প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মিজানুর রহমান রানার মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিক উপন্যাস
এই জনমে
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) পূর্ব কথা : ঠিক সেই সময়টাই বিকট আওয়াজে দূরে কোথায় বাজ পড়লো যেন। সাথে আরেকটি গুলির আওয়াজ হলো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইরণা, ইমতিয়াজ ও তুয়ার আহমেদের মধ্যে ইমতিয়াজ বুকে হাত রেখে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ইমতিয়াজের দেহ। ধীরে ধীরে সে চোখ বন্ধ করলো।
দুই. পৃথিবীর নানা প্রান্তে অসংখ্য মানুষের বসবাস। শুধু নানা রকমের মানুষই নয়, গাছ-মাছ, পশুপাখিও বিচিত্র ধরনের। অনেক প্রাণী রয়েছে, আমরা এখনও যার নাম জানতে পারিনি। আমাদের দৃষ্টিসীমার অগোচরে অনেক কিছুই হয়, অনেক কিছুই জন্মিয়ে মহাকালের আবর্তে আবার চলেও যায় অনাদর-অবহেলায় আর চরম অযত্নে। এই পৃথিবীতে আসা আর চলে যাওয়া। কিছুটা সময় সময়ের অতিথি হওয়া। এরপর কেউ কেউ চলে যায়, রেখে যায় হাজার মানুষের চেয়েও ব্যতিক্রম কিছু সৃষ্টি। যা তাকে অনেক দিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখে, যুগ-যুগান্তরে। সেলাই করার সুতো খুঁজতে খুঁজতে এসব কথা ভাবছিলেন অনন্যা চৌধুরী। ঘরের এখানে ওখানে সুতো খুঁজতে খুঁজতে যখন পেরেশান, ঠিক তখনই হঠাৎ করে বিকট আওয়াজে দু কান বন্ধ হবার উপক্রম হলো তার। তিনি ঠিক যেন কিছুক্ষণ কালা হয়ে রইলেন। এরপরই আবার বিকট আওয়াজ। তিনি বুঝতে পারলেন কোথাও বোমা পড়ছে। মনটা অজানা আশঙ্কায় দুলে উঠলো তার। মনে মনে ভাবলেন, তাহলে কি দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে? মনে মনে আওড়াতে লাগলেন, ‘সাত মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে গিয়েছিলাম আমি। লোকে লোকারণ্য মঞ্চের চারদিক। বঙ্গবন্ধু নির্ভয়ে বলেছিলেন, তোমরা প্রস্তুত থাকো...। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’। তাহলে কি সেই সংগ্রাম শুরু হয়ে গেল? ভাবতে ভাবতে ঘরের বাইরে চলে এলেন অনন্যা। ঠিক এই সময়ই একদল পাক-বাহিনী তার বাড়ির অনেক দূরে দেখা গেল। কী করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এই মুহূর্তে তাঁর স্বামী, সন্তান কেউ বাড়ি নেই। তিনি একা। আবার তাকালেন দূরে, পথের কিনারায়। কী মনে করে আর তারা বাড়ির এদিকে এলো না। মনে হলো, হাফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি। সেদিন আর স্কুলে পড়াতে গেলেন না।
আজকের সকালটা কেমন যেনো বিমর্ষই লাগছে। গরমকাল হওয়া সত্ত্বেও আজ সূর্য কেমন যেনো মলিন হয়ে আছে। মেঘে ঢাকা আকাশ। সকালের সূর্যটা আজ আকাশে উঠলেও মেঘের আনাগোনায় দৃশ্যমান নয়। চিরসতেজ এই বাংলায় আজ কিসের ছায়া পড়েছে? অনন্যা চৌধুরী ভাবছেন। আকাশে শকুনের ওড়াওড়ি দেখে মনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো তার। হঠাৎ বাতাস বন্ধ হয়ে গেল। কোথাও যেন গাছের পাতা নড়ছে না। কেমন যেন এক ঘোরলাগা সকাল। কোনো কিছুতেই মন বসছে না। তবুও স্কুলে গেলেন। কিন্তু মন বসলো না তার। দুপুরের পূর্বেই বাড়িতে ফিরে এলেন তিনি। ঠিক বিকেলেই অস্থিরতা বাড়লো প্রকৃতির। এই সময় মনে হলো দূরের পথে কিসের যেনো শব্দ পাচ্ছেন তিনি। জানালা দিয়ে দেখলেন একদল পাক-সেনা এদিকেই আসছে। অনন্যা দ্রুত ঘরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। সন্তর্পণে তারা এলো। বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেললো। অফিসারসহ ক’জন সেনা এসে দরজায় আঘাত করলো। কিন্তু অনন্যা দরজা খুললেন না। এ সময় ক’জন সিপাহী ভেঙ্গে ফেললো দরজা। দরজা ভাঙ্গার পূর্বেই অনন্যা জীবন বাঁচাতে খাটের তলায় লুকিয়ে পড়লেন। সিপাহীরা তন্ন তন্ন করে খুঁজে খাটের নিচ থেকে অনন্যা চৌধুরীকে বের করে আনে। এরপর প্রশ্ন করে, তার স্বামী কোথায়? অনন্যা নির্বিকার। কোনো কথা বললেন না। কিন্তু অফিসারটা ক্রমে ক্রমে তার কাছে আসে। অনন্যা দেখলো তার বুকের জমিনে লিখা আছে ‘আওরঙ্গজেব’। অফিসারের নাম ‘আওরঙ্গজেব’। সোনালি কালিতে বুকে লেখা নাম তার।
অনন্যা ভাবতে লাগলো, ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ৪৯ বছর মুঘল সা¤্রাজ্যের শাসক ছিলেন ‘আওরঙ্গজেব’। প্রকৃতপক্ষে তিনি প্রায় সম্পূর্ণ ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছিলেন তার ফতোয়া-ই-আলমগীরীর শরিয়াহ আইন এবং ইসলামি অর্থনীতির মাধ্যমে। তিনি ছিলেন বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর এবং শাহজাহানের পরে ষষ্ঠ মুঘল সম্রাট। তিনি সম্রাট শাহজাহানের পুত্র। তিনি একজন দক্ষ সামরিক নেতা ছিলেন। যাঁর শাসন প্রশংসার বিষয় ছিলো। তিনি ইংরেজদের পরাজিত করেছিলেন ইঙ্গ-মুঘল যুদ্ধে। প্রচণ্ড গতিতে ধাক্কা খেলো অনন্যা। আজকের এই পাক বাহিনীর অফিসারের নামও আওরঙ্গজেব। দুজনের কী বিশাল ব্যবধান। একজন ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের শাসক আর এই পাক বাহিনীর অফিসার? অনন্যা ভাবেন, স¤্রাট আওরঙ্গজেব কুরআনের একজন হাফেজ ছিলেন এবং সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও তিনি সাধারণভাবে জীবনযাপন করেছেন। তিনি টুপি এবং নিজের হাতের লিখা কুরআন বিক্রি করতেন আর রাজ্যের সম্পদ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন না। হুংকার দিলো অফিসার আওরঙ্গজেব, ‘তেরা নিরঞ্জন কিধারে? কাঁহি গেয়া?’ ভাবনায় ছেদ পড়লো অনন্যার। তার স্বামী কোথায় গেছে জানতে চায় এই অফিসার। সে জানে তার স্বামী কোথায় আছে তা জানালেও মরবে, আর না জানালেও মরবে। তাহলে বলে কী লাভ? অফিসার আরও এগিয়ে এসে এবার ধাক্কা দিয়ে অনন্যাকে ফেলে দিলো মাটিতে। মাটিতে পড়ে প্রচণ্ড ব্যথা পেলো অনন্যা। কোমরটা যেনো ভেঙ্গেই গেছে তার। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলেন তিনি। হেসে উঠলো আওরঙ্গজেব নামের বদ অফিসারটা। ভাবলেন অনন্যা, নামের আগে আওরঙ্গজেব লাগলেই বাদশা হতে পারে না, কুকুরও হতে পারে। ঠিক সেই কাজটাই করলো লোকটা। অনন্যার সাথে কুকুরের মতোই আচরণ শুরু করে দিলো। গায়ের উপর থেকে তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে চাইলো সে, কিন্তু পাক বাহিনীর এই প্রশিক্ষিত কুকুরটাকে কোনোভাবেই তিনি শরীরের উপর থেকে ছড়াতে পারেননি। শরীরটাকে খামছে খুবলে কুকুরটা খেতে লাগলো। মনের অজান্তে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো--এমনও কুকুরের দেখা পাবো এই জনমে তা তো ভাবতেই পারিনি হায়!
আওরঙ্গজেবের কাজ শেষ। এরপর সিপাহীরা অফিসারের নির্দেশে শুরু করে তার ওপর পাশবিক নির্যাতন। এ সময় দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠলো পাক অফিসার। বললেন, আভি কিধারে হ্যায় তোমহারা শেখ মুজিব? এ সময় বাতাসের শোঁ শোঁ ধ্বনি শোনা গেলো বাইরে। বাতাসে শোনা গেলো সেই ধ্বনি ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকো...।’ এক সময় ক্রমে ক্রমে সিপাহীদের পৈশাচিক খায়েশ পুরো হলো। বিধ্বস্ত বিবস্ত্র অনন্যা চৌধুরী পড়ে আছেন খাটের কোণায়। চুঁইয়ে চুঁইয়ে কপাল থেকে ঘাম ঝরছে তার। তিনি ভাবছেন, বেঁচে আছেন নাকি মরে গেছেন? মরে গেলে কোথায় যাবেন? স্বর্গে নাকি নরকে? ভাবছেন, এরা কি মানুষ নাকি পশু? এরা কোন্ গ্রহের মানুষ? পৃথিবীর নাকি মঙ্গলের? শুধুমাত্র নিজেদের অধিকার চাওয়ায় আজ সারাদেশের মানুষের ওপর এই নির্যাতনের খড়গ! তারা ছেলেবুড়া কিছুই মানছে না। মানুষের কি কোনো মূল্য নেই? এসব ভাবনা ভাবার সময় অফিসার ও তার সৈনিকরা বাড়ির অন্য সদস্যদের খুঁজতে গেলো। এই সময় অনন্যা চৌধুরী নিজকে উঠালেন খাট থেকে। পরনের কাপড়চোপড় ঠিক করে নিয়ে বাড়ির পেছন দরজা দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে চলে গেলেন। পরে আর সৈনিকরা তাকে খুঁজে পেলো না। খুঁজে না পাওয়ার কারণে এ সময় অফিসার আওরঙ্গজেব প্রচণ্ড রাগে আগুন হয়ে গেলো। তার সৈনিকদের কয়েক ঘা বসিয়ে দিলো। আর বললো, ভালো করে খোঁজ তাকে। ক্যাম্পে এই মহিলাকে বড়ই প্রয়োজন। কিন্তু সৈনিকরা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও যখন অনন্যা চৌধুরীকে আর পেলো না, তখন রাগে-দুঃখে গান পাউডার দিয়ে তার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে যায়।
বাড়িতে দাউ দাউ করে জ্বলছে অগ্নিশিখা বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে। এ সময় বাড়ির একটু দূরের জঙ্গল থেকেই তার মূল্যবান সাহিত্যকর্ম, কাগজপত্র পুড়তে দেখেন অনন্যা চৌধুরী। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও রক্ষা করতে পারেননি। ঘৃণা লজ্জা আর কষ্টে মুষড়ে পড়েন তিনি। বহ্নিশিখায় ভেসে উঠলো একটি নামণ্ড-আওরঙ্গজেব। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন, যতদিন বেঁচে থাকেন তিনি ততদিন এই নামটি ভুলবেন না। কারণ আসল আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন শক্তিশালী সুপুরুষ। ২৮ মে ১৬৩৩ সালে স¤্রাট আওরঙ্গজেব অল্পের জন্য হাতির পায়ের নিচে পদদলিত হয়ে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান। তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে উন্মত্ত হাতিটির মোকাবেলা করেছিলেন। তাঁর এই সাহসিকতায় তাঁর পূর্বেকার সম্রাট অত্যন্ত খুশি হয়ে তাঁকে বাহাদুর খেতাবে ভূষিত করে দুই লাখ রুপি পুরস্কার প্রদান করেছিলেন। এই ঘটনার স্মরণে ফারসি এবং উর্দু ভাষায় পংক্তিমালার মাধ্যমে আরঙ্গজেব বলেছিলেন, ‘‘যদি সেদিন হাতির সাথে যুদ্ধটা আমার মধ্য দিয়ে শেষ হতো তাহলে কোনো লজ্জা ছিলো না। লজ্জা তো এমন কি কোনো সাম্রাজ্যকেও ঢেকে দিতে পারে। এতে কোনো অগৌরবের কিছু নেই। লজ্জা সেখানে যা ভাইয়েরা আমার সাথে করেছে।” অনন্যা চৌধুরী ভাবেন, প্রকৃত স¤্রাট আওরঙ্গজেব যা বলেছিলো, আজকের নকল পাক বাহিনীর অফিসার আওরঙ্গজেব তার উল্টোটাই আমার সাথে করেছে। তারা আমার সাথে যা করেছে তা শুধু আমার একার লজ্জা নয়। পুরো পাকবাহিনীর জন্যে লজ্জাকর! (চলবে)