যে ফুল দিয়ে তুমি মহান ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে, সেগুলো চুরি করা!”

“কী করব? চাইলে তো আর দিতেন না।” বললাম আমি।

‘আমার এ কথা শুনে তিনি ভ্রু দুটি এমনভাবে কুঁচকালেন যে আমার মনে হলো, সব সময় কেন ও দুটি ওভাবেই থাকে না! তারপর হেসে বললেন, “এতগুলো দিতাম না এটা ঠিক। তবে একটা নিশ্চয়ই দিতাম।”

“মাত্র একটা! একটা ফুল শহীদ মিনারে দেব!” আমি চরম বিস্মিত হয়ে বললাম।

‘আমার কথা শুনে তিনি বললেন, “দেখো, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ফুলের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে না। মূল বিষয়টা হচ্ছে, তুমি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করো কি না। বুঝেছ? আর যেকোনো ব্যাপারে চেষ্টা করবে, সৎ সাহস নিয়ে সত্যি কথা বলার।”

‘ব্যাপারটা বুঝলাম এবং স্বীকার করলাম। এক হাতে ফুলের ব্যাগ আর মনে অনন্য এক অনুভূতি নিয়ে সেদিন বাড়িতে ফিরলাম। এরপর কোম্পানির কাজে আরও বেশি করে মনোনিবেশ করলাম এবং আমার কর্ম–এলাকা আপুদের বাড়ির রাস্তায় সীমাবদ্ধ করলাম। আপুর সঙ্গে তখন প্রায়ই দেখা আর অনেক অনেক কথা হতো। আপুর ছিল বই পড়ার অভ্যাস। তাই অনেক বিষয় জানতেন এবং খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতেন। আমার যে বই পড়ার অভ্যাস নিয়ে তোরা কানাকানি করিস, সেটা আমি পেখম আপুর কাছ থেকেই পেয়েছি।’

এটুকু বলে রায়হান ভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলেন, আমরা তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছি, নাকি শুধু তাঁর টাকায় কেনা বাদামের শ্রাদ্ধ করে চলেছি।

আমাদের চেহারায় মনোযোগের আভাস পেয়ে রায়হান ভাই আবার বলতে শুরু করলেন, ‘দিনগুলো ভালোই কাটছিল বুঝলি! তত দিনে আমি বুঝে ফেলেছি যে এই অনন্য অনুভূতির নামই ভালোবাসা। একদিন সৎ সাহস আমার ওপর ভর করায় আচমকাই আপুকে বলে ফেললাম, “আপু, তুমি না আমার স্বপ্নের রাজকন্যা।”

‘আপু চুপ করে কিছু সময় আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, “স্বপ্নের রাজকন্যা তো স্বপ্নে থাকে, তোমার আসলে একজন বাস্তবের রাজকন্যা দরকার।” এরপর আরও জানালেন যে তাঁরও একজন রাজকুমার আছে, স্বপ্নে এবং বাস্তবেও, ওই একজনই। বিষয়টা জেনে আমার কেন জানি কষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একধরনের আনন্দও হতে লাগল। অদ্ভুত একধরনের মুক্তির আনন্দ, যেন এত দিন আমি বন্দী হয়ে ছিলাম। বছরখানেক পর আপুর বিয়ে হয়ে যায় ওই রাজকুমারের সঙ্গে। আপু ও তাঁর স্বামী ময়ূর আপুর সাহায্যে কানাডায় চলে যান। এরপর এখন পর্যন্ত আর দেশে আসেননি। তবে ওই ঘটনার পরও যত দিন দেশে ছিলেন, আমাকে প্রিয় বন্ধুর মতো কাছে কাছে রাখতেন। এমনকি কানাডায় গিয়েও তিনটি চিঠি দিয়েছিলেন। খরচ জোগাড় করতে না পারায় আমার আর ওই সব চিঠির কোনো উত্তর দেওয়া হয়নি। জানিস, আজকাল না মাঝেমধ্যেই খুব ইচ্ছা করে... ওই যে, ওই যে, ভাসছে!’

চারদিকে হঠাৎ শোরগোল শুরু হয়ে যায়। এই শোরগোলে ঢাকা পড়ে যায় রায়হান ভাইয়ের মনের ইচ্ছার কথা। আমরা বুঝতে পারি, সেই আজব প্রাণী দেখা দিয়েছে। আমাদের ধারণামতো আসলেই ব্যাটা বড় কোনো শুশুক কি না, তা নিশ্চিত হতে নদের দিকে দৌড় লাগাই আমরা। ছুটে গিয়েও দেখতে পাই না আজব প্রাণীটিকে। শুধু দেখি, জলের বুকে তাঁর রেখে যাওয়া বৃত্তাকার ঢেউগুলো।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়