প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
(প্রথম পর্ব)
আমার জন্ম ১৯৬৫ সালে, রাজশাহীর মিশন হাসপাতালে। আমার অতি শৈশব কাটে রাজশাহীর আড়ানিতে। তারপর চাঁদপুর শহরে আসি। যেহেতু জন্ম রাজশাহীতে, তাই রাজশাহী আমার কাছে মধুরতম জন্মভূমি। যেখানে আলোকিত পলান সরকার ছিলেন।
যদিও গ্রাম বলছি, কিন্তু একদমই গ্রামের মতো ছিলো না আড়ানি। অনেক সুন্দর এবং আধুনিক একটা পরিবেশ পেয়েছিলাম আমরা। সবাই? না, কিন্তু অনেক মেয়ে সাইকেল চালাতো। ঘরে ঘরে গান-বাজনা ছিলো। বাড়িগুলো ছিলো আল্পনা আঁকা। আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, মাটির দেয়াল ছিলো। পুরোটাই আল্পনা করা। উৎসব উপলক্ষে ঘর-বাড়ি-উঠোন আল্পনায় রঙিন হয়ে উঠতো।
বাবা ছিলেন বিডি মেম্বার। ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন সেই সময়ে। বর্তমানে আড়ানি একটি পৌরসভা। সে সময় বাবার জীবন ছিলো আনন্দে ভরপুর, রঙিন। আর সব কিছুতেই একটা পরিপাটি ভাব ছিলো। বাড়িতে রমরমা একটা ভাব ছিলো। মাকে সাহায্য করার জন্যে রাণীর মা ছিলো। কড়াই ভরে দুধ জ্বাল হতো। মা দুধের গ্লাস নিয়ে উঠানময় আমদের পিছনে দৌড়াতো।
আমরা যে বাড়িতে থাকতাম সেখানে মাংস রান্নার রেওয়াজ নেই। তখনকার দিনে হিন্দু বাড়িতে খাসির মাংস রান্নার রেওয়াজ খুব কম ছিলো। বনেদি পরিবারে রান্না হতো। বাবা ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে রান্না করে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। সেখানে রুস্তম কাকা তো ছিলোই। ছিলো বাবার অনুজ হযরত কাকা। এতো বিনয়ী মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। তিনি চাঁদপুরের বাড়িতেও অনেক এসেছেন।
উৎসবগুলো ছিলো এতোটাই আনন্দমুখর, যা শুনলে সবাই ভাববে আমি অতিমাত্রায় বলছি। দুর্গোৎসবের কথা ভুলতে পারি না আজও। বড়াল নদীতে নৌকায় করে দুর্গা মায়ের বিসর্জন! বাবার জীবনে তেমন দিন আর আসেনি। রঙিন সব মুখগুলোর ছবি, আজও বুকের মধ্যে আঁকা। ফটিক কাকা, ঝন্টু কাকা, গনেশ ডাক্তার, রাশ চৌধুরী কাকা। বাবার খুব জনপ্রিয়তা ছিলো।
আমার কাকা, বাবার একমাত্র ভাই সুধাংশু বিকাশ সাহা আড়ানিতেই থাকতেন। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। কাকার পরিবারও আড়ানিতে থাকতো। যদিও বাবাদের আদিনিবাস নোয়াখালীতে। কিন্তু রাজশাহীকে আমরা দুই পরিবরের সবাই অনেক মিস করি। কারণ আমাদের অনেকেরই জন্ম রাজশাহীতে। বাবা দীর্ঘ সময় রাজশাহীতে ছিলেন।
বড়াল নদীর খুব কাছেই ছিলো আমাদের বাড়ি। বড়াল নদীতেই আমরা স্নান করতাম। মনে পড়ে, বালির মধ্যে পা ঢুকিয়ে দিয়ে বালির ঘর তৈরি করতাম। পরে পা আলতো করে খুব ধীরে ধীরে বের করে আনতাম। গুহার মতো হতো। পুকুর খুবই অল্প ছিলো, নদী-খাল-বিল ছিলো। আম বাগান, লিচু বাগান। টমটমের গাড়ি অর্থাৎ ঘোড়ার সুন্দর গড়িতে আমরা রেলস্টেশনে যাওয়া-আসা করতাম। আর পুরানো বৃহৎ আকারের সেই বটগাছ। সেই বটগাছের ঝুড়ি পরে আছে নিচ পর্যন্ত। সেই বটগাছের চারিদিকে গোল করে শান বাঁধনো সিঁড়ি। সবাই বটগাছের ছায়াতে বসে নদীর বাতাস পাবে। ভোলা যায় এসব স্মৃতি!
বিকেলে খেলার জন্যে মাঠে চলে যেতাম। যদিও আমার খেলার বয়স হয়নি। মা জামাকাপড় পরিয়ে দিতেন। ছোটদার (প্রবীর) হাত ধরে মাঠে যেতাম। ছোড়দা খেলতো। আমি বসে বা দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমাদের বাড়ির পরই কসমসদের বাড়ি ছিলো। কসমসের আম্মাকে আম্মা ডাকতাম। হয়তো নিরাপত্তার জন্যে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতো খুব। বাবার খুব পরিচ্ছন্ন জীবন ছিলো। নন্দী মামা (সম্ভবত গ্রাম থেকে নিয়ে গেছিলো তাকে) আমাকে কোলে করে চাঁদনী রাতে উঠোনে, বাড়ির বাইরে খোলা জায়গায়, যেখানে সজনেগাছ বাতাসে দোল খেতো, সেখানটায় ঘুরে বেড়াতো। তখন জানতাম নন্দী মামা আমার সব। সে যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাবো। শুধু একটা চালের বস্তা নিয়ে যেতে হবে।
খুব বৃষ্টির পর যখন রৌদ উঠতো, রঙধনু সাত রঙের পসরা নিয়ে আকাশে আভা ছড়াতো, তখন বাবা আমাদের ছোট দু ভাই-বোনকে বাইরে নিয়ে যেতো। যেখানে মাছ ধরার চাঁই বসিয়ে নদী, খাল-বিলের উপচেপড়া জল নিচের দিকে ছুটে চলে। জেলেরা চাঁই দিয়ে জলধারা থেকে মাছ ধরতো। বাবা তাদের থেকে খুব রঙিন চকচকে ছোট ছোট বেশ কিছু খলিশা মাছ নিয়ে পরিষ্কার ঝকঝকে কাঁচের বোতলে পরিষ্কার জলে মাছগুলো রাখতো। বাসায় এনে টেবিলে রেখে দিতো। তখন আমি খুব ছোট। কিন্তু শৈশবের স্মৃতি মধুর অমলিন।
বাবার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানটি খুব বড় ছিলো। ভিতরে খোলা জায়গা। সিমের গাছ ছিলো। ফুলগুলো এতো সুন্দর। সকালের সোনালি আলো বেগুনি ফুলের উপর পড়লে দারুণ লাগতো। গরুঘর ছিলো। সেখানে ২/৩টি গরু পালা হতো। রুস্তম চাচা দেখভাল করতো। চাচা পিতলের জগ ধরতেন আর বাবা নিজ হাতে দুধ দুইতেন। সেই অনেক দুধ মা পিতলের কড়াইতে জাল দিতেন, দুধ খাওয়ানোর জন্যে আমাদের পিছনে উঠোনময় দৌড়াতেন। সেই দুধ থেকে ঘি, ছানা, দই, ক্ষির হতো। মিষ্টি, ক্ষীরের সন্দেশ তৈরি হতো, সবটাই মায়ের হাতের তৈরি।
রাণীর মা কাজ করতেন আমাদের। আমি তাকে লানীর মা বলতাম। ‘র’-এর উচ্চারণ করতে পারতাম না। রাজশাহীর আড়ানিতে উৎসব, পালাপার্বণ চমৎকারভাবে পালন করা হতো। এক রথের মেলাই হতো একমাস যাবৎ। সেই রথ, কেউ কল্পনাও করতে পারবে না, কত নান্দনিক এবং গর্জিয়াস ছিলো। একটু বর্ণনা করি
পুরো রথটিই পিতলের তৈরি। সামনে দুটো বড় বড় ঘোড়া তা-ও পিতলের। এখানে বলা প্রয়োজন তখন আমরা টমটম অর্থাৎ ঘোড়ার গাড়িতে যাওয়া-আসা করতাম। সেগুলোও সাজানো গুছানো ছিলো। আড়ানি থেকে রেলস্টেশনে আসতে-যেতে আমরা টমটমে করেই এসেছি-গিয়েছি।
ফিরে আসি রথের গল্পে। নিচে বারোটি বড় চাকা ছিলো। টেনে নেয়ার জন্যে। দোতালা ছিলো রথটি। চারকোণা। উপরে চারিদিকে বসার ব্যবস্থা ছিলো। অনেক সুন্দর কারুকাজ ছিলো চারদিকে। সবটাই পিতল এবং কারুকাজখচিত। পুরহিত, পূজারী সবাই উপর থেকে কলা, বাতাসা, নারিকেলের টুকরো ইত্যাদি ছুঁড়ে দিতো আর নিচে সহ¯্রাধিক মানুষ, যারা রথ টানতে, দেখতে, অংশ গ্রহণ করতো, তারা সেগুলো অর্থাৎ প্রসাদ পাওয়ার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়তো। একমাস যাবৎ এ উপলক্ষে মেলা চলতো। সেই মেলাতে হরেক রকমের জিনিস বিক্রি হতো বলাই বাহুল্য। তখন তো মাটির জিনিসের অনেক কদর ছিলো। কাস, পিতল, লোহা তো ছিলোই। কিন্তু মনে দাগ কেটে যাওয়ার মতো ছিলো পাঁপড়। সেই রকম বড় কড়াইয়ে সেই রকম বড় অথচ পাতলা পাঁপড় বিক্রি হতো। আর স্বাদে ছিলো অসাধারণ।
আড়ানির মুডি মুড়কির কথা অরেক গল্প-কাহিনী। বেতের তৈরি বেশ বড় পাত্র। যার আঞ্চলিক নাম ‘ধামা’। কড়াইতে গুড় পাক দিয়ে সেই ধামাতে একজন ঢালতো। অন্যজন ধামাতে রাখা খৈকে কাঠির সাহায্যে গুড় দিয়ে পেঁচিয়ে ফেলতো, তারপর যথারীতি ঘরে তৈরি মুড়ি মিশিয়ে তৈরি হতো মচমচে ‘মুড়ি মুড়কি’। আমরা উৎসব আনন্দে সন্দেশ, মুড়ি মুড়কী দেশীয় খাবার খেতাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ নান্দনিক রথটির ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। আমরা চলে আসি ১৯৬৮ বা ১৯৭৯ সালের প্রথমে। জন্মভূমি মায়ের মতো প্রিয়। আমাদের ঘরে মায়ের হাতে সুঁই সুতার কারুকাজ করা ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’ ফ্রেমে ছবি বাঁধানো ছিলো। সাতদিন ধরে বৈশাখী উৎসব পালন হতো। মহরমের সময় বলি খেলা, লাঠি খেলা, তলোয়ার খেলা হতো খুব ধুমধাম করে হতো। ঈদের আনন্দ ছিলো অনেক বেশি।
আগেই বলেছি, বাবার খুব জনপ্রিয়তা ছিলো। ১৯৬৭ সালের দিকে শরৎত্রিবেদি নামে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে যেভাবেই হোক মেরে ফেলে। বাবা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে এতোদিনের পরিচিতি, নাম, যশ, খ্যাতি সব ছেড়ে যে মাটির সাথে বাবা মিশে গেছিলো, সেই আড়ানি ছেড়ে চাঁদপুর চলে আসে।
এরপর চাঁদপুর। সেটা ১৯৬৮ বা ১৯৬৯ সাল হবে। হারিকেনের আলো ছেড়ে তখন আমরা প্রথম বিদ্যুতের আলো ঘরে পাই। রাস্তাঘাটে বিদ্যুতের আলো দেখতে পাই। ছায়া পিশি আর আমরা একসাথে আদালতপাড়ায় খান মঞ্জিলের দোতালা ভাড়া নিই। পিশিরা তখন তিনজন। পিশির মেয়ে শিপ্রা আমার বন্ধু হয়ে যায়। পিশেমশায় পুরাণবাজার মধুসূদন স্কুলের শিক্ষক, পংকজ বিহারি সাহা। আমরা ছয়জন। দাদা পরে রামকৃষ্ণ মিশনে চলে যায়। অনেকটা যৌথ পরিবারের মতো ছিলাম আমরা। যদিও সবকিছুই আলাদা ছিলো। কিন্তু একদিনের জন্যেও মনোমালিন্য হয়নি।
মিশন রোড ধরে যখন রামকৃষ্ণ আশ্রমে যেতাম তখন রাস্তার সারি করা নিয়ন আলোগুলো কি সুন্দর লাগতো! ছোটোবেলার সেই মোহময় অনুভূতিগুলো কীভাবে বুঝাবো। টানা লেকের টলটলে জলের তিরতির ঢেউয়ের উপর বিদ্যুতের আলোর নাচন সত্যি মন কেড়ে নিতো। আর রামকৃষ্ণ আশ্রমের পুকুরের লাল শাপলা ফুল! কি সুন্দর লাগতো! কত বড় পুকুর ছিলো আশ্রমের! আর রামকৃষ্ণ মিশন সবসময়ই শান্ত আনন্দময় পরিবেশ বিরাজমান।
তখন এ ডকাতিয়া নদীর জল মোটামুটি সব পুকুর-খাল-বিল লেকের সাথে যুক্ত করা ছিলো। ফলে জলগুলো পরিষ্কার থাকতো। জোয়ারে পুরো শহরের নদীর সাথে খাল-বিল-পুকুরের জল বাড়তো, ভাটায় কমতো। যা এখন নেই। মুখার্জিঘাটে আমরা মাঝে মধ্যে স্নান করতাম। তবে বেশির ভাগ সময় বিএডিসি ভেতরের রাস্তা দিয়ে ঢুকে পাটের গুদাম ঘরের সামনে দিয়ে নদীতে স্নান করতাম। তখন তো বিএডিসি সরকারি জায়গা ছিলো। ডাকাতিয়া নদী থেকে জল ভেতরে প্রবেশ করে বড় পুকুরের মতো ছিলো। ওই পুকুরের পাশ ঘেঁষেই সুন্দর এক বাড়ির মতো ছিলো। হয়তোবা কোয়ার্টার। সেখানে দিদির এক বন্ধু যার নাম বকুল, সে থাকতো। খুব ভালো গান গাইতো।
রবীন্দ্র সংগীত যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে/জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে ॥/সব যে হয়ে গেল কালো, নিবে গেল দীপের আলো,/আকাশ-পানে হাত বাড়ালেম কাহার তরে?/অন্ধকারে রইনু পড়ে স্বপন মানি।/ঝড় যে তোমার জয়ধ্বজা তাই কি জানি!/সকালবেলা চেয়ে দেখি, দাঁড়িয়ে আছ তুমি এ কি,/ঘর-ভরা মোর শূন্যতারই বুকের ’পরে ॥
বকুল দি খুব সুন্দর করে গান গাইতো।
আমরা পুকুরে স্নান করতাম খুব কম। পুকুরের পূর্বদিকের পাড় ঘেঁষে যে রাস্তা, সে রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে গুদামের পাশ দিয়ে গিয়ে নদীতে স্নান করতাম। সাথে শিপ্রার ঠাকুর মা আমরা দিদিমা ডাকতাম তিনি ছিলেন। মুখার্জিঘাটলায় অনেক পুরুষ স্নান করতো। তাই আমরা এ পাশটায় স্নান করতাম। অনেক শুশু মাছ দেখতাম, মনে হতো ডিগবাজি দিয়ে সাঁতার কাটছে।
নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে খুব বেশি সময় নিলো না। বাবা-মা দুজনেই ছিলেন যেখানে যেমন থাকতে হয়, সেভাবেই নিজেদের খাপ খাইয়ে নেন। পাকশি ব্রিজ বর্তমানের হার্ডিজের ব্রিজের ঝিকঝিক শব্দ, আম বাগানে আম কুড়ানোর মধুর স্মৃতি ম্লান হয়ে যাচ্ছিলো।
বিদ্যুতের আলো এখনে এসে প্রথম পাই। অবশ্য তখন রাস্তার লাইটগুলো টিমটিমে ছিলো। এখনকার মতো ঝকঝকে ছিলো না। জীবন আরও একধাপ এগিয়ে গেলো। তখন দালান ছিলো না বললেই চলে। আমরা খান মঞ্জিলের দোতালায় থাকতাম। অন্যদিকে মৃর্ধা মঞ্জিল দোতালা ছিলো। কালু হালদার সাহেবের পাকা দোতালা বাড়ি ছিলো। আমাদের বিপরীতে ছিলো চাঁদপুর কলেজের রসায়ন বিভাগের মান্নান স্যার, আর বাবু সরোজিৎ পোদ্দারের টিনের চালার পাকা বাড়ি, দুটোই আয়তনের দিক থেকে এবং সৌন্দর্যের দিক দিয়ে অতুলনীয় বিশাল বাড়ি। তখন পাড়া মানেই আপনজনদের উঠোন। (চলবে)
তৃপ্তি সাহা : লাইব্রেরি উন্নয়ন কর্মকর্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর।