মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মিশরে ঈদে মিলাদুন্নবীর ঐতিহ্য ‘আরুসাত-আল-মোলিদ’ : জন্মদিনের পুতুল
  •   'বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ অপরিহার্য'
  •   চাঁদপুরের ২৪তম পুলিশ সুপার মুহম্মদ আব্দুর রকিব
  •   ফরিদগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে শোভাযাত্রা
  •   ওয়াইফাই সংযোগ দিতে গিয়ে প্রাণ গেল যুবকের

প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

অনলাইন ডেস্ক
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

(ঊনবিংশ পর্ব)

মানুষের জীবনে মা এক মহা বটের মতো। একজন নারী যখন কিশোরী হতে মা হয়ে ধীরে ধীরে তাঁর সংসারের বিস্তৃতি ঘটায় তখন ঐ কিশোরীই হয়ে যায় একটা আস্ত বট। তখন কেবল তাঁর নাড়িজাত সন্তানেরা বটের ঝুরি হয়ে বৃক্ষ ও ভূমির সাথে সংলগ্ন থাকে তা নয়, সংসারের আরও অনেক কর্ম তাঁকে আশ্রয় করে ঘটে। আমার মায়ের জীবন যেন চলচ্চিত্রের মতো আমার সামনে একটার পর একটা দৃশ্যকে টেনে আনলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে জন্ম এবং শৈশব কাটানো মা আমার তাঁর বাপের ঘরে বড্ড আদুরে দুলালী হয়ে কাটিয়েছেন পুতুল খেলার শৈশব। যেদিন মায়ের বিয়ে হয়ে যায়, সেদিনও তাঁর সন্নিহিত ছোট ভাইয়ের সাথে খেলার পুতুল নিয়ে খুনসুঁটি ছিলো। সেই মা আমার একে একে ঊনসত্তর বছরে পা দিয়ে পাড়ি দিলেন বহু সংস্কৃতির দেশে, বেড়াতে নয়, আরোগ্যের অসম্ভব এক প্রচেষ্টায়। মায়ের কাছে কিছু কিছু সংস্কার ছিলো। তিনি জন্মবারে আমাদের কোনো ভাইবোনকে মাথার চুল কাটাতে দিতেন না। আবার মঙ্গলবারে নিজেও শুভ কোনো কাজে নামতেন না। মঙ্গলবারে আলোকনপ্রাপ্ত গৌতম বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। মহাপরিনির্বাণ হলো দেহান্তর ঘটা যাতে তিনি আর পুনর্জন্মে আসবেন না। কাজেই এদিন আমার মা পারতপক্ষে কোনো শুভ কাজের পরিকল্পনা রাখতেন না। এ কারণে তিনি পরেরদিন তাঁর চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেন। মায়ের সাথে আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম হলো বড়োমামা। বিভিন্ন দরকারি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে ঠিক হলো, আগে রেডিওথেরাপির মাধ্যমে ক্যান্সারের টিউমারটা ছোট ও সংকীর্ণ করে আনা হবে। অতঃপর অপারেশন বা শৈল্য চিকিৎসার মাধ্যমে তা অপারেশন করে মাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। দিল্লির ধরমশীলা হাসপাতালে মাকে ভর্তি করানো হলো। ষোলো তারিখ থেকে মায়ের রেডিওথেরাপি শুরু হলো। প্রথম দুটো রেডিওথেরাপি মায়ের শরীর কোনোমতে নিতে পারলো। পরেরটা নেওয়ার আগে মা দুর্বল হয়ে পড়লেন। মায়ের রক্তক্ষরণ শুরু হলো। দুদিন বন্ধ রাখা হলো রেডিওথেরাপি দেওয়া। মায়ের শরীরে রক্ত দেওয়া শুরু হলো। আকস্মিক মায়ের অবস্থার অবনতি হতে শুরু করলো। মাকে আইসিইউতে স্থানান্তরিত করা হলো। যারা রেডিওথেরাপি সম্পর্কে জানেন তারা বুঝেন, এটি কেবল ক্যান্সার কোষই নষ্ট করে না, বরং সুস্থ কোষও নষ্ট করে দেয়। ফলে, দৈহিক সামর্থ্য না থাকলে কারও পক্ষে রেডিওথেরাপি সহ্য করা কঠিন। হাসপাতালে যে ক’দিন মা সম্বিৎ নিয়ে ছিলেন, সে ক’দিন তিনি মুঠোফোনে আমার বড় দুভায়ের সাথে কথা বলেছেন। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মেঝদার সাথে মায়ের কথা হতো টুকটাক। মা তাকে অনেক উপদেশ-অনুরোধ করেছেন। কার জন্যে কী করতে হবে, কাকে কী বলতে হবে তা মা বলেছেন। আবুধাবী প্রবাসী বড়দার সাথেও মায়ের কথা হয়েছে। তবে তিনি বড়দাকে তেমন কোনো দায়িত্ব চাপিয়ে যাননি। ছাব্বিশ তারিখে বড়োমামার ফোন এলো। একটা সিদ্ধান্ত তিনি দিয়ে দিয়েছেন ডাক্তারদের কথার পরিপ্রেক্ষিতে। দিন দুয়েক লাইফ সাপোর্টে থাকার পর মায়ের শরীর হতে সব কলকব্জা সরিয়ে ফেলা হলো। মা নিঃশ্বাস হারা হয়ে পাড়ি জমালেন যেখান থেকে এসেছিলেন সেখানেই। মায়ের সাথে আমার-আমাদের চূড়ান্ত কথা হলো না। দুহাজার এগার সালের ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি আমার মা জীবিত থেকে হয়ে গেলেন চিরজীবী। সেদিন সকালে আমি সামনের গেস্টরুমে শুয়েছিলাম একা। সকালের আলো ফুটে তীব্র হতে শুরু করলে আমি জেগে উপুড় হয়ে বুকে বালিশ দিয়ে লিখছিলাম আমার বাবার জীবনের-সংগ্রামের গল্প। কে যেন বইয়ের কাঠের আলমারির গায়ে দুটো টোকা দিয়ে গেল। আমি সচকিত হয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে ভেবেছিলাম, এ বুঝি দুষ্টু টিকটিকি। কিন্তু সকাল আটটার পরে যখন খবর এলো তখন বুঝতে পারলাম, হয়তো আমার দেহান্তরিত চিরজীবী মা জানিয়ে গেছে, বিদায় নিয়ে গেছে তাঁর পথভোলা পুত্রের কাছে।

একদেশ হতে অন্যদেশে জীবন নিয়ে মানুষের আসা-যাওয়া সহজ হলেও জীবনহীন মানুষ সহজে আসতে-যেতে পারে না। আমার মায়ের ক্ষেত্রেও সেসব বিধিনিষেধ আরোপিত হতে শুরু করলো। কিন্তু ওইদেশে ছিলো আমার কাকাতো ভাই টুকুন, যার ভালো নাম পৃথ্বীশ। আরও ছিলো আমার পিসতুতো ভাইয়েরা। বড়োমামার শিক্ষার জোর ছিলো বিধায় সবাই মিলে প্রাণহীন মাকে কফিনে ভরে পাঠিয়ে দিলো বাংলাদেশে। আমার পিসি ও তাঁর পুত্রবধূরা মাকে স্নান করিয়ে সাদা চাদর গায়ে দেওয়ালেন এবং পুতঃপবিত্র করিয়ে পাঠিয়ে দিলেন তাঁর আজন্ম মাতৃভূমিতে। ফেব্রুয়ারির আটাশ তারিখ মা এলেন বাংলাদেশে। বিমানের কার্গো হতে অপরাহ্নে আমরা কয়েকজন মাকে নিয়ে এলাম লাশবাহী ফ্রিজিং যানে। সন্ধ্যার আঁধার গায়ে মেখে আমার অন্তরালোকনে আলোকিত মা এলেন তাঁর বাড়িতে, পায়ে হেঁটে নয়, কাঁধে চড়ে বাকশো বন্দি হয়ে। সময় গড়াতে চললো। নিজের ঘরে চির নিদ্রিত মা কফিনে বন্দি হয়ে থাকলেন কয়েক ঘন্টা। গরমে মরদেহ যাতে নষ্ট না হয় তাই কফিন খোলা হয়নি এবং রাত আটটার পর থেকে মাকে ফ্রিজিং গাড়িতে রেখে কাতালগঞ্জ নবপণ্ডিত বৌদ্ধ বিহারের আঙ্গিনায় রাখা হলো। প্রতীক্ষা তাঁর বড় ছেলে আসার। মেঝ জন আসতে পারেননি ভিসা জটিলতায়। রাতের বেলাতেই মাকে নিয়ে রওয়ানা দিলাম আমরা মায়ের বাবার বাড়ি চাঁদগাঁও বাহির সিগন্যাল বড়ুয়া পাড়ায়। রাতভর মা সেখানে ছিলেন। মায়ের মরদেহ রাখা হলো চাঁদগাঁও সার্বজনীন বৌদ্ধ বিহারে যার সিংহ-তোরণে শোভা পাচ্ছিলো সম্রাট অশোকের কীর্তির আদলে অশোকচক্রের এশীয় সিংহযুগল। এ বিহারে মায়েরও কিছু দান আছে উপাসিকা হিসেবে। মায়ের পিতৃভূমির এই বৌদ্ধ বিহারে মায়ের শবাধার রাখা হলো বারান্দায় আর সেই শবাধারকে সামনে রেখে রাতভর চললো বুদ্ধকীর্তন। মায়ের মা মানে আমার দিদিমা বেঁচে নেই। তিনি ঊনিশশো বিরানব্বই সালে প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু মায়ের কাকিমা ছিলেন। তিনি মায়ের সেজ কাকি। তাঁকে সবাই টটি’র মা বলে ডাকে। তিনি জেগে ছিলেন রাতভর আমাদের সাথে। জানি না বুদ্ধকীর্তনের সুর ও কাহিনী আমার মায়ের কানে পৌঁছেছিলো কি না। তবে বাপের বাড়ির শেষ আদরটুকুতে তারা মমতা ঢেলে দিয়েছিলো আমার মায়ের নিথর ও নিষ্প্রাণ দেহে। ভোরের অরুণ ফুটে উঠলো জবার মতো বিকশিত হয়ে। আমরা গাড়ি নিয়ে মায়ের সাথে ছুটলাম আমাদের গ্রামে যেখানে মা কূলবধূ হয়ে এসেছিলো বার্মা প্রত্যাগমন করে ঊনিশশো চৌষট্টি সালে। বৃটিশের তৈরি কালুঘাটের লাল সেতু পেরিয়ে আমরা চললাম। কর্ণফুলির বুক চিরে উত্তর হতে দক্ষিণে আমরা চললাম। বাবার শবাধার যেবার গ্রামে আনি সেবার মা ছিলেন আমাদের দলপতি। মায়ের নির্দেশ পেয়ে আমরা বাবাকে নিয়ে চলেছিলাম শেকড়ের টানে। আজ মায়ের শবাধারের শেকড়যাত্রায় দলপতি কেউ নেই। আমরা একই বৃন্তের দশটি কুসুম ম্রিয়মাণ। তার মধ্যে একটি দূরদেশে আর নয়টি প্রাণহীন হয়ে মাকে ঘিরে ছুটছি তাঁর অন্তিম যাত্রায়।

মা ছিলেন গ্রামের সবার কাছে প্রিয় এবং সমীহমাখা শ্রদ্ধার পাত্রী। তাঁর সফেদ চুলে সাদা কাশের অবয়বে মনে হতো ইন্দিরা গান্ধীর মতো দেখতে। তাঁর সুপরামর্শে উপকৃত হয়েছে গ্রামের অনেকেই। তাঁর দান ও কল্যাণ চেতনায় জীবনে স্বস্তি পেয়েছে অনেক নিকটজন। তাই তিনি যখন পৌঁছালেন গ্রামে, তখন হুমড়ি খেয়ে পড়লো গ্রামবাসী মাকে এক নজর দেখতে। অপরাহ্নের সূর্য তখনও দেদীপ্যমান। বাড়ির আঙিনায় বসেছে অনিত্য সভা। জীবন অনিত্য অসার। জীবনের তৃষ্ণা যে উপেক্ষা করতে পেরেছে, আসবকে যে ক্ষয় করতে পেরেছে সে-ই অর্জন করেছে নির্বাণ। অর্থাৎ পৃথিবীর এই অস্থায়ী নিবাসের আশ্রয় সে-ই ছিন্ন করতে পেরেছে একেবারেই, যে বা যারা পার্থিব আসবকে জলাঞ্জলি দিতে পেরেছে এবং উপেক্ষা করতে পেরেছে। অনিত্য সভাকে পার্থিব ভাষায় শোক সভা বলে অনেকেই। কিন্তু বুদ্ধের শিক্ষায় শোক নেই। তবে মৃত্যু মানুষের দুঃখমুক্তির সুযোগটা কেড়ে নেয় যদি কেউ দুর্লভ এই মানব জন্মে নিজেকে বোধপ্রাপ্ত না করতে পারে। সামাজিক লোকাচারে কিছু কিছু রীতি সমাজ পালন করে। মায়ের ক্ষেত্রেও তা করা হলো। যারা মায়ের কাছে সম্পর্কে মেয়ের মতো ছিলো, ভাসুরকন্যা, দেবর কন্যা, ভ্রাতুষ্পুত্রী; তারা সবাই একটা করে ছাতা নিয়ে এলো প্রয়াত মায়ের শবাধারের পাশে রাখতে। আর যারা মায়ের কাছে সম্পর্কে পুত্রবৎ ছিলো তাদের পত্নীরা নিজ নিজ সন্তানের হয়ে একটা করে লাঠি শবাধারের পাশে রাখতে লাগলো। কেননা, বলা হয়, মেয়ের নাতি মাথার ছাতি, পুতের নাতি হাতের লাঠি। এই লোকাচার মূলত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। যদিও শ্মশান অব্দি এগুলো কিছুই যায় না।

মায়ের শবাধার যখন খোলা হলো তখন দুপুর দুটো কি আড়াইটা। উঠোনে সূর্যরশ্মি বিলিয়ে চলছিলো হিরের দ্যুতি। হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো মায়ের মুখখানি জ্যোতির্ময়ী হয়ে উঠলো যেন। সূর্যালোকের সোনালি কিরণে মায়ের নিথর মুখখানি উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো তাঁর সুকর্মের প্রজ্ঞায়। গ্রামীণ মানুষের যা হয়, এক্ষেত্রেও তা হলো। কেউ কেউ মায়ের মুখে স্মিত হাসি অবলোকন করতে পেলো, কেউ কেউ মায়ের মুখে উজ্জ্বল অরুণশোভাকে আবিষ্কার করলো। শুধু আমার চোখে আমার মায়ের বেদনাহত মুখের অভিব্যক্তিটুকু জীবন পেয়েছে বলে ভ্রম হলো। রক্তহীন মুখের মানচিত্রে উৎকীর্ণ হয়ে আছে তাঁর বিগতকালের কৃত্রিম ধাতব মৌলের তেজষ্ক্রিয়তার বিকিরণ।

সায়াহ্নের আসন্ন আঁধারকে সাক্ষী মেনে পার্থিব-অপার্থিব জগতের পর্দা হটিয়ে মাকে তোলা হলো শ্মশানে, যেখানে মাত্র বছর পাঁচেক আগে বাবাকে আনা হয়েছিলো অন্তিম যাত্রায়। কাঠের শরীরে আগুনের ঝিলিক খেলে যায়। অস্থির গিঁটগুলো ছুটে যাওয়ার শব্দ আমাদের বুকের পাঁজরে এসে লাগে। তবু তা মেনে নিতে হয়। নচেৎ বিবিধ হিংস্র জীব ও জীবাণুর আক্রমণে নিথর দেহখানা নির্যাতিত হবে নিশ্চিত। অগ্নি একদিকে শুচি করে আর অন্যদিকে ভস্ম করে। সামাজিক কর্মে নিপুণ যুবকেরা দলবেঁধে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটুকু নিজেদের কাঁধে নিয়ে নেয়। সন্ধ্যা গড়িয়ে গভীর রাত হওয়ার আগেই আমার সোয়া পাঁচ ফুটের মা একমুঠো ভস্ম হয়ে গেলো জীবনের অনিত্যতায়।

বৌদ্ধদের নিয়ম আছে, মৃত্যুর সাতদিনের মধ্যে পারলৌকিক মঙ্গলার্থে ধর্মকর্ম সম্পন্ন করার। এটাকে ‘সাত তারিখ ক্রিয়া’ বলে। মায়ের জন্যে তাঁর শ্মশানারোহণের তৃতীয় দিনেই এই পুণ্যকর্ম তথা সংঘদান সম্পাদনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংঘদান মানে হলো ভিক্ষু সংঘকে আহারে আহ্বান করে দান-দক্ষিণা দেওয়া। তার আগের সন্ধ্যায় মায়ের পারলৌকিক মঙ্গল কামনায় আমি শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষিত নিলাম। মুণ্ডিত মস্তকে গেরুয়া বা কাষায় বস্ত্র ধারণ করে আমি প্রব্রজ্যিত হলাম। এ নিয়ে তৃতীয়বার আমি প্রব্রজ্যিত হলাম। প্রথমবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে, দ্বিতীয়বার পিতার মৃত্যুতে এবং তৃতীয়বার মায়ের মৃত্যুতে। প্রথমবার আমার শ্রামণ্যধর্মে নাম ছিল সুমনশ্রী। একবার ছিল তিষ্য। আর একবার কী ছিল মনে পড়ে না। শ্রামণ্যধর্মে দীক্ষিত থাকাকালীন আমার কেবল টেলিভিশন দেখতে মন চাইতো। কিন্তু শ্রমণদের দশশীলের একটি একটি হলো ‘নচ্চ গীত বাদিত বিসুখ দসসনা বেরমনি সিক্খাপদং সমাদিযামি।’ অর্থাৎ 'নৃত্য-গীত-বাদ্য বিসুখচিত্তে বা খারাপ মানসিকতা নিয়ে দর্শন করবো না; এই শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।' তাই সঙ্গত কারণেই নিজেকে রোধ করতে হয়েছে। তবে এসময়ে কিছু বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠেরও সুযোগ হয়েছে। সাতদিন গেরুয়া পরিধান করে থাকার কথা থাকলেও তিনদিন ছিলাম। কারণ আমি যেহেতু প্রথমবার সাতদিন থাকার শিক্ষা সমাপন করেছি, তাই পরের বারে আমার জন্যে এই নিয়ম শিথিল ছিলো।

মাকে বিদায় জানিয়ে আবার আমরা যে যার জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পথে আসতে আসতে চিন্তা করলাম, আমার কাছে মায়ের কী আছে। তাঁর ব্যবহারে চশমা, হাতের আটপৌরে একজোড়া সাদামাটা চুড়ি, একটা পরিধেয়, সাদা ব্লাউজ ব্যাগে ভরে আমি ট্রেনে চেপে ফিরতে লাগলাম আমার কর্মক্ষেত্রে। আসতে আসতে মনে ভেসে উঠছিলো মায়ের সাথে আমার আচার-আচরণ। আমার বড় ছেলে প্রত্ন স্কুলে স্পোর্টসে দৌড়ে দ্বিতীয় হয়েছিলো। নাতির মুখে তা জেনে মা বলেছিলো, ‘বাবা তো প্রথম হতো।’ ভাবলাম, মা তাঁর মশাল বাহককে কী সুন্দর করেই না প্রণোদিত করেছিলেন! আওয়াজ তুলে মেঘনা চলেছে মেঘনার দিকে আর আমার দুচোখে স্মৃতির মেঘনা ছুটেছে শোকভার হাল্কা করতে করতে। আমার মা এক অনন্য বোধিবৃক্ষ আমাদের কাছে। আমার মায়ের প্রজ্ঞাতেই আমাদের চেতনায় উপ্ত হয়েছিল জগৎকল্যাণের বীজ। মা এখনও মাঝে মাঝে স্বপ্নে আসেন। মা এখনও স্মৃতিতে জেঁকে বসেন। মা এখনও সাগরিকা ট্রেন হয়ে চট্টগ্রাম হতে চাঁদপুরে আসেন দুপুরে, আমার কর্মব্যস্ত শহরে, আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়