প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
কবিতা একদিকে যেমন শিল্প তেমনি অন্যদিকে বাস্তবতার নির্যাস। এতে মিশে থাকে জীবন ও সমকালের চেতনা ও যাতনার ফল্গুধারা। একটি কবিতাই যখন একটি যুগকে একাকী ধারণ করে তখন তা হয়ে যায় যুগবাণী। এরকম যুগবাণীর কবিতা বিরল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি যুগের গূঢ় বাণীকে গাঢ়ভাবে ধারণ করে। ‘বিদ্রোহী’ নিছক কোনো একটি সাদামাটা কবিতা নয়। এটি কোনো এক উচ্চাভিলাষী তরুণের স্বপ্ন-সন্দর্শনও নয়। ‘বিদ্রোহী’ একটি আন্দোলনের নাম, ‘বিদ্রোহী’ একটি যুগান্তরের সূচনা। ‘বিদ্রোহী’ কেবলমাত্র কোনো ব্যক্তি-মনোরঞ্জনের সাহিত্য নয়। ‘বিদ্রোহী’ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে আত্মজাগরণের এক অভূতপূর্ব উপাখ্যান। একজন যুদ্ধফেরৎ কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার মাত্র বাইশ বছর বয়সে যুগান্তরের যুগবাণী লিখে হৈ চৈ ফেলে দিবে তা কেউ কস্মিনকালেও ভাবেনি। তাও আবার ঔপনিবেশিক যুগে বসে উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগের উদ্বোধনের বাঁশি বাজিয়ে দিবে ---সে আশা কেউ স্বপ্নেও লালন করেনি। কিন্তু ফকির আহমদের ক্ষ্যাপা ছেলে, ‘অবেলার ডাক’-এ উতলা করে তোলা মা জাহেদার অভিমানী নজর আলীই যুগবাণীর অমর স্রষ্টা হয়ে দাপিয়ে বেড়ালেন উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
‘বিদ্রোহী’র জন্ম-উপাখ্যান চমকপ্রদ না হলেও ঘটনাবহুল। বৃটিশ রাজশক্তির পক্ষে ঊনপঞ্চাশ নম্বর বাঙালি পল্টনে যুদ্ধ করে নিজের রাজভক্তির পরিচয় দিয়েছেন তাও খুব বেশিদিন হয় নি। কিন্তু এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর অন্তর্লোকে যে চেতনার জাগরণ ঘটে গেলো, তাঁর ভাবনার জগতে যে আমূল বিপ্লব সাধিত হলো তাই-ই তাকে অবিস্মরণীয় করে রেখে গেছে। ‘বিদ্রোহী’ জন্ম নেয়ার পূর্ব সময়টাতে তাঁর মনের মৃত্তিকায় যিনি ভালো করে ভূমি কর্ষণ করে দিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন, তাঁরই নিকট বন্ধু মুজফ্ফর আহমদ। সন্দ্বীপের এই কৃতী সন্তানই সে সময় এমন দারুণ উপযোগী সাম্যবাদী চেতনার ভূমি পেয়ে তাতে বপন করেন কমিউনিজমের বীজ। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তখন কমিউনিজমই এক ও অদ্বিতীয় শক্তি হিসেবে প্রকাশিত ও প্রতিষ্ঠিত ছিল। লাল ঝা-ার হাওয়া পেয়ে নজরুল প্রশান্ত না হয়ে বরং উত্তাল হয়ে ওঠেন তাঁর মনের মাতাল সমীরে। ফলে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনার উদ্বোধনের জন্যে যে হরফের দরকার ছিল, সেই হরফ তাঁর সদ্য অঙ্কুরিত চেতনাকে দান করে গেছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। ঊনিশশো একুশের ডিসেম্বরে ভূমিষ্ঠ হওয়া ‘বিদ্রোহী’ প্রায় পঞ্চাশ বছর এগিয়ে ছিল তাঁর সময়ের চেয়ে। কেন তা পঞ্চাশ বছরের মাইলফলক দিয়ে পরিমাপের হিসেব কষছি তা পরে আলোচ্য। কিন্তু ‘বিদ্রোহী’র প্রথম অধিষ্ঠান পেন্সিলের আঁকের মাধ্যমে যার প্রথম শ্রোতা ও দর্শক কবিবন্ধু মোজাফ্ফর আহমদ। যদিও তার প্রাথমিক নিস্পৃহতা কবিকে হতোদ্যম করেছে, তবু ঊনিশশো বাইশের ছয় জানুয়ারিতে সদ্যোজাত ‘বিদ্রোহী’ সাপ্তাহিক ‘বিজলী’র মাধ্যমে পাঠকের মনন-পাতে পরিবেশিত হয় এবং এরপর থেকে কবিকে আর মোজাফ্ফর আহমদের নির্মম নিস্পৃহতার মতো নৈরাশ্য কারো কাছে পেতে হয় নি। ‘বিজলী’তে চমকে ওঠার পর পত্রিকাটির পুনর্মুদ্রণের প্রয়োজন হয়। এটা ‘বিজলী’র চমক ছিল না বরং ‘বিদ্রোহী’র আলোকন-প্রভার বিচ্ছুরণ ছিল। ‘বিদ্রোহী’কে মাসিক ‘মোসলেম ভারত’-এ প্রথম পাঠানো হলেও তা ছাপার বিলম্বের কারণে ‘বিদ্রোহী’র জন্যে প্রথম আলোর স্বীকৃতি পায় নি। ‘বিদ্রোহী’র সূতিকাগার তিন বাই চার, তালতলা লেনের দ্বিতল বাড়ির নীচতলার একটি আঁধারপ্রবণ ঘর যা কোলকাতা পুরসভার কাছে আজও হেরিটেজ এর মর্যাদা পায়নি, অথচ পাওয়ার অধিকার ছিল।
‘বিদ্রোহী’ কেন যুগমানসের যুগবাণী হয়ে উঠল তা বেশ চিন্ত্যনীয়। ‘বিদ্রোহী’ বিষয়ে অনেক মতের আবিষ্কার থাকতে পারে। তবে বিশেষত কয়েকটি বিষয়ের কারণেই ‘বিদ্রোহী’ যুগমানসের যুগরবি। সাদামাটা চোখে দেখলে ‘বিদ্রোহী’ বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের এক মহা শক্তিমান কুশীলব। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অপসারণ ও বিনাশই এর লক্ষ্য। দেশ-মাতৃকার স্বাধীনতা এবং শোষণের নিগড় হতে মুক্তিই ‘বিদ্রোহী’র অভীষ্ট। কিন্তু আরেকটু তলিয়ে দেখলে বুঝা যায় ‘বিদ্রোহী’ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে এক নব সাংস্কৃতিক চর্চার উদ্গাতা। যদিও নজরুলের ‘বিদ্রোহী’র অনেক পরেই ফিলিস্তিনী লেখক ও গবেষক এডওয়ার্ড সাঈদের “অরিয়েন্টলিজম (১৯৭৮)” এবং ইব্রাহিম ফ্রান্ৎজ ফানোর ‘ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক (১৯৫২)’ ও ‘রেচেড অব দি আর্থ (১৯৬১)' উত্তর-উপনিবেশিকতাবাদের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। নজরুলের এই কবিতার মাধ্যমে উত্তর-উপনিবেশিকতাবাদের যে বীজের অঙ্কুরোদম হয়েছে তাই-ই আমাদের এনে দিয়েছে জাগরণের এক ভোর। কবির ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি তাই কেবলমাত্র ভারতবর্ষের কবিতা হয়ে আটকে থাকে নি, তা একই সাথে আন্তর্জাতিকতাকেও ধারণ করেছে। বিশ্বের তাবৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক শোষিত মানুষের মনের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে ‘বিদ্রোহী’ হয়ে উঠেছে বিশ্বমানুষের কবিতা।
‘বিদ্রোহী’ আমাদের সংক্ষিপ্ত কলেবরে মহাকাব্যের পটভূমিকে এঁকে দিয়ে গেছে। মহাকাব্যের নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আমাদের ভাবনায় নতুন চাপ সৃষ্টি করেছে। কলেবরে বিশালতা কিংবা নায়কের করুণ পরিণতি ছাপিয়ে ভাবের বিশালতায় ঘটমান বিষয়ে মহাকাব্যের নতুন নির্মিতি হতে পারার সম্ভাবনাকে জাগ্রত করে গেছে ‘বিদ্রোহী’।
কবিতার প্রকৌশলে ‘বিদ্রোহী’ এক নব বিপ্লবের সার্থক জন্মদাতা। তিরিশোত্তর পঞ্চকবির জ্বলজ্বলে তারকা কবি জীবনানন্দ দাশ যে ছন্দ বিদ্যুতে যুগের বেদনাকে ধারণের কথা বলে গেছেন, তা নজরুলের ‘বিদ্রোহী’তে ঝঙ্কৃত হয়ে বেজেছে। ছয়মাত্রিক মুক্তক মাত্রাবৃত্তের যে বিপ্লবী আচরণ তাতে ফুটে উঠেছে সেই নিরিখে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় এনেছে নতুন ভোর। দ্রোহকে শিল্পের পর্যায়ে এনে, গালাগাল ও ধমকের সমষ্টিকে কবিতায় পরিণত করে ‘বিদ্রোহী’ দিয়ে গেছে সাহিত্যের নতুন ভাষা। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে নূতন এক আঙ্গিক দানের পাশাপাশি উত্তম পুরুষে লেখা পৃথিবীর সর্বোত্তম কবিতাকে উপস্থাপন করে গেছে।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার অমূল্য সম্পদ নারীকে কবিতায় প্রদত্ত সম্মান। এ কবিতায় নারীশক্তিকে যেভাবে স্মরণ করার প্রয়াস ছিল তাতে পূজনীয়া আদ্যাশক্তি হয়েই দেবী বা যৌবন-ভীতু পল্লীবালার অবয়বে প্রণম্য হয়েছে নারী। বিধবা, অবমানিত কিংবা অভিমানী নারীর বেদনাকে তিনি যেভাবে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ধারণ করেছেন, তাতে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নয় বরং হয়ে উঠেছে সমাজ-মুক্তির নাড়ির স্পন্দন।
‘বিদ্রোহী’ কেন এত দীর্ঘকাল ধরে জনপ্রিয় কিংবা বৃটিশ রাজের ভারতবর্ষ ত্যাগের পরেও ‘বিদ্রোহী’ কেন এত আদৃত তা তলিয়ে দেখতে গেলে যা আমাদের সামনে দাঁড়ায়, তা হলো জনকল্যাণ। ‘বিদ্রোহী’র মূলভাষ্য যতটা না বৃটিশের প্রতি বৈরিতা বা নিজের পরাধীনতার মুক্তি, তার চেয়ে অধিক স্বনিত হয়েছে এতে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোলের প্রশমন। স্বাধীন দেশে আজও উৎপীড়িতের কান্নার রোল স্তব্ধ হয় নি। আজও হ্যাভ এবং হ্যাভ নটস্ এর দ্বন্দ্বে মানব-সভ্যতা ঘুনে ধরা। এই শ্রেণিবৈষম্য হতে মুক্তির বারতা নিয়ে ‘বিদ্রোহী’র আবির্ভাব বলেই ডিভাইড এন্ড রুল মূলমন্ত্র মানা বৃটিশ লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেলেও ‘বিদ্রোহী’র প্রয়োজন অক্ষত রয়ে গেছে। এ কারণে শতবর্ষে এসেও আজ মনে হয়, ‘বিদ্রোহী’ আমার পূর্ব পুরুষের কবিতা, ‘বিদ্রোহী’ আমার স্বকালের কবিতা এবং ‘বিদ্রোহী’ অবশ্যই উত্তর প্রজন্মের কবিতা।
‘বিদ্রোহী’ যেমন বহুল পঠিত ও চর্চিত কবিতা তেমনি এই কবিতার মতো বিরোধিতা আর কোন কবিতাকে সহ্য করতে হয় নি। একদিকে প্যারোডির নেতিবাচক চাপ আর অন্যদিকে ভাব অনুকরণের অভিযোগে ‘বিদ্রোহী’ কাবু তো হয় নি মোটেই, বরং পাশে পেয়েছে অসংখ্য শুভাকাক্সক্ষীকে। ‘শনিবারের চিঠি’র অশনি জাগানো সজনীকান্ত দাস সাহিত্য সমালোচক ও কবি মোহিতলাল মজুমদারের ‘ব্যাঙ’ শিরোনামে প্যারোডি কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে এবং কবি গোলাম মোস্তফা ‘নিয়ন্ত্রিত’ কবিতার মাধ্যমে ‘বিদ্রোহী’র প্যারোডি করে কবিতাটিকে পীড়ন দিতে গিয়ে বরং বিপরীতে হিত করে তোলেন। অর্থাৎ এতে ‘বিদ্রোহী’ আরও জ্বলজ্বলে মেঘহীন হয়ে উঠেছে। তবে মোহিতলাল মজুমদার তার ‘আমি’ প্রবন্ধের ভাব অনুকরণের দায় চাপিয়ে যখন ‘বিদ্রোহী’কে খাটো করতে চান কিংবা সৈয়দ আলী আহসানের মতো প্রাজ্ঞ প-িত ‘বিদ্রোহী’কে ওয়াল্ট হুইটম্যানের ‘সঙ অব মাইসেল্ফ’ কবিতার অনুরূপ বলে আঙুল তোলেন তখন ‘বিদ্রোহী’ সত্যিকার অর্থেই রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু এতসব ঈর্ষা আর ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে ‘বিদ্রোহী’ তবু ধ্রুবতারা হয়েই জ্বলে আছে সাহিত্যের পরিম-লে। তাই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নয় এক বিজয়ী বীরের নাম, যার বিদ্রোহ সফল হয়েছে অভিলক্ষ্যে পৌঁছে।
‘বিদ্রোহী’ জগতকে স্বার্থপরতা ত্যাগের শিক্ষায় পুনঃজাগ্রত করার দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছে। জগত-শাস্তা মহামতি বুদ্ধ মানুষের কল্যাণের জন্যে, দুঃখ হতে আর্তমানবতার মুক্তির জন্যে রাজবেশ ত্যাগ করে গ্রহণ করেছিলেন গৈরিক বেশ, অনাগরিক সন্ন্যাসীর ব্রতে নিজে বের হয়েছেন দুঃখ নিরোধের আলোকনের পথে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সিদ্ধার্থ গৌতমের সেই মহাভিনিষ্ক্রমণকে স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক’ বলে। এখানে যতটা না ব্যক্তি বা ঘটনা প্রধান হয়ে উঠেছে, তার চেয়ে বেশি প্রতিভাত হয়েছে মুক্তিমার্গ বা দর্শন। বুদ্ধ বলেছেন, ‘অত্তাহি অত্তনো নাথ, কোহি নাথ পরসিয়া।’ অর্থাৎ মানুষ নিজেই নিজের ত্রাতা। মানুষকে ত্রাণ করবে এমন কেউ নেই। একারণেই তিনি আহ্বান জানিয়েছেন, ‘অত্তদীপ বিহারথ, অত্ত সরণা অনন্য সরণা।’ অর্থাৎ নিজেই নিজের দীপ হয়ে জ্বলো। নিজের শরণই অনন্য শরণ। কবি নজরুল তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বুদ্ধের এই আত্মদীপের দর্শন অন্তরে ধারণ করেই বলেছেন, ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ।’ এই চরণটি দ্যোতনাম-িত হলেও এতে নিজের সামর্থ্য ও ইচ্ছার কাছেই নিজের শরণাগত হওয়ার কথা ব্যক্ত হয়েছে। ‘বিদ্রোহী’ এ কারণেই আজও সমকালীন, আজও সমান প্রাসঙ্গিক।
যে কারণে ‘বিদ্রোহী’ নবযুগের সূচনা করেছে তার বেশ কিছু কারণ উপর্যুক্ত ব্যাখ্যায় আলোচিত হলেও মূলত যে কারণে ‘বিদ্রোহী’ যুগান্তরের আগাম দূত তা হলো কবিতাটির মাধ্যমে কবির প্রেরিত বিজ্ঞানবার্তা। লেটো গানের ভ্রমর কবি কিংবা ওয়াহেদ বক্সের রুটির দোকানের শ্রমিকের মনে বিজ্ঞানের এই আগাম বার্তা আসাটা অস্বাভাবিক। কিন্তু জন্মকালে যাঁর জন্মস্থানের লাল মাটিকে আঁধার করে নেমেছিল ক্ষ্যাপা কালবৈশাখী, তিনি যে বিরাট কল্পবিজ্ঞানী তা অস্বীকার করার কোন জো নেই। ‘বিদ্রোহী’তে তিনি একদিকে নিজে যেমন মহামারির কথা উল্লেখ করেছেন, তেমনি অন্যদিকে উল্কা বা ধূমকেতু কিংবা শনির কথা উচ্চারণ করে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে নিজের স্বচ্ছ ধারণা ও চর্চার কথা ফুটিয়ে তুলেছেন। আজ, ‘বিদ্রোহী’র জন্মশতবর্ষের প্রাক্কালে মহামারির ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে পৃথিবী হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। সেই মহামারিকে মোকাবেলায় আমাদের যে বিজ্ঞানেরই দ্বারস্থ হতে হবে তা আমরা কবির কণ্ঠেই শুনতে পাই। কবি নিজেই আবিষ্কারের নেশায় বিজ্ঞানের জগতে অভিযাত্রীরূপে যাত্রা করে বিশ্বজগত ঘুরে দেখার কথা তাঁর অন্য একটি কিশোর কবিতায় বলেছেন যার ধারণা তিনি ব্যক্ত করেছেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতার বিজ্ঞান বার্তায়। তিনি বলেছেন, ‘মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি
চন্দ্র-সূর্য গ্রহ-তারা ছাড়ি
উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাতৃর।’
কবি যখন এ কবিতা লিখেছেন তখন কিন্তু মানুষ চন্দ্র বিজয় করে নি। মানুষ তারও সাতচল্লিশ বছর (প্রায় পঞ্চাশ বছর) পরে চন্দ্রাভিযানে মহাকাশ জয় করেছে। ঊনিশশো ঊনসত্তর সালের তের জুলাই মানুষের চন্দ্র বিজয়ের ঘটনা পৃথিবীবাসীর বিজ্ঞান বিষয়ক ধারণাকে স্বচ্ছ ও প্রগাঢ় করে তুলেছে। কবি নজরুলের সেই 'চন্দ্র-সূর্য গ্রহ-তারা' ছেড়ে যাওয়ার কিংবা মহাকাশবিদ্যার আভাস ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় আমরা বুঝে নিই আজ, কবি নজরুল একজন সত্যিকারের কল্প বিজ্ঞানী ছিলেন।
নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় যে আদর্শ তরুণের কথা ভেবেছিলেন তিনি অরুণ খুনের তরুণ। এই বাক্যাংশটুকু শুনেই অনেকের আক্কেল গুড়ুম হওয়ার কথা। কারণ সবাই যেখানে অরুণকে জ্বালাতে কিংবা উজ্জ্বলতর করতে সচেষ্ট হন, সেখানে অরুণ নেভাতে নজরুল উত্তুঙ্গ হয়ে ছিলেন। আদতেই নজরুল অরুণ খুনের তরুণ হয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় রাজত্ব করেছেন পাঠকের চিন্তাসমুদ্রে। আগে বলা হতো বৃটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য কখনো অস্ত যায় না। কবি বৃটিশ সাম্রাজ্যের সেই সূর্য তথা অরুণকে অস্তমিত করাতে চান বা অন্য অর্থে খুন করতে চান। এই খুন মারার খুন নয় বরং পরাধীন জাতিকে ঔপনিবেশিক পরাধীনতার হাত থেকে বাঁচানোর পবিত্র অভিযান বা ব্রত। ভারতবর্ষ যদি বৃটিশমুক্ত হয় তবে এমনিতেই বৃটিশ সূর্যের পতন অনিবার্য। নজরুল সেই অরুণ খুনের তরুণ হতে চেয়েছেন দেশমাতৃকার জন্যে।
‘বিদ্রোহী’র যে পটভূমি কিংবা প্রচ্ছদপট, তাতে পৌনে দুশ বছরের ঔপনিবেশিকতার অবসানের আকাক্সক্ষা ও শপথ যেমন ব্যক্ত হয়েছে, তেমনি বৃটিশদের পতনোত্তর তাদের চাল-চলনকে বর্জনের ডাকও তিনি দিয়েছেন। সমুদয় কারণে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি উপনিষদের আত্মানং বিদ্ধি তথা নিজেকে জানার ও আত্ম-আবিষ্কারের একটি আধুনিক আহ্বান বলেই প্রতীয়মান। ‘বিদ্রোহী’র নিজের ভাষ্যকে আমাদের স্বীয় জীবনের মূলমন্ত্র করে নিয়েই বলি,
‘আমি সহসা আমারে চিনেছি আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।’
জয়তু ‘বিদ্রোহী’, জয়তু বিশ্ব মানবতা।