প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) ॥ দশ.
শান্তিপুর গ্রামের মানুষ নুপুরের মৃত্যুতে একটা ঘোর চক্করের মাঝে অবস্থান করছে। গত দুই মাস পুলিশ এ বিষয়টির পেছনে লেগে আছে। অবশ্য বলতে বলতে দুই মাস চলে গেছে। অথচ পুলিশ এখনো কাউকে আটক করতে পারেনি। এ নিয়ে এলাকার মানুষ আড়ালে-আবডালে নানা কথা বললেও প্রকাশ্যে কেউ টুঁ শব্দও উচ্চারণ করতে চায় না। গ্রামের সম্মানিত যারা আছেন, তারাও এ বিষয়ে কথা বলতে নারাজ। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর শান্তিপুর গ্রামে কখনো পুলিশ আসেনি। অবশ্য এমন কোনো ঘটনাও ঘটেনি। অথচ নুপুরের ঘটনায় পুলিশ মাঝে মাঝেই এসে ঘুরে যায়। যদিও পুলিশ ঘটনার অন্তরালে কী পেলো তা কেউ জানে না। পুলিশ না জানালেই কী? যদিও গ্রামের মানুষের চেয়ে পুলিশ ঢের বেশি জানে। নিপু ও শোলকাকে পুলিশ ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তা এক কান দুই কান করে সবাই জেনে গেছে। কিন্তু দুই একদিন আটক কিংবা থানায় আটক না রাখায় সাধারণ মানুষ এ নিয়ে ভিন্নভাবে নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। আর ঘটনার পরদিন তো শুভকে পুলিশ প্রায় সারারাত আটকে রেখেছে। তার পরপরেই ঢাকা চলে যায় সে। যদিও এ বিষয়গুলো গ্রামের মানুষ সহজভাবেই নিয়েছে। তাদের মনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়নি। অবশ্য আখড়া এলাকায় ভুত-পেতিœ থাকে তা সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে। তাই সন্ধ্যার পরেই আখড়া এলাকায় মানুষ যেতে চায় না। মূলত সংস্কৃত ‘অক্ষবাট’ শব্দ থেকে উদ্ভূত আখড়া শব্দের মূল অর্থ ছিল মল্লভূমি বা ক্রীড়াভূমি। পরবর্তীকালে অর্থ সম্প্রসারণের ফলে আখড়া বলতে কুস্তি খেলার স্থান, নৈতিক ও শারীরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বৈষ্ণব সঙ্গীতকেন্দ্র ইত্যাদিকেও বোঝায়। কখনও কখনও সাধু-সন্তবৃন্দ তাদের বাসস্থান এবং আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধণের কেন্দ্র হিসেবেও আখড়া গড়ে তুলতেন। তরুণদের শারীরিক ও নৈতিক উন্নয়ন সাধনের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি বাংলার কিছু জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিল। ব্রিটিশপূর্ব যুগে স্থানীয় জমিদারগণ এবং সরকার বিভিন্ন সময়ে ভূমি মঞ্জুরির মাধ্যমে আখড়ার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
বাংলায় বৈষ্ণবদের আখড়া ছিল সংখ্যায় বেশি এবং সেগুলোর প্রাধান্যও ছিল সর্বাধিক। বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত হিন্দুঅধ্যুষিত প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই বৈষ্ণবদের আখড়া দেখা যেত। সেগুলোর মাধ্যমে প্রধানত বৈষ্ণব ধর্মের চর্চা হতো। এ বাড়ির আখড়ার ২০-৩০ কাঠার একখণ্ড জায়গা ছিলো। পাশেই হিন্দুদের দাহ ও মাটি দেয়া হয়। একটা ছোট্ট মন্দিরও ছিলো। বহু বছর আগে এক বৈষ্ণব থাকতো এখানে। তার কোনো সন্তান-সন্তদি ছিলো না। কোনো কাজ করতো না। বৈষ্ণবদের দৈনন্দিন কাজের মধ্যে একটি ছিল ভোররাতে গৃহস্থদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান গেয়ে তাদের ঘুম ভাঙানো। বিনিময়ে গৃহস্থরা তাদের টাকাণ্ডপয়সা, ধান-চাল ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করতো।
আর ওসব দান-খায়রাত নিয়ে জীবন চলতো বৈষ্ণবদের। অনেক আগে বৈষ্ণব মারা গেলে এখানে মাটি দেয়া হয়। ওই বৈষ্ণবের চিতার ওপর টিনের টং এখনো আছে। মাঝে মাঝে বৈষ্ণবনী এসে ঝাড়মোছা দিয়ে যেতো। বৈষ্ণবের স্ত্রীকে বলা হয় বৈষ্ণবনী। অবশ্য বৈষ্ণবনীও কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। তাই বৈষ্ণবের চিতা এখন আর ঝার-মোছা বা পরিষ্কার করা হয় না। সন্ধ্যার পর মাঝে মাঝেই এখানে কোনো একজনকে দেখতে পায় মানুষ। বৈষ্ণবের চিতার যত্ন নেয়া হয় না বলে সে ক্ষেপে থাকে। তার আত্মা উপরে ঘোরাফেরা করে। তাই মাঝে মাঝে এখান দিয়ে সাধারণ মানুষ যাবার সময় হামলা করে। ভয় দেখায়। বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে। শুধু শান্তিপুর নয় অন্য গ্রামের মানুষও এ আখড়া সম্পর্কে জানে। যারা জানে আখাড়া সম্পর্কে তাদের মধ্যে গুটিকতেক লোক আছে যারা ভূত-পেতিœ বিশ্বাস করে না। বাকি সবাই বিশ্বাস করে।
এভাবে দিন যতো চলে যায় ততই নুপুরের ঘটনা মানুষ ভুলে যায়। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মূলত পৃথিবীর পরতে পরতে প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা ঘটে। সব ঘটনা মানুষ মনে রাখে না। মনে রাখার প্রয়োজন মনেও করে না। সবচেয়ে ভালো আর সবচে খারাপ ঘটনাগুলো ইতিহাস হয়। যা মানুষ মনে রাখতে বাধ্য। যেমন বাঙালি জাতি মনে রাখবে ব্রিটিশদের নীলকর আইন, সূর্য আইন, ভাষা আন্দোলন কিংবা পাাকিস্তানের নির্যাতন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। আবার বাংলাদেশ ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জিতেছে তা মানুষ মনে রেখেছে। ড. ইউনুস শান্তিতে নোবেল পেয়েছে তাণ্ডও মানুষ মনে রাখবে। তেমনি রানা প্লাজা ট্রাজেডিও মানুষ মনে রাখবে। এমন অসংখ্য ঘটনা মানুষ মনে রাখে। অবশ্য সময় আবর্তনে এসবও ভুলে যায়। শুধুমাত্র যে সকল ঘটনা পুস্তকবদ্ধ হয়, সেসব ঘটনাই কালে কালে প্রবাহমান থাকে। চলমান ঘটনাকে অবশ্য গণমাধ্যম কিছুদিন জিইয়ে রাখে। যদিও গণমাধ্যমও পরে তা ভুলে যায়। একসময় ঘটনাস্থলের মানুষও তা মনে রাখতে চায় না। শুধু এক নুপুর নয়, এমন হাজার হাজার নুপুরের ঘটনা আড়ালে পড়ার জ্বলন্ত উদাহরণ আছে। যদিও ঘটনার পেছনের ঘটনা উঠে আসে খুব কমই।
নুপুরের মৃত্যু ঘটনা যে শুধু শান্তিপুর গ্রামের মানুষের আগ্রহ ছিলো তা কিন্তু নয়। শুভর গ্রাম সোনাইপুরের মানুষেরও ছিলো ব্যাপক কৌতূহল। ছেলের বিপদের কথা শুনে নিপুর বাবা ফজুলল হক প্রবাস থেকে দেশে ছুটিতে এসেছেন। অথচ তিনি ছয় মাস আগে ছুটি কাটিয়ে বিদেশ গেছেন। শুধুমাত্র ছেলের বিপদের কথা ভেবে ছুটে এসেছেন তিনি। এই যে ঘটনার তিন মাস পেরিয়ে গেলো কোনো কিছুই পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি। এমনকি ঘটনাটি এখন খুবই তুচ্ছ ঘটনা বলেই মনে হচ্ছে। পুলিশের নীরবতা মানুষের মনে প্রশ্ন তৈরি করলেও ঝামেলা বড় না হয়ে ছোট হয়েছে এনিয়ে মানুষ স্বস্তি নিচ্ছে। তবে এখন মাঝে মাঝেই শোলকা থানায় যায় ঘুরে আসে। ইতোমধ্যে সবাই জেনে গেছে শোলকার সাথে ওসি সাহেবের সাথে ভালো সম্পর্ক। নুপুর হত্যার মামলা আর বেশি দূর এগুবে না। যদিও পুলিশ বাদী হয়ে তিন অথবা চারজনকে অজ্ঞাতনামা আসামী করে মামলা রুজু করেছে। শোলকার আবদারে এলাকায়ও পুলিশ নজরদারি কমিয়ে দিয়েছে। এখন শুধু টার্গেট শুভ। (চলবে)
[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]