শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা গণফোরামের কর্মী সমাবেশ
  •   নিষেধাজ্ঞার প্রথম দিনে ফরিদগঞ্জে অবাধে ইলিশ বিক্রি
  •   পিকনিকে যাওয়া শিক্ষার্থীর মরদেহ মেঘনায় ভেসে উঠলো দুদিন পর
  •   নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি না করার শপথ করিয়েছেন এমএ হান্নান
  •   বিকেলে ইলিশ জব্দ ও জরিমানা

প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

যেভাবে চাঁদপুর নামকরণ

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
যেভাবে চাঁদপুর নামকরণ

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সমৃদ্ধভূমি চাঁদপুর। হাজার বছরে অসংখ্য মানুষের কর্মে-শ্রমে-ঘামে গড়ে উঠেছে এ সুবর্ণ-অঞ্চল। ভূ-তাত্ত্বিকদের মতে, চাঁদপুরের স্থলভাগ গঠিত হয়েছে প্রায় ২৪ লক্ষ বছর আগের প্লাইস্টোসিন এবং হলোসিন যুগে। তাই ভূতাত্ত্বিক গঠন অনুসারে এ ভূখণ্ডটি নিঃসন্দেহে বহু প্রাচীন। পার্গিটার-এর আঁকা প্রাচীন মানচিত্রে চাঁদপুর ছিল ‘কিরাতাস’ অঞ্চলভুক্ত। ১৫৬০ সালে আঁকা জীন ডি ব্যারোসের মানচিত্রে ‘ট্রপো’ অর্থাৎ ত্রিপুরার উল্লেখ রয়েছে। ১৬৫২ সালে স্যানসন দ্য আবেভিল-এর আঁকা মানচিত্রে ‘বান্দের’ নামে চাঁদপুর বন্দরকে চিহ্নিত করা হয়। ১৭৮১ সালে মেজর জেমস্ রেনেল তাঁর মানচিত্রে প্রথমবার চাঁদপুরের অবস্থান সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন।

ঐতিহাসিক তথ্যমতে, চার শতক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার প্রাচীন জনপদ ‘সমতট’-এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বৃহৎসংহিতা গ্রন্থে ছয় শতক থেকে সমতটকে স্বতন্ত্র জনপদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রাচীনকালে চাঁদপুর ছিল সমতটের অধীনে। গুপ্ত, পাল ও সেন রাজারা এ অঞ্চল শাসন করেছেন। ১৩৫১ সালে ইসলাম প্রচারক হযরত শাহরাস্তি (রঃ) চাঁদপুরের শ্রীপুর গ্রামে আসেন। স¤্রাট আকবরের অন্যতম নবরত্ন অর্থমন্ত্রী টোডরমল (১৫০০-১৫৮৯)-এর ‘তুমার জমা’র বিবরণে ‘চান্দপুর’ নামক পরগণার উল্লেখ রয়েছে। এ পরগণার বার্ষিক রাজস্ব ছিল ৩ হাজার টাকা। মধ্যযুগের কবি দোনাগাজী ষোল শতকের মধ্যভাগে চাঁদপুরে থেকে রচনা করেন ‘সয়ফুলমূলক বদিউজ্জামাল’ কাব্য। চাঁদপুরের বিভিন্ন স্থানে এখনো মধ্যযুগের পুরাকীর্তি ও স্থাপনা রয়েছে। নদীবন্দর হিসেবে সুখ্যাত চাঁদপুরকে এককালে ‘গেট ওয়ে অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’ বলা হতো। তাই এ অঞ্চল যে বহুকাল থেকে সুবিদিত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

১৮৫৮ সালে চাঁদপুর ছিল ত্রিপুরা জেলার অন্তর্ভুক্ত। ১৮৭৮ সালে চাঁদপুর মহকুমা এবং ১৮৯৭ সালের ১ অক্টোবর চাঁদপুর পৌরসভা গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধেরও অনেক পরে ১৯৮৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুরকে জেলা ঘোষণা হয়। চাঁদপুর জেলার ৮টি উপজেলা, ৮৮টি ইউনিয়ন ও ১৩৬৫টি গ্রাম রয়েছে। মোট আয়তন ১৭০৪.০৬ বর্গকিলোমিটার। সংসদীয় আসন পাঁচটি।

চাঁদপুর নামকরণ নিয়ে চারটি মতামত ও জনশ্রুতি রয়েছে।

ক. চাঁদ ফকির : বিখ্যাত সাধক ছিলেন চাঁদ ফকির। তিনি কোড়ালিয়া ও পুরন্দপুর গ্রামে ‘এলমে তাসাউফের বাইয়াত’ দিতেন। তাঁর অনেক শিষ্য ও ভক্ত ছিলো। তিনি আনুমানিক ১৭৮০/৮১ সালে মারা যান। কোড়ালিয়া গ্রামে নব্বইর দশকেও তাঁর মাজারের অস্তিত্ব ছিল। যা পরে মেঘনার ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর পর শিষ্য ও ভক্তরা এ জনপদকে চাঁদপুর নামে অভিহিত করেন। ধারণা করা হয়, এভাবে জনশ্রুত হতে হতে এ অঞ্চলের নাম হয় চাঁদপুর।

খ. শাহ চাঁদ আউলিয়া (রহ.) : তিনি দিল্লির সুলতান কর্তৃক নিয়োজিত প্রশাসক ও খ্যাতিমান ব্যক্তি ছিলেন। ১৪৯৪-১৫৩৫ সাল পর্যন্ত তিনি মেঘনা তীরের চাঁদপুর, সীতাকুণ্ডের চাঁদপুর, আসামের চিরা চাঁদপুর, চট্টগ্রামের চাঁদগাঁও ও পটিয়ার প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে চট্টগ্রামের পটিয়ায় শ্রমতি নদী সংলগ্নে তাঁর মাজার রয়েছে। ধারণা করা হয়, তাঁর স্মরণে এ জনপদের নাম হয় চাঁদপুর।

গ. চাঁদ সওদাগর : মধ্যযুগে রচিত মনসামঙ্গল কাব্যের বিখ্যাত চরিত্র চাঁদ সওদাগর। তিনি সপ্তডিঙা মধুকর ভাসিয়ে নদীপথে বাণিজ্য করতেন। তাঁর নাম অনুসারে এ জনপদের নামকরণ করা হতে পারে।

ঘ. জমিদার চাঁদ রায় : শ্রীপুরের বিখ্যাত জমিদার ছিলেন চাঁদ রায়। তাঁর জমিদারি চাঁদপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। তিনি স¤্রাট আকবরের অধীনতা অস্বীকার করেন। ১৬০১ সালে প্রয়াত হন। ঐতিহাসিক জে এম সেনগুপ্তের মতে, চাঁদ রায়ের নামে এ অঞ্চলের নাম হয় চাঁদপুর।

বিখ্যাত ভূগোলবিদ মেজর জেমস রেনেল (১৭৪২-১৮৪০) ভারতের প্রথম সার্ভেয়ার জেনারেল ছিলেন। তিনি চাঁদপুর অঞ্চলের জরিপ করেছেন এবং মানচিত্র এঁকেছেন। ১৭৬৫ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি তিনি চাঁদপুরে জরিপ কাজ শুরু করেন। তাঁর দিনপঞ্জি নিয়ে লেখা বই ‘ঞঐঊ ঔঙটজঘঅখঝ ঙঋ গঅঔঙজ ঔঅগঊঝ জঊঘঘঊখখ’। বইটি ১৯১০ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশ করে। দিনপঞ্জিতে রেনেল চাঁদপুরের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর জার্নালের ১৩৮, ১৪৪ ও ২২৭ পৃষ্ঠায় চাঁদপুর বানান লিখেছেন ‘ঈযধহফঢ়ড়ঁৎ’। এছাড়া ১৭৭৬ সালে তাঁর আঁকা মানচিত্রে চাঁদপুরের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। সে হিসেবে চাঁদ ফকিরের নামানুসারে চাঁদপুরের নামকরণ হওয়ার সম্ভবনা থাকে না। কেননা, চাঁদ ফকির মারা যান ১৭৮০/৮১। বলা হচ্ছে, মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণে এ জনপদের নাম চাঁদপুর রাখা হয়। অথচ জেমস রেনেলের দিনপঞ্জিতে ১৭৬৫ সালে চাঁদপুরের কথা উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ চাঁদ ফকিরের মৃত্যুর অন্তত ১৫ বছর আগে থেকেই এ অঞ্চলকে চাঁদপুর নামে ডাকা হতো।

চাঁদ ফকির ব্যতীত অন্য তিনজনের মধ্যে যে কোনো একজনের নামানুসারে চাঁদপুর-এর নামকরণ করা হতে পারে।

সূত্র :

১. প্রিয়তোষ সাহা, চাঁদপুর পরিক্রমা : ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ঢাকা : আহমদ পাবলিশিং হাউজ, ২০১৬, পৃ. ১৯-২০।

2. T. H. D. La Touche (Editor), The Journals Of Major James renneel, India : The Asiatic Society, 1910, P-138, 144, 227.

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান : ২৭টি গ্রন্থের লেখক ও সম্পাদক। তার দুটি বই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও প্রেস ইন্সটিটিউট বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। চাঁদপুর বিষয়ক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : চাঁদপুর সমগ্র। প্রতিষ্ঠাতা- সেন্টার ফর হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচারাল রিসার্চ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়