প্রকাশ : ৩০ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
ফিরে পেতে চাই শৈশবের ঈদ
তাসমিয়াহ রহমান
রাত এখন প্রায় ১টা। এতো রাতে আমার বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। গভীর চিন্তা কিংবা পুরানো স্মৃতি হাতরে বেড়ানোর এখনই সময়। আজ খানিকটা মন খারাপ। কত করে বাবা-মাকে বললাম এবার আমাদের সাথে ঢাকায় ঈদ করতে। কতদিন সবাই মিলে একসাথে ঈদ করি না। মাঝে কয়েকটা ঈদ কীভাবে কেটে গেলো টের পাইনি। ভেবেছিলাম এবার সবাই মিলে ঈদ করবো তা বুঝি আর হচ্ছে না। মা-বাবা বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় ঈদ করতে আসতে পারবে না। কারণ বাবা অসুস্থ। এ শরীরে বাবার জন্যে নড়াচড়া কষ্টকর।
|আরো খবর
কেনো জানি আজ পুরানো স্মৃতিগুলো খুব করে মনে পড়ছে। আহা! কি মজাই না হতো শৈশবের ঈদ। আমরা ছিলাম পাঁচ ভাই-বোন। বাবা আমাদের জন্যে পঁচিশ রোজার পর নতুন জামা কিনে আনতেন। নতুন জামা পেয়ে আমরা আনন্দে নাচানাচি শুরু করে দিতাম। জামার দামের ব্যাপারে কোনো কৌতূহল ছিলো না আমাদের ভাই-বোনদের মধ্যে। মা এসে বলতেন, নতুন জামা লুকিয়ে রাখতে হয়, না হলে ঈদের আনন্দ শেষ হয়ে যায়। আমরা দৌড়ে গিয়ে বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখতাম। পাশের ঘর থেকে দিনা, মিনু আমাদের ঈদ জামা দেখতে আসলে আমরা নানা বায়না করে ঈদের জামা দেখাতাম না। কারণ আমরা ধরেই নিয়েছিলাম পাড়া-প্রতিবেশী জামা দেখে ফেললে আমাদের ঈদ শেষ হয়ে যাবে। জামা পেয়ে মনে সারাক্ষণ খুশি কাজ করতো। খুশি মনে ঈদের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকতাম। বালিশের নিচ থেকে রাতের অন্ধকারে বের করে জামার গন্ধ শুকতাম। ঈদ না আসা পর্যন্ত এভাবেই মাথার কাছে নতুন জামা নিয়ে ঘুমাতাম।
এরপর শুরু হতো রোজার ঈদের সবচেয়ে উত্তেজনার মুহূর্ত। চাঁদ দেখা নিয়ে কত যে উত্তেজনা ছিলো শৈশবে! একবার তো দাদি, মা, বাবা, ভাই বোন মিলে ইফতার করতে বসেছিলাম। দিনা, মিনুসহ বাচ্চাদের চিৎকার শুনতে পেলাম ‘চাঁদ উঠছে রে, অই চাঁদ উঠছে রে’ সাথে থাকতো থালা-বাসনের ঝনঝন। অর্থাৎ সবাই থালা-বাসন চামচ নিয়ে চাঁদ দেখতে আমাদের ছাড়া বাড়িতে ভিড় জমিয়েছে। আমিও ছুটে চললাম সেদিকে। পেছন পেছন ছুটে চললো বড় আপাও। চাঁদ দেখার পর সবাই মিলে চলে যেতাম পাশের বাড়িতে। সেখান থেকে গাছের মেহেদী পাতা সংগ্রহ করে বয়সে বড়রা সে পাতা বেটে সবাই মিলে হাতে লাগাতো এবং আপারা আমাদের লাগিয়ে দিতেন। সেই কি আনন্দ। এখন অনেক মিস করি দিনগুলো। কতদিন হয় দিনা, মিনি, মিনুদের সাথে দেখা হয় না!
অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ করে আসতো পবিত্র ঈদ। কনকনে শীতের সকালে মা ভোরে আমাদের ঘুম থেকে তুলে গোসলের জন্যে পাঠিয়ে দিতেন। গোসল করে এসে নতুন জামা পরতাম। ঘর নতুন জামার গন্ধে ভরে উঠতো। মা ভোরে উঠেই সেমাই, পায়েস রান্না করে ফেলতেন। তারপর আমাদের সবাইকে মা খাইয়ে দিতেন।
একটা ব্যাপার ভুলে গেলাম কি করে! আমাদের ঘরে রেওয়াজ ছিলো ঈদের দিন বড়দের সালাম করে দোয়া নেয়ার। সবাই মিলে হেঁটে ঈদগাহে নামাজ পড়াশেষে কোলাকুলি করতাম। এমনকি ক্রিকেট খেলতে গিয়ে বল্টুর সাথে মারামারি হওয়ার পরও ঈদ আসলে কোলাকুলি করতে ভুল করতাম না। এটা অবশ্য মা বারবার করে বলে দিতেন ঈদের দিন অতীতের সব ভুলে কোলাকুলি করতে। আমাদের ঈদগাহ্ েঅনেক রকম দোকান বসতো খোলা আকাশের নিচে। বাঁশি, বেলুন, লাটিম, ছড়কি, লারেলাপ্পা, চুড়ি-মালা, খাবারের হরেক পদ নিয়ে বসতো। সেগুলা কিনে পকেট ভারি করে ঘরে ফিরতাম। ঘরে ঢুকেই মায়ের রান্নার গন্ধ পেতাম। গন্ধ শুনেই ক্ষিদা পেয়ে বসতো আমার। তারপর সবাই একসাথে বসে খাবার খেতাম। সারাদিন হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যেই কেটে যেতো ঈদ। সারাদিন আশপাশে থেকে বাঁশির আওয়াজ জানান দিতো সেটা ছিলো একটা বিশেষ দিন।
শৈশবে যাদের সাথে ঈদ করতাম এখন তাদের সাথে বছরে একবারও দেখা হয় না। বড় আপা, টিলু ভাই থাকে আমেরিকাতে। আমি ঢাকায়। টিনি, মিনি থাকে ঢাকার বাইরে। যে যার মতো ঈদ করছে। আমার মতো নিশ্চয়ই সবাই এখন শৈশবে কাটানো সময়গুলো খুব মিস করে, আবার ফিরে পেতে চায় শৈশবের ঈদ। কোলাকুলি করে সব কলুষতা মুছে দিতে চায়, ভাই ভাই একে-অপরকে বুকে টেনে নিয়ে সব বিভেদ ভুলতে চায়। শৈশবের মতো করেই হয়ত আবার আরেকটা ঈদ উপভোগ করতে চায়!
অতঃপর এসব ভাবতে ভাবতে চোখ লেগে গেলো। ঈদের দিন সকাল। আমার সাত বছরের ছেলেকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। তারপর সেমাই খেয়ে বাবা ছেলে নামাজ থেকে ফিরলাম। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম ছেলেটা আমার ট্যাব নিয়ে বসেছে। আমি কাছে গিয়ে তাকে বললাম ‘আজ ট্যাবে গেমস্ খেলে না বাবা, আজ তো ঈদ, ঈদ উপভোগ করো’। ছেলে আমাকে উত্তরে জানালো ‘মা বলেছে আজকে পড়তে বসতে হবে না। বসে আছি একা একা, তাই গেমস্ খেলছি বাবা’। আমি কিছুই বলতে পারলাম না। তারপর তার কপালে চুমো খেয়ে আমি রুমে এসে বসলাম। নতুন করে ভাবনার দুয়ার খুলে গেলো আজ আমার। শৈশবের সময়গুলো এখনো মিস করি, ফিরে পেতে চাই, এমনকি এটাও জানি শৈশব আর ফিরে পাবার নয়। শৈশবের ঈদের মতো এই আনন্দ এইভাবে আর কখনো ফিরে আসবে না। আমি তো আমার স্মৃতিতে শৈশবকে ফ্রেমবন্দি করতে পেরেছি কিন্তু আমার ছেলের শৈশব! সে যখন কৈশোর পেরিয়ে আমার বয়সে আসবে ‘শৈশবের ঈদ’ তার কাছে কেমন হবে?
এসব ভাবতে ভাবতে দৌড়ে চলে গেলাম ফোনের কাছে। একে একে বড় আপা, টেলু ভাই, টিনি, মিনি সবাইকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো আগামী কুরবানির ঈদে সবাই মিলে বাবা-মায়ের সাথে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যাবো। আমাদের ছেলে-মেয়েদের মাঝেই আবার নতুন করে ‘শৈশবের ঈদ’কে ফিরে পেতে চেষ্টা করবো।