রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০

শঙ্খঘোষের কবিতা : নির্মাণশিল্পের নতুন পাঠ
অনলাইন ডেস্ক

কবি আদতে পণ্ডিত নন। পাণ্ডিত্য দিয়ে কাব্য নির্মাণও তাই কবির মোক্ষ নয়। বাস্তবিক পাণ্ডিত্য দিয়ে কাব্যের নির্মিতিও হয় না। কবিতার নির্মাণে সাদাসিধে প্রত্যবেক্ষণ আর গভীর বোধই মূল প্রকৌশল। শঙ্খ ঘোষের কবিতার নির্মাণ কৌশল ঢোল-বাদ্য পেটানো আড়ম্বরধারী নয়। কাউকে চমকে দেয়া কিংবা কাউকে চমকিত করার কৌশল এ কবিতায় নেই। কবিতাগুলো অনুচ্চ কণ্ঠের, কবিতাগুলো সুসংহত বক্তব্যের। কবিতাগুলো ছিদ্রান্বেষী নয়, কবিতাগুলো চ্যুতি প্রতিরোধী। শঙ্খঘোষের কবিতার ভাষা বৈঠকী নয়, আটপৌরেও নয়। এ ভাষা তাঁর নিজের মনন-সরোবরে জাত। এ ভাষা পরমাত্মীয়ের মতো আন্তরিক, এ ভাষা মিশুক মানুষের মতোই মায়াবতী, এ ভাষা প্রাণে তৈরি করে স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের আবেশ। কবিতায় জোয়ার নেই, ভাটাও নেই, তবু কবিতার স্রোত বৈচিত্র্যধারী, কবিতার স্রোতে মৃদু কলনাদী। বিবাহের আয়োজনে নেপথ্য সঙ্গীতসুধার মতোই এ কবিতা বিরক্ত করে না নিজেকে জাহির করে, কিন্তু আগ্রহীর শ্রবণকে পরিতুষ্ট করে। তাঁর কবিতার ভাষা আন্দোলনের নয়, তাঁর কবিতার ভাষা কাউকে দোষারোপেরও নয়। তাঁর কবিতার ভাষা দৃঢ় কিন্তু বিনা আঘাতে অভিলক্ষ্য বিজয়ে পারঙ্গম। এ ভাষায় প্রচলিত বা অপ্রচলিত কোনো শব্দের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই, এ ভাষায় পর-আপনের ইতস্ততা নেই। শঙ্খ ঘোষের কবিতার নির্মাণ প্রকৌশল না আকাশচুম্বি অট্টালিকার কাঠামো, না আবার কুঁড়েঘরের দুঃখ-বিলাপ। বাবুইয়ের শিল্প তাতে উপভোগ্য, স্বাধীনতার সুখ সেখানে উদ্বৃত্ত। শঙ্খঘোষ তাই কবিতার বাস্তুবিদ্যার অনন্য নির্মাতা, কবিতার গৃহায়নে আত্মবিশ্বাসী এক মানবীয় বিশ্বকর্মা। কবিতারা অন্ত্যমিল প্রধান নয় কিংবা অন্ত্যমিল প্রবণও নয়, তবু পড়তে গেলে কোথা থেকে অন্ত্যমিলেরা যেন উঁকি মারে মনের ভেতর। তাঁর কবিতায় অনুপ্রাসের ঝনঝনানি নেই, ছন্দ বিদ্যুতের চমকানি নেই, পেলব প্রেমের কোমল অর্ঘ্য নেই, আছে বলতে চাওয়ার স্নিগ্ধতা। তাঁর কবিতারা সত্য বলতে আগ্রহী এবং সত্য বলতেই নিবেদিত। তাঁর কবিতারা গদ্যের কড়া হাতুড়িও হানে না, আবার গদ্যের মতো এতো পর্দাহীন সরাসরি বলতেও পারে না। গদ্যকে কবি শঙ্খঘোষের ভয়, তা বড় বেশি সোজা সাপ্টা। কিন্তু কবিতায় একটা আড়াল থাকে। নিজেকে লুকোনোর আড়াল নয়। অন্যকে ফাঁকি দেয়ার আড়াল নয়। এ আড়াল স্বস্তির, এ আড়াল বলতে পারার স্বাচ্ছন্দ্যের আড়াল। কবি শঙ্খ ঘোষ সাহসী মানুষ, কিন্তু সভ্যতানিষ্ঠ শিষ্টাচার তাঁর প্রতিবাদকে বজ্রনির্ঘোষে পরিণত করেনি। তাঁর প্রতিবাদ কবিতায় স্বনিত হয়েছে কার্যকর শ্রাব্য সীমায়।

কবি শঙ্খঘোষের কবিতা কালের ঘাতসহ কিন্তু নিস্তরঙ্গ নয়। জড়তা নয়, শমিত গতিশক্তিই তার প্রাণ। তাঁর কবিতা রবীন্দ্রনাথের ভাষ্যের মতোই বলে না, বাজে। তবে এই বাদন কোন দুন্দুভি কিংবা কড়া-নাকাড়ার বাদন নয়, এ বাদন হৃদয়ের স্পন্দনের মতো শ্রুতিসুখি, সহনীয় ও শোভন। এ বাদন বহতা নদীর কলধ্বনির মতো। অনুপ্রাসের কাচভাঙার মতো শব্দ নিনাদ সৃষ্টি কিংবা কানে তালা লাগানোর প্রয়াস নেই। এ বাদন দৃঢ় কিন্তু উত্ত্যক্ত করে না। তাঁর কবিতায় প্রতিবাদ ধারাল অসি নিয়ে ছুটে আসেনি, কিংবা প্রস্তর যুগের মানুষের মতো অস্ত্রশস্ত্র বাগিয়ে এগিয়ে আসে নি। এ প্রতিবাদ ব্যক্তিত্বে অটল এবং ধারে তীক্ষ্ণ। তাঁর প্রতিবাদ গালাগাল কিংবা খিস্তি-খেউড় নির্ভর নয়, তাঁর প্রতিবাদ ধমক প্রবণও নয়। এ প্রতিবাদের ভাষা আলাদা কিন্তু ধনুকের টঙ্কারের শক্তি ধারণ করে। তিনি ক্ষুধার্তের হয়ে বলেন না, ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো’, কিংবা ‘সব শালা কবি হতে চায়’ বলে খেদ ঝাড়েন না। তিনি প্রতিবাদে নিজের স্বতন্ত্র ভাষা বিনির্মাণ করেছেন। ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেয়ার দুঃসাহস না দেখালেও রাষ্ট্রশক্তিকে কবিতায় তিনি চোখ রাঙিয়ে নিষিদ্ধের তালিকায় পড়ে যান। নজরুলের পরে বাংলা কবিতায় তিনি হয়ে ওঠেন রাজনৈতিক প্রতিবাদের কবি-সেনাপতি। সুভাষ বা সুকান্তের প্রতিবাদী রাজনৈতিক কবিতাকে গণনায় ধরেই বলা যায়, শঙ্খ ঘোষ কবিতায় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে পৌরোহিত্য করেছেন।

কবি শঙ্খ ঘোষ নদী এলাকার মানুষ। তাঁর লেখায় নদীর মতোই পরিব্রাজন ফুটে ওঠে। মামাবাড়ি চাঁদপুরে তাঁর জন্ম। শৈশবের বেশ কিছুটা কাল কেটেছে চাঁদপুরেই। মেঘনার তীরে পালবাজারের আড়তদারদের ব্যস্ত গলির এক বাড়িতে তাঁর জন্ম। মামারা ওকালতি পেশার সাথে জড়িত। বাড়িটি অযত্ন আর অবহেলায় হারিয়েছে তার প্রকৃত রূপ। চাঁদপুর ইলিশের বাড়ি। ইলিশ অ্যানাড্রোমাস ফিশ্। অর্থাৎ তাঁর জীবন চক্রের জন্ম ও শৈশব-কৈশোর অংশ কাটে মিঠা পানিতে। তারপর যায় সমুদ্রে যৌবনবতী হয়ে। ফিরে আসে আবারো প্রজননকালে। কবি শঙ্খ ঘোষও বুঝি সে রকম। তিনি তাঁর যৌবন কাটিয়েছেন বাঙালির তৎকালীন সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক রাজধানী বলে খ্যাত কোলকাতায়। লব্ধপ্রতিষ্ঠ হয়ে তিনি আবারও এসেছেন বেড়াতে তাঁর জন্মভিটা চাঁদপুর ও পৈত্রিক ভূমি, সন্ধ্যা নদীর তীরবর্তী বানারীপাড়ায়। এসেছেন পদ্মালগ্না পাবনাতেও। বাংলা ডায়াস্পোরা সাহিত্যের এক অনন্য ধ্বজাধারী ব্যক্তিত্ব হলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। তাঁর কবিতায় পরিযায়ী মানুষের কষ্টগুলো নিজস্ব ভাষারীতিতে ফুটিয়ে তুলেছেন। মৌলিক ও সম্পাদিত কাব্যগ্রন্থগুলোর নামকরণ হতেই বুঝতে পারি কেন কবি শঙ্খঘোষের কবিতা-সম্ভার অ্যানাড্রোমাস ইলিশের মতো উপাদেয়। দিনগুলি রাতগুলি, এখন সময় নয়, নিহিত পাতালছায়া, আদিম লতাগুল্মময়, মূর্খ বড় সামাজিক নয়, বাবরের প্রার্থনা, তুমি তেমন গৌরী নও, পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, প্রহরজোড়া ত্রিতাল, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, বন্ধুরা মাতি তরজায়, ধুম লেগেছে হৃদকমলে, লাইনেই ছিলাম বাবা, গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ, শবের উপরে শামিয়ানা, ছন্দের ভিতরে এত অন্ধকার, জলই পাষাণ হয়ে আছে, সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি, মাটিখোঁড়া পুরোনো করোটি, গোটাদেশজোড়া জউঘর, হাসিখুশি মুখে সর্বনাশ, প্রতি প্রশ্নে জেগে ওঠে ভিটে, বহুস্বর স্তব্ধ পড়ে আছে, শুনি নীরব চিৎকার, এও এক ব্যথা উপশম ইত্যাদি শিরোনামের গ্রন্থগুলো তাঁর কাব্যভাষার প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ও অনন্যতার কথা বলে। একেকটি কাব্যগ্রন্থ ভিন্ন স্বরের, ভিন্ন স্বাদের। একই স্বাদের কবিতা দ্বিতীয়বার পাঠের অভিজ্ঞতা কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতায় বিরল। কবিতায় লাবণ্য যেমন আছে তেমনি আছে ঝাঁঝালো আঁচ, আছে মিষ্টি মধুরতা। তাঁর কবিতাগুলো বাঁচাল নয়, কথা বলে কম কিন্তু ভাবায় অধিক।

‘যমুনাবতী’ তাঁর প্রথম দিককার কবিতা। কোচবিহারের খাদ্য আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত এক কিশোরীর করুন জীবনাবসানের প্রেক্ষাপটে কবিতাটি রচিত। কবিতায় না প্রতিবাদ, না ক্ষোভ, না অভিসম্পাত ফুটিয়েছেন তিনি। তারপরও এক অদ্ভুত কাব্যভাষায় তাঁর প্রতিবাদই মুখ্য হয়ে উঠেছে। তিনি যখন স্বয়ং কিশোরীর করুণ কণ্ঠস্বরে আর্তি করেন দেশ-জননীর কাছে, তখন চোখের জল অজান্তেই গড়িয়ে পড়ে মানবিক জনতার গ- বেয়ে।

‘নিভন্ত এই চুল্লীতে মা

একটু আগুন দে

আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি

বাঁচার আনন্দে।’-এই চরণগুলো তখন আর পেলব কবিতা থাকে না, হয়ে যায় বল্লমের সুতীক্ষ্ণ ফলা। নির্লিপ্ত ভাষায় যখন কবি উচ্চারণ করেন সত্যের আখ্যান, তখন তা ধারাল হয়ে খড়গের মতো চেপে বসে রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্ণধারের ওপর। জনতার বুক হতে দীর্ঘশ্বাস যেন অনির্বাণ চুল্লীর শিখা হয়েই জ্বলতে থাকে। ভুখা-নাঙ্গা মানুষের অন্নকষ্টে মৃত্যুবরণের পাশাপাশি যারা বেঁচে থেকেও নিত্য মরণের বিভীষিকা বরণ করে, তাদের জীবনচিত্র খুবই মর্মস্পর্শী করেই কবি শঙ্খ ঘোষ শব্দচিত্রে এঁকে তুলেছেন। ‘বস্তি’ কবিতাটিতে কবিকে আমরা বস্তি জীবনের ক্লেদ ও যন্ত্রণাকে মহাকাব্যিক করে তুলতে দেখি। তিনি বলেন,

‘আমরা যেখানে থাকি তার ঠিক পাশেই মস্ত বস্তি

সকালে দুপুরে রাত্রে সেখানে কেবলই ধস্তাধস্তি

চিলচিৎকারে পাড়া ফেটে যায়, ওড়ে শব্দের ফুলকি

এক্ষুনি কোনো রক্তারক্তি হবে তাতে আর ভুল কী!’

ঘর পেয়েও শান্তিহীন এই সব মানবেতর জীবনের দুঃখস্রোতে আপন মর্মকে ভাসিয়ে তিনি নদীর মতোই বলে চলেন,

‘ঘরের মধ্যে পথ পেয়েছি, পথের মধ্যে ঘর

সবাই এখন আপন আমার, কেউ নয় আর পর।’

বৃটিশদের বর্বরতার চিহ্ন জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-। রবীন্দ্রনাথ এরই বিরোধিতা করে বর্জন করেছিলেন নাইটহুড। শঙ্খ ঘোষ সে সময় না পারলেও আগরওয়াল হত্যাকা-ের তীব্র বিরোধিতা করেছেন সশরীরে ও কবিতায়। তাঁর ‘ছেলেধরা বুড়ো’ কবিতাটি তাই আমাদের জানিয়ে দেয়,

‘যদিও বধির, তবু ধ্বনিরও তো ছিল কিছু দেনা

সবই কি মিটিয়ে দিয়ে গেল তবে রণবীর সেনা ?’

কবিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে কম নিগৃহীত হতে হয়নি কবিতায় তাঁর মূল্যবোধের নান্দনিক প্রকাশের জন্যে। নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতে কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতাগুলো এক একটি ধ্রুপদী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এ কারণেই তাঁকে বার বার কবিতায় আশ্রয় নিতে হয়েছে রূপকের। যদিও তিনি কবিতায় সত্য বলার পক্ষপাতী, তবুও সে সত্যে তিনি আড়াল খোঁজেন বিড়ম্বনা এড়ানোর জন্যে। ‘অপমান’ কবিতায় তিনি যখন বলেন,

‘খুবই দেখেশুনে বৈঠা বাইতে হবে

ওঁত পেতে আছে ঘাটে ঘাটে ঘড়িয়াল ---

কবিতায় যদি গল্প লুকোন থাকে

টপ করে তাকে গিলে নেবে সিরিয়াল!’ -তখন আমাদের বুঝে নিতে কষ্ট হয় না, লুকিয়ে থাকা রূপকে কী নিহিত আছে। মানুষ যেমন কবির কবিতার উপজীব্য, তেমনি তিনি সবুজ পরিবেশকেও টেনে নেন কবিতায় পরম মমতায়। বিপর্যস্ত পরিবেশের গাছের মধ্যে বাঁচার আর্তনাদ শুনতে পেয়ে তিনি জানিয়ে দেন আমাদের,

‘ও-মেয়েরা আর মেয়ে নয় ওরা টুনটুনি বুলবুলি

মেয়ে হয়ে আজ দাঁড়িয়ে রয়েছে সমস্ত গাছগুলি। (সবুজ ছড়া)’

মানুষের মধ্যে মানবিক জীবন বোধের প্রতি আকাক্সক্ষা অপ্রতিম। সেই অপ্রতিম আকাক্সক্ষা হতেই বঞ্চিত মানুষেরা চায় এতটুকু মর্যাদা। কিন্তু সেই মর্যাদাকর জীবনের খোঁজে কষাঘাত সইতে সইতে মৃত্যু এসে হানা দেয় দ্বারে। জীবন ও স্বপ্নের অন্ত তখন শেষ নিঃশ্বাসে আটকে থাকে। কবি শঙ্খ ঘোষ মর্যাদাকাক্সক্ষী এইসব বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠরূপে কবিতায় শ্লেষ জাগিয়ে নিজেই কণ্ঠ চড়িয়ে নেন ক্ষোভে,

‘অন্ত নিয়ে এতটা ভেবো না ।

মৃত্যুপথে যেতে দাও

মানুষের মতো মর্যাদায় ----শুধু

তোমরা সকলে ভাল থেকো।

কিন্তু কাকে বলে ভাল থাকা? জানো?

কতদিন তোমাকে বলেছি স্বর উঁচু করে

কথা বলো আবেগে ভাসিয়ে দাও দেশ। (যাবার সময়ে বলেছিলেন)’

দুই বাংলার আলো-বায়ু-জলে সুপুষ্ট কবি শঙ্খ ঘোষ জানেন মাটির মায়া সে কী জিনিস। মাটির ঘ্রাণে তিনি যে জীবনের সুর শুনতে পান, সে জীবনই তাঁকে শুনিয়ে দেয় পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ। তিনি মাটিলগ্ন মানুষকে মাটিচ্যুত করার হীন ষড়যন্ত্রকে রুখে দাঁড়ান কবিতায়। রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি কবিতায় নিজে বিবৃতি দেন,

‘গোধূলি রঙিন মাচা, ও পাড়ায় উঠেছে আজান’

এ দাওয়ায় বসে ভাবি দুনিয়া আমার মেহমান। এখনও পরীক্ষা চায় আগুন-সমাজ।

এ-মাটি আমারও সেকথা সবার সামনে কীভাবে প্রমাণ করব আজ। (মাটি)’

জীবন কবির কাছে বড়ই আরাধ্য। জীবনের প্রতিটি ক্ষণ তিনি অন্তর দিয়ে উপলব্ধিতে আগ্রহী। শব্দায়মান পৃথিবী কবিকে তাঁর এই আরাধনা থেকে দূরে রাখে। কবি পার্থিব সকল শব্দাবলিতে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। তাঁর বিরক্তি তিনি প্রকাশে অকুণ্ঠ। আমরা কবির সেই বিরক্তি শুনতে পাই কবিতায়,

‘এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো/শব্দহীন হও/শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর/লেখো আয়ু লেখো আয়ু...।(আয়ু)’

জীবনকে প্রতি পলে পলে আপন অস্তিত্বে অনুভব করা কবি যেন সাধনায় সিদ্ধি পেয়ে বাকসিদ্ধ তাপসের মতই বলে ওঠেন, ‘আমার অতীত নেই, ভবিষ্যৎও নেই কোনোখানে (পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ)।’ কবি আসলে সর্বদা বর্তমানেই অধিষ্ঠান করেন। ভবিষ্যত তার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করলেও কবি ‘সবিনয় নিবেদন’-এ বলেন,

‘আমি তো আমার শপথ রেখেছি

অক্ষরে অক্ষরে

যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন

দিয়েছি নরক করে।

দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল

অন্যে কবে না কথা

বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে

সেটাই স্বাভাবিকতা ।’

কী দারুণ শ্লেষ কবির! কবি যে তরোয়ালধারী নন। তাই অসির ফলায় নয়, কবিতার তীক্ষèতায় তিনি চাবকে দেন যত ক্ষমতার অপব্যবহারকারী দানবীয় শক্তিকে। জনতার জীবনকে যে নরক করে তুলেছে তাকে পংক্তির আঘাতে কবি পর্যুদস্ত করে তোলেন। এবং অতঃপর কবি অসাম্প্রদায়িক ও অরাজনৈতিক চেতনার বলে বলীয়ান হয়ে আবারও আঘাত হেনে নিপীড়নকারী শাসকের বুকে ভারী পাথরের মতো কবিতা চাপিয়ে দেন,

‘আমার ধর্মও নেই আমার অধর্ম নেই কোনো

আমার মৃত্যুর কথা যদি কেউ দূর থেকে শোনো

জেনো-এ আমার মাটি এ কাল আমার দেশকাল

জালিয়ানওয়ালাবাগ এবার হয়েছে আরওয়াল!’

একদিকে সবুজ পরিবেশ নিধনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, অন্যদিকে নাগরিককে রাজনীতির খেলা দিয়ে উদ্বাস্তু করে তোলার পাঁয়তারা-এসব কিছুকে যেমন কবি শঙ্খঘোষ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন কবিতায়, তেমনি মাওবাদীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

‘মাওবাদী

সহজ চলার ছন্দটা আজ

একটু না-হয় দাও বাদই!’

যে মাওবাদী পথ হারিয়েছে, কবি তাকে থামতে বলে বুঝিয়ে দেন, মানুষকে অতিষ্ঠ করে মানুষের কল্যাণ করা কোনো কালেই সম্ভব নয়। তাই ভ্রম পথ পরিহার করে মাওবাদীকে জীবনের পথে ডাক দিয়েছেন।

কবির নিষিদ্ধ হওয়া কবিতা জোড়ার মধ্যে ‘রাধাচূড়া’ অন্যতম, যার জন্যে সতীর্থ ও সুহৃদ কবি-সাহিত্যিকরা আন্দোলন করেছেন, রাজপথে নেমেছেন। কবি ‘রাধাচূড়া’-তে রূপকের আশ্রয় নিয়ে বলেছেন,

‘খুব যদি বাড়্ বেড়ে ওঠে

দাও ছেঁটে দাও সব মাথা

কিছুতে কোরো না সীমাছাড়া

থেকে যাবে ঠিক ঠাণ্ডা, চুপ

ঘরেরও দিব্যি শোভা হবে

লোকেও বলবে রাধাচূড়া।’

রূপকের আশ্রয় নিলেও বুঝতে অসুবিধে হয় না, ডান্ডা মেরে জনগণকে ঠা-া করার যে নকশা ক্ষমতাবান প্রয়োগ করেছে তাতে বরং উল্টো হলো ফল, ঠাণ্ডা হওয়ার পরিবর্তে বরং ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে জনগণ। গণজাগরণের গণশক্তি হিসেবে ‘রাধাচূড়া’-কেই কবি দাঁড় করিয়েছেন যেন আদ্যাশক্তির প্রতীকরূপে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে। গণতন্ত্রে অমনোযোগী জান্তাকে কবি গণতন্ত্রের ছবক শেখাতে চান। কবি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন,

‘মত কাকে বলে, শোনো । মত তা-ই যা আমার মত

সেও যদি সায় দেয় সেই মতে তবে সে মহৎ’।

অতএব, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শক্তিতে আরূঢ় পক্ষ শোষিত জনতার মতকেও আমলে নিতে হবে। নচেৎ সেই গণতন্ত্র সফল হওয়ার নয়।

কবি পার্সি বিশি শেলির কবিতা বিষয়ক কথাটা কবি শঙ্খ ঘোষের বেলায় হাড়ে হাড়ে সত্য। কবিতা হলো পরিতৃপ্তির বিষয়। কবি তার কবিতার মাধ্যমেই পরিতৃপ্তি অর্জন করেন। কবি শঙ্খ ঘোষ যেন সেই মতকেই বাস্তবায়িত করে তোলেন। তিনি তাঁর কবিতা দিয়েই প্রতিবাদে, খেদোক্তিতে পরিতৃপ্তি অর্জন করেন। ঘটনা ঘটিয়ে তিনি পরিতৃপ্ত হন না, বরং ঘটনা ঘটছে তা পর্যবেক্ষণ করে এবং অন্যকে অবহিত করার মধ্যেই তাঁর পরিতৃপ্তি। জীবনের দীর্ঘ আয়ু-সংস্কারে কবি শঙ্খ ঘোষ যা লিখে গেছেন তাতে অপরিমেয় সূক্ষ্ম সৌন্দর্য বিরাজমান। জন কীটস্ যেমন বলেছেন, 'কবিতা মুগ্ধ করবে তার সূক্ষ্ম অপরিমেয়তায়, একটি মাত্র ঝংকারে নয়', তেমনি শঙ্খ ঘোষের কবিতাগুলোতেও সূক্ষ্মতার অপরিমেয়তা। এই নান্দনিকতাই তাঁর কবিতাভাষ্যকে করে তুলেছে ফল্গুধারার মতো ধ্রুপদী ও শোভন-সুন্দর। এই সৌন্দর্য সম্ভারে আনত কবি অকপটে তাই বলতে পারেন,

‘আমার সবটাই আলো আমার সবটাই অন্ধকার

আমার সবটাই জন্ম আর আমার সবটাই মৃত্যু-দ্বার’।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়