রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০

বাঙালি সংস্কৃতিতে নবান্ন
অনলাইন ডেস্ক

সংস্কৃতি বলতে একটি জাতির আবহমান ধারাকেই বুঝায়। সংস্কৃতির কোনো একক সত্তা নেই। সংস্কৃতি মানেই সামষ্টিক প্রবহমানতা। সংস্কৃতি মানেই গতি। সংস্কৃতিতে শেকড়ের গন্ধ যেমন আছে তেমনি আছে আধুনিকতার উচ্ছলতা। সংস্কৃতি অবশ্যই প্রগতিময়। সময়ের সাথে, যুগের ধারায় সংস্কৃতি সংস্কারকে স্বীকার করে নেয়। সংস্কৃতি মৌলিকতা যেমন রক্ষা করে তেমনি নতুনত্বকেও প্রশ্রয় দেয়। তবে মৌলিকতা বিধ্বংসী কোনো নবীনতাকে সংস্কৃতি মেনে নিতে নারাজ। সংস্কৃতিতে অনুশীলনের বা চর্চার যেমন নিরন্তরতা আছে তেমনি সৃজনের আনন্দও সমধিক বিদ্যমান। কমল-হীরের পাথরের বিদ্যে হতে ঠিকরে পড়া আলোকে রবীন্দ্রনাথ উপমাচ্ছলে সংস্কৃতি বলে বোঝাবার চেষ্টা করলেও সংস্কৃতি যে সর্বদা শিক্ষা হতে উৎসারিত হয় তা নয়। অশিক্ষিত সমাজেও সংস্কৃতির চমৎকার ধারা বিদ্যমান।

বাঙালি সংস্কৃতির উদ্ভব বেশ পুরোনো। কারও কারও মতে চার হাজার বছরের পুরোনো। চর্যাপদের আবিষ্কারে একহাজার বছরের পুরানো সংস্কৃতিকে জানা সম্ভব হলেও বুদ্ধের ভিক্ষুসংঘে আজ হতে দু হাজার পাঁচশ চৌষট্টি বছর আগেও বঙ্গীশ নামে একজন ভিক্ষু ছিলেন, যিনি কথায় কথায় পদ্য রচনা করতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। অর্থাৎ বাঙালি সংস্কৃতির উদ্ভব বা উন্মেষের কাল চার হাজার বছরের কম নয়। বাঙালি সংস্কৃতির অনুষঙ্গ অজস্র এবং বৈচিত্র্যময়। চর্যাপদের কবি ভুসুকু পা যখন বলেন, ‘ভুসুকু আজি বঙ্গালি ভইলি’, তখন সত্যিকার অর্থেই বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশের বাজনা শুনতে পাওয়া যায়। চর্যায় যখন ধ্বনিত হয়, ‘তুলা ধুনি ধুনি আঁসু রে আঁসু, আঁসু ধুনি ধুনি নিরবর সসু’, তখন দর্শন নয়, ফুটে ওঠে সমাজ চিত্র, ফুটে ওঠে ধুনুরির জীবন। এভাবেই সংস্কৃতি হয়ে ওঠে সমাজের আপনজন।

নবান্নের উদ্ভব ও চর্চা

নবান্ন প্রকৃত অর্থেই কৃষিভিত্তিক বাঙালি সমাজের সোঁদা মাটির গন্ধমাখা উৎসব। এটি একটি লোকজ উৎসব। কিষাণ-কিষাণীর গায়ের ঘাম, বাংলার উর্বর মাটির মায়ের মমতার ঘ্রাণ আর পাকা ধানের সুগন্ধে মৌ মৌ করা উৎসব হচ্ছে নবান্ন। কার্তিকের শেষে অগ্রহায়ণ যখন এসে প্রকৃতির পাতা ঝরায় তখন আমন ধানের কনকরূপের শোভায় মাঠ হয়ে ওঠে শিল্পীর অনির্বচনীয় ক্যানভাস। সেই ধান সংগ্রহ করে যখন গোলা ভরে ওঠে তখনই কৃষকের মনে দুঃখ-বেদনা দূর হয়ে সুখের সুর বেজে ওঠে। উৎসবের মাদলবাদ্য বেজে ওঠে কিষাণীর মনের আঙিনায়। সেই ধানকে ভাঙিয়ে যখন চাল উৎপন্ন হয় তখন সমৃদ্ধি উছলে পড়ে পল্লির কোণে কোণে।

‘নবান্ন উৎসব’ হলো শস্যোৎসব, যা এক এক এলাকায় এক একটি ফসলকে কেন্দ্র করে হতে পারে। বাংলাদেশে আমন ধানকে কেন্দ্র করে পহেলা অগ্রহায়ণ নবান্ন উৎসব হলেও উত্তর-পশ্চিম ভারতের ওয়াজিরাবাদে বৈশাখ মাসে নবান্ন উৎসব হয়। সদ্য সংগৃহীত গমই তাদের নবান্ন-শস্য। কোথাও কোথাও মাঘ মাসে নবান্ন উদ্যাপিত হয়। নবান্ন উৎসবের সূচনা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও তা যে হাজার বছরের পুরানো এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। লোক গবেষক ড. আশরাফ সিদ্দিকীর দেয়া তথ্যমতে মঙ্গলকাব্যের আদলে মধ্যযুগে রচিত শিবের কাব্য ‘শিবায়ন’-এ উল্লেখিত আছে, শিব স্বয়ং একশোর বেশি রকমের ধানের চাষ করতেন এবং তা থেকে প্রাপ্ত নতুনধান্যে নিজের অন্ন সংস্থান করেছেন।

নবান্নের লোকাচার

সনাতন সম্প্রদায় নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্য করে পি-দান করে। তারা মনে করে, নতুন ধানে তৈরি অন্ন গ্রহণের আগে পূর্বপুরুষদের কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত। এ আয়োজনকে ‘কাকবলী’ নামে অভিহিত করা হয়। এটা নবান্ন শ্রাদ্ধ নামে লোকাচার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কাকবলীতে কাককে পিতৃপুরুষের প্রতিনিধিরূপে চিন্তা করে আহ্বান করা হয়,

‘কো কো কো, আমাগো বাড়ি শুভ নবান্ন/শুভ নবান্ন খাবা কাকবলী লবা/পাতি কাউয়া লাথি খায়/দাঁড় কাউয়া কলা খায়/কো কো কো, মোরগো বাড়ি শুভ নবান্ন।’

বাঙালি মুসলিম সমাজে মসজিদে শিন্নি দিয়েই নবান্নকে বরণ করার রেওয়াজ ছিলো। সনাতনী সমাজে নবান্নকে কেন্দ্র করে স্নান সেরে শুদ্ধ বস্ত্রে কৃষক মাঠে গিয়ে প্রথমে আড়াই গাছি ধান কেটে এনে পূজো করেন। তারপর বাড়ির মহিলারা নিজেদের পবিত্র করে জমি হতে আনা ধান সংগ্রহ করে গোলায় তোলেন। অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষে পঞ্জিকা দেখে নবান্ন উৎসব পালিত হয়। নবান্ন উৎসবের পরের দিনকে ‘বাসি নবান্ন’ হিসেবে পালনের সংস্কৃতি চালু আছে। আগের দিনের উদ্বৃত্ত খাবার দিয়ে বাসি নবান্ন উদ্যাপিত হয়। নবান্নের একটা পর্ব হলো ‘বীর বাঁশ’, যেখানে একটি বাঁশকে গর্ত করে পুঁতে তাতে দুধ ও কৈ মাছ রেখে লোকাচার পালন করা হয়। আসলে এক এক সম্প্রদায়ে নবান্নের লোকাচার এক এক রকম। দিনের বেলার নবান্নে অন্যদের বাড়িতে আহার গ্রহণ করলেও রাতের নবান্নের আহার নিজের বাড়িতে গ্রহণ করেন সবাই।

নবান্নের আহার

নবান্ন উদ্যাপনে প্রায় কুড়ি থেকে চল্লিশ পদের ব্যঞ্জন তৈরি হয়। খেজুরের গুড়ের সাথে দুধ মেশানো পায়েস, চালের গুঁড়োর সাথে তিন-চার পদের ফল মেশানো শিরণি বানানো হয়। খৈ, মুড়ি-মুড়কি, পিঠা-পুলি, ক্ষীর ইত্যাদি খাবার তৈরি করা হয়। আগেকার দিনে ঢেঁকিতে ধান থেকে চাল ভাঙিয়ে তা দিয়েই নবান্ন উৎসব উদ্যাপিত হতো। ¤্রাে উপজাতীয়রা নতুন ধানের অন্নের সাথে মুরগির মাংসের ব্যঞ্জনে আপ্যায়িত হয় নিজেরাই। বাসি নবান্নকালে খাসির মাংসের তরকারি যোগ হয় কোনো কোনো অঞ্চলে। বাসি নবান্ন পান্তা নবান্ন নামেও অভিহিত হয়।

নবান্নের অতীত

অতীতের বাঙালি নারী নবান্নের দিন ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে নিজেরা শুচিসিদ্ধ হয়ে নানা লোকাচার পালন করতেন। তবে অঞ্চলভেদে তা ভিন্নতা দেখায়। কোথাও কোথাও নবান্নের দিনে বাড়ির নারীরা নয় রকম ফল দিয়ে নয়টি কলাপাতায় নৈবেদ্য সাজিয়ে নয় জায়গায় স্থাপন করে। নয় রকম সবজি দিয়ে নয় পদের ব্যঞ্জন তৈরি করা হয় দুপুরে খাবারের জন্যে। খাবারের তালিকায় নয় রকম শাক থাকে। নয় ধরনের মিষ্টি তারা আগে খেতেন। কোথাও কোথাও নয় রকমের মাছের তরকারি হলেও কেউ কেউ সেদিন কোনো আমিষ খেতেন না। আসলে তাদের কাছে নবান্ন হলো নয়ের প্রতীক। তাই সর্বত্রই ছিল নয়ের সমাহার।

শ্রী দীনেন্দ্রনাথ রায়ের ‘নবান্ন’ প্রবন্ধ থেকে তৎকালীন বাঙালি সমাজের নবান্ন আয়োজনের একটি চিত্র পাওয়া যায়। তিনি বর্ণনা করেন : ‘অবশেষে নবান্নের আয়োজন আরম্ভ হইল। আচার্য-কর্তিত কলার পেটকোতে তিনি নবান্নের জন্য গৃহে প্রস্তুত আতপ চাউল এক মুষ্টি রাখিয়া, একটা বড় পাত্রে কতকগুলি ফলমূল, আখ, আলু, কলা, মুলো, নারিকেল চাকা চাকা করিয়া কাটিয়া রাখিলেন, এবং একটা বড় পাথরের খোরায় এক খোয়া কাঁচা দুধ একটা খেত্তুরে বাটীতে এক বাটী নূতন খেজুরে গুড় ও বড় পিতলের রেকাবীতে বাতাসা, কাঁচা গোল্লা, গুড়ে মো-া প্রভৃতি মিষ্টান্ন রাখিয়া দিলেন; ছেলেমেয়েরা অদূরে বসিয়া সদ্যঃস্রতা সিক্তকেশা শুভ্রবসনা পিসীমার কাণ্ড দেখিতে লাগিল। ...ছেলেরা কলাপাতে অল্পপরিমাণ নবান্ন লইয়া চারিদিকে ছুটিয়া চলিল। কেহ ছাতের উপর কাক শালিক প্রভৃতি পাখীর জন্য তাহা রাখিয়া আসিল; কেহ ঢেঁকির ঘরে গিয়া ইঁদুরের গর্তে খানিক ঢালিয়া দিল; মাছদের নবান্ন খাওয়াইতে একটি ছেলে নদীতে চলিল; একটি ছেলে খানিকটে নবান্ন গরু বাছুরের জন্য গোয়ালঘরে লইয়া গেল; কেহ শৃগালের জন্য চাট্টি চাউল খান দুই শাঁক আলু ও এক টুকরা পাকা কলা লইয়া বাঁশবনে কিংবা আশ্যাওড়ার জঙ্গলে ফেলিয়া আসিল। সকল জন্তুর জন্য নবান্ন বিতরিত হইলে, গৃহস্থ পরিবারগণ একত্র সমবেত হইয়া, দুধ গুড় ও নানাবিধ ফলমূল মিশ্রিত চাউল খাইতে আরম্ভ করিল। বাড়ির বউ ঝিরা এক এক বাটি চাউল লইয়া রান্নাঘরের বারান্দায়, উননের ধোঁয়ায়, ভিজে চুলে, পা মেলিয়া বসিয়া, সিক্ত ত-ুলরাশি নতমুখে চর্বণ করিতে লাগিল। রাখাল, কৃষাণ ও পরিবারস্থ অনুগত ব্যক্তিগণ সকলের নবান্ন হইয়া গেল...। ’

নবান্নের হাহাকার

আবহমানকাল ধরে বাঙালি কৃষিজীবী সমাজে বিশেষত নতুন ধানকে কেন্দ্র করে নানা অঞ্চলে নানা আয়োজনে শস্যোৎসব পালিত হয়ে আসছিলো। যে ধানগুলো নিয়ে বাঙালি উৎসবে মেতে উঠতো সেগুলোর নাম বাহারি। যেমন : কুসুমকলি, ঘৃতশাল, চন্দনচূড়া, চন্দ্রপুলি, আকাশমণি, কপিলভোগ, ঠাকুরভোগ, তিলসাগরী, তুলসীমালা, দাদখানি, দুধকমল, নীলকমল, পঙ্খিরাজ, পদ্মরাগ, বাকশালি, বেগম পছন্দ, কাজলা, কামিনী, সূর্যমুখী, হরিকালি, হীরাশাল, কালিজিরা, কাশফুল, চিনিসাগর, জটাশালী, জনকরাজ, জামাইভোগ, ঝিঙেমাল, ভাদ্রমুখী, মতিহার, ময়ূরপঙ্খি, মানিক শোভা, মুক্তাঝুরি, রাঁধুনিপাগল, রানিপাগল, রাজভোগ, সন্ধ্যামণি ইত্যাদি। কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু কালের বিবর্তনে আজ এই হরেক রকম ধানের বেশির ভাগই মার খেয়েছে উচ্চফলনশীল ইরি ধানের কাছে। এর পরিণামে বাঙালির হেঁশেল হতে হারিয়ে গেছে বিভিন্ন নামের ও স্বাদের পিঠা যেমন : চুকা পিঠা, খান্দেশ পিঠা, পাতা পিঠা, ছাঁট পিঠা, জামাইভোগ, কন্যাভোগ, হাফরি পিঠা, পোয়া পিঠা, তেলপোয়া, আন্দেশা, ক্ষীরপুলি, ক্ষীরমোহন, ভক্তি, পাক্কন পিঠা, দানাদার, দুই বিরানি, জালি পিঠা, মুখসওলা, কলা পিঠার মতো নাম না জানা পিঠাপুলি। নতুন ধানের চাল দিয়ে এসব পিঠা তৈরির কলাকৌশল আজ আর কারও রন্ধনবিদ্যায় খুব একটা দেখা যায় না।

নবান্নের সংস্কৃতি

নবান্ন বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি, বাঙালির শেকড়ের উৎসব। নবান্নকে কেন্দ্র করে ধানের গোলায় ও ঘরে আঁকা হয় আল্পনা। সেই আল্পনায় সহজ-সরল গ্রমীণ বধূর মনের পবিত্রতা ফুটে ওঠে। ধান কাটা হতে শুরু করে নবান্ন দিনের উৎসব পর্যন্ত মেতে ওঠে বিভিন্ন গানে। ধান ভানার গান গেয়ে গেয়ে ঢেঁকিতে চাল ভাঙা হয়। আবার নতুন ধানকে সিদ্ধ করতে গিয়েও গানের সুর বেজে ওঠে শ্রমক্লান্ত কণ্ঠে। নবান্নের মেলায় জারি-সারি-বাউল ও মুর্শিদি গানের ফোয়ারা ছোটে। এর পাশাপাশি বিচার গান বা কবি গান বা ধুয়াগানের আসরও বসে রাতজুড়ে।

নবান্নের গ্রামীণ মেলায় হরেক রকমের পশরা যেমন : মিঠে-ম-া-সন্দেশ, মুরালি-গজা, পুতুল, মাটির হাঁড়িকুড়ি, বাঁশি-চুড়ি ইত্যাদি পাওয়া যায়। আরও পাওয়া যায় নান্দনিক শিল্পের ডালা, কুলা, চালুনি ইত্যাদি।

ঊনিশশো আটানব্বই সাল থেকে কর্পোরেট ব্যবস্থাপনায় নবান্নের নগরায়ন হয়ে গেছে। প্রতি বছর রাজধানীতে দুদিনব্যাপী নবান্ন উৎসব হয় ঘটা করে।

আমাদের সংস্কৃতিতে নবান্ন

আমাদের নগর ও গ্রামীণ সংস্কৃতিতে নবান্নের প্রভাব কম নয়। আল্পনা শিল্প হতে শুরু করে নাচগান, রন্ধনশিল্প কিংবা সাজ-সজ্জা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই নবান্ন নিয়ে আসে উৎসবের আমেজ। নবান্ন নিয়ে নতুন গান বাঁধে গায়েনরা। কবিতায়, সাহিত্যে নতুন কবিতার ঘ্রাণে জেগে ওঠে মৌতাত। যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘নবান্ন’, নজরুলের ‘অঘ্রাণের সওগাত’, জসীমউদদীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’, জীবনানন্দের ‘আবার আসিব ফিরে’ ইত্যাদি কবিতায় নবান্ন বাক্সময় হয়ে উঠেছে পংক্তিতে-পংক্তিতে। নবান্ন আমাদের মধ্যে জাগ্রত করে বাঙালিয়ানার সৌভ্রাতৃত্ব। নবান্ন আনে নবীনের জয়গান। নবান্ন উৎসবের আনুষ্ঠানিকতাই আমাদের জানিয়ে দেয়, একসময়ে অগ্রহায়ণই ছিলো বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। অগ্র মানে প্রথম আর হায়ণ মানেই মাস। কিন্তু খাজনা আদায়ের সুবিধার নাম দিয়ে স¤্রাট আকবরের সভাসদ আমির হামযা ও আবুল ফজল বৈশাখকে প্রথম মাস বানিয়ে দেয়ায় নবান্নের গুরুত্ব গেছে কমে। অথচ নবান্ন কেবল নতুন ধানের অন্ন তা নয়, নবান্ন প্রকৃত অর্থেই নতুন বছরের অন্নও ছিল। বাঙালি আজ নবান্নের প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে কেবল বাংলা মাসের সাথে হিজরী মাসের সমন্বয় করাতে গিয়ে।

নবান্ন হলো সমৃদ্ধির উৎসব, সম্ভাবনার উৎসব। নতুন ধান নিয়ে আসে নতুন আশার আলো। সাংবাৎসরিক অন্নসংস্থান নবান্নই করে দেয়। তাই নবান্ন কৃষিজীবী সমাজে নিয়ে আসে প্রকৃত অর্থেই আনন্দের বার্তা। নবান্ন মানেই সুখের হাতছানি, দুখের সমাপ্তি। তাই নবান্ন বাঙালির স্বপ্ন দেখার উৎসবও বটে।

নবান্ন আজকাল

যতোই আধুনিকতা গ্রাস করছে আমাদের, যতোই গ্রাম হচ্ছে শহর, ততোই আমরা হারাতে বসেছি আমাদের শেকড়ের উৎসব আর বাঙালিয়ানা। এর প্রভাব পড়েছে আমাদের উৎসব উদ্যাপনেও। পহেলা বৈশাখ চলে এসেছে পান্তায় আর নবান্ন চলে এসেছে মাটি ছেড়ে বর্ণিল রঙ্গমঞ্চে। কৃষিকে আজকাল আনস্মার্ট পেশা হিসেবে গণ্য করে শেকড়ের নবান্ন হয়ে গেছে গেঁয়ো সংস্কৃতি। মানুষের মাঝে ধর্মীয় বিভেদের কারণে কখনো কখনো হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির বদনাম নিয়ে নবান্নের মতো আম বাঙালির উৎসব হয়ে পড়েছে কোণঠাসা। আকাশসংস্কৃতির বদৌলতে গ্রামেও আজকাল বিদেশি সিরিয়ালের ¯্রােত প্রবাহিত হওয়ায় নবান্ন উৎসব মার খেয়ে গেছে। পরন্তু কৃষক তার ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় ক্ষেত সোনার ধানে ভরে উঠলেও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় কৃষক ভুলে যায় উৎসবের কথা। নবান্ন আজকাল তাই কেবল কলমে আছে, কর্মে নেই বললে অত্যুক্তি হবে না। এর পাশাপাশি একথাও বলতে হয়, আগে ছিলো আমন ধানই বাঙালির প্রধান শস্য। কিন্তু এখন ইরি মৌসুমে প্রাপ্ত ইরিধানই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আমনকেন্দ্রিক উৎসবে এখন ভাটা পড়েছে। নবান্নকে নিয়ে কবি জীবনানন্দের ভাষায় আজ তাই আক্ষেপে দগ্ধ হয়ে বলতে হয়,

‘এইখানে নবান্নের ঘ্রাণ ওরা সেদিনও পেয়েছে;

নতুন চালের রসে রৌদ্রে কতো কাক

এ-পাড়ার বড়ো মেজোও-পাড়ার দুলে বোয়েদের

ডাকশাঁখে উড়ে এসে সুধা খেয়ে যেত;

এখন টুঁ শব্দ নেই সেই সব কাকপাখিদেরও;’

(জীবনানন্দ দাশ, ১৯৪৬-৪৭)

তথ্যসূত্র

১. ‘বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ’, ড. দুলাল চৌধুরী সম্পাদিত, আকাদেমি অফ ফোকলোর, কলকাতা ২০০৪

২. ‘নবান্ন’, চিন্তাহরণ চক্রবর্তী, ভারতকোষ, চতুর্থ খ-, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, ১৯৭০

৩. ‘বাংলার লোক-সংস্কৃতি’, আশুতোষ ভট্টাচার্য, ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া, নতুন দিল্লি, ২০০৫

৪. ‘নবান্ন’ প্রবন্ধ, শ্রী দীনেন্দ্রনাথ রায়।

৫. ‘শিবায়ন’, উইকিপিডিয়া।

৬. দু’ বাংলার নবান্ন উৎসবের গুরুত্ব ও তাৎপর্য : ডঃ সুবীর ম-ল।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়