প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
বই সমালোচনা
‘রবীন্দ্রনাথ ও চাঁদপুরের মানুষেরা’
সঞ্জয় দেওয়ান
বাঙালি শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব শঙ্খ ঘোষ ও সন্জীদা খাতুনকে উৎসর্গ করে সম্প্রতি প্রকাশিত তরুণ সাহিত্যিক মুহাম্মদ ফরিদ হাসানের ‘রবীন্দ্রনাথ ও চাঁদপুরের মানুষেরা’ গ্রন্থটি সৃজনশীল গবেষণাক্ষেত্রে এক অভিনব সংযোজন। রবীন্দ্রনাথের জীবনে চাঁদপুরের মা, মাটি ও জলের হাওয়া যে হিল্লোল তুলেছে তারই আখ্যান রচিত হয়েছে গ্রন্থটির পরতে পরতে। রবীন্দ্রনাথের জীবনের সঙ্গে চাঁদপুরের যে সকল কৃতী মানুষের নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, লেখক তারই সুললিত বয়ান করেছেন। বাঙালির বাতিঘর রবীন্দ্রনাথ কুমিল্লায় এসে পৌঁছেন ১৯২৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি । ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে তিনি আগরতলার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সেখানে চারদিন থাকার পর ২৬ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ত্যাগ করেন। রবীন্দ্রনাথ এদিনই ট্রেনযোগে চাঁদপুর এসে পৌঁছেন। দিনটি ছিল শুক্রবার। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী, কন্যা নন্দিনী, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালীমোহন ঘোষ ও মি. মরিস। শহরের বহু গণ্যমান্য লোক রবীন্দ্রনাথকে সাদরে গ্রহণ করেন। লেখক জানান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চাঁদপুর-আগমনের সংবাদটি ১৯২৬ সালের ২ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লেখক দুঃখের সাথে জানান, পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যে সকল বক্তব্য দিয়েছিলেন, তার সবক’টি সংরক্ষিত হলেও চাঁদপুরের বক্তব্যটি কোথাও অনুলিখন বা রক্ষিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ২৭ ফেব্রুয়ারি শনিবার সকালে চাঁদপুর থেকে স্টিমারযোগে নারায়ণগঞ্জ যান। চাঁদপুরে আসার পথে রবীন্দ্রনাথ ‘ফাগুনের নবীন আনন্দে’ গানটি রচনা করেন বলে জানা যায়। রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, শান্তিনিকেতনের শিক্ষক, সংগঠক কালীমোহন ঘোষ চাঁদপুরের বাজাপ্তির (অধুনা হাইমচর উপজেলার অন্তর্গত) কীর্তিমান পুরুষ। লেখকের ভাষায়, ‘১৯০৪ সালে কবির ‘স্বদেশি সমাজ’ প্রবন্ধটি পড়ে তিনি রবীন্দ্র-অনুরক্ত হয়ে পড়েন।’ রবীন্দ্রনাথ স্মৃতিচারণে বলেছেন,‘আমাদের স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্র হচ্ছে কৃষিপল্লীতে তার চর্চা আজ থেকেই শুরু করা চাই, তখন কিছুক্ষণের জন্যে কলম কানে গুঁজে এ কথা আমাকে বলতে হল-আচ্ছা, আমিই এ কাজে লাগব; এই সঙ্কল্পে সহায়তা করবার জন্যে সে দিন একটিমাত্র লোক পেয়েছিলুম, সে হচ্ছে কালীমোহন।’ লেখকের বয়ান, ‘কবি কালীমোহন ঘোষকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ডব্লিউ বি ইয়েটস, এজরা পাউন্ড, এইচ জি ওয়েলস, আর্নেস্ট রিস, ঈভলিন আন্ডারহিল, অ্যালিস মেনিল, রটেনস্টাইনের কাছে পাঠাতেন।’ রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য শান্তিদেব ঘোষ ও দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তাঁরই সুযোগ্য সন্তান। জীবিত অবস্থায় কালীমোহন ঘোষ ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে চিঠি আদান-প্রদানের ঘটনাও জানা যায়।
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ‘সওগাত’ প্রথম সংখ্যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়েছিলেন। লেখক জানান, ‘পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ সওগাতের জন্য ‘পথের সাথী’ নামে একটি কবিতা চিঠিসহ পাঠান। রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ ও কবিতা পাওয়া নাসিরউদ্দীনের জন্যে উৎসাহের ও সম্মানজনক ছিল।’ জাতীয় পণ্ডিত শান্তিদেব ঘোষ ছিলেন প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশারদ, লেখক, কণ্ঠশিল্পী, নৃত্যশিল্পী ও অভিনেতা। তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রথম একলা বসে গান শিখার সুযোগ পেয়েছিলেন। লেখক শান্তিদেবের ভাষায় জানান, ‘১৯৩৫ থেকে গুরুদেব অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হবার আগ পর্যন্ত একটানাভাবে তাঁর কাছে গান শিখেছি।’ শান্তিময় ঘোষকে শান্তিদেব ঘোষ নামকরণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলাদেশের প্রথম নারী চিত্রশিল্পী চিত্রনিভা চৌধুরীর নামকরণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তার আসল নাম ছিল নিভাননী। রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত তাঁর ছবি আঁকার খোঁজ নিতেন। রবীন্দ্রনাথ তাকে বলতেন, ‘তোমার শক্তি আছে, তুমি পারবে, আমি আশীর্বাদ করলাম।’ লেখক জানান, ‘তাঁর ছাত্র ছিলেন সুখময় মিত্র, নীহাররঞ্জন চৌধুরী, সুকৃতি চৌধুরী ও শঙ্খ চৌধুরীর মতো বরেণ্যরা’। চাঁদপুরের আল্পনাশিল্পী সুকুমারী দেবী কালীমোহন ঘোষের শ্যালিকা ছিলেন। লেখক জানান, ‘১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশে সুকুমারী দেবী শান্তিনিকেতনে কলাভবনের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আল্পনার কাজ শেখাতেন। বিনয় মুখোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম যাযাবর। তার সাথেও রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ছিল। লেখকের ভাষায়, ‘পরবর্তীকালে যাযাবর রবীন্দ্রনাথকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, কথা বলেছেন, সাংবাদিক হিসেবে তাঁর সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন।’ দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ রবীন্দ্রনাথের সরাসরি ছাত্র ছিলেন। তিনি বলতেন, ‘আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে এই পৃথিবীতে জন্মে তুমি কী পেলে? আমার উত্তর রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ।’ লেখকের বয়ান, ‘সাগরময় ঘোষ মনে করতেন, ঘুম থেকে উঠে দু ঘন্টা ধ্যানমগ্ন থেকে রবীন্দ্রনাথ যা চিন্তা/উপলব্ধি করতেন, তা-ই পরবর্তী চার ঘন্টায় কাগজে-কলমে প্রকাশ করতেন’। সাগরময় ঘোষের জবানীতে আমরা জানতে পারি, রবীন্দ্রনাথ ছাত্র-ছাত্রীদের অনুরোধ ফেলতেন না, শিক্ষার্থীদের শিশুসুলভ নানা আবদারও তিনি পূরণ করতেন।’ কবি অবণীমোহন চক্রবর্তীও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন। লেখক আমাদের বোলপুরের দুর্ভিক্ষে চাঁদপুরের মহিলাগণের বস্ত্র দানের কথা জানান। রবীন্দ্রনাথের সাথে চাঁদপুরের মানুষের সম্পর্কের যে রোমাঞ্চকর বয়ান লেখক করেছেন তা প্রকৃত পাঠকের তৃষ্ণা নিবারণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। প্রথম সংস্করণ সত্ত্বেও মুদ্রণ প্রমাদ চোখে পড়ার মতো নয়। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন আইয়ুব আল আমিন। প্রকাশক : চাঁদপুর পৌরসভা, চাঁদপুর। মূল্য ২৫০ টাকা।