প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
একজন নির্বাক মানুষ

নির্বিকার ভঙ্গিতে গভীর মনোযোগের সঙ্গে ছবি এঁকে চলেছেন লোকটি। চক, সবুজ পাতা ও বাহারি ফুল দিয়ে চলে তাঁর নিপুণ চিত্রকর্ম। কারও মনোযোগ আকর্ষণ করার বাড়তি চেষ্টা ছাড়াই চলে এ কাজ। কিছু উৎসুক জনতা আগ্রহভরে দেখে। আর মনে মনে ভাবতে থাকে ‘পাগলের কাণ্ড’। কখনো প্রতিবাদী, আবার কখনো নিবেদনীয় এই শিল্প পথচারী তরুণ-যুবার কাছে বেশ চিত্তাকর্ষক মনে হতে থাকে।
লোকটার পরনে একটা ময়লা লুঙ্গি। অনেক জায়গায় ছেঁড়া। কখনো সেই সব চিত্রকর্মের মতো করে লুঙ্গিতে জোড়াতালি দেওয়া। দাড়ি-গোঁফ মিলিয়ে যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বেশভূষা হতো, তাহলে ‘রবীন্দ্রনাথ’ ভেবেও মানুষ ভুল করত। চুল, দাড়ি, শরীর সব ধুয়ে সাফ করে দিলে লোকটাকে স্বাভাবিক মানুষই মনে হতো!
শহরের এক আলোকচিত্র সাংবাদিক দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করে ভবঘুরে সেই চিত্রকরের চিত্রগুলো ক্যামেরাবন্দী করে রাখেন। অনেক চেষ্টা করেও কখনো তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের করতে পারেননি। যদিও মুখভঙ্গি ও চালচলন মিলিয়ে মনে হয়েছে, মানুষটা সবার সবকিছু বোঝেন। শুধু উত্তর না দিয়ে নির্বিকার থাকেন। ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে থাকেন অপলক।
কখনো কখনো দীর্ঘদিন পড়ে থাকা বালুতে জমা গাড়ির গ্লাসে শুধু হাতের আঙুলে এঁকে দিয়ে যান ব্যবচ্ছেদের গল্প, যা দেখে উঠতি বয়সী প্রেমিক যুগল ছবি তোলে। সেলফি নিয়ে ফেসবুকে আপলোড দেয়। চিত্রকর সেসবের কিছুই অবগত নয়। কে ছবি তুলল, কে আপলোড দিল, তাতে তাঁর কীই–বা আসে যায়!
লোকটি জানেন, মায়া বড় অদ্ভুত সংকট তৈরি করে। তিনি মায়ায় জড়াতে চান না। মায়া ছেড়ে এই ভবঘুরে সন্ন্যাস জীবন বেছে নিয়েছেন। এ জীবনে কোনো নিশ্চয়তাণ্ডঅনিশ্চয়তার বালাই নেই। খাওয়া কিংবা বিলাসিতাও স্পর্শ করে না। যখন যে দেখে, সে তার নিজের অনুভূতি দিয়ে নিজের মতোই ব্যাখ্যা দেয়। মানুষটার সেসব জানা হয় না। জানার তাগিদও নেই। কোনো এক প্রিয়জন হারানোর পর তাঁর এই নিঃসঙ্গ নির্বিকার জীবন। এই শহুরে জীবনে তাঁকে নিয়েও সাধারণের ভাবার অবকাশ আছে!
প্রকৃতিতে মানুষ যেমন বুদ্ধিদীপ্ত, তেমনই স্বার্থপর। এই স্বার্থপরতাই তাকে পথে নামিয়ে এনেছে। যদিও সেসব অনেক দিনের পুরোনো কথা।
আজ মানুষটা শুধু এঁকেই চলেছেন। তাঁর এযাবৎকালের সবচেয়ে দীর্ঘ চিত্রকর্ম এটি। আলোকচিত্র সাংবাদিক তাঁর ওপর গবেষণা করে দেখেছেন যে প্রতিটি চিত্রকর্মের পট ভিন্ন। অথচ সেগুলো দৈর্ঘ্য–প্রস্থ মিলিয়ে ১০–১২ ফুটের বেশি নয়। কিন্তু এবারের চিত্রটি শুধু এঁকেই চলেছেন তিনি। শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। তারপরও মানুষ বিরক্ত নয়। চিত্র আঁকার কারণে রাস্তায় জট লাগে। দীর্ঘ জট। গাড়ি ও মানুষের চলাচল একপাশে রেখে অন্যপাশে আঁকা হচ্ছে। মনের মাধুরী মিশিয়ে আঁকা এ চিত্র। শেষে দেখা যাচ্ছে একটি সূর্য উদিত হচ্ছে। নতুন সূর্য! এই সূর্যের দিকে অসহায় মানুষ তাকিয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে। কোনো অংশে পুলিশ গুলি করে মানুষকে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে। কোনো অংশে মুখ চেপে ধরে আছে মানুষকে। কোনো অংশে প্রতিবাদী মানুষ প্রদীপ জ্বালিয়ে কাউকে স্মরণ করছে। একটি পতাকা উড়ছে পতপত করে। কিছু দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মুখচ্ছবি।
লোকটি এই চিত্র এঁকে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন। মানুষ হা করে তাকিয়ে আছে। কী করবে, ভেবে উঠতে পারছে না! আর তখনই ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে যান শফিক সাহেব। বুঝতে চান, এই স্বপ্নের মানে কী! চিন্তায় পড়ে যান। কাউকে কিছু বলেন না।
কিছুদিনের মধ্যেই দেশে একটা বিরাট পরিবর্তন লক্ষ করেন। এই পরিবর্তন স্বপ্নের সেই ছবির পরিবর্তনের সঙ্গে মিলে যায়। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। নির্বাক সেই মানুষ যিনি চিত্র এঁকে বুঝিয়ে দেন যে নতুন বাংলাদেশ অত্যাসন্ন। মানুষ মুখিয়ে ছিল নতুন সূর্যের জন্য। নতুন চিন্তার অধিক্ষেত্রের জন্য। আজ সেই ছবির বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি, যাকে নিয়ে আশায় বুক বাঁধা যায়।