শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২১, ০০:০০

স্মৃতির পাতায় তুমি
অনলাইন ডেস্ক

মিলি। আমার স্ত্রী। আজ মিলির তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। লোকসমাজে আমি একজন আদর্শ স্বামীর দৃষ্টান্ত। যে কি না তার স্ত্রী মারা যাওয়ার তিন বছর পরেও দ্বিতীয় বিয়ে করিনি। প্রতি বছর মাদ্রাসায়, এতিমখানায় অনেক খরচ করি স্ত্রীর নামে। আদর্শ না হয়ে পারি বলুন? আমি একজন বাবাও বটে। আমার পাঁচ বছর বয়সী একটি ছেলেসন্তান রয়েছে।

মিলিকে ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম। আসলে আমার দেখা মিলি ছিলো জগতের সেরা মেয়ে। যাকে চোখ বন্ধ করে ভালোবাসা যায়। বিশ্বাস করা যায়। খুব সহজ-সরল স্বাভাবিক মায়াবী একটা মেয়ে মিলি। বিয়ের আগে জমিয়ে প্রেম করেছি আমরা। প্রেম করেছি বলা যায় না, প্রতিদিন নতুন করে আমি মিলির প্রেমে পড়তাম। এতো হাসিখুশি প্রাণবন্ত একজন মানুষ। তার ভুবন ভোলানো হাসি, মায়াবী চোখ আমাকে পাক্কা প্রেমিক বানিয়ে ফেলেছিলো!

আমার মিলি যখন রাগে-অভিমানে কাঁদতো আমারও চোখে পানি চলে আসতো। আমি পাগলের মতো হয়ে যেতাম তার রাগ ভাঙাতে। প্রচণ্ড রাগী ছিলো মিলি। তবু আমি কীভাবে যেনো ওকে আমার ঘরে পোষ মানিয়ে ছিলাম। মিলি রাগী হলেও বাধ্য ছিলো, আমার সব কথা শুনতো। আমি বুঝে গিয়েছিলাম আমাকে পাগলের মতো ভালো মিলি ছাড়া আর কেউ বাসতে পারবে না। আমি স্বার্থপর হই আর যাই হই মিলিকে আমার চাই-ই চাই।

আমি আমার মিলিকে আমার করে পেয়েছিলাম কোনো এক বসন্তের দিনে। প্রেমিকা মিলি থেকে আমার স্ত্রী মিলি যেনো আরও সুন্দর। আরও মায়াবতী হয়ে গেলো। প্রথম যেদিন স্ত্রী মিলিকে কাছে পেলাম সেদিন আমি মিলিকে ডায়েরি গিফ্ট করে বলেছিলাম মিলি এই ডায়েরিটা তোমার জন্যে। মিলি লাজুক মুখ করে আমার দিকে তাকালো। কিছু বললো না। আমি একটু হতাশ হয়ে বললাম, জিজ্ঞেস করলে না এতো কিছু থাকতে ডায়েরি কেনো? মিলি লজ্জা আর হাসি মিশিয়ে বললো, তুমি তো পাগল, পাগলে কি না গিফ্ট দেয়, বলে হিহি করে হাসতে লাগলো!

আমি কিছুটা সিরিয়াস মুড নিয়ে বললাম, মিলি শোনো সংসারজীবনটা অনেক কঠিন, এখানে মনোমালিন্যগুলোকে বেশি প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। দিলেই সংসারে অশান্তি হবে। আর যেহেতু তুমি অনেক রাগী সবকিছু চেপে বসে থাকো তা-ই একটা সহজ সমাধান আমি বের করেছি! সেটা হলো এই ডায়েরি! মিলি এবার একটু আগ্রহ নিয়ে বললো, তা-ই নাকি? বলো দেখি তোমার কেমন সমাধান।

আমি এবার বিজ্ঞের মতো বললাম, আমি একজন আদর্শ স্বামী হতে চাই, আর এজন্যে অবশ্যই তোমার সাহায্য প্রয়োজন। মিলি এবার খিকখিক করে হাসতে শুরু করলো, হাসি যেনো থামেই না!

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, উফ্ আমার কথা শুনবে তো আগে নাকি? শোনো এই ডায়েরিতে তুমি প্রতিদিন আমার সম্পর্কে কিছু না কিছু লিখবে? আমার দোষ-গুণ যা ইচ্ছে। আমি প্রতিদিন রাতে সেটা পড়বো এবং নিজেকে সংশোধন করবো। মনে থাকবে?

মিলির আনন্দে ঝলমল করতে করতে বললো, ফ্যান্টাসটিক আইডিয়া, তুমি তো অনেক জোস হাজবেন্ড! তুমি আদর্শ স্বামীর প্রথম ধাপ পার করে ফেলেছো। প্রথমদিনেই বউকে ইমপ্রেস করে ফেলছো।

আমি কিন্তু আদর্শ স্বামীর দায়িত্ব পালন করা শুরু করে দিয়েছিলাম, দুই-তিন দিন পর পর ডায়েরি পড়তাম। গালভরা একগাদা প্রশংসা লিখে রাখতো মিলি। কিন্তু জীবনের রঙগুলো মনে হয় সব জায়গায় এক রকমভাবে ছড়ানো থাকে না। সাদা-কালো অংশও থাকে। আমার জীবনটাও একসময় সাদামাটা হতে লাগলো।

কাজের অনেক ব্যস্ততা। বড় সন্তান হিসেবে পরিবারের দায়িত্ব সবকিছু মিলিয়ে আমি যেনো রোবট হয়ে গেলাম। মিলির প্রতি কেয়ার কমে শূন্যের কোঠায় নেমে আসলো। সত্যি বলতে কি আমার কোনো কিছুই আর ভালো লাগতো না। মিলির রাগ-অভিমান উটকো ঝামেলা মনে হতে লাগলো। বাসায় আসলেই মিলির গোমরা মুখ আমার দেখতে ভালো লাগতো না। আমি চাইতাম মিলি হাসিমুখে কথা বলুক কিন্তু না তেমনটি হয়নি। প্রথমদিকে রাগারাগি করতো। আসতে আসতে রাগ করাও ছেড়ে দিলো মিলি। বিয়ের প্রথমদিকে মিলি খুব ঘুরতে যেতে চাইতো। আমি তখন নিয়ে যেতে পারিনি। আসলে আর্থিক দিক থেকে অতোটা স্বচ্ছল ছিলাম না। মিলিকে নিয়ে অবশ্য পরে একবার কক্সবাজার ঘুরে এসেছিলাম।

আমি মিলিকে প্রায়ই বিমর্ষ হয়ে জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম। কিন্তু কেনো যেনো জানতে চাইতাম না মন খারাপের কারণ। মিলি চাপা স্বভাবের। কারণ বের করাও কঠিন কাজ ছিলো। তাই আর আগবাড়িয়ে ঝামেলায় পড়তে চাইতাম না। তবে এতো না বলার মধ্যে মিলির কয়েকটা আবদার খুব মনে পড়ে। আমাদের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকীতে মিলি বলেছিলো, সাকিব আসার সময় আমার জন্যে বেলি ফুলের গাজরা আনতে পারবে? আজকে আমি তোমার পছন্দের নীল শাড়িটা পরবো। আমি সেদিন রাতে খালি হাতে গিয়েছিলাম। আমি আসলে ভুলে গিয়েছিলাম। লজ্জায় আর মিলির সাথে কথা বলিনি, মিলি খুব সুন্দর করে সাজগোজ করে আমার জন্যে অপেক্ষা করেছিলো। সেদিন হয়তো ওকে ভালোবেসে বুকে টেনে নিতে পারতাম। কিন্তু আমি সাহস পাইনি। আর বেচারি রাগে-অভিমানে-ক্ষোভে ওপাশ ফিরে সারারাত কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছে। সবকিছু বুঝেও আমি নিশ্চুপ ছিলাম। কেনো ছিলাম জানি না।

সেদিনের পর মিলি আমার কাছে কিচ্ছু চায়নি। একদম কিচ্ছু না। একদিন মিলি আমার হাত ধরে বলেছিলো সাকিব একটা কথা রাখবে? আমি গম্ভীর মুখে বলেছিলাম হুম, বলো।

মিলি কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, আমার খুব অস্থির লাগতেছে এই কয়টা দিন তুমি প্লিজ আমার কাছে থাকো। অফিস থেকে ছুটি নিলে হয় না? আমার কেনো যেনো ন্যাকামি লাগলো। এসব আহ্লাদি কথাবার্তা বিয়ের আগেই ভালো লাগতো এখন লাগে না। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বললাম, মিলি তুমি তো শিক্ষিত মেয়ে, কাজের জায়গায় কোনো কম্প্রোমাইজ চলে না এটা কি তুমি বুঝো না।

মিলির ছলছল চোখে আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো, প্লিজ সাকিব, প্লিজ! আমার তোমাকে খুব পাশে পেতে ইচ্ছে হয়। প্লিজ জাস্ট কয়েকটা দিন! আমি অনিচ্ছা সত্বেও বললাম, ঠিক আছে আমি চেষ্টা করবো। সত্যি বলতে আমি কোনো চেষ্টাই করিনি। আমার কেনো যেনো বাসায় আসতে ভালো লাগতো না। এমন না আমি মিলিকে ভালোবাসতাম না অথবা পরনারী আশক্তি! তবু কেনো যেনো সংসারটা আমার ভালো লাগতো না। হঠাৎ একদিন আমার ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিয়ে আমার মিলি চলে গেলো না-ফেরার দেশে।

আসতে আসতে মিলির শূন্যতা টের পাওয়া শুরু করলাম। আমার আর মিলির ঘরে ঢুকলাম। খাটে মিলির ওড়না পড়ে ছিলো। বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠলো। আমার এমন লাগলো কেনো, আমি তো সংসার থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু বিছানায় মিলির বালিশ-কোলবালিশ পড়ে আছে আমার মিলি তো নাই!

আমার বুকের ভেতর হুহু করে উঠলো। আমি সেদিন প্রথম কাঁদলাম। হাউমাউ করে কাঁদলাম। মিলির কাপড়-চোপড় জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম। আমি কি হারিয়েছি। আমার সব দুঃখ-কষ্ট তো মিলির সাথে শেয়ার করতাম এখন এই কষ্ট আমি কাকে বলবো? একা ঘরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসলো। আমি তো সংসার থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম। মিলির কাছ থেকে তো চাইনি, তবে কেনো মিলি চলে গেলো।

আমি পাগলের মতো মিলির ড্রয়ারের কাপড়গুলো একটা একটা করে বের করতে লাগলাম, সব কাপড়ে মিলির শরীরের গন্ধ মিশে আছে! তারপর ই হঠাৎ চোখে পড়লো সেই ডায়েরিটা যেটা বিগত কয়েক বছর পড়া হয়নি। আমি পড়তে লাগলাম, আর শিহরিত হলাম। আমি কতটা নিষ্ঠুর, আমি কতটা পাষাণ!

মিলি আমাকে বিশ্বাস করেছিলো। ভেবেছিলো আমি তার অভিযোগগুলো পড়বো। শোধরাবো কিন্তু আমি দিনের পর দিন তাকে অবহেলা করেছি, আমার প্রতিটা অবহেলার গল্পশেষে মিলি গোটা গোটা করে লিখেছে। যতো যাই হোক আমার সাকিব পৃথিবীর সেরা স্বামী। এটা লেখার কোনো যুক্তি খুঁজে পেলাম না। হয়তো সে নিজেকে শান্ত্বনা দিতো। আর মনে-প্রাণে চাইতো আমি সত্যিই আদর্শ স্বামী হই।

মিলির কিছু লেখা আমার মনে দাগ কেটে গেছে। যার জন্যে আমি নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবো না।

এক. সাকিব তুমি তো জানতে আমার খুব জ্বর, আমার অসুখ করলে একা থাকতে ভালো লাগে না। খেতে ভালো লাগে না। কি হতো যদি বাসায় ফিরে আমার কপালে হাত রেখে জ্বর মাপতে। একটু আদর করতে। তুমি এতো মনভোলা কেনো সাকিব? আমাকেও ভুলে যাবা? অবশ্য চেষ্টা করে লাভ নাই আমি তোমাকে কোনোদিন ভুলতে দিবো না, আমার আদর্শ স্বামী!

দুই. সাকিব তুমি বকলে আমার খুব কষ্ট হয়। আমার কষ্টগুলো আর আগের মতো কেনো বোঝ না? আমাকে আর ভালো লাগে না? আমার সাথে আর খারাপ ব্যবহার করো না প্লিজ!

তিন. নিজেকে খুব একা লাগে ইদানীং। আমি সম্ভবত স্ত্রী হিসেবে আদর্শ নই। আমারও উচিত ছিলো সাকিবকে ডায়েরি দেয়া, আদর্শ স্ত্রীর গুণগুলো জানা যেতো তাহলে। যদিও জানি সাকিব আর ডায়েরি পড়ে না। আমার জন্যে ওর এতো সময় কই!

চার. আমার কাটা হাতটা সাকিব নিজ হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলো ঠিকই, কিন্তু একটা বার জিজ্ঞেস করলো না, মিলি ডান হাত কেটেছে, ভাত খাবে কীভাবে? আমি হেল্প করবো? সাকিব তুমি কি জানো না আমার তোমার হাতে খেতে ভালো লাগে। আজ না খেয়ে থাকবো, কি হবে খাবো না ভাত।

পাচ. খুব বাজে স্বপ্ন দেখি আজকাল। সাকিবের সাথে আরেকজনের বিয়ে। আল্লাহ তুমি আমার সাকিবকে আমার সাথে জান্নাত দিও। আর কিছু চাই না। আমার সেরা স্বামী যেনো শুধু আমারই থাকে...

এটাই ছিলো মিলির শেষ লেখা, আমার সাথে জান্নাত! আমি কি করে পারবো আরেকজনের সাথে সংসার বাঁধতে! আমি তো মিলিকে অবহেলায় ছুড়ে ফেলে রেখে হত্যা করেছি! আমি যদি আমার স্ত্রীর খেয়াল রাখতাম তবে সে এতো ডিপ্রেশনে ভুগতো না।

আমার দেয়া প্রতিটি উপহার যত্নে আগলে রেখেছিলো মিলি। মরা গোলাপ, বেলিতে ভরপুর ব্যাগ! কবে না কবে দিয়েছি সব রেখে দিয়েছে। অথচ আমি তাকেই ফেলে দিয়েছি। প্রচণ্ড রাগ-অভিমান বুকভরা কষ্ট নিয়ে আমার মিলি চলে গেছে আমাকে ছেড়ে। দিয়ে গেছে উপহার হিসেবে আমার ছেলেকে!

আমার ছেলেটা দেখতে অবিকল মিলির মতো হয়েছে। মিলির মতো রাগও হয়েছে। মিলির শরীরের গন্ধ আমার ছেলের শরীরেও। যে কি না সকাল-বিকেল-রাতে মিলির স্মৃতি বহন করে।

আচ্ছা মানুষের কি আরেকটা জনম হয়? আরেকবার পৃথিবীতে আসা যাবে! যদি পারতাম তবে আমি সত্যি সত্যি আমার স্ত্রীর সেরা স্বামী হয়ে থাকতাম। ইশ যদি পারতাম একবার নিজেকে শোধরাতাম।

মিলি জানো, আমার এখন খুব ইচ্ছে হয় এই পৃথিবীর সব ছেড়ে তোমার কাছে চলে যেতে। কিন্তু তোমার উপহারটার জন্যে পারি না। তোমাকে ছাড়া থাকাটা আমার জন্যে অনেক কষ্টদায়ক। আবার তোমার দেয়া সর্বশ্রেষ্ঠ উপহারটার দিকে তাকালে সকল কষ্ট সহ্য করে থাকতে হয়। আমি হয়তো আদর্শ স্বামী হতে পারিনি কিন্তু যদি বেঁচে থাকি আদর্শ বাবা হবো, দেখে নিও। ভালো থেকো আমার মায়াবতী আর আমাকে ক্ষমা করো।

* পাঠক ফোরাম বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা

[email protected]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়