প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
জোড়া প্রেম
ফেসবুকে নয়নের রোম্যান্টিক কবিতার প্রেমে পড়ে যায় তন্নী। নয়ন টানা কুড়ি বছর ধরে মালয়েশিয়াতে থাকে। তার বয়স আটত্রিশ। শরীরচর্চা নিয়মিত করার কারণে সাতাশের বেশি মনে হয় না। নিত্যদিন শেফ আর ছবি এডিট করে ছবি ফেসবুকে পোস্ট দেয়। ছবির সাথে কবিতার লাইন ক্যাপশন দেয়। এগুলো পড়ে আর সুন্দর সুন্দর ছবি দেখে ফিদা হয় তন্নী। কখনো কখনো কবিতার কিছু লাইন বুঝতে পারে না তন্নী। তাই মেসেঞ্জারে কল দেয়। নয়নও খুব সুন্দর করে ব্যাখা করে। ফলে আরো দুর্বল হতে থাকে তন্নী।
অন্যদিকে তন্নী শ্যামলা। সুন্দরী বান্ধবির ছবি দিয়ে ফেসবুক চালায়। নিজের ছবি কখনো পোস্ট করেনি। তন্নীর কণ্ঠ মিষ্টি বলে নয়নও অবসর পেলেই কলে কথা বলে। সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে।
মিষ্টি কথায় দুঃখ উড়ায়। তবে তন্নী সত্যই ভালোবাসে নয়নকে। সে সবে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। সে মনে মনে ভেবে রেখেছে একদিন নয়নকে সব সত্য বলবে। যদি নয়ন সত্যিই ভালোবাসে তবে তাকে গ্রহণ করবেই। ছবি না দিলেও তন্নীর বাসার আসল ঠিকানাই দেয়। সে ভেবে রাখে যদি নয়ন অভিযোগ আনে তুমি প্রতারক তবে সে বলবে। তাহলে সে বলবে, আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবেসেছি। কিন্তু চেহারা কালো বলে ছবি দিতে চাইনি। যদি তোমার পছন্দ না হয়। সম্পর্ক না করো তাই। আর তোমাকে পেতে চাই বলেই, আসল ঠিকানা দিয়েছি। কন্ট্রাক্ট নম্বর দিয়েছি।
সেদিন নয়ন বাসা আসতেই ওর মা কল দেয়। বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার পর বলে, বাবা বয়স তো অনেক হলো এবার বিয়েটা করে ফেলো। তুই অচিরেই দেশে আয়। এক মাসের মধ্যে করে ফেল সব কিছু।
সংসার আর ভাই-বোনের কথা চিন্তা করতে করতে বিয়ের বয়স যে শেষ হয়ে যাচ্ছে সেই খেয়াল আছে?
এখন আমাদের সব হয়েছে। আমার শেষকথা বিয়ে আগামী মাসের মধ্যেই তোকে করতে হবে।
নয়ন ফোন কেটে দেয়। এতোকাল পরে তার বিয়ের কথা শুনে লজ্জা লাগছে!
নয়ন সিদ্ধান্ত নেয় তন্নীকে তার আসল পরিচয় দিবে। ওরজিনাল ছবি দিবে। ভালোবাসার কথা বলবে। যদি তন্নী সত্যিই ভালো হয় তবে এগুলো কোন বিষয় না। কেননা প্রিয় মানুষকের ভুল ক্ষমা করাই প্রকৃত ভালোবাসা। ভালোবাসার ক্ষেত্রে বয়স কোনো ব্যাপার না।
নয়ন তন্নীকে কল দেয়। অস্থির হয়ে কল দিতে থাকে। কিন্তু অনলাইন, নম্বর কোনটাতেই পাওয়া যায় না তন্নীকে।
হঠাৎ নয়নের মনে হয় এভাবেই একদিন দিয়াকে অনবরত কল দিয়েছিলো কিন্তু কোন লাভ হয়নি।
মনের অজান্তেই নয়ন চলে যায় বিশ বছর আগে। সেই দিয়া। নবম শ্রেণিতে থাকাকালে যার সাথে প্রেম হয়েছিল।
সেই প্রথম প্রেম, প্রথম অনুভূতি! কি রুপ তার। দুনিয়ার রূপসী হুর।
সে যেমন লম্বা। তার চুলগুলো অনেক লম্বা ছিলো। ডাগর ডাগর চোখ, তার ভ্রু ছিলো চাঁদের বাঁকের মতো। যার ঠোঁট দুটো দেখলে স্বর্গীয় সরাবের স্বাদকেও ভুলে থাকা যায়। মনে পড়ে জীবিকার জন্য যেদিন প্রবাসে চলে আসবে। তার আগের দিন গভীর রাতে লুকিয়ে দিয়াদের বাড়িতে দেখা করছিল। বিদায়বেলা সেই কি আবেগ। সেই কি কান্না। দিয়ার কপালে ঠোঁট দিয়ে ভালোবাসার তিলক এঁকেছিল। আর একটা শেষ চিরকুট।
তার আগে দুজন দুজনকে কথা দিয়েছিল কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে না। দিয়া বলেছিলো ওর জন্য অপেক্ষা করবে। কিন্তু সেই কথা রাখেনি! দুই বছর না যেতেই অন্যের ঘরে চলে গেছে। বিয়ের আগের দিন নয়ন যোগাযোগ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু লাভ হয় না। বান্ধবিদের মাধ্যমে যোগাযোগ করে নয়ন। কিন্তু দিয়া সরাসরি জানিয়ে দেয় ওর অভাবের সংসারে আসতে পারবে না। সে অনেক টাকাওয়ালা আর স্মার্ট ছেলে পেয়েছে। তাকেই বিয়ে করবে। ডিস্টার্ব যাতে না করে। নয়নের প্রতি তার কোনো অনুভূতি নেই!
নয়ন বুঝতে পারে, তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে! সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে ঢুকে একটা আবেগি পোস্ট দেয়। পোস্টটা তন্নীর বান্ধবির নজরে যায়। মেসেজ দিয়ে জানতে চায় কি হয়েছে ভাইয়া। নয়ন সত্য বলে না। কৌশলে দিয়াকে ইঙ্গিত করে। জানতে চায় দুদিন ধরে দিয়া সাথে কথা নাই। তুমি কি কিছু জানো, ওর কি হয়েছে? ওর বান্ধবি তরুলতা জানায়, ওর ফোন নষ্ট। তাই দুদিন যোগাযোগ করতে পারেনি।
নয়ন ওর বান্ধবির কাছ থেকে শিওর লোকেশন নিয়ে ফোন রেখে দেয়।
গত বিশ বছরে অনেক টাকা কামিয়েছে নয়ন। সবাই জানে বাবাহীন ভাই-বোনকে মানুষ করতেই টানা বিদেশ করছে নয়ন। কিন্তু দিয়া নেই বলেই এত বছর দূরে থেকেছে। নয়নের নতুন অনুভূতি জাগ্রত হয়েছে। তাই একেবারে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। অতঃপর প্লেনে উঠে পরেরদিন দেশে আসে।
প্লেনে উঠে ভাবে সরাসরি আগে দিয়াদের বাসাই উঠবে। সারপ্রাইজ দিবে। বন্ধু শিশিরকে আগ থেকেই এয়ারপোর্টে থাকতে বলে। ওর আসার ব্যাপারে আর কেউ জানে না। কত কথা চিন্তা করে। নয়ন ভাবে নয়নের বয়স নিয়ে কোন কথা তুলবে না তন্নীর পরিবার। কারণ তার এখন অনেক টাকা হয়েছে। কেননা বর্তমানে টাকাওয়ালা মানুষের সাত খুন মাপ হয়ে যায়।। নয়ন পারে না আলোর গতিতে আসতে।
অতঃপর বন্ধু শিশিরকে নিয়ে দিয়াদের বাসার দরজায় নক করে। একটা আঠারো বছরের তরুণী দরজা খুলে দেয়।
শিশির বলে, এটা কি তন্নীদের বাসা?
তন্নী ‘হ্যাঁ’ বলবে এমন সময় চোখ যায় নয়নের দিকে। সন্দেহ করে বলে, তুমি বোধহয় নয়ন। এম আই রাইট?
নয়ন তন্নীকে চিনতে পারিনি। পারার কথাও নয়। নয়ন অবাক হয়। শিশিরের দিকে তাকায়। শিশির হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়িয়ে ইশারা দেয়।
নয়ন বলে, জ্বি। আমি নয়ন।
তন্নী মৃদু হেসে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায়। ওদের দুজনেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
তোমরা বসো। আমি তোমাদের সব বলছি। প্লিজ, কথাগুলো বোঝার চেষ্টা কইরো।
হঠাৎ তন্নীর মা গেস্ট রুমে চলে আসে। তন্নী উনাকে লক্ষ্য করে বলে, আমার আম্মু।
নয়ন উনাকে দেখেই চমকে যায়। সোফা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। শিশিরও অবাক হয়। এক হাত দিয়ে নয়নের ঘাড়ে হাত রাখে।
নয়ন লক্ষ করে সেই রূপ আর নেই। চোখের নিচে কালি জমে গেছে। গালগুলো ভেঙে গেছে। বোঝা যায় ভদ্র নারীটি একা একা বহু পথ পাড়ি দিয়ে চলছেন। অতঃপর নয়ন নির্বাক হয়ে শিশিরকে টেনে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসলো।