প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
ছোটবেলার ঈদ আনন্দ

জীবন চলার পথে প্রতিজন মানুষের ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়বেই। কারণ ছোটবেলার চঞ্চলতা কখনোই ভুলবার নয়। শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো খুব মিস করি এবং মনে পড়ে। পবিত্র ঈদ উদযাপনসহ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় আসছে আনন্দঘন উৎসবের মধ্য দিয়ে।
ছোটবেলার সোনালি দিনগুলো যদিও আর কোনোদিন ফিরে পাবো না জানি! ছোটবেলার ঈদ আনন্দ, সেইদিনগুলো প্রায়ই মনে পড়ে। বিশেষ করে বেশি মনে পড়ে পবিত্র মাহে রমজান শুরু হওয়ার পর থেকে। অনেক স্মৃতি পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন ঘিরে। বাঙালি ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টিতে হিন্দু-মুসলিম কোনো ভেদাভেদ নেই। যা যুগ যুগ ধরে বাঙালি মননে ঐতিহ্য বহন করে চলছে।
আমার এই জীবন চলায় গ্রামেই বড় হয়েছি। গ্রামে বড় হয়েছি বলেই কাঁদামাটিতে বয়ে চলাসহ নান্দনিক -চমৎকার প্রকৃতি ও মানুষের ভালোবাসা মায়ামমতা এবং আনন্দ উপভোগ করতে করতে অনেক জেনেছি, অনেক শিখেছি, সমাজকে বুঝতে চেষ্টা করেছি, যা এখনো করে চলছি।
আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা চাঁদপুর শহরের বাবুরহাট দাসদী গ্রামের মনোরম পরিবেশে । আর প্রিয় গ্রামে রয়েছে দুইটি দিঘি। সুবিশাল দিঘি দুইটির নাম রয়েছে। প্রথমটির নাম অভয় বাবুর দিঘি, অন্যটির নাম দশআনি দিঘি। দিঘি দুটির সৌন্দর্যের মাঝে রয়েছে মানুষের জীবন চলার বাস্তবতা ও ছন্দ।
একমাস সিয়াম সাধনায় মাহে রমজান আসে আনন্দ ও সৌহার্দ্য সস্পর্ক আরো বেশি সুদীর্ঘ হয়। ঈদুল ফিতর সুখ-শান্তি-আনন্দ বিলিয়ে দেয় বাঙালি ঘরে ঘরে। পবিত্র রোজার সময় একরকম নিরবতার অনুভূতি সৃষ্টি হয়ে থাকে। ছোটবেলা থেকে পবিত্র ঈদুল ফিতর মানেই হচ্ছে নানা ধরনের সেমাই তৈরি করা এবং অতিথি অ্যাপায়নে সেমাই নাস্তা।
ঈদুল ফিতরের পূর্ব থেকেই হাট-বাজারসহ শহরের মার্কেটগুলোতে নতুন জামা-কাপড়, জোতা কেনাকাটা করা হয় বেশি। বন্ধুদের জিজ্ঞেস করতাম, কি রে দোস্ত এ বছর ঈদের কেনাকাটা কবে করবি? এ বছর কী ধরনের পোশাক কিনবি ইত্যাদি।
বন্ধুদের সঙ্গে ঈদের কেনাকাটার জন্যে মার্কেটে যাবার উৎসাহ ও আনন্দটা দারুণভাবে উপভোগ করতাম। যা সত্যিই মিস করি। তবে ঈদের সেমাই তৈরিটা আমার কাছে খুব ভালো লাগতো। বিশেষ করে বাড়িতে ময়দা দিয়ে মেশিনের সাহায্যে অথবা পরিস্কার কাঠের পিড়িতে যেই সেমাই তৈরি করা হতো তা খুব ভালো লাগতো।
পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতায় পাটি বিছিয়ে রোদের মধ্য তৈরি করা সেমাইগুলো দারুণ সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা হতো। যা আজ প্রায় বলা চলে বাসা বাড়িতে বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে। বর্তমান ও ভবিষৎ প্রজন্ম বলতেই পারবে না হাতে বানানো সেমাই কী এবং তার স্বাদ কত। এখন কেউ আর মেশিনের সাহায্যে ময়দা দিয়ে সেমাই তৈরি করতে তেমন দেখা যায় না!
গ্রামের যুবক-শ্রেণি প্রায়ই ঢাকামুখি ছিলো। ঢাকাতে বিভিন্ন দোকান বা শপিংমলে চাকুরি করতো। ঈদের সময় বাড়িতে একেক করে যখন আসতো এলাকা তখন ঈদ আনন্দ উৎসবের আমেজ দারুণ সৃষ্টি হতো। মজার ব্যাপার হলো চাকুরি করে ঢাকা থেকে তারা দলবেঁধে এসে তাদের কথার উচ্চারণ পাল্টে যেতো। আর তারা তখন পুরাণ ঢাকার ‘ঢাকাইয়া ভাষায়’ কথা বলতো একজন অন্যজনের সাথে। যেমন : ‘কি রে হালায় কি করতাচ্ছত, আবে হালায় কি কইবার চাইতাচ্ছত, তরে না কইতাছি বেশি পেচাল পারবি না’সহ মাঝে মাঝেই ঢাকার ভাষায় নিজেদের বন্ধুদের গালাগাল করা হতো। তখন শুধুই চুপ করে তাদের আনন্দ-উল্লাস আর কথাগুলো শুনতাম।
ঈদের দিনসহ সপ্তাহব্যাপী এলাকায় নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। আয়োজনের মধ্যে ছিলো টিভি ভিসিআরে হিন্দি ও বাংলা সিনেমা দেখা, খেলাধুলার মাঝে ছিলো গোল্লাছুট, হা-ডু-ডু, ষোলগুটি, চোখ পলান্তি, ফুটবল উল্লেখযোগ্য।
তখন মাইকে গান বাজিয়ে ও ঈদের আনন্দ উৎসব উপভোগ করা হতো। সত্যিই সেই ঈদ আনন্দ উৎসবের আমেজ এখন আর নেই, যা ঈদ আসলেই স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। আমার বাড়ির পাশের কাকা আঃ খালেক পালোয়ান চাকুরি করতেন পদ্মা পেট্রোলিয়াম কোম্পানিতে। তিনি ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসতেন এবং ঈদের দিন সকালে আমাদের বাড়িতে আসতেন, পারিবারিক খোঁজখবর নিতেন। কাকার কাছ থেকে অনেক স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি। কাকা দারুণ স্মার্ট ও উদার মনের মানুষ ছিলেন। আজকের দিনে আমি খুব মিস করি শ্রদ্ধেয় প্রয়াত খালেক কাকাকে।
ঈদ আসবে, আসছে এবং ঈদ এসেই গেছে। অতীত স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। তার কারণ বন্ধু এবং বন্ধুদের সাথে আড্ডা খুশ-গল্প, দুষ্টুমি, সিনেমা দেখা, নদীর পাড়ে ঘুরতে যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া, বন্ধুদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গিয়ে সেমাই খাওয়া আজ খুব মনে পড়ে।
বন্ধু আলমগীর পাটোয়ারী ঢাকা চাকুরি থেকে ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসলে ২ মাসেও ঢাকা যেতো না। তার কারণ আলমগীর দেশে আসা মানেই খেলাধুলা, মুখরোচক খাওয়া-দাওয়া, এলাকার কার কী অবস্থা বা সমস্যা তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া, ছোটখাটো মারপিটসহ দ্রুত সময় চলে যেতো। আর আলমগীর ঢাকা থেকে আসামাত্রই তার সাথে সর্বক্ষণ চলাচলে ছিলাম আমি, বন্ধু জহির, নজির, মফিজ তালুকদার, আঃ রহমান ভাই, মাসুদ পালোয়ান ভাই, আকতার মাঝি, মফিজ পাটোয়ারী, শাহজালাল পালোয়ান বজু ও মিন্টু শেখ। এছাড়া এলাকার বড় ভাই বা কাকাগণকে আমরা উল্লেখযোগ্যভাবে সম্মান করেই চলতাম এবং এখনো তা বঝায় রেখে চলছি।
আজ-কাল সেই রকম অনুভূতি আড্ডাটা আর নেই। প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী মান্না দে গাওয়া গানের ভাষায় যদি বলি, ‘কপি হাউজের আড্ডাটা আজ আর নেই, কোথায় হারিয়ে গেছে, সোনালি বিকেলগুলো সেই’। বা ‘বন্ধু জানি না তুমি কেমন আছো, দিনগুলো কিভাবে কাটাই, একবার এসে দেখে যাও বন্ধু’। এখন যার যার সংসার ও কর্মব্যস্ততার মাঝে এবং নানা কারণে সব আনন্দ বিলীন হয়ে গেছে। তবে মোটামুটিভাবে সম্পর্কটা ঠিক আছে। যা ছোটবেলা কিশোর বয়স থেকে শুরু হয়েছিলো। তবে সময় ও কালের পরিবর্তন, পাশাপাশি সংগঠন করা, সাংস্কৃতিক চর্চা, সাংবাদিকতা, গান, নাটক, কবিতা, লেখালেখি করাসহ নানাভাবে এলাকার বাইরে বন্ধুত্বের সংখ্যা ও পরিধি বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেহেতু ছোটবেলা থেকেই বলা চলে আড্ডা খোশগল্প অজানাকে জানবার আগ্রহ মনে সবসময় জাগ্রত রয়, সেই হিসেবে চলছি এবং জীবনের পথচলায় চলবো আশা রাখি।
পবিত্র ঈদ উদযাপনে একরাশ আনন্দ পাওয়া ও ভাগাভাগি করা। হ্যাঁ, একটা বিশেষ কালের পরিবর্তন হয়েছে, আর তা হলো! ঈদ আনন্দ উৎসবের পূর্ব থেকেই প্রিয় মানুষকে ঈদকার্ড লিখে নিমন্ত্রণ দেওয়ার ছোটাছুটি করা হতো, যা এখন আর তা করতে হয় না। বরং স্মার্টফোনের মাধ্যমে নিমন্ত্রণ জানানো হয়।
বর্তমানে গ্রাম-শহর কোনো পার্থক্য তেমন একটা নেই। তার কারণ গ্রামেও পিচঢালা রাস্তা এবং ইন্টারনেট-ফেসবুক ব্যবহারের অফুরন্ত সুযোগে সবকিছুই হাতের মুঠোয় এখন রয়েছে। এর ফলে ঈদ আনন্দ আগের চেয়ে বহুগুণ উন্নত। স্মৃতি রক্ষায় প্রতি মুহূর্তের ছবি তোলা আনন্দগুলো বন্ধুদের সাথে শেয়ার করা, ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া।
বলা চলে, স্মার্ট যোগাযোগে প্রবেশ আমাদের সকলের। তাই পুরোনো বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনসহ অনেক সহজে একজন অন্যজনকে কাছে পেয়ে থাকবেন এবং থাকি।
একটা বিষয়, না বলেই নয়, তা হলো স্মার্টফোন, ফেসবুক, ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণে একজন বন্ধু অথবা আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীদের প্রতি যে বিশেষ আর্কষণ, হঠাৎ দেখা হয়ে যাবার সে আনন্দ পাওয়া যেতো তা এখন একেবারে কমে গেছে। আর তার কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার। পরিশেষে সকলের সুখ শান্তি-সমৃদ্ধি কামনা করে পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানাই।