মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মিশরে ঈদে মিলাদুন্নবীর ঐতিহ্য ‘আরুসাত-আল-মোলিদ’ : জন্মদিনের পুতুল
  •   'বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ অপরিহার্য'
  •   চাঁদপুরের ২৪তম পুলিশ সুপার মুহম্মদ আব্দুর রকিব
  •   ফরিদগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে শোভাযাত্রা
  •   ওয়াইফাই সংযোগ দিতে গিয়ে প্রাণ গেল যুবকের

প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

এই জনমে

মিজানুর রহমান রানা
এই জনমে

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বারো.

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১।

হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছে। এতোদিন যারা যেখানে পালিয়ে ছিলো পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের ভয়ে আজ তারা বেরিয়ে এসেছে। জানা গেছে দেশ স্বাধীন ও শত্রুমুক্ত হয়েছে। হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে যৌথবাহিনীর কাছে।

টেনে-হিঁছড়ে বাড়ি থেকে ধরে এনে মেহের জল্লাদ ও তার সাগরেদ হেকমতকে কুকুরের মতো পেটাচ্ছে একদল মানুষ। দুরন্ত মার খেতে খেতে সবার পায়ে ধরছে মেহের জল্লাদ। কাতর ভঙ্গিতে বলছে, ‘ভাইরা, দয়া করেন, আমাদেরকে ছেড়ে দিন। আমাদেরকে আর মারবেন না।’

কে শোনে কার কথা। দেশ তো স্বাধীন হয়ে গেছে। এই স্বাধীন দেশে এখন আর রাজাকারদের ঠাঁই নেই। স্বাধীনতার আগে তারা যা করছে, আজ সমবেত জনতা তার প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বে।

দুজনকে পিটাতে পিটাতে আধামরা করে ফেললো জনতা। এরপর মেহের জল্লাদ ও হেকমতের জামাকাপড় খুলে ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কেউ কেউ তাতে লবণ আর মরিচের গুঁড়া লাগিয়ে দিলো।

এ সময় মেহের ভাবতে লাগলো, সেও তো এমনিভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে লবণ আর মরিচের গুঁড়া লাগিয়ে দিয়ে নির্যাতন শেষে হত্যা করেছিলো অনেক মানুষকে। তারপর এই নদীতেই তাদের লাশগুলো ফেলে দিয়েছিলো। আজ মানুষজন তাকেই একই কায়দায় প্রতিশোধ নিচ্ছে।

আর সহ্য করতে পারলো না তারা। জনতার ফাঁক গলে কোনো মতে পাগলের মতো দৌড়াতে দৌড়াতে পাশের নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে তলিয়ে গেলো দুজন।

উত্তেজিত জনতা পানিতে নেমে অনেক খোঁজাখুঁজি করলো। কিন্তু মেহের জল্লাদ ও তার অনুচর হেকমতকে আর খুঁজে পেলো না।

এক সময় নদীটার অপর পাড়ে ভুস করে দুজন মানুষ পানির নিচ থেকে ভেসে উঠলো। একজন মেহের জল্লাদ আর অপরজন তার অনুচর হেকমত। সারা শরীরে রক্ত-যখম নিয়ে তারা অতিকষ্টে নদীর কিনারায় উঠলো। তারপর ঝাউগাছ লতাপাতার আড়ালে বসলো।

‘ওস্তাদ, জানে বাঁইচা গেছি। কিন্তু শরীরে আগুন জ্বলছে।’ বললো হেকমত।

‘এই আগুন একদিন সারাদেশে ছড়িয়ে দিবো আমরা। রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে প্রতিটি বাড়িতে-গাড়িতে দাউ দাউ করে জ্বলবে আগুন।’ উত্তর দিলো মেহের জল্লাদ। ‘আমরাই এই দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবো। চালের দাম বাড়াবো, ডালের দাম বাড়াবো, তেলের দাম বাড়াবো। তারপর মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলবো। যেভাবে আমাদের গায়ে ব্লেডের খোঁচা দিয়ে লবণ মরিচের গুঁড়া মাখিয়ে দিয়েছে, ঠিক তেমনি এই দেশের প্রতিটা মানুষকে আমরা তিলে তিলে মারবো। আমরাই ফায়দা লুটবো। তেল, লবণ, মরিচ, পেঁয়াজ, আলুর দাম বাড়িয়ে দিবো। আমাদেরকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। দেশে অসন্তোষ সৃষ্টি হবে। তারপর যা করার জনগণই করবে।’

সারাদেহে ব্লেডের আঁচড় আর লবণ মরিচের গুঁড়ায় অসহ্য ব্যথা যন্ত্রণা নিয়ে বলতে লাগলো মেহের জল্লাদ, ‘দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এরা স্বাধীনতার সুফল পাবে না। এদেরকে আজীবন আমাদের মতো মেহের জল্লাদরাই শোষণ ও শাসন করবে। আর বাঙালিকে এমনিভাবে দমিয়ে রাখবো, স্বাধীন হয়েও এরা নিজ দেশে পরাধীন হয়েই থাকবে। আমরা এই দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের এমন অবস্থায় ফেলে দিবো, যাতে তারা না খেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরে। আর শাসকদেরকে গুপ্তহত্যা করবো, বিভিন্ন মত ও পথের সৃষ্টি করে ফেতনা-ফ্যাসাদ লাগিয়ে দিবো। যাতে দেশের শাসক ও জনগণ সারাক্ষণ টেনশনের মধ্যেই থাকে। দেশের উন্নয়ন তো দূরের কথা, এরা সারাক্ষণ কাড়াকাড়ি, মারামারির মধ্যেই থাকবে। এদিকে আমরা কালোবাজারি করে, সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটবো।’

কথাগুলো বলে মেহের মৃদু হাসলো। কারণ জোরে হাসলে ওই পাড়ের জনতা তার হাসি শুনতে পাবে।

হেকমত প্রশ্ন করলো, ‘ওস্তাদ, এটা কীভাবে সম্ভব? আমাদেরকে তো কিছুদিন পরই পুলিশ খুঁজে খুঁজে বের করবে, তারপর কারাগারে ঢোকাবে। জেল হবে, ফাঁসি হবে, তখন কী করবেন?’

আবারও হাসলো মেহের। তারপর বললো, ‘জেল-ফাঁসি হবে নারে বোকা! যদি গ্রেফতার করে তবে কারাগার আমাদেরকে আটকে রাখতে পারবে না। কারণ আমাদের দলের অনেকেই আছে এই দেশে। পাকিস্তানেও আমাদের লোক আছে, আমরা ক’দিনই আর জেলে থাকবো। জেল থেকে বের হলেই তারপর শুরু হবে খেলা। আসল খেলা। তুই সেটা বুঝবি না।’

না বোঝার মতো ভান করে মাথা দোলালো হেকমত। এরপর প্রশ্ন করলো, ‘এটা কি অন্যায় নয়? যুদ্ধের সময় বুঝিয়েছিলেন আমরা দেশের পক্ষে যুদ্ধ করছি, আর দেশের বিপক্ষে মুক্তিযোদ্ধারা কাজ করেছে তাই, তাদের মারছি। গণিমতের জন্যে মানুষের জানমালের উপর হামলা করছি, নারীদের ভোগের সামগ্রী বানিয়েছি। কিন্তু দেশ তো স্বাধীন হয়ে গেছে। এখন?’

আবারও মৃদু হাসলো মেহের জল্লাদ, সেই হাসিতে হেকমত দেখলো, আস্ত একটা শয়তান তার সামনে বসে বসে শয়তানি হাসি হাসছে।

হেকমত মনে মনে বললো, ‘হে আল্লাহ। আমাদের দেশটাকে এর মতো জল্লাদদের হাত থেকে রক্ষা করো মাবুদ।’

হেকমত বুঝতে পারে বাঙালি স্বাধীন হয়েছে, তবে স্বাধীনতা পায়নি। মেহের জল্লাদের মতো সুচতুর স্বার্থবাজে সমাজ ভরে আছে। শুধু সময় পরিবর্তন হবে, কিন্তু মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে না। ভাগ্য পরিবর্তন হতে নিজেদেরকে পরিবর্তন করতে হবে। নিজেদেরকে পরিবর্তন এতো সোজা না।

এ সময় আবারও বাতাসের শোঁ শোঁ ধ্বনি শোনা গেলো নদীর তীরে। বাতাসে দোলা দিলো নদীর পাড়ের সোনালু ফুলের গাছগুলো। গাছের পাতায় পাতায় বেজে উঠলো সেই ধ্বনি। ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকো...।’ (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়