রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২১, ০০:০০

কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
অনলাইন ডেস্ক

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি শিশু ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, সংগীত, চিত্রকলা, নাটক যতোই দেখি, পড়ি ও শুনি ততোই যেনো নতুনকে খুঁজে পাই। কবিগুরু এমন কিছু গান-কবিতায় কথা লিখে গেছেন জীবনের চলার পথে এবং মন-মানসিক স্বাস্থ্য হঠাৎ খারাপ হলে কবিগুরুর সৃষ্টির বাণীগুলো খুব প্রশান্তি এনে দেয়।

কোনো এক সৎ কাজে বা মানবিক সহযোগিতার উদ্যোগ নিলে, সামাজিক কিংবা সাংস্কৃতিক কোনো কাজে বের হলে শত বাধা-বিপত্তিসহ অনেক বেরসিক উক্তি কথা শুনতে হয়, তার কারণ হলো বর্তমান সমাজব্যবস্থায় ধান্ধাবাজি, তোষামোদ ও তৈলবাজির দেখতে দেখতে একপর্যায়ে হতাশার মাঝে মন যখন অস্থির হয়ে যায়, তখন কবিগুরুর বাণীই ভাঙামনকে জাগ্রত করে।

কবিগুরু লেখে গেছেন ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে’।

যদিও কবিগুরুর জীবদ্দশায়, আজকালকার মতো ধান্ধাবাজি, তৈলবাজি ও অতিমাত্রায় তোষামোদ সমাজব্যবস্থা ছিলো না, এমন তিনি দেখেননি যা বর্তমান বাঙালিদের মাঝে চলমান! তবুও তিনি তৎকালীন ভবিষ্যৎ ১শ’ বছরের মধ্যে কি হবে বা কি ঘটবে তা উপলব্ধি করেছেন!

কবিগুরুর জ্ঞানপরিধি ছিলো বিশাল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ও বাঙালিকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিতি করতে সক্ষম হয়েছেন। কবিগুরু জমিদারী কাজে বাংলাদেশের শিলাইদহ, শাহজাদপুর এবং পতিসরে বেশ কিছু সময় ছিলেন। সবুজপ্রান্তরঘেরা নদীমাতৃক বাংলার পল্লীর ছায়াঘেরা বাংলাদেশকে খুব মন-প্রাণ উজার করে এ বাংলার পলি-দোআঁশ মাটির গন্ধ অনুভব করেছেন। তিনি এ অঞ্চলের মানুষের সাথে মিশেছেন ও ভালোবেসেছেন। কিন্তু! কবিগুরু এদেশের মানুষের কাছ থেকে হয়তো আঘাত পেয়ে একটি কবিতায় লিখেছেন, ‘রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি’। যা সত্যিই বিস্ময়কর এবং আচার্য্য বিষয়।

১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান জেল থেকে মুক্তি পেয়ে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি হিসেবে আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিজ স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা বুকে ধারণ করে হাজার হাজার বাঙালির মাঝে উপস্থিত হয়ে সেদিন বঙ্গবন্ধু বক্তব্যে বলে ছিলেন, ‘দেখে যান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে, আপনি দেখে যান।’

কবিগুরু তাঁর সৃষ্টিকর্মে লেখনিতে বাস্তবতাকেই বারবার তুলে ধরেছেন! কবিগুরুর প্রেম-ভালোবাসার ছোঁয়া কবিতা ও গানে বাস্তবতাকেই বেশি তুলে ধরেছেন মনের আবেককে নয়।

কবিগুরু প্রকৃতির প্রেম-মায়াও ছিলো প্রখর। তাই তো তিনি গান রচনায় লেখেছেন, ‘গ্রাম ছাড়াই রাঙ্গামাটির পথ, আমার মন ভুলায় রে’।

কবিগুরুর অবস্থান কোথায় নেই, তিনি সবসময় সব জায়গায় সদা জাগ্রত। গ্রামের প্রকৃতি আর শহরের দালান-কোঠা যে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম তা তাঁর লেখনিতে বারবার ফুটিয়ে তুলেছেন, তিনি লিখেছেন, ‘দেও ফিরিয়ে অরণ্য, লও এ নগর’। আবার বলেছেন, মানুষ অমিতাচারী, যতোদিন সে অরণাচর ছিলো ততোদিন অরণ্যের সঙ্গে পরিপূর্ণ ছিলো তার আদান-প্রদান; ক্রমে সে যখন নগরবাসী হলো তখন অরণ্যের প্রতি মমত্ববোধ যে হারালো। গভীর প্রেমময় গানের ভাষায় রচনা করেছেন, ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখতে তোমায় পাইনি...’।

আমাদের বাঙালি সমাজব্যবস্থায় হিংসা, বিদ্বেষ তুলনামূলক অনেক বেশি। বিশেষ করে হিন্দু আর মুসলিম, জাতি জাতিতে! কবিগুরু হিন্দু আর মুসলিম নিয়ে মন্তব্য করেছেন এইভাবে, ‘যে দিকে যাই শুধু হিন্দু-মুসলমান, হিন্দু-মুসলমান কথাই শুনি! কিন্তু আমরা কতটুকু মানুষ এটা তো বলি না!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ থেকে শুরু করে গীতি ও নৃত্যনাট্য, এমনকি উপন্যাস রচনায়ও তিনি একজন সিন্ধ পুরুষ ছিলেন। অসামান্য প্রতিভা নিয়ে জন্মেছেন কবি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন সমৃদ্ধ বংশপরম্পরার ঐতিহ্য ও নান্দনিক শৈল্পিকময় পরিবেশ। কবিকে নানামাত্রিক পরিপূর্ণ করতে নিয়ামকের ভূমিকা রাখেছে। বহুবিধ পথযাত্রায় কবিগুরুকে থমকে দাঁড়াতে হয়নি।

প্রায়ই ৮০ বছর অতিক্রান্ত হতে যাচ্ছে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে কবিগুরুর চলে যাওয়া। কিন্তু, আজও ভাবতেই পারা যায় না কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শারীরিক অনুপস্থিতি!

শ্রদ্ধেয় লেখিকা নাজনীন বেগম কবিগুরুকে নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণমূলক লেখায় বলেছেন বা লিখেছেন, সুজন সম্ভারে এখনও তিনি কি মাত্রায় সজীব এবং সরব উপস্থিতি। দুঃখ-শোক, আনন্দ-বেদনায় সকল মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ আজ পর্যন্ত কত প্রাসঙ্গিক এবং অপরিহার্য এ নিয়ে সিংহভাগ মানুষেরই কোনো দ্বি-মত নেই। তিনি লিখেছেন, স্বল্পসংখ্যক মানুষ যারা রবীন্দ্রনাথ পড়ছেন, তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধারণও করছেন। তবু স্বীকার করতে কেনো জানি দ্বিধান্বিত। মৃত্যু চিরস্থায়ী বেদনা এবং প্রস্থান হলেও কীর্তিমান মানুষরা আপন বৈভবের সম্ভারে কখনও বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যান না। এমন সব ক্ষণজন্মা মহামানব যুগেরও কালের প্রতিনিধি হয়ে সর্বকালের জন্যে আলোকবর্তিকা পৌঁছে দিতেও নিরন্তর কাজ করে যান।

২২ শ্রাবণ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরস্থায়ী প্রস্থানের শেষ গন্তব্যে চলে গেলেন। মৃত্যুকে কখনও মানতে পারেননি। তার পরেও কত আপনজনের নির্মম চলে যাওয়াকে কঠিনচিত্তে মেনেও নিতে হয়েছে। প্রথম জীবনে মৃত্যুর বন্দনা করেছেন কাব্যিক আবহে। মরণকে মিলিয়েছেন শ্যামের সঙ্গে। আবার পৃথিবী ছেড়ে না যাওয়ার আকুতি ও নান্দনিকবোধে অলঙ্কৃত হয়েছেন। নিজের চলে যাওয়ার ক্ষতবিক্ষত অনুর্ভব কতখানি পীড়া দিয়েছে কিংবা সহনীয় হয়েছে তা-ও অপ্রকাশ্যে থেকে যায়। সৃজনযজ্ঞে বহুমাত্রিক আঙ্গিনায় স্বাচ্ছন্দ্য এবং আদম্য বিচরণ করা সৃষ্টির এই মহানায়ক দীর্ঘ জীবন পাড়ি দিয়েছেন বিশ্বমানবতার জয়গান গেয়ে। প্রচলিত সমাজ সংস্কারে নিজেকে উজাড় করে দিয়েও আধুনিকতা ও সময়ের নির্মাল্যে কি মাত্রায় সম্পৃক্ত হতে পেরেছিলেন সে-ও যেনো এক মুগ্ধতার বিস্ময়। আর বিশ্বজনীনতার অপার সমরোহে আপন সৃষ্টি বলয়কে উৎসর্গই শুধু নয় সর্বমানুষের মিলিত জয়ধ্বনিতে নিজেকে পূর্ণ করা সেটাই বিশ্বকবির অপরিমের লীলা-বৈচিত্র্য। ঠাকুর বাড়ির সমৃদ্ধ পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথ নিজেকে তৈরি করেছেন অন্য সাধারণ দশজনের মতো। পর্বতপ্রমাণ প্রতিভা আর অসাধারণ সৃজন ক্ষমতায় তার সর্বব্যাপী বিচরণ সেখানে সূর্যের দীপ্ত কিরণের মতোই জ্বলে উঠতেন আপন খেয়ালে।

প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়, বাংলার বর্ষা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরই আবিষ্কার। এক বারি স্রোত সিক্ত প্রকৃতির পরশে কবির অনন্ত যাত্রা শ্মশানে গিয়ে পৌঁছায়। কোলকাতার নিমতলীর শ্মশান। সর্বশেষ অস্ত্রোপচারের জটিল চিকিৎসা জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতেই সম্পন্ন হওয়ার বিতর্কিত বিষয়টি আজ অবধি অজানাই থেকে যায়।

তৎকালীন কোলকাতার বিখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়, ডাঃ স্যার নীল রতন সরকারের মতো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এমন অপারেশন বাসায় করতে সম্মত ছিলেন। বলা হয়ে থাকে কোলকাতা তখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অনেকখানি এগিয়ে। শুধু তাই নয়, অবিভক্ত পরাধীন ভারতে ১৮৩৫ সালে কোলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা ঊনবিংশ শতাব্দির নবজাগরণের ছোঁয়ায় আধুনিকতার নির্মাল্যে অত্যন্ত যুগোপযোগী উপহার ছিলো। তবুও হস্পিটাল নেয়া হয়নি কবিগুরু কে!

১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (২২ শ্রাবণ) কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চির বিদায়ের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ জীবনের সৃষ্টি ও কর্মযজ্ঞের যবনিকাপাত হয়। কবিগুরু দেশপ্রেম ছিলো গভীর থেকে গভীর, যা তাঁর গান রচনায় বলে গেছেন, যে রবীন্দ্র সংগীত শুনলে দেশপ্রেম মন-প্রাণ উজ্জীবিত হয়, তা হলো ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’।

পরিশেষে বলবো, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমকাল কিংবা আধুনিক নন, বরং কবিগুরু সৃষ্টিকর্মে ছিলেন একেবারে চিরকালের।

কবিগুরুর ৮০তম প্রয়াণ দিবসে তাঁর স্মৃতির প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, বাঙালি এবং বিশ্বের সকল সাহিত্য, সংস্কৃতি ভাবধারা মানুষের মনে বিস্ময় স্মৃতি হয়ে বেঁচে রবে। কবিতা, গান, চিত্রঙ্গনে, নৃত্যকলা ও নাটকে বর্ষার প্রকৃকিতে সদা জাগ্রত হয়ে আছো থাকবে হে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়