রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   বয়ারচর সংযোগ ব্রিজ ও বেড়িবাঁধ রক্ষায় এলাকাবাসীর মানববন্ধন
  •   জার্মানিতে কঠিন হচ্ছে রাজনৈতিক আশ্রয়
  •   ইতালির দ্বীপে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ ২১
  •   অভিভাবকহীনতায় দিশেহারা চাঁদপুরের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা
  •   আহতদের দেখতে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে প্রধান উপদেষ্টা

প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

একাত্তরের প্রেম

হাসানাত রাজিব
একাত্তরের প্রেম

‘অন্ধকার প্রকট হয়ে আসছে। যতদূর চোখ যায় তার সবটাই মিলিটারিরা অগ্নিঝড়া পায়ে দাপিয়ে বেরাচ্ছে। আমি কীভাবে আসব তোমার কাছে? কীভাবে আকাশমুখি চন্দ্রস্নানে আমি নিজেকে হারাব। ’ কথা শেষ না হতেই রুনা আরমানকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদে চলেছে। আরও কিছুক্ষণ দিঘির শান বাঁধানো ঘাটে মৃদু বাতাসে একসাথে থাকার প্রবল ইচ্ছাটাকে বিসর্জন দিয়ে আরমান চলে যেতে চাইল। যেকোনো সময় মিলিটারিরা চলে আসতে পারে। যখন দুজন সমগ্র আকাশভারি পায়ে দুদিকে হেঁটে চলে যাচ্ছিল, রুনা পিছন থেকে আরমানকে ডাক দিল। কাছে এসে সুরা ফাতিহা পড়ে আরমানের পুরো মুখে ফুঁ দিল। আর কপালে চুমু দিয়ে বলল, ‘ভীষণ সাবধানে থেক’

রুনার বাবা রিটায়ার্ড স্কুল শিক্ষক। দুর্ঘটনায় এক পা হারিয়েছে। রুনার মা নেই। তাদের বাড়ির পেছনে আরমান একটা বড় গর্ত করে সেখানে রাতের বেলা থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এখানে মিলিটারিরা এলেও যেন তাদের খুঁজে না পায়। গ্রামের মুদি দোকানদার কাদির জমাদার একজন রাজাকার। সবার মুখে মুখে শোনা যায় কিছুদিন আগে তার সহযোগিতায় অন্তত ১২ জন যুবক মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে এনে মিলিটারিরা অসহনীয় নির্যাতন করে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখেছিল। সে সারাদিন দোকানদারি করে রাতের বেলা মিলিটারিদের সাথে নিয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি চষে বেড়ায়। সেদিন রাতের নির্জনতায় মিলিটারিদের পায়ের আওয়াজে জমিন বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। রুনাদের বাড়ির গেইট লাথি দিয়ে ভেঙ্গে ফেলেছিল। রুনা আর রুনার বাবা গর্তের ভিতরে চোখ বন্ধ করে আল্লাহ আল্লাহ করছিল। কাদির জমাদার বলছিল, ‘স্যার, এ বাড়িতে একজন সুন্দরী মেয়ে আছে’ মিলিটারি সর্দার বলল, ‘বহত বারিয়া। তেরা পাসান্দ কাভি বুরা নেহি হো সাকতা’ ভয়ে রুনা আর তার বাবার প্রাণবায়ু বের হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল। রুনা ভয়ে কাঁপছিল।

এ গ্রামের পূর্ব-পশ্চিমে প্রতি বছর আনন্দ মেলার আয়োজন হয়। এ বছর সেটাকে আনন্দ বলা যাবে কিনা আমি দ্বিধার মধ্যে আছি। সেই এলাকা এখন মিলিটারিদের দখলে। গ্রামের কিছু বৃদ্ধরা তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে উপঢৌকন দেয়ার বিনিময়ে ছোট করে আয়োজন করেছে এবার। ছোট ছোট বাঁশ, তালপাতা আর নিচে প্লাস্টিকের বিছানা পেতে বৃদ্ধরা লুঙ্গি, গামছা, মেয়েদের প্রসাধনী, চুড়ি, গহনা ইত্যাদি বিক্রি করে। অন্যান্য সময় এ মেলায় প্রচণ্ড হৈহুল্লোর থাকে। ভিড়ের জন্য হাঁটা মুশকিল হয়ে যায়। আর এবার পুরো মাঠ নীরব চাদরে ঢাকা। মাঠের একেকটা ঘাস পর্যন্ত ভয়ে একটুও নড়ছে না। মেলার প্রবেশদ্বারে মিলিটারিদের মহড়া। বৃদ্ধ পুরুষ কিংবা মহিলা ছাড়া আর কাউকে পেলেই যোদ্ধা সন্দেহে ধরে নিয়ে যায়। রুনা গতবছর এ মেলা থেকে আরমানকে এক জোড়া চুড়ি আর এক পাতা টিপ কিনে দিতে বলেছিল। আরমানের কোনো চাকরি ছিল না। এখানে সেখানে দু-একটা ছোটখাটো কাজ করে কোনোরকম দিন চলে যেত। তাই আর কিনে দিতে পারেনি। মনস্থির করে রেখেছিল টাকা হলেই কিনে দিবে।

দুজন মিলিটারি গেটের দুপাশে বসে সিগারেট টানছে। আরমান ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে। তার হাত পা প্রচণ্ড কাঁপছে। আজ কোনো ভয়ই তাকে দমাতে পারবে না। এক অন্যরকম শক্তি কাজ তার প্রতিটি শিরা উপশিরা চালনা করছে। রুনার নিবেদিত ভালোবাসায় আরমান যেন তেজোদীপ্ত পুরুষ। সে সুযোগ খুঁজে যাচ্ছিল মেলায় ঢোকার জন্য। কিছুক্ষণ পর যে দৃশ্যটা তার সামনে আসলো তার জন্য সে কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না। ২ জন মিলিটারি কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে এনে বন্দুকের বাট দিয়ে বেধরক মারছে। তাদের সবার শরীর থেকে ফল্লুধারায় রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। এভাবে মারতে মারতে সকলকে মেরে ফেলছে। আরমান স্থবির হয়ে রইল। তার দু-চোখ বেয়ে ক্রমাগত পানি ঝরছিল। মানুষকে এভাবে মারা যায়!

আরমান নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল। ‘আমি এতটা কাপুরুষ কীভাবে হতে পারি! আমার ভাই, বোন, বাবা আর মায়ের দেহ থেকে নরপিশাচরা এভাবে রক্ত নিংড়ে নিচ্ছে আর আমি এর বদলা নিতে পারছি না! রাগে আর জিদে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে তার। কিছুক্ষণ পর মাথা ঠাণ্ডা হয়ে এলে সে বাড়িতে ফিরে এল। গভীর রাতে বাসা থেকে বের হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আস্তানায় গিয়ে একটানা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়। আর কোন কিছুর দিকে মনোযোগ নেই তার। যুদ্ধ ছাড়া অন্য কিছুতে ধ্যান নেই। রুনার কথা মনে পড়লেও তার কাছে এই দেশটাই প্রিয়তর হয়ে গেল। বাকিদের তুলনায় সে দ্রুত সবকিছু শিখে নিচ্ছিল। ক্রোধ বা রাগের এ একটা ভালো দিক। একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে জেদ থাকলে তা তুলনামূলকভাবে সফলতার সাথে অনেক দ্রুত শেষ করা যায়।

১০ দিন একটানা প্রশিক্ষণ নেয়া সমাপ্ত হলে আরমানসহ আরও ৬ জনের একটা দলকে মিলিটারি ক্যাম্পে আক্রমণ করার নির্দেশনা দেয়া হয়। নির্দেশনা পাওয়া মাত্র তারা সকলে হামলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। গভীর রাতে যখন সবাই ক্যাম্পের কাছাকাছি এল, ভয় যেন সবার পুরো শরীরে এসে ভর করল। এটাই ছিল তাদের প্রথম আক্রমণ। ঝিরিঝিরি হতে হতে বৃষ্টি ভীষণভাবে বেড়ে গেল। সবাই কাদামাটিতে হাঁটু গেড়ে চুপটি করে বসে রইল। আরমান বলল, ‘দ্্্্্্্্্্ুইটা বোম থাকলে ক্যাম্পটা একেবারে উড়াইয়া দিতাম’ এই দলটা নবীন হওয়াতে বোমা নিক্ষেপ করা শিখানো হয়নি। ৬ জন চারপাশে বিক্ষিপ্তভাবে জায়গাটাকে বেষ্টন করে তাদের উপর গুলির বৃষ্টি বর্ষণ করল। প্রায় আধা ঘণ্টা পর মিশন সফল করে ৫ জন ক্যাম্প থেকে বের হয়ে আসল। অন্য একজন ফিরে আসতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের সবাই খুশি। কমান্ডারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আরমান কিছুদিনের জন্য বাড়িতে ফিরে এল।

সকাল ৮টা। রুনাকে দেখার জন্য আরমানের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করছিল। কিন্তু সে রুনার বাড়িতে গিয়ে কাউকে খুঁজে পেল না। পুরো বাড়িটা খালি হয়ে পড়েছিল। সামনের উঠোনটা যেন সমস্ত বেদনায় বিধ্বস্ত বাড়িটাকে আঁকড়ে ধরে আছে। কেঁদে কেঁদে আরমানকে সব বলে দিতে উন্মুখ হয়ে আছে। বাড়ির পেছনে গিয়ে খোঁজ নিল। কোথাও রুনাকে পাওয়া গেল না। ঘরের ভিতরে সবকিছু এলোমেলোভাবে পরে ছিল। আরমান ভীষণ বেপরোয়া হয়ে গেল। খোঁজ নিয়ে জানতে পারল রাজাকার কাদির জমাদার রুনাকে মিলিটারিদের হাতে তুলে দিয়েছে। আরমান প্রচণ্ড চিৎকারে আকাশ ভারী করে ফেলল। কিছুক্ষণের মধ্যে সবকিছু যেন শেষ হয়ে গেল আরমানের। পুরো গ্রাম চষে বেরিয়েও রুনার খোঁজ মিলল না। কাদির জমাদারকেও পাওয়া যাচ্ছিল না।

সন্ধ্যা হওয়ার পর আরমান বিষণ্ণ মনে দিঘির সিঁড়িতে বসে আছে। মনটা তার খাপছাড়া হয়ে আছে। ক্যাম্পে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না তার। কিছুদিন আগেও সবকিছু কত জীবন্ত ছিল। সেদিন বিকেলে আরমানের বাবা তাকে অনেক রাগারাগি করেছিল। সকাল থেকে না খেয়েছিল। বিকেলে এসে দিঘীর ঘাটে একা বসেছিল। সন্ধ্যা হতেই আরমানের চোখে আধো ঘুম। পুরো আকাশ সৌন্দর্য নিয়ে রুনা যেন তার সামনে এসে হাজির। পাশে বসেই রুনার শাসনসুলভ কণ্ঠে যেন রবীন্দ্রনাথ এসে ভর করেছে। ‘এই যে বালক, অন্ন আহার না করিয়া নিজেকে সুপুরুষ প্রতিষ্ঠা করিবার আর কোন পন্থা কি পাওয়ার জো হয় নাই? এমন বিষণ্ণ চেহারার বালকের সহিত আমার পিতা তাহার মেয়েকে তুলিয়া দিতে সম্মত হইবে না। আর যদি কেহ ইহাকে ভালোবাসা অত্যধিক পাইবার কৌশল করিয়া থাকে, তবে কৌশল খাটিবে না বৈকি! ‘চোখজুড়ে পানির ফোয়ারা ঝরছে আরমানের।

কয়েকদিন পর এক বন্ধু রুনার খোঁজ নিয়ে এল। সে এখনো বেঁচে আছে। মিলিটারিদের কাছে বন্দি আছে। কিন্তু এভাবে আরমান রুনার কাছে যেতে পারবে না। সারাদিন রাত অনেক পরিকল্পনা করার পরেও কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছেনা। প্রচণ্ড প্রতিশোধের ঝড় বুকের মধ্যে নিয়ে আরমান মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প থেকে ২টা গ্রেনেড চুরি করে মিলিটারিদের আস্তানায় গেল। চারপাশে শত শত মিলিটারিদের পাহারা। আরমান বুঝতে পারল এখান থেকে কোনোভাবেই রুনাকে উদ্ধার করা সম্ভব না। আর এদিকে রুনাকে ছাড়া সে কোনোভাবেই বেঁচে থাকবে না। আরমানের এক পকেটে ২টা গ্রেনেড আর অন্য পকেটে মায়ের দুহাতের চুড়ি। গ্রেনেড দুটোর চাবি খুলে অনেক জোড়ে দৌড় দিয়ে আস্তানার ভিতরে ঢুকে পরল এবং গ্রেনেডের মুখ থেকে আঙুলসরিয়ে নিল। চোখের পলকে পুরো আস্তানা উড়ে গেল। চারপাশে সবার লাশ ছিন্নভিন্ন হয়ে পরে রইল। আরমানের নিথর দেহটাকেও পরে থাকতে দেখা গেল। রুনাকে দিবে বলে মায়ের কাছ থেকে আনা চুঁড়িগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে। আর আরমানের চোখ দুটো যেন মৃত্যুর পরেও রুনাকে দেখার জন্য ব্যথায় কাতর হয়ে আছে। কিন্তু অনেক খুঁজেও রুনার কোন নিশানা পাওয়া গেল না।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়