প্রকাশ : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
এই রিকশা!
জ্বি মামা।
সারি ঘাট যাবে?
একেবারেই সারি ঘাটে গিয়ে নামবেন?
না, সারিঘাটের একটু আগে নামিয়ে দিলেই হবে।
আচ্ছা মামা উঠুন।
রোজ রিকশা নিতে গিয়ে দু-চার বার দরাদরি করাটা মানিকের স্বভাব হলেও।
আজ কিন্তু স্বভাবে এঁটে আছে বিচিত্র রকমের পরিবর্তন।
কোনো রকম দরাদরি ছাড়াই রিকশায় মানিকের বিস্ময়কর উঠে যাওয়ার কতক কারণের মধ্যে মন খারাপের কারণ টুকু ‘এক’ হিসেবে ধরে এগিয়ে গেলে মন্দ হয় না। বলা তো যায় না, একটা কারণের ফুটো সারাতে গিয়ে যদি দু-চারটা ফুটো আরো বেশি বের হয়ে যায় তখন অবশ্য সেগুলোর জোড়াতালি দিতে দিতে কলম-কালির সমাপ্তি হওয়ার আশঙ্কা করা যায়। আর এ তো কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না।
জানেন তো!
পাঠক গল্পের গুছানো অংশটুকু নিজের জীবনের বিনোদন হিসেবে পেতে চায়, অথচ একটা বিকৃত ঘটনার কথা শুনলে বিরক্তের শেষ থাকে না।
সময় আর পরিস্থিতির সাথে সাথে মানুষ অনেক কিছু দেখে, বোঝে, শোনে, উপলব্ধি করে।
আর এ হিসেবে আমার মনে হয় বিভৎস ঘটনাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে কারো অনুভূতি কারো কাছে প্রকাশের মাধ্যমে হিসেবে এই গল্পপ্রথার প্রচলনের কারণেই লেখকদের এতো সম্মান।
কেউ ঘটনা বলে খুশি, কেউ-বা ঘটনাকে গল্প হিসেবে পড়ে খুশি। খুশিটা এখানে দুভাবেই নিজের আলাদা অবস্থানটুকু খুব সহজেই বানিয়ে নিচ্ছে।
মানুষকে সময়ের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। নতুবা সকালের বাস-মিস, ট্রেন-মিস, লঞ্চ-মিসের মতো বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে কতক্ষণ।
এসব বিষয় পরিস্থিতিসাপেক্ষে কারো কাছে বড় দুর্ঘটনা, আবার কারো কাছে ছোট একটা ভুল। যেহেতু মানিকও এমন-ই দু-একটা বড় পরিস্থিতির মুখামুখি হয়েছি, সুতরাং তার কাছে এগুলো বড় দুর্ঘটনা হিসবেই বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়। তবে আপনারা চাইলে এর পরিবর্তন ঘটিয়ে ছোট ভুল হিসেবে ধরে নিতে পারেন। ব্যক্তিসুবিধায় এর পরিবর্তন কারো কাছেই কাছে অবৈধ বলে মনে হয় না।
তাছাড়া পাঁচ মিনিট দেরির জন্যে নীলার কাছে মানিকের ভয়াবহ জবাবদিহিতার বিষয়টা চাক্ষুষ দেখা সেই পরিবেশের লোকজন ছাড়া আর কারোই বুঝার ক্ষমতা নেই। অবশ্য তাদেরও বোঝার ক্ষমতা হতো না, যদি না তারা নিজ চোখে সে-সব দেখতে না পেত।
৩২ বছরের মানিকের কাছে ১৭ বয়সী নীলা বয়স হিসেবে ছোট হলেও শাসনের দিক দিয়ে যেনো তারা একে অপরের উল্টো।
মানিক বিবাহিত নীলা জানে। তবে বিবাহিত শব্দটুকু যেনো মুখ আর মগজের কাছেই সীমাবদ্ধ। এছাড়া আর এর কোনো প্রকার প্রয়োজনীয়তা দুজনের একজনেও কখনো হয়েছে কি-না জানা নেই। অবশ্য হলে জানার কথা ছিলো। সুতরাং হয়নি।
সম্পর্কে ঝগড়াঝাটি এক-আধটু হয়েই থাকে, তবে সেক্ষেত্রেও এই বিবাহিতের বিষয় কোনো প্রকার সমস্যা তৈরি করতে সক্ষম হয় না।
বিবাহিত!
এটা কেবল সম্পর্কের শুরুতে যেনে রাখার জন্যই প্রকাশ। নয়তো এর আর কোনো প্রয়োজন না সেদিন পড়েছে, আর না আজ পড়ছে।
মাঝে মাঝেই মানিক ভাবে বিবাহিত বিষয়টুকু না জানালেও বোধহয় তার আর নীলার সম্পর্কে কোনো প্রকার সমস্যা হতো না।
তো যাই হোক সময়ের সাংঘর্ষিকতার পর থেকে মানিক যে কি পরিমাণ সময় সচেতন হয়েছে, তা আর বলে বোঝানো যাবে না।
কয়েকবার তো এমনও হয়েছে যে, নীলা বাসা থেকে বেরিয়ে মানিককে কল দিয়ে রওনা দিতে বললো, অথচ মানিক তখন ঘুমের মধ্যে ডুবে ছিলো। সেই ডুবে থাকা ঘুম থেকে উঠেও নীলার আগে সে পার্কে উপস্থিত হয়ে তার সময় সচেতনতার প্রকাশ ঘটায়।
ফাহিমকে স্কুলে দিয়ে আসার জন্যে অহনা সকাল থেকেই চেঁচিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অহনা যতোই চেঁচামিচি করুক না কেনো, মানিক অহনার কথা একদম শুনবে না। বিয়ের প্রথম দু মাস যথেষ্ট প্রেম-ভালোবাসা পেয়ে ফাহিম ভেবেছিলো বিয়ের আগে প্রেম না করায় ¯্রষ্টা বোধহয় তার জন্য প্রেমের খনি প্রস্তুত করে রেখেছে। অহনাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে মানিক ধন্য অনুভব করতে লাগলো। জীবনের সবচেয়ে খুশির সময়-ও এতটা খুশি মনে হয়নি, যতটা স্ত্রীর এমন অভাবনীয় ভালোবাসা পেয়ে হয়েছে।
কিন্তু হায়, একটা কথা আছে না-‘উপর থেকে দেখে বিচার করো না নয়তো পস্তাবে’
মানিকের বেলায়ও ঠিক তেমনটা ঘটলো, হঠাৎ-ই রূপ বদলালো অহনার। অহনার এমন অস্বাভাবিক হারে পরিবর্তন মানিককে অবাক থেকেও আরো বেশি অবাক করেছে মানিক বিস্ময়ে হতভম্ব প্রায়।
আগে কোনো ভুল করলে কিংবা, বাজার করে দু-একটা সদাই কম আনলে অহনা সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতো। এমনটা যেনো আর না হয় সেই বিষয় মাথায় রাখার জন্য মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে দিত।
অথচ এখন! এখন ভুল না হলেও ‘ভুল হতেও তো পারতো’ এই ধরে মানিকের মানসিক প্রশান্তি কেড়ে নেয়ার সম্পূর্ণ চেষ্টা মত্ত অহনা।
জীবনে সবচেয়ে কাছের কেউ হয়ে থাকলে সে হয় ‘বন্ধু’, বাবা-মাকেও যে কথা বলা যায় না! বন্ধু কাঁধে হাত রেখে অনায়াসে তার চেয়েও গভীর কথা বলে ফেলা যায়। বন্ধুরা হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক ডোজের মতো। প্রথমে কেউই নিতে চায় না, কিন্তু অবস্থায় অবনতি অতি উচ্চ মাত্রায় নামতে থাকলে তখন গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। মানিকের ক্ষেত্রেও সেটাই হলো। অবশেষে সেও তার বন্ধুর কাছে সবকিছু বলে মানসিক শান্তি পাওয়ার রাস্তা চাইলো। এমন নরকীয় জীবন মানিকের আর প্রয়োজন নেই, সে এসব থেকে মুক্তি চায়।
অবশেষে অনেক কিছু ভেবে, অনেক পরামর্শ নিয়ে। মানিক নীলার সাথে সম্পর্কে যাবে বলে মনস্থির করে। এতে অবশ্য মানিকের বন্ধুই সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিলো। নীলা আর মানিকের প্রেমের শুরুতেই কথা ছিলো, তাদের বিয়ে হবে না, সে আগেই বিবাহিত। তবুও নীলা প্রেমে রাজি। সম্পর্ক বাড়াতে প্রস্তুত সে। আগে থেকেই মানিকে তার পছন্দ। অবশ্য সে কথা মানিকের বন্ধু আর নীলা ব্যতীত আর কেউই জানে না। এমনকি মানিকও না। কিন্তু বিবাহিত ছেলে জানার পরও নীলা সম্পর্কে জড়াতে চায় কেনো, সেটা জানা নেই মানিকের। আর এ সম্পর্কে সে আর কিছু জানতেও চায় না৷ তার চাই প্রশান্তি। এতো কিছু ভেবে বোকামী করার কোনো মানেই হয় না। তার পর যে আরো ৩ বছর কেটে গেলো, সেই তিন বছরেও তার একটা বারের জন্য মনে হয়নি, ঘরে তার অশান্তি; স্ত্রী তার তেলেবেগুনে। বাসায় যা কিছুই হোক না কেনো। নীলার মেসেজ পেলেই সাথে সাথে ছুটে চলে আসতো পার্কে। একসাথে বসে গল্প, হাসি-তামাশা। গোলাপ বিনিময়। সে নিজেকে প্রায়-ই প্রশ্ন করতো! স্ত্রী আর প্রেমিকার মধ্যে পার্থক্য কি? কি এমন বিশেষত্বে দুইয়ের কাছ থেকে দুই অনুভূতি গ্রহণ করতে হয়। এই ভাবনাগুলো স্থায়ী নয়, মাঝে মাঝে ঝড়ের মতো মনে আসে, ভাবনার স্তম্ভে নাড়া দেয়, ফের কোথায়ও হারিয়ে যায়। মানিকের যেই ইচ্ছেটা কখনো পূরণ হবে বলে ভাবেনি, সেটাই হলো এই ‘প্রেম’। সেই স্কুলজীবন থেকে একটা প্রেম করবে বলে ভেবে রেখেছে। অথচ তা কখনোই সম্ভব হয়নি, ভার্সিটি অবধি অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু কেউ আসেনি ভালোবাসি বলার জন্য, কিংবা সে-ও যে কাউকে গিয়ে ভালোবাসি বলবে, অতটুকু সাহসও মনে সঞ্চার করতে পারেনি। তারপর চাকরি জীবনে ঢুকে এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয়া। অতঃপর বাবা-মা এর পছন্দমত বিয়ে তারপর সংসার আর তারপর এই অশান্তি থেকে নিজের মনকে অন্যমনস্ক করার জন্য নীলার প্রতি ভালোবাসার সৃষ্টি। কতটা ভুল, আর কতটা ঠিক সেসব নিয়ে এখন আর একটুওভাবে না মানিক। তার কাছে জীবনের সবকিছুই মনে হয় ভুল, আবার সবকিছুই ঠিক।
সবাই ভালোবাসা দিবস পালন করে। মানিকেরও এ দিনটি পালন করতে ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে করে প্রিয়তমাকে নিয়ে একটা শান্ত পরিবেশে ঘুরতে যেতে। সুযেগ পেলেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভালোবাসি বলে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছেটুকুও হয় তার। কিন্তু এই সবই স্বপ্নের দখলে, এমন উগ্রমেজাজী বউ নিয়ে এসব কল্পনা করাতেও ভয় পায় মানিক। সুতরাং অনুভূতির এই ছোটছোট ইচ্ছেগুলো বাস্তবে সংঘটিত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই।
কিন্তু নীলা! সে এই-সবকিছুর অনুভূতি উপলব্ধিতে সহায়তা করেছে মানিককে।
মানিকের প্রায়-ই মনে হয় তার স্ত্রী হিসবে অহনার চেয়ে নীলাই বেশি যোগ্য।
দুই.
পকেট থেকে টিস্যু বের করে নীলার দিকে এগিয়ে দিলো মানিক। কোনো কিছু না বলেই টিস্যুটা হাতে নিল নীলা। চোখে প্রশ্নের ছলচাতুরী থাকলেও মানিকের হাতটা ফিরিয়ে দিতে মন চায় না তার।
সে জানে সে বিয়ে করতে পারবে না জেনেও মানিককে যথেষ্ট ভালোবাসে। অবশ্য যথেষ্ট বললেও ভুল হবে। বলতে হবে যথেষ্টর চেয়েও বেশি। অবশ্য এ বিষয় মানিকও অবগত। টিস্যুর এগিয়ে দেয়ার পাশাপাশি টিস্যু দিয়ে ইশারায় চোখের জলটুকু মুছে নিতে বললো মানিক। কোনো প্রকার সংকোচ না করেই মানিকের ইশারাটুকু নীলা খুব সুন্দর করে মেনে নিল। নীলার চোখজুড়ে দূরত্বের শোক। খুব দ্রুত আলাদা হয়ে যেতে হবে যেনেও, মানিককে কাছে পাবার এই দুষ্কর ইচ্ছেটুকু নীলার কাছে এখনও সূচনাকালীন।
মানিক ডানপাশ থেকে গোলাপের গুচ্ছটা হাতে নিয়ে নীলার দিকে এগিয়ে দিলো। মানিক জানে আগামী দু-চার দিনের মধ্যে নীলার বিয়ে। চাইলেও আর তার সঙ্গে ফাগুনের মূহূর্ত কাটাতে পারবে না। তাই বলে এই শেষ ফাগুন তো আর হাত ছাড়া করা যায় না। সে হিসেবে গোলাপের গুচ্ছ কিনে আনতে কোনো প্রকার ভুল করতেও মানিক রাজি নয়।
নীলা অতি যতেœ তিন-চারটা বিয়ের কার্ড বের করে মানিকের দিকে এগিয়ে দিলো। ডিজাইন বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মানিকের পছন্দটা জানতে চাইতেই, মানিক সাথে সাথে জানিয়ে দিলো। সম্ভবত মানিকের পছন্দের ডিজাইনওয়ালা কার্ড-ই সে তার বিয়েতে বিলি করতে চায়। কিন্তু কার্ডের ডিজাইন পছন্দ করার বিষয়টা মানিকের কাছ থেকে নেয়া হলেও ডিজাইনের একটা কার্ডও মানিকের জন্য না। কার্ড মানিকের পছন্দের ছাপানো হলেও মানিককে দাওয়াত দিয়ে নিজের কষ্ট আর এক ফোঁটাও বাড়াতে চায় না নীলা।
সন্ধ্যা হতে আর অল্প বাকি। নীলারও চলে যেতে হবে। শেষ বসন্ত আর শেষ গোলাপ হাতে নিয়ে।
দু কদম এগিয়ে পিছে তাকালো নীলা। মানিক এখনও আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, নীলার সম্ভব্য প্রস্থানপথ।
না-নীলা এতদ্রুত গেলো না। আবার ফিরে এলো সে। চোখে যেনো হাজার অনুরোধের ঝড়। তবুও গলা কঠোর করে বললো, ‘আমার পর আর কারো সাথে এভাবে সম্পর্কে যাবে না তো!’
না যাবো না।
সত্যি তো!
হুম সত্যি।
এতক্ষণে চোখে অশ্রুর নিরব বিক্ষোভ বাড়তে লাগলো।
এবার শুরু হলো অনুরোধের ঝড়। প্লিজ আর কোনো সম্পর্কে জড়িয়ো না৷
আচ্ছা ঠিক আছে, জড়াবো না। তুমি কেঁদো না প্লিজ।
আচ্ছা কাঁদবো না,
কিন্তু দেখো!
তুমি বিবাহিত হওয়ার পরও আজ চারবছর আমরা একসাথে একটা সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলাম। তোমার স্ত্রী যদি এটা জানতে পারতো তাহলে অনেক কষ্ট পেত।
মানিক মাথা নিচু করে কথাটা গিললো।
কি বলছি শুনছো!
-হ্যাঁ, শুনছি; বল
আমার বিয়েতে এসো না,
আচ্ছা।
আচ্ছা! কেবল আচ্ছা?
জানতে চাইবে না কেনো আসতে নিষেধ করলাম!
কেনো করেছ?
তোমাকে বিয়ে বাড়িতে দেখলে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না৷
তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি।
শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরে কয়েক মুহূর্ত কাটিয়ে ছেড়ে দিলো নীলা।
এই রিকশা!
রিকশা থামিয়ে উঠে পড়লো, নীলা। ইতোমধ্যে শহরের লাল-নীল বাতির সমারোহ শুরু হয়ে গেছে।
পার্কের কানায় কানায় স্তব্ধতার পর্দা পড়ে গেছে। আর দুটো মনের বিপর্যয়ে সম্পর্কের মৃত্যুতে শেষ হলো চার বছরের প্রেম। নিজরে অজান্তেই মানিকের চোখে জল চলে এলো। না এভাবে কাঁদলে হবে না। বাসায় পেঁয়াজ শেষ। পেঁয়াজ নিয়ে যেতে হবে।