রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   বয়ারচর সংযোগ ব্রিজ ও বেড়িবাঁধ রক্ষায় এলাকাবাসীর মানববন্ধন
  •   জার্মানিতে কঠিন হচ্ছে রাজনৈতিক আশ্রয়
  •   ইতালির দ্বীপে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ ২১
  •   অভিভাবকহীনতায় দিশেহারা চাঁদপুরের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা
  •   আহতদের দেখতে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে প্রধান উপদেষ্টা

প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৪, ০০:০০

খণ্ড খণ্ডে অখণ্ড জীবন

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
খণ্ড খণ্ডে অখণ্ড জীবন

(সপ্তদশ খণ্ড)

অতি শৈশব থেকেই নিজের চিন্তা ও নিজের মত প্রকাশের স্বাধীন প্রয়াস আমার মধ্যে উঁকি মেরে উঠে। তা আরও উস্কে দেয় খেলাঘর। উপস্থিত বক্তৃতা ও নির্ধারিত বক্তব্য দিতে দিতে একসময় মুখে যুক্তি ও কথার ফুলঝুরি ফুটতে থাকে। তৃতীয় শ্রেণিতে এসে আমার বিতর্কে হাতেখড়ি হয়। অতঃপর সেটা বড় মঞ্চে আমাকে পৌঁছে দেয় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়। সেন্ট প্ল্যাসিডস্ স্কুলের স্কুল ডে ছিলো অক্টোবর মাসে। সে উপলক্ষে আমাদের স্কুলে একটা বিতর্ক হবে নবম শ্রেণি বনাম দশম শ্রেণি। আমি নবম শ্রেণির দলনেতা। শ্রদ্ধেয় বাবুল আইচ স্যারের সিদ্ধান্তে। যদিও ষষ্ঠ শ্রেণিতেই তখন পড়ি। তারপরে তো মৌসুমী শিশু প্রতিযোগিতায় এবং শিক্ষা সপ্তাহ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করি। কাজেই বিতর্ক আমার শৈশব হতেই রক্তে প্রলয় দোলা আনতো বলেই কোথাও বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন দেখলে আর স্থির থাকতে পারতাম না। চাঁদপুরে বিতর্ক উৎসবের ক্ষেত্রেও তাই। শাহেদ রিয়াজ আমার এই কথা কাজী শাহাদাতকে জানালেন। শাহেদ রিয়াজ হলেন চাঁদপুরে সূর্যের হাসি ক্লিনিকের ম্যানেজার। বন্ধুতুল্য রিয়াজ ভাইয়ের মারফতে শাহাদাত ভাই খোঁজ পেলেন তাঁর এক নতুন শক্তির উৎসের। দুহাজার নয় সালে বিশ্ব হার্ট দিবসে চাঁদপুর হার্ট ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে চাঁদপুর রোটারী ভবনে আয়োজিত হয় দিবস উদযাপনী অনুষ্ঠান। সেইখানে প্রথম আমি জনাব কাজী শাহাদাতকে সরাসরি দেখি। তখন তাঁর মাথার চুলে-গোঁফে তিনি মেহেদি ব্যবহার করতেন। তাঁর সেদিনের বক্তব্যের সূচনা ছিলো শয়নকক্ষের বৈদ্যুতিক পাখার স্থানচ্যুতি ও পতন। তিনি পাখাটি তাঁর নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন উপহার হিসেবে মমতার ফল্গুধারায়। পাখার পতনে তিনি কোনো প্রকার আহত হননি কিন্তু হকচকিয়ে গেছেন। বেশ ভালোই তাৎক্ষণিক বক্তব্য রাখলেন। বক্তব্য শুনে বুঝলাম, মানুষকে বিরক্ত না করে তিনি অবিরাম বক্তব্য দিতে সক্ষম। তাঁর বক্তব্যের উল্লেখযোগ্য দিক হলো কিছু কিছু স্থানিক ও কালিক ইতিহাস স্মৃতিতে জমা আছে। তিনি সেগুলো অবলীলায় প্রাসঙ্গিক করে তুলে বলতে পারেন।

তৎকালীন চাঁদপুর হার্ট ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কার্ডিওলজিস্ট ডা. বিশ্বনাথ পোদ্দার। সভাপতি ছিলেন বর্তমানে প্রয়াত ডা. এ কিউ রুহুল আমিন। সেদিনের অনুষ্ঠানের স্পন্সর ছিলেন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের কার্ডিয়াক টিম। মনে পড়ে একটা মন্তব্য সবার মুখে মুখে ছিলো। এতোক্ষণ হার্ট ডিজিজ হতে মুক্ত থাকার জন্যে লাইফস্টাইল মডিফিকেশনের কথা বলা হলেও নাস্তার সময় দেখা গেল সেই জাংক ফুড, যা হার্টের সুস্থতার জন্যে কোনোভাবেই উপযোগী নয়। ঐ অনুষ্ঠান শেষে সিদ্ধান্ত হয়, হার্ট ফাউন্ডেশন, চাঁদপুরে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তি করা হবে। তবে পরে তা আর করা হয়নি। বর্তমানে এ সংগঠনটি মহানিদ্রিত অবস্থায় আছে।

বিশ্ব হার্ট দিবস মূলত ঊনিশশো নিরানব্বই সালে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের শেষ রোববার এই দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রথম দুহাজার সালে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে বিশ্ব হার্ট ফেডারেশন যৌথ উদ্যোগে মানুষের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ দিবসটি উদ্ যাপন করে।

দুহাজার নয় সালের দিকে বাসায় দৈনিক প্রথম আলো এবং দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ রাখি। সেই সুবাদে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের সুবাদে জানতে পারলাম, দ্য ডেইলি স্টার ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের যৌথ আয়োজনে সেলিব্রেটিং লাইফ শিরোনামে মা-কে নিয়ে গানের লিরিক্স প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। সে বছরের আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য ছিলো পিঙ্ক রিবন তথা ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতা। প্রতিযোগিতায় ফটোগ্রাফি এবং আঁকা ছবির ইভেন্ট ছিলো। আমি বাংলা লিরিক্স প্রতিযোগিতায় অংশ নিলাম। চিন্তা করলাম, ষোলো লাইনের মধ্যে চার তুকের একটা গান লিখবো। অনেকেই গানের কবিতাটি ভালো ভাবে লেখেন না। তাই আমার মনোযোগ ছিলো একটা মানসম্পন্ন সমিল গানের কবিতা লিখবো। ঘরের ভেতর পত্নীর বিভিন্ন টুকটাক ফরমায়েশ খাটতে খাটতে এক টুকরো পরিত্যক্ত কাগজে পেন্সিলে একটা গানের কবিতার কাঠামো দাঁড় করালাম। যেহেতু ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতা, তাই গানের একটা করুণ আখ্যান তৈরি করলাম। একজন শিশু বড় হয়ে তার শৈশবে ক্যান্সারে আক্রান্তে হারিয়ে যাওয়া মায়ের স্মৃতিতে ভারাতুর হয়ে ভাবছে। আজ একাকী অন্ধকারের রাতে আকাশভরা তারার মেলায় সে তার মাকে খুঁজে বেড়ায়, যিনি জ্যোৎস্নার রূপোলি জরির জামা গায়ে লুকিয়ে আছেন হয়তো কোনো এক তারার আড়ালে। বাতিল কাগজের টুকরোয় পেন্সিলে লেখা গানটি পকেটে নিয়ে চলে গেলাম চেম্বারে। তারপর রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে ঘষা মাজা করে একটা নির্মেদ গানের কবিতা তৈরি করলাম। পাঠিয়ে দিলাম অতঃপর আয়োজকের ঠিকানায়। তারপর মাসখানেক গত হলো। নভেম্বরের শেষ দিকে মনে হয় ফোন পেলাম, আমি দশজন বিজয়ীর একজন। তবে কততম হলাম তা জানালো না। কুরিয়ারে আমন্ত্রণ কার্ড পেলাম। নির্দিষ্ট দিনে আমার চেম্বার সহকারী কামালকে নিয়ে চলে গেলাম বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। যেহেতু মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান মাননীয় প্রধান অতিথি, তাই নিরাপত্তা কর্মীরা আমাদের কাছ থেকে ফোন-ব্যাগ সংগ্রহ করে রেখে দিলো। ফলে আমাদের ব্যক্তিগত ক্যামেরায় আর ছবি তোলা গেলো না। ছবির জন্যে ভরসা হলো অ্যাসাইন্ড ক্যামেরা সাংবাদিকেরা।

মঞ্চে মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং জনাব মাহফুজ আনাম বসলেন। একে একে আমাদের ডাক পড়লো। শুনলাম, আমার গানের বাণী বাংলা বিভাগে চতুর্থ হয়েছে। একটা সনদ, একটা সুন্দর ভাস্কর্যের মিনিয়েচার এবং নগদ তিন হাজার টাকা পেলাম। মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান আমাকে নিজমুখে কনগ্রাচুলেশনস্ জানিয়ে অভিনন্দিত করলেন। তাঁর সেই অভিনন্দনের মোলায়েম শব্দ এখনো কানে বাজে।

দুহাজার নয়ের ডিসেম্বরে আবারও দৈনিক প্রথম আলোর একটি বিজ্ঞাপন আমার পত্নী সংরক্ষণ করে আমাকে দেয়। বিজ্ঞাপনটি ছিলো আজাদ প্রোডাক্টসের আয়োজনে বিশ্ব মা দিবস উদযাপন উপলক্ষে রত্নগর্ভা মায়েদের সম্মাননা বিষয়ক। তারা আয়োজক হিসেবে নির্দিষ্ট ফরম্যাটে আবেদনপত্র পূরণ করে পাঠাতে বলেছে। এতে মায়েদের সম্পর্কে বিবিধ প্রয়োজনীয় তথ্য চাওয়া হয়েছে। পত্রিকাটি আমি পড়ে ফেলে রাখলাম এক জায়গায়। কিন্তু প্রতিদিন আমার গৃহনেত্রী আমাকে তাগাদা দিতো, যাতে মায়ের জন্যে ফরম পূরণ করে পাঠাই। বললাম, আরও কতো কতো খ্যাতিমান মায়েরা আছেন! সে বলতো, আমার মনে হয় মা পাবেন। তুমি পাঠাও। ব্যস্। আমি নিমরাজি হয়ে ফরম পূরণ করতে থাকি। স্বপত্নী নিজে তার শাশুড়ি মাকে ফোন করে করে আমার ভাইবোন সবার জন্ম তারিখ ও শিক্ষাগত যোগ্যতার বিস্তারিত সংগ্রহ করে। আবেদনপত্রে একটা অনুচ্ছেদ লিখতে হতো, কেন আপনার মাকে রত্নগর্ভা মা সম্মাননা দেওয়া হবে। খুব সাবধানে অনুচ্ছেদটা লিখলাম, যাতে কোনো হাল্কা কথা না আসে। ডাকযোগে ঠিকানা বরাবর পাঠিয়ে মাকে জানিয়ে রাখলাম, মা দিবস উপলক্ষে সম্মাননা দিতে তোমার কাছে ফোন আসতে পারে। একটু সাবধানে থেকো যাতে ফোনটা ধরতে পারো। দুহাজার দশের জানুয়ারিতে পাঠানোর সর্বশেষ তারিখ ছিলো। এরপর মাসতিনেক প্রায় গত হলো। আমি বুঝে নিলাম, আর খবর হবে না। এপ্রিল মাসে একদিন মা ফোন করে জানালো, তিনি সিএনজি ট্যাক্সিতে করে গ্রামের বাড়ি থেকে শহরের বাসায় আসছিলেন। পথিমধ্যে তাঁকে ফোন দেওয়া হয়েছিলো। তিনি কিছু বুঝলেন আর কিছু গাড়ির আওয়াজে মিলিয়ে গেলো। তারপরও বুঝলেন, তাঁকে বিশ্ব মা দিবসের সম্মাননার জন্যে মনোনীত করা হয়েছে। যাই হোক, বুকভরা সুখ এসে ভরিয়ে দিলো। মা তাঁর একটা সম্মাননা পাবেন, স্বীকৃতি পাবেন; এই ভেবে মলয় মধুর হাওয়ায় ভেসে গেলাম। দুহাজার দশ সালের মে মাসের প্রথম রোববার হোটেল শেরাটনের বল রুমে মায়েদের সম্মাননা জানানো হবে। ঐদিন আজাদ সাহেব আরও একটা ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে নিহত সেনা সদস্যদের মায়েদের দশজনকে বিশেষ সম্মাননা জানানো হলো। আর দশজন মাকে সে বছরের রত্নগর্ভা মা সম্মাননায় ভূষিত করা হলো। আমার মা-ও এঁদের মধ্যে ছিলেন অন্যতমা। প্রধান অতিথি ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জনাব আবুল কালাম আজাদ। প্রধান বক্তা ছিলেন তৎকালীন এফবিসিসিআই সভাপতি জনাব আনিসুল হক। আরও ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক। তাঁকে সেদিন বাবা হিসেবে সম্মাননা দেওয়া হয়েছিলো। অনুষ্ঠানে আরও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বরেণ্য নাট্য ব্যক্তিত্ব জনাব রামেন্দু মজুমদার। প্রতিজন মাকে সম্মাননা জানানোর আগে স্ক্রিনে তাঁর সন্তান ও তাঁর বিষয়ে একটা ভিডিওচিত্র উপস্থাপন করা হলো সাথে নেপথ্যে বর্ণনাসহ। মায়েদের মধ্য থেকে চার-পাঁচজনকে বলতে দেওয়া হলো। কী বলবেন তাৎক্ষণিক তা বুঝে উঠতে না পেরে মা আমার পিঠের পেছনে মুখ লুকোলেন আড়ষ্টতায়। মাকে নিয়ে রামেন্দু মজুমদারসহ একটা ছবি উঠালাম।

দুহাজার দশের এপ্রিলে আমাদের চাঁদপুর বিএমএ'র অভিষেক অনুষ্ঠান হয়। ভেন্যু ছিলো চাঁদপুর ক্লাব। আমি প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হিসেবে ম্যাগাজিন প্রকাশের দায়িত্ব পাই। পাশাপাশি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করি। এ প্রথম আমাকে সঞ্চালক হিসেবে চাঁদপুরের মানুষ জানতে পেলো। যদিও আমি ছোটবেলা থেকে অর্থাৎ তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন উপস্থাপনা করে আসছি, তবু চাঁদপুরে থিতু হওয়ার পর আমি কখনও কোন অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করিনি। অনুষ্ঠান চলাকালীনই সহিদউল্লাহ ভাই খুব প্রশংসা করলেন। ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাথে আসা আমার সহপাঠী বন্ধুরা তো জানতো আগে থেকেই। টান টান একটা সফল অনুষ্ঠান হলো এবং আমাদের নতুন কমিটির অভিষেক হলো।

দুহাজার দশ সালের পঁচিশে এপ্রিল চাঁদপুরে দেড়শ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলো। এ সময় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসে এর উদ্বোধন করলেন। গুণরাজদীর এ অনুষ্ঠানে বিএমএ'র প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হিসেবে আমিও আমন্ত্রিত হলাম। তখন আমার বড় ছেলে প্রত্ন পীযূষ সবে মাত্র তিন বছর পার হয়েছে। কথা পরিষ্কার বলতে পারে। আমি যে শেখ হাসিনার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাবো তা সে জানতো। যখন সভা শেষে বাসায় আসি সে তখন আমাকে জিজ্ঞেস করলো, শেখ হাসিনা তোমাকে কী দিয়েছে? তখন আমার হাতে একটা লাঞ্চ বক্স ছিলো, যাতে ক্যাফে কর্নারের বিরিয়ানি ছিলো। ওটা তৎক্ষণাৎ তার হাতে দিয়ে বললাম, শেখ হাসিনা তোমার এই ভাত পাঠিয়েছেন। সেই থেকে আমার ছেলেটি অনেকদিন বিরিয়ানিকে শেখ হাসিনার ভাত হিসেবে জানতো। তার মাকে এরপর থেকেই সে মাঝে মাঝে বলতো, মা আমাকে শেখ হাসিনার ভাত দাও। তার মা-ও বুঝে নিতো, ছেলে বিরিয়ানি খেতে চাইছে। বিরিয়ানি খেতে খেতে প্রত্ন হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, শেখ হাসিনাকে আমাদের বাসায় আনলে না কেন? তাকে বললাম, তিনি আসলে তুমি কী খেতে দিতে? কেন, ডাব খেতে দিতাম! তার উত্তর শুনে আমি কিছুটা অবাক হলাম। বিকেল চারটায় আউটার স্টেডিয়ামে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সভা ছিলো। প্রত্ন বললো, আমি শেখ হাসিনাকে দেখতে চাই। অগত্যা তাকে কাঁধে নিয়ে আউটার স্টেডিয়ামে গেলাম। মঞ্চ উঁচু করে বানানো ছিলো বলে আমরা বাপে-পুতে শেখ হাসিনাকে ভালো ভাবেই দেখলাম। আমাদের এই ঘটনা ছড়া আকারে লিপিবদ্ধ আছে শিশুদের জন্যে লেখা ছড়া গ্রন্থ ‘তারা মাসী চাঁদ মামা’ বইয়ে।

দুহাজার দশের জুন আমাকে আরও একটা আনন্দে সিক্ত করে তুললো। পনর জুনে চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে সন্ধ্যায় জন্ম হলো আমাদের প্রখরের, যে এসে প্রত্নকে বড়ো করে দিলো। প্রিয়দর্শিনী শ্রদ্ধেয় মিনু রানি সরকারের হাতে সিজার অপারেশনের মাধ্যমে প্রখর এলো পৃথিবীতে। প্রখরের জন্মের আগে, যখন সে তার মায়ের গর্ভে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো পৃথিবীতে আসার, তখন একটা শ্বেতশুভ্র লক্ষ্মী প্যাঁচা আমাদের পুবের বারান্দায় রেলিংয়ে কিছুদিনের জন্যে অধিষ্ঠান করেছিলো। আমরা গৃহবাসী তিনজনেই তখন তাকে পরিচর্যা করতাম। নারকেল গাছের ডালে-পাতায় দিনভর ঘুমোতো আর মাঝে মাঝে বারান্দায় ভেতরে আসতো গ্রিল গলিয়ে। অবশ্য প্রখর ভূমিষ্ঠ হওয়ার কয়েকদিন আগে আর তাকে দেখা যেতো না। প্রখরের জন্মকালীন আমাদের হাসপাতাল নিবাসের সময় সিদুল বাবু আমাদের জন্যে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন। রামকৃষ্ণ আশ্রম থেকে দুবেলা খাবার এনে দিতেন। বাসা থেকে খাবার নিয়ে যেতেন হাসপাতালে। প্রখরকে বাসায় আনা হলো তিনদিন পরে। তারপর শুরু হলো আমাদের ব্যস্ত সময়। দোলনায় ঠেলে ঠেলে প্রখরকে গান গেয়ে ঘুম পাড়ায় তার খুদে বড় ভাই। এই ফাঁকে তাদের মা রাঁধে-বাড়ে। আষাঢ়ের প্রথম দিনে প্রখরের ধরায় আগমন আমাদের আনন্দের বানে ভাসিয়ে দিলো। এই ফাঁকে টুকটুক করে আমার ইভ টিজিং বিরোধী লেখা কিছু কবিতা জমা হয়ে গেলো। তখন দেশজুড়ে ইভ টিজিং হয়ে উঠেছিলো রীতিমতো নাভিশ্বাস। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এ বিষয়ে একটা কবিতাপত্র বের করবো। কবিতাপত্রের নাম দিলাম 'আমার মায়ের সুচিকিৎসা চাই।' বিজয় মেলায় ষোল ডিসেম্বরে আমি এই কবিতাপত্রের মোড়ক উন্মোচন করি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব প্রিয়তোষ সাহার হাত দিয়ে এই কবিতাপত্রের মোড়ক উন্মোচিত হয়। এই মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যানার তৈরিতে সহযোগিতা করেন জনাব আবদুল আউয়াল রুবেল। তিনি কুমিল্লা থেকে ব্যানারটি আমাকে করিয়ে দেন। ডা. দেলোয়ার হোসেন লিটন ভূঁইয়া ভাইকে প্রকাশক করে কবিতাপত্রটি চট্টগ্রামের পরিচয় প্রিন্টার্স থেকে বের হয়। পরিচয় প্রিন্টার্সের মালিক ছিলো আমার গ্রামের ভাতিজা সুমন। তবে তার কাজটি আমার মন ভরাতে পারেনি। কবিতাপত্র কী তা বুঝাতেই আমাকে গলদঘর্ম হতে হয়েছে। অথচ এই কবিতাপত্রের কবিতাগুলো ছিলো সমিল স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা, শুধু শেষ পৃষ্ঠার নাম কবিতাটি ছিলো গদ্যছন্দ বা মুক্তছন্দে লেখা। শেষ কবিতাটি ছিলো পৃথিবীকে নিয়ে যে কি না আমাদের অত্যাচারে অসুস্থ হয়ে পড়েছে এবং তার প্রভাব বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও হিমালয়ের বরফ গলার মধ্য দিয়ে প্রতিভাত হয়ে উঠছিলো। ইভটিজিং বিরোধী বাকি কবিতাগুলোতে বিভিন্নভাবে নারীর প্রতি সহিংসতাকে প্রতিরোধের আহ্বান জানানো হয়েছে। কবিতাপত্রটির মূল্য ছিল ষাট টাকা মাত্র। উল্লেখ্য, আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তোমার নিবীতে অন্য কেউ'-এর শুভেচ্ছা মূল্যও ছিল ষাট টাকা। এই কবিতাপত্রটির বেশকিছু কপি বিনামূল্যে সৌজন্য সংখ্যা হিসেবে বিতরণ করতে হয়েছিল এবং অবশিষ্ট কপিগুলো অপসোনিন ফার্মাসিউটিক্যালসের এরিয়া ম্যানেজার অনুপদার বদৌলতে খুব দ্রুতই বিক্রি হয়ে গেলো। এই কবিতাপত্রের ফলস্বরূপ চাঁদপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব প্রিয়তোষ সাহা আমার কাছে একটা ইভটিজিং বিরোধী পথনাটক চাইলেন। আমি একটা পথনাটক তাঁকে লিখে দিলাম। নাটকের নাম ‘ফিরিয়ে দাও ইভের হাসি’। তবে তিনি বদলি হওয়ার কারণে আর নাটকটি নিয়ে কাজ করতে পারেননি।

যেদিন প্রিয়তোষ সাহার কাছে যাই আমি আর মাসুমসহ মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিতে, সেদিন তাঁর সাথে আমার টুকটাক কথা হলো। তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর। আমার মেজদাও বাকৃবি অর্থাৎ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাই প্রায় মিনিট দশেকের আলাপ চললো। মোড়ক উন্মোচনের অনুষ্ঠানে আমি সময় পেলাম মাত্র দুমিনিট। এরপর জেলা প্রশাসনের আয়োজনে বিজয় দিবসের আলোচনা সভা শুরু হয়ে গেলো। সময় আসলে ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটায়। তবে হুবহু নয়, কিছুটা পরিবর্তিত রূপে। কেননা, সেদিন আমি যেমন মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের জন্যে সময় চাইতে গিয়েছিলাম, তেমনি আজ আমি অনেককেই মোড়ক উন্মোচনের সময় করে দিতে পারি। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলায় আমি এর মাত্র কয়েক বছর পরে প্রতিযোগিতা উপ-কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব প্রাপ্ত হই।

(চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়