প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
আজ পর্যন্ত সুমন তার আগ্রহের সবিশেষ বস্তুটি খুঁজে পায়নি। বিচিত্র বিষয়ে তার আগ্রহ। বর্ষার অবিরল ধারার মতো অনিঃশেষ টানের বান শারদ প্রাতেই শুকিয়ে খানখান। ফলে, তার নিজের কোনো কিছু আর হয়ে ওঠে না। যখন যা ভালো লাগে তা নিয়ে পড়ে থাকে। ইদানীং তার আগ্রহের বিষয় গোয়েন্দা সিনেমা। বিশেষ করে সত্যজিৎ রায়ের। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার বেশ ক’টি ডিভিডি সংগ্রহ করে সে। অপেক্ষা করে তার বন্ধু শাহীনের। শাহীন তার ক্লাসমেট। বন্ধুও। শাহীনের নিজস্ব কম্পিউটার ও টেলিভিশন রয়েছে। সে প্রতিদিনই নিয়ম করে সুমনের কাছে আসে। কখনো প্রয়োজনে কখনো অপ্রয়োজনে। মাঝে মাঝে সুমনের মেসে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে আসে। তাকে তার বন্ধুরা উইলিয়াম সমারসেট মমের ‘দ্য অ্যান্ট এন্ড দ্য গ্রাসহোপার’ গল্পের নায়ক টম বলে চালিয়ে দেয়। শাহীনের চলন বলন, চিন্তা-চেতনা টমের মতোই। হঠাৎ জুতার আওয়াজ পায় সুমন। শাহীনের আগমন র্বাতা টের পায়। এক মেসে দীর্ঘদিন কাটানোর ফলে সুমন জুতার আওয়াজ শুনে বলতে পারে, কে আসছে! পরিচিত জনের কাক্সিক্ষত পায়ের আওয়াজে প্রসন্ন হয় সুমন। সে শাহীনকে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার ক্যাসেট দেখায়। শাহীন ইতোপূর্বে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখেনি। সেও মনে মনে খুশি হয়। শাহীন একটা সিগ্রেট ধরায়। সিগ্রেটের ধোঁয়া কু-লী পাকিয়ে উপরে পালায়। সুমনকে টান দেওয়ার প্রস্তাব করে। সুমন এক টান দেয়। ভিতরে নেয় না। মুখ থেকে বের করে দেয়। এটা তার হয় না। এক্কেবারে আনাড়ি।
শাহীন আনমনে ‘দৈনিক প্রথম আলো’ পত্রিকায় চোখ পাতে। ছবি দেখে। হয়তো দেখে না। রেখে দেয়। কী সব ছাইপাঁশ! পকেটে হাত রাখে। পকেট থেকে এক বান্ডেল টাকা বের করে। সব হাজার টাকার কড়কড়ে নোট। টসটসে। সুমন এতো টাকা একবারে দেখে নি। কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে জিগ্যেস করে, ‘কত টাকা এখানে?’ শাহীন মৃদু হেসে জবাব দেয়, ‘মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকা।’ সুমনের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়। সে বলে, ‘কী কস! এতো টাকা কিসের জন্য?’ শাহীন নিরুত্তাপ জবাব দেয়, ‘এক লোক আসবে, তাকে টাকাটা দিতে হবে, তার ভাই বিদেশ থেকে পাঠাইছে।’ সুমন বিষয়টা প্রথমে আমলে নেয় না। কথাবার্তার এক পর্যায়ে সে বুঝতে পারে এগুলি হুন্ডির টাকা। সে তখন জানত না হুন্ডি সম্পর্কে। পরবর্তীতে সে জানতে পারে, ‘হুন্ডি দেশের আইন দ্বারা নিষিদ্ধ অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থ হস্তান্তর ব্যবস্থা। হুন্ডি সংস্কৃত শব্দ ‘হুন্ড’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যার অর্থ হলো ‘সংগ্রহ করা’। এটি মুগল আমলে পরিচিতি লাভ করে কিন্তু ব্রিটিশ আমলে জনপ্রিয়তা পায়। সুমন শাহীনের কাছে জানতে পারে, ‘হুন্ডির মাধ্যমে কম খরচে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে দ্রুত টাকা পাঠানো যায়। সুমন একটু বিচলিত হয়। সে গুগলে সার্চ করে। হুন্ডির অপকারিতা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। সে জানতে পারে সরকার এতে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। সুমন অসহায় দৃষ্টিতে শাহীনের দিকে চোখ পাতে। শাহীন দাঁত কেলিয়ে হাসে। শাহীনের সদর্প জবাব, ‘আমার পকেট খরচের টাকাটা হয়ে যায়, তাই করি। টিউশন করে টাকা কামাই করা আমার ঠিক পোষায় না।’ শাহীন টাকাগুলো সুমনের টেবিলের দেরাজে রাখে। সুমন টাকা রাখতে কুণ্ঠা বোধ করে। সে বিচলিত হয়ে বলে, ‘দেখ, আমার টেবিলে তালা নেই, টাকা চুরি টুরি হতে পারে।’ শাহীন গদগদ হয়ে বলে, ‘না, চুরি হবে না তুইতো আছত। তুই থাক, আমি একটা সিগারেট নিয়া আসি।’ শাহীন ঠাস ঠাস শব্দে বেরিয়ে যায়। সুমন টাকাগুলি হাতে নিয়ে ওজন মাপার চেষ্টা করে। ঘ্রাণ নেয়। নতুন টাকার ঘ্রাণ অন্য রকম আবেশ সৃষ্টি করে। মোহ তৈরি করে। ঘোর লাগায়। সুমন সন্তর্পণে টাকাগুলো রেখে দেয়। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার ক্যাসেট হাতড়ে বেড়ায়। সোনার কেল্লা এবং জয়বাবা ফেলুনাথ সিনেমা সেখানে। সুমন রাতে এক গ্লাস পানি খায়।
শাহীনের সাথে রাতে থাকবে। শাহীন রিক্সা ডাক দেয়, ‘এই খালি, যাইবা?’ সুমনের একটু মন খারাপ হয়। সুমন শাহীনকে বলে, ‘দেখ, ওনি কিন্তু আমাদের বাবার বয়সি, ওনাকে তুমি করে বলাটা ঠিক না। আপনি করে বলা উচিত। কারো দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা অনুচিত।’ শাহীন মৃদু হেসে বলে, ‘ওরে বাপরে, এ দেখি মানবতার অবতার এসে হাজির চাঁদপুরে। আরে তুমি করে বলাটা এতো খারাপ না।’ এরপর শাহীন রিক্সা ডাক দেয়, ‘এই মামা, মমিন পাড়া যাবেন?’ ‘হ, যামু মামা।’ ভাড়া কত? পঁচিশ টাকা। না, মামু বিশ টাকা ভাড়া, বিশ টাকাই দিমু। ঠিক আছে ওডেন। তারা দুজন রিক্সায় ওঠে। রিক্সার চাকা ঘোরে। ক্রিং ক্রিং বেল বাজে। গন্তব্যে পৌঁছে। ফ্রেশ হয়। কিছুক্ষণ টেলিভিশনে খবর দেখে। শাহীন তার রাতের খাবার নিয়ে আসে। একপ্লেট ভাত। সাথে গরুর গোশত। খাবারের সামনে এলে ক্ষুধা আড়মোড়া দিয়ে জেঁকে বসে। শাহীন তাকে খাওয়ার জন্য বলে। নিয়মরক্ষার জন্য। সুমনের পেটে প্রচুর ক্ষুধা। সে খাবার মুখে পুরে নেয়। জীবনে প্রথমবার সে গরু গোশত খায়। এমনিতে সে প্রথা বিরোধী মানুষ। দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে নতুন একটা খাবার মুখে নেওয়া অনেকটা চ্যালেঞ্জের বিষয়। সে এক লহমায় খেয়ে নেয়। শাহীন তাকে খেতে দেয় উৎসাহ নিয়ে। মুরগীর মাংস হলে ঐ রকম উৎসাহে ভাটা পড়ত। ক্ষুধার রাজ্যে ধর্মীয় রীতি অসহায়। খাবারের পালা শেষ হয়। শাহীন কম্পিউটার চালু করে। ডিভিডি চালু করে সিপিইউতে। সোনার কেল্লা। সোনার কেল্লায় লালমোহন বাবুর (জটায়ু) চরিত্র প্রথম আত্মপ্রকাশ হয়। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের একটি চমৎকার গোয়েন্দা উপন্যাস সোনার কেল্লা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় তারা তন্ময় হয়ে উপভোগ করে। ভোরে আজান দেওয়ার আগ পর্যন্ত তারা ফিল্ম দেখে। শাহীন এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে যায়। সুমন ও। সুমন মোবাইলে এলার্ম দিয়ে রাখে। সকাল আটটায় তার টিউশন। মাসের শেষ। পকেট ফাঁকা। টিউশন গেলে টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। টিউশনের টাকায় মেস ভাড়া, খাওয়া দাওয়া চলে। তাকে আটটায় উঠতেই হবে। নির্ধারিত সময়ে ফোনে এলার্ম বেজে ওঠে। হন্তদন্ত হয়ে টিউশন করতে বের হয় সুমন। টিউশন শেষে মেসে ফিরে। গোসল সারে। দুপুরের খাবার খায়। মোবাইলে রিং টোন বেজে ওঠে। শাহীনের ফোন। সুমন কল রিসিভ করে। স্বাভাবিক সে। শাহীন মিহিসুরে বলে, ‘দোস্ত, আমার বান্ডেল থেকে তুই তিন হাজার টাকা আনছস’। সুমনের মাথায় বজ্রপাত হলো যেনো। তার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। মাথা ঘুরপাক খায়। সে চোখে সর্ষে ফুল দেখতে পায়। সুমন স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে। বলে, ‘দোস্ত, আমি কোনো টাকা আনিনি, তোই আমার বাসায় আয়, তারপর একটা সমাধান বের করব।’
শাহীন চোখের পলকে হাজির হলো। তারা দুজন মেসের বাইরে রাস্তায় দাঁড়াল নিরিবিলি। শাহীন মিষ্টিসুরে বলল, ‘দোস্ত, আমি জানি টাকাটা তুই আনছস, তোর হয়তো কোনো দরকার লাগছে হঠাৎ, আমার ঘুমের ডিস্টার্ব হবে তাই না বলে নিয়া আইছস। কিন্তু আমার পার্টি এখন ফোন দিছে তাদের আজকেই টাকা লাগবে, তাদেরকে টাকা দিতে হবে আজ বিকেলেই। এখন টাকা গুণতে গিয়া দেখি তিন হাজার টাকা শর্ট। তুই কি টাকা খরচ করে ফেলছস? দোস্ত, আমার টাকাটা এখন লাগবে।’ শাহীন এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে যায়। সুমনের বুকের ভেতর কম্পন শুরু হয়। কথা আটকে যায়। জিভ আড়ষ্ট হয়। তবু সে মাথা ঠা-া রাখার চেষ্টা করে। সুমন জোর দিয়ে বলে, ‘দোস্ত, তোর টাকা আমি সত্যিই ধরি নাই, তবে তুই আমাকে কিছু তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করলে, তোর টাকার একটা হদিস পাওয়া যেতে পারে।’ সুমন জিগ্যেস করে, ‘তোর বাসায় আর কে কে আছে?’ শাহীনের জবাব, ‘আমার কাকী, কাকাতো ভাই ২জন, দাদা, কাকাতো বোন।’
কাকাতো ভাইয়ের বয়স কত?-ছোটটার দশ মাস, বড়টা আট বছর। কাকাতো বোনের বয়স কত?-‘পনের ষোলো বছর হবে। সুমন বলে, ‘এদের কারো হাত টানের অতীত রেকর্ড আছে কিনা?’ শাহীনের উত্তর- ‘না, আগে কখনো টাকা পয়সা চুরি হয় নাই। ওদের যথেষ্ট টাকা পয়সা আছে, চুরি করার দরকার হয় না, যখন যা দরকার তা চাইলেই পায়।’
সুমন বলল, ‘আমি যখন সকাল আটটার দিকে বের হইছি তখনতো দরজা খোলাই ছিল। ঐ সময় কেউ কি তোর ঘরে ঢুকছে?’ শাহীনের জবাব, ‘নারে, কারো শব্দ পাই নাই।’ সুমনের উদ্বেগ বাড়তেই থাকে। শাহীন বলে ওঠে, ‘দোস্ত, তুই ভালো করে মনে করার চেষ্টা কর, তুই কোনো কাজে আনছস কিনা’। সুমন বলল, ‘দোস্ত, আচ্ছা, এবার তুই বলতো, সারাদিন আজ তুই কখন কী করছস?’ শাহীনের উত্তর, ‘আমি বারোটায় ঘুম থেকে উঠছি, গোসল করছি, তারপর কাকাতো ভাইকে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ জমির উদ্দীনের চেম্বারে নিয়া গেছি।’ সুমনের কৌতূহলের পারদ উপরে ওঠে। সে সোৎসাহে জিজ্ঞাসা করে, ‘তোর সাথে আর কে গেছে ডাক্তারের চেম্বারে?’ শাহীন বিরক্তি নিয়া বলে, ‘আমার কাকী গেছে’। সুমনের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। সে পুনরায় জিজ্ঞাসা করে ‘তোরা যে ডাক্তার দেখালি, ডাক্তারের ফি কে দিছে?’ শাহীনের চোখে মুখে এবার খুশির ঝিলিক বয়ে যায়। সে এবার সদর্পে ঘোষণা করে, ‘দোস্ত, আমার এবার মনে পড়ছে, কাকী ডাক্তার দেখানোর জন্য আমার কাছ থেকে তিন হাজার টাকা নিছিল, আমি একদম ভুলে গেছি।’ সুমন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মনে হলো মৃত্যুর ফাঁদ থেকে সে ফিরে এসেছে। সুমন মনে মনে স্বগতোক্তি করে, ‘আমার দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে পরোক্ষভাবে এতক্ষণ আমাকে চোর বানানো হলো। আজ আমার সময় খারাপ, তাই যে যা খুশি বলে যায়, যা খুশি ভেবে নেয়। সময় একদিন আমারও আসবে।’
সুমন কষ্ট চাপা রেখে তাকে বলল ‘কাল রাতে ফেলুদার সিনেমা দেখে আমারও আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে, যে কোন সমস্যা মাথা ঠা-া করে চেষ্টা করলে সমাধান করে ফেলা যায়। তার জন্য চাই একাগ্রতা, ধৈর্য এবং সাধনা।’ শাহীন ফ্যাল ফ্যাল করে সুমনের কথা গিলে। চাপা স্বভাবের মানুষ হওয়া সুমন শাহীনকে কটু কোনো কথা বলেনি সেদিন। সুমনের কেবল সুমেন চন্দের একটা বিখ্যাত লাইন মনে পড়ে, ‘বড়লোক এবং গরীবে এমনি দরকার বোধে গম্ভীর আবহাওয়ার মধ্যে কথাবার্তা হয়তো চলতে পারে, কিন্তু ভাব যাকে বলে, মানসিক ঘনিষ্ঠতা যার নাম তা কখনও হতে পারে না।’ এ ঘটনার এক যুগ। সুমন এক যুগ এর কারণ হাতড়ে বেড়ায়। এক সময় হয়তো কারণ খুঁজে পায়, ‘অন্ত মিলের অভাব’।
সম্প্রতি প্রকাশিত কথা সাহিত্যেক মোজাফ্ফর হোসেনের ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’ বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য সংযোজন। একুশটি গল্প দিয়ে সাজানো বইটি একুশের মাসে প্রকাশিত হয়েছে মননে একুশের চেতনা ধারণ করে। জাদুবাস্তবতার এক অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে গল্পের শরীরের ভাঁজে ভাঁজে। প্রতিটি গল্পই পাঠককে সম্মোহনের মধ্য দিয়ে চেতনাকে পরম উৎকর্ষে পোঁছে দেয়। আমাদের প্রতিদিনের ঘটনাকে এর দৃষ্টিত অবলোকনের দীক্ষা দেয়। ‘একটি খুনের স্বীকারোক্তি লোকদের দখলের অপেক্ষায়। গল্পকারের ভাষায়, ‘প্রাচীরটা হাত-পা ছড়াতে ছড়াতে খগেনের উঠোনের প্রায় সবটুকু খেয়ে ফেরেছে’। এ পরিচিত এক দৃশ্য। সংখ্যালঘুর জমি দখলের চিত্র এখানে ফুটে উঠেছে। খগেন নিয়ম করে চেয়ারম্যানকে গালিগালাজ করে, হত্যার কথা ব্যক্ত করে। খগেনের চল্লিশ বছরের ইচ্ছা চেয়ারম্যানকে হত্যা করার। একদিন চেয়ারম্যান খুন হয়। খগেন ঘুম থেকে উঠে খবরটা পায়। নিজের অক্ষমতার জন্য তার আফসোস হয়। খগেনকে আসামি করা হয়। দারোগা খগেনকে জিজ্ঞাসা করে, ‘এটা তোর কাজ?’ ‘জে, হতি পারে’ সে সরাসরি উত্তরটা দিতে পারে না। খগেন এক পর্যায়ে দারোগাকে জানায় গত রাতে চেয়ারম্যানের দুই পক্ষের দুই ছেলের মধ্যে জমির ব্যাপারে ভাগাভাগি নিয়ে বিবাদের কথা। দারোগা কৌশলে খগেনকে হত্যার দায় স্বীকার করতে বাধ্য করায়। দারোগা তার সহকর্মীকে জবানবন্দিতে টিপসই নিতে বলে। তখন পাঠক আবিষ্কার করবে খগেনের দুই হাতই কনুই পর্যন্ত কাটা। কনস্টেবল তাকে ভর্ৎসনা করে ‘চুরি-ডাকাতি করতে গিয়া ধরা খাইছিলা নাকি?’ তখন পাঠক আবিষ্কার করবে, ‘যুদ্ধে খগেনের হাত দুটি কেটে নিয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা। চেয়ারম্যান তখন যুবক, শক্ত করে খগেনের পা দুটো বেঁধে দিয়েছিল।’ পাঠকের তখন বোধোদয় হয়। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুর আঁচড় থেকে এখনো মুক্ত হয়নি দেশ। ঘাপটি মেরে বসে থাকা একাত্তরের রাজাকারদের উত্তর প্রজন্মের হাতে আজও দেশের মুক্তিকার্মী মানুষের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়।
দ্বিতীয় গল্প ‘শেষ মাথাটি কাটা পড়ার আগে’ গল্পটি লেখকের জবানিতে বলা। ঘুম থেকে উঠে লেখক দেখেন ‘রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে মাথাবিহীন মানুষ।’ তার প্রথমে স্বপ্ন মনে হয়। পরবর্তীতে তিনি আবিষ্কার করেন তার ছোটবোন, মা, বাবা, প্রেমিকা, শাশুড়ি সবাই মাথা কাটা। লেখক এ গল্পে সংসারের এক সারমর্ম তুলে ধরেছেন, ‘মা এভাবেই সংসারে রোবটের মতো কাজ করে যাচ্ছেন বহু বছর ধরে। মাথা থাকা না থাকাতে তার কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা না।’ লেখক আরও বলেন, ‘মাথাবিহীন মানুষের সড়কে একমাত্র মাথাযুক্ত মানুষ হিসেবে আমার চলতে অসুবিধা হয়। মাথাবিহীন মানুষের মতো নিশ্চিস্ত হেঁটে যেতে পারি না। দেখে কষ্ট বাড়ে। মাথা না থাকলে মানুষের চিৎকার দেওয়ার, দ্রোহ প্রকাশ করার ভাষা থাকে না।’ মাথাবিহীন এই সমাজে নারী, ছেলে শিশু কিংবা মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। প্রতিবাদ হয় না। লেখক পথ ভুল করা যুবকরা চাপাতি, পিস্তল, রড নিয়ে খুলে বেড়ায়। লেখক এক নষ্ট সময়ের আখ্যান বুনেছেন। লেখক এও বলেন, ‘মাথা থাকলে ন্যায়বোধ থাকবে।’ মাথা থাকার কারণে লেখকের প্রেমিকাও তার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। লেখক এ গল্পে বলেছেন ‘ এ রকম প্রকাশ্যে মানুষ হত্যার প্রতিবাদ করা দরকার। আমার যেহেতু মাথা আছে, আমি চাইলেও প্রতিবাদ না করে থাকতে পারি না।’ গল্পকার এখানে তথাকথিত ভদ্রলোকদের মুখে সপাটে চপেটাঘাত করেছেন। যারা অন্যায় দেখেও না দেখার ভান করে। ভালো থাকার আশায়। লেখক খুনি ড্রাইভারকে থানায় নিয়ে গেলে পুলিশ খুনি ড্রাইভারকে ছেড়ে লেখককে লকআপে ঢুকিয়ে ফেলেন। লেখক রূপকের মাধ্যমে সমাজের চরম অরাজকতার কথা ইঙ্গিত করেছেন। লেখকের বয়ান, ‘মাথাবিহীন মানুষের রাষ্ট্রে কারো মাথা থাকা নিশ্চয় অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।’ বোধবুদ্ধিহীন মানুষের মাঝে নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় এখন মাথাটা কেটে ফেলে দেওয়া। ঘুণে ধরা সমাজে রক্ষণশীলদের দাপট। মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে আছে কতগুলো কাগুজে কানুন। মুক্তবুদ্ধির টুটি চেপে ধরে আছে। সারা পৃথিবী যেখানে মঙ্গলে যাবার প্রচেষ্টায়, সেখানে আমরা যেতে চাচ্ছি জঙ্গলে। গল্প পড়তে পড়তে পাঠকের মনের ক্যানভাসে মাথাবিহীন মানুষের চিত্রই ভেসে উঠবে।
তৃতীয় গল্প ‘স্পাই’ একজন হতভাগ্য সংখ্যালঘুর পীড়িত জীবনের খতিয়ান। হিন্দু লোকটি তার জন্মভিটায় ফেরত আসলে স্থানীয়রা তাকে ‘স্পাই’ মনে করে। অত্যাচার করে। গল্পকারের ভাষায়, ‘হিন্দু হলে ভারতীয় স্পাই হবে এরকম একটা বিশ্বাস বাতাসে কে বা কারা যেন কবে ভাসিয়ে দিয়েছে, আমাদের নিঃশ্বাসের সঙ্গে তা রক্তে মিশে গেছে। একপর্যায়ে গল্পে জানা যায় এই দেশ, বাড়ি সেই লোকটিরই। গল্পের শেষে জানা যায়, বউ আর মেয়েকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে পুড়িয়ে মারছে পাকিস্তানিরা, স্থানীয়রা করছে দেশছাড়া। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর পর্বের এক সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের করুণ পরিণতির কথা বর্ণনা করা হয়েছে। লেখক এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন পাঠককে।
‘মানুষের মাংসের রেস্তোঁরা’ গল্পে লেখক এবং তার বন্ধু হারুন মানুষের মাংসের স্বাদ গ্রহণের জন্যে একটা হোটেলে আসে। অর্ডারও করে। গল্প করতে করতে মাংস খায়। গল্প পড়তে পড়তে পৃথিবী নামক গ্রহটিকেই মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ মনে হয়। যেভাবে মানুষ মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, হত্যা করছে, একে অপরের শোষণ করছে। প্রতীকী অর্থে মানুষই মানুষের মাংস খাচ্ছে। প্রবাদ আছে, কাক কাকের মাংস খায় না, কিন্তু মানুষ মানুষের মাংস খায়। মানুষ মানুষের ক্ষতি করে। গল্পকারের ভাষায়, ‘ইসরায়েল ফিলিস্তিনি শিশুদের মাংস থেকে এক ধরনের আচার তৈরি করে বাজারে ছেড়েছে, এত দাম যে, কারো একার পক্ষে কিনে খাওয়া সম্ভব না। বিশ্বসংঘ থেকে শুরু করে বড় বড় এনজিওর মিটিংয়ে নাকি পরিবেশন করা হয়।’ লেখক আন্তর্জাতিক রাজনীতির কদর্যতার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন শ্লেষের মাধ্যমে। সিরিয়া, ফিলিস্তন, ইয়েমেনের সাম্প্রতিক নির্মমতার নিষ্ঠুরতার করুণ কাহিনী তিনি বর্ণনা করেছেন। গল্পে রেস্তোরাঁর ম্যানেজার এ পর্যায়ে জানায়, ‘অনেক অবিবাহিত মা জারজ সন্তানদের আমাদের কাছে বিক্রি করে যায়। ভালো দাম পায় বলে আজকাল আর কেউ গর্ভপাত ঘটায় না। দেহব্যবসার চেয়ে এই ব্যবসাটা ভালো।’ মানবিকতার চরম বিপর্যয়ের অস্থির চিত্র। গল্পের শেষের দিকে জানা যায়, বিশ্বের নব্বইভাগ মানুষ পশুর মতো খেটে মরছে আর দশ ভাগ মানুষ কেমন ভোগ করছে দেখেছিস? সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্র সব ব্যর্থ। ক্ষমতার রাজনীতিকে আমরা দোষ দিই, আসল অপরাধী হলো শিল্পপতিরা। না, অপরাধী আমরা, শালা মধ্যবিত্তরা।’ গল্পে লেখক হতাশা ব্যক্ত করেন, ‘সমাজ পরিবর্তন করা এখন শিল্পীদের কাজ না। শিল্পবিমুখ সমাজে সে সুযোগ আর নেই খেতে খেতে তারা তাকিয়ে দেখে সামনের টেবিলে দেশি বিদেশিরা মিলে মিটিং করছে। তাদের আলোচ্য বিষয় বস্তির মানবাধিকার নিয়ে। এ যেন শিয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দেওয়ার ব্যাপার। তথাকথিত সমাজকর্মীদের অসার কার্যকলাপের তীক্ষনভাবে নিন্দা করেছেন লেখক। -সঞ্জয় দেওয়ান।