শনিবার, ১২ এপ্রিল, ২০২৫  |   ২৪ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

ঈদের লাল টুকটুকে পাঞ্জাবি

কনক কুমার প্রামানিক
ঈদের লাল টুকটুকে পাঞ্জাবি

হুইলচেয়ারে বসে সারাদিন শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ভিক্ষা করেন পঞ্চাশোর্ধ্ব গফুর মিয়া। পেছনে আট-নয় বছরের ছেলে জামিল গাড়ি ঠেলে নিয়ে বাবাকে ঘুরে বেড়ায় সারাক্ষণ। বাপ ছেলে দুজনের পরনে ময়লা শতছিন্ন পোশাক ওদের দরিদ্রতার অস্তিত্বের জানান দেয়। হতদরিদ্র নিঃস্ব ওরা। সম্পদ বলতে কিছু নাই। সারাদিন এখানে সেখানে হাত পেতে যা পায় তা দিয়ে সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে বাপ ছেলে মিলে রান্না করে খায়। প্রতিদিন তিনবেলা খাবার ওদের জোটে না। ছিপছিপে কালো মোটাসোটা খাটো গড়নের গফুর একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। খুব ছোটবেলাতে দুর্ঘটনায় হাত-পা চারটায় হারিয়ে ফেলেছে। জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করেই কেটে যায় তার প্রতিটি দিন। আজকাল ভিক্ষুকের সংখ্যা বেজায় বেড়েছ বলে আগের মতো রোজগারপাতি হয়না। মানুষ ভিক্ষা দিতে চায় না। দান খয়রাতে মানুষের আগ্রহ অনেক কমে গেছে। আর্তনাদের করুণ সুরে মানুষের কাছে ভিক্ষা মাগে বাপ-বেটা। দুনিয়াতে দুজন ছাড়া দুজনের আর কেউ নাই। একসময় গফুর মিয়া শহরের একপ্রান্তে নদীর পাশে বড় কড়ই গাছটার নিচে বসে ভিক্ষা করতো। সেখানেই তার পাশে বসে আরেক ভিখারিনী কমেলাও ভিক্ষা করতো। আস্তে আস্তে ওদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারপর গফুর কমেলা বিয়েও করে। ভালোই চলছিল ওদের ছোট্ট সুখের সংসার। জামিলের জন্মের পর সুখে পরিপূর্ণ হয় ওদের সংসার। কথায় আছে, সুখ ক্ষণস্থায়ী। কারো কপালে বেশিদিন স্থায়ী হয়ন া। কোন এক ভোরে অজানা সুখের সন্ধানে জামিল ও গফুরের সংসার ছেড়ে অন্য কারো সাথে পালিয়ে যায় কমেলা। জামিলের বয়স তখন দুই বছর। তখন থেকে খুব কষ্ট করে জামিলকে মানুষ করেছে গফুর মিয়া। শুধু ছেলেটার কথা চিন্তা করে সে আর দ্বিতীয় বিবাহ করে নাই। বস্তির একটা ঘুপচি ঘরে থাকে দুজন। মাসিক পাঁচশ টাকা ভাড়া গুনতে হয়। মালিক লোকটা বেজায় খারাপ। মাঝে মাঝেই বস্তিতে এসে ভাড়ার টাকা নিয়ে গোলমাল করে। পান খাওয়া মুখে বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করে। তার মতে এখানে যারা বাস করে তারা আদৌ কোন মানুষই নয়। মাসের এক তারিখে থুতু দিয়ে টাকা গুনে নিয়ে যায়। কোন আপিল চলে না।

রমজান মাস চলছে। বাপ ছেলে দুজনেই রোজা রেখে ভিক্ষা করে বেড়ায়। প্রচন্ড রোদ গরমে খুব কষ্ট হয় ওদের। তবুও জীবন তো আর থেমে থাকে না। জীবন চলে জীবনের নিয়মে। ইফতার সেহরিতে ভালো খাবারও জোটে না। সারাদিন মাথা খুব ঝিমঝিম করে। তবুও রোজকার মতো বস্তিতে এসে বাপ ছেলে শাক-সেদ্ধ রান্না চাপায়। রাতে খাবার পর আবার সে ভাতে পানি দিয়ে রাখে। সেহরিতে পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে রোজা রাখে। মাঝে মধ্যে কারো উছিলায় রাস্তায় ভালো ইফতার জোটে ওদের কপালে। সেদিন আনন্দে দু'চোখ চিকচিক করে জামিলের। রোজা প্রায় শেষের দিকে। আর কয়েকদিন পরেই ঈদ। সমাজের কিছু বিত্তবান লোক এ সময় গরীরদের যাকাত ফেতরা দিয়ে থাকেন। এসময় ওরা কিছু লুঙ্গি জামা পেয়ে থাকে। যা সারা বছর দুজনে ব্যবহার করে । এবারও ওরা বেশ কয়েক জায়গা থেকে লুঙ্গি, জামা ও সেমাই চিনি পেয়েছে। কিন্তু জামিলের গায়ের মাপে কোন শার্ট পায়নি। তাই ওর মনটা খুব খারাপ। গফুর বিষয়টা লক্ষ করে। জামিলের বহু দিনের ইচ্ছা একটা লাল টুকটুকে পাঞ্জাবি পড়ে ঈদ করার। বড়লোকদের সে দেখেছে তারা কত সুন্দর সুন্দর পাঞ্জাবী পড়ে ঈদের নামাজ পড়তে আসে। তার বয়সী বস্তির অনেক ছেলেরাও পাঞ্জাবী পড়ে ঈদের নামাজ পড়তে যায়। গফুরের কাছেও বিষয়টা খুব খারাপ লাগে। ছেলেকে একটা পাঞ্জাবি যে কিনে দিবে সে সামর্থ্য তার নাই। তবুও সে অল্প অল্প করে কিছু টাকা জমায়। দেখতে দেখতে ঈদ চলে আসে। চাঁদরাতে গফুর ছেলেকে রান্না করতে দিয়ে বস্তির আরেকটা ছেলেকে নিয়ে বের হয়। ফুটপাত থেকে ছেলের জন্য একটা লাল টুকটুকে পাঞ্জাবি কিনে। চুপিচুপি এনে রেখে দেয় সে। তারপর খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কাল সকালে ঈদ। কাল আর ওরা ভিক্ষা করতে যাবেনা। ঘুম থেকে উঠে সকাল বেলা গোসল সেরে ঈদের নামাজের জন্য প্রস্তুতি নেয় ওরা। গফুর লুকিয়ে রাখা পাঞ্জাবিটা বের করে এনে ছেলের সামনে ধরে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় জামিল। এর আগে কখনো ছেলেকে এতোটা খুশি হতে দেখনি সে। আবেগে বাবা ছেলে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে। গফুরের চোখে পানি ঝলমল করে ওঠে। সে এক চরম খুশির মূহুর্ত । খুশির সে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে ঝুপড়ি ঘরটার প্রতিটি কোণে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়