প্রকাশ : ৩১ জুলাই ২০২৩, ০০:০০
ধনাগোদার কোল থেকে বেড়িয়ে আসা বোয়ালজুড়ি খাল। বর্ষায় বেশ দেখা যায়। একেবারে নদীর মতোই। কিন্তু শীত কিংবা গ্রীষ্মে একেবারেই প্রাণ যায় যায় অবস্থা। এর কোলঘেঁষে গড়ে উঠেছে বিশাল বাজার। মিশরকে যেমন নীল নদের দান বলা হয় তেমনি এই বাজারকেও বোয়ালজুড়ির দান বললেও ভুল হবে না। পাকা রাস্তা থাকা সত্ত্বেও এই বাজারের অধিকাংশ মালামাল ট্রলারের মাধ্যমেই আসে।
বাজারের অধিকাংশ মুদি দোকানি হিন্দু। বিশেষ করে পুরানো মুদি দোকানগুলো হিন্দুদের। এরকমই একটি দোকান আছে সুমিতদের। সকলেই এক নামে চেনে অমিত সাহার মুদির দোকান। অমিত সাহা সুমিতের বাবার নাম। বেশ বেচা-কেনা হয়। সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা।’ সেই সুবাদে আশপাশের দু-তিন গ্রামের খুচরা মুদি দোকানিরা অমিত সাহার দোকান চিনতে ভুল করে না।
সুমিতদের নিজস্ব ভিটা। একেবারে খাল ঘেঁষেই। নিচতলায় দোকান দোতলায় বাসা। সুমিতের রুম থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলোর সাঁ-সাঁ শব্দ শোনা যায়। একটু কান পাতলেই পানির কলকল ধ্বনি শোনা যায়।
সুমিতরা দুই ভাই এক বোন। সুমিত সবার বড়। তারপর ভাই তারপর বোন। ভাইটা ক্লাস সেভেনে পড়ে। বোনটা সবে মাত্র স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। বেশ ভালো ছাত্র সুমিত। মাধ্যমিকে অল্পের জন্য ‘এ প্লাস’ মিস হয়েছে। সুমিতদের পরিবারে সেই একমাত্র মাধ্যমিক পাস। ছেলের পড়াশোনায় দুরন্তপনা দেখে মা বেশ গর্ব করেন। কিন্তু তার বাবা চায় সে দোকানের কাজে তাকে সাহায্য করুক। তার বাবার মন্তব্য, ‘লেখাপড়া করে কিছু করা যায় না।’ কিন্তু সুমিত চায় সে খুব বড় হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ কমপ্লিট করে সিএ করবে। সে নিজে নিজে ভেবে অবাক হয়, তার সহপাঠী আমান পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও টাকার জন্যে বই কিনতে পারেনা। কী অদ্ভুত! তার বাবার টাকাণ্ডপয়সা থাকা সত্ত্বেও পড়াশোনায় তার বাবার তিক্ততার কারণ সে খুঁজে পায় না।
বন্ধুদের অনেকেই তোলারাম, নটরডেম, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ার মতো কলেজে ভর্তি হলেও বাবার রক্ষণশীলতার কারণে সুযোগ থাকার পরেও ভর্তি হতে পারেনি ব্যবসা শাখার এই তুখোর ছাত্র। মনে মনে সে ভাবে সৃষ্টিকর্তা বুঝি তার স্বপ্নগুলোকে উড়াবার সুযোগ দেবেন না। তারপরও সে থেমে নেই। স্থানীয় কলেজে ভর্তি হয়েছে। নিয়মিত কলেজে যায় আবার বাবার সাথে দোকানেও বসে। যদিও দোকানে দুজন কর্মচারি রয়েছে তারপরও তাকে বসতে হয়। প্রচুর ভিড় থাকে দোকানে।
সুমিতের প্রতিদিনের রুটিনটা হলো- সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে কোনো মতে নাস্তা খেয়ে হিসাব বিজ্ঞান প্রাইভেটে যাওয়া। তারপর কলেজের ক্লাসে যোগ দেয়া, ক্লাস শেষ করে কোনো মতে দু লোকমা খেয়ে দোকানে। নিজেদের দোকান তারপরও কেমন যেনো মনে হয় তার। তার কাছে মনে হয় সেও যেন আর দুজন কর্মচারীর মতোই।
আগামীকাল ক্লাসে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ বিষয়ের উপর একটি পরীক্ষা হবে। প্রতিদিনের মতো আজও দোকান থেকে এসে পড়ায় নিমগ্ন হয় সুমিত। একটা কর্মচারী ছুটিতে গেছে বিধায় আজ বেশ খাটুনি হয়েছে সুমিতের। আর একটা অধ্যায় বাকি আছে। সুমিতের মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। বাকি অধ্যায়টা সকালে পড়বে বলে শুয়ে পরে।
সকালে পড়তে বসবে এমন সময় শুনে কর্মচারীটা আজকেও আসবে না। তার উপর বাবা এসে বলল, একটু দোকানে যাতো সুমিত। শরীরটা ভালো লাগছে না।’ তার মানে আজকে সুমিতের কলেজে যাওয়া হবে না। তাহলে তার পরীক্ষাও দেয়া হবে না! মনের মাঝে বজ্রপাত শুরু হয়। ছেলের করুণ দৃষ্টি মাকে সব বুঝিয়ে দেয়।
মা সান্ত¡না দেয়, তুই পরীক্ষা শেষ করে তারাতারি চলে আসিস। আমি ততক্ষণে পলাশ কে ডেকে আনি।
সুমিতের আর ডেটাবেজ চ্যাপ্টার পড়া হয় না। কিছুক্ষণ দোকানে থেকে কলেজে চলে যায় সুমিত।
পরীক্ষা শেষ হবে বারোটায়। এগারোটা সাতান্ন বাজে। হঠাৎ ফোনটা কেঁপে উঠে। নিশ্চয়ই বাবার ফোন। পরীক্ষা শেষ করে সোজা দোকানে চলে যায় সুমিত।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার। হাটের দিন। দোকানটা কেমন এলোমেলা দেখাচ্ছে। ব্যাগটা ফেলে শ্রান্তি ক্লান্তি ভুলে কাজে লেগে যায় সুমিত। মালপত্র দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ, ঝাড়ু দেওয়া, পেঁয়াজ বাছা এভাবে দু ঘণ্টা কাজ করে সুমিত। ঘাড় ফেরাতেই দেখে মা পেছনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। একটু হেসেই মনের মাঝে জমে থাকা মেঘগুলো কে আড়াল করে সুমিত। মাকে বুঝায় তার কিছুই হয়নি। বেলা চারটায় তার গোসল ও আহার জুটে।
রাত্রে সুমিত ছুটি পায়। মনটা কেন যেনো হু-হু করে কেঁদে উঠে। ছাদে এসে রেলিং ধরে খালের প্রবাহমান পানির দিকে চেয়ে ভাবে, হে নদীর স্রোত তুমি কত স্বাধীন! আমি যদি তোমার মতো হতে পারতাম। যদি সংকীর্ণ জীবনের পরাধীন স্বপ্নগুলোকে নিজের ইচ্ছে মতো ভাসাতে পারতাম। একবার জোয়ারে, একবার ভাটায়। খালের ওপারের পাটোয়ারী বাড়ির মসজিদের মিনারটা দেখা যায়। অন্ধকারে উঁচু নিচু অনেক আবছায়ার মাঝেও মিনারের অবয়বটা দেখা যাচ্ছে। যেনো এই মধ্যরাতে সকল জঞ্জালকে ছাড়িয়ে সুমিতের লালিত স্বপ্নটাই উঁকি দিচ্ছে।