প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন
(অষ্টম খণ্ড)
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে গোল চত্বর আছে একটা। এই গোল চত্বরটির নাম মোজাম্মেল চত্বর। পুরুষ শিক্ষার্থীরা এই গোল চত্বরের লোহার বাঁকানো শিকের উপরে বসে আড্ডা মারতো অবসরে। গোল চত্বরের পাশাপাশি লম্বা আইল্যান্ডের শিকেও আমরা বসতাম। বড় ভাইদের মুখে শোনা, ইএনটির মোহাম্মদ হোসেন স্যার নাকি দেখলেই এইসব শিকে বসা ছাত্রদের দাঁড়া করাতেন এবং বলতেন, প্যান্ট খুললে পাছায় শিকের দাগ দেখা যাবে। আমাদের অ্যানাটমির ডিসেকশন ক্লাসে শুরুতেই পেয়েছিলাম শায়খুল স্যারকে। তিনি ফরমালিনে সংরক্ষণ করা মেইল জেনিটালিয়া পড়াচ্ছিলেন প্রথম ক্লাসেই। সহজাত আড়ষ্টতা সবাইকেই পেয়ে বসেছিলো। একবার অ্যানাটমির সফট পার্টের ভাইবা পরীক্ষায় আমাদের এক বন্ধু মেইল জেনিটালিয়ার স্পেসিমেন ভুলে ইরেক্ট পজিশনে ধরেছিলো। তা দেখে আমাদের ফারুক স্যার এক্সটার্নাল ম্যাডামকে সম্বোধন করে বললেন, দেখছেন! দেখছেন! ছেলেটা কী বেয়াদব! আমার আগে যে নারী শিক্ষার্থীকে ভাইবাতে কিডনি স্পেসিমেন দেওয়া হয়েছিলো ধরতে, সে ভুলে পরীক্ষার চাপে বলে ফেলেছিলো, ‘দিজ্ আর দ্য স্পেসিমেন অব হিউমেন টেস্টিস।’ এটা বলার সাথে সাথে তাকে ভুল পথে পরিচালিত করে নিয়ে গেলেন প্রশ্নকর্তা। আসলে ভাইবা পরীক্ষায় পরীক্ষকের দেওয়া লিফট ধরতে কখনো সহজ হয় আর কখনো এমন কঠিন হয়ে যায় যে, সেই লিফট ধরে এগুতে গেলে ফেল ছাড়া আর কিছু গত্যন্তর থাকে না। আমাদের হিস্টোলজি ক্লাস পেতেন অ্যানাটমির কিউরেটর নূরুল ইসলাম স্যার। তিনি খুব মজার মানুষ ছিলেন এবং দেখতে বিদেশিদের মতো অবয়ব। তাঁর ক্লাসে একবার স্লাইড দেখতে গিয়ে মাইক্রোস্কোপ নামাতে নামাতে স্লাইড ভেঙ্গে ফেলেছিলাম।
আমরা কলেজে ঢোকার তিনমাস পরেই শুরু হয়ে গেলো রাজনৈতিক অস্থিরতা। ট্রিপল মার্ডারের কারণে দীর্ঘদিন আমাদের কলেজের পাঠদান স্থগিত হয়ে যায়। ছাত্রলীগের অনেককেই তখন ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে হয়। কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশে এবং মধ্যপ্রাচ্যে আশ্রয় নিতে হয়েছিলো। তাদের জীবন ছিলো এ সময় বেশ কষ্টের। এদের কেউ কেউ শুধু কয়েক মাস ইন্টার্নশিপ বাকি ছিলো বিধায় আটকে ছিলেন।
এই তিনমাস গ্যাপের কারণে আমিও জড়িয়ে যাই মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিতে। ফলে ক্যাম্পাসের প্রতি আমার কম টান তৈরি হয়। আমার বন্ধুরা যখন বিকেলে বিপরীত লিঙ্গের সহপাঠীর সাথে হেঁটে হেঁটে ইকিরি-মিকিরি কথা বলতে বলতে ক্যাম্পাস চষে ফেলতো, আমি তখন পরের দিন কোচিং ক্লাস নেওয়ার জন্যে লেকচারশিট বানাতাম। অর্থের চেয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে মন জয় করার একটা আপ্রাণ চেষ্টা ছিলো। কোচিং ক্লাস নেওয়ার দিনগুলো ছিলো ঘটনাবহুল। একবার আমাদের ক্ল্যাসিক কোচিং সেন্টারের কাতালগঞ্জ শাখার একজন নারী শিক্ষার্থীকে ইভটিজিং করার ফলে বড় একটা গ-গোল হয়। মারামারির জন্যে ক্যাডার হিসেবে যাদের নেওয়া হয়েছিলো, তাদের মধ্যে আমার পাড়ারও একজন ছিলো। ভার্সিটি ভর্তির বাংলা ক্লাস নিতো রাজু। মেডিক্যালে আমাদের দুবছরের সিনিয়র জাবেদ ভাই আর রাজু তলে তলে আমাকে না জানিয়ে সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছিলো। কিন্তু তাদের চেষ্টা সফল হলেও থমথমে ভাব বিরাজ করছিলো। আমার পাড়ার ক্যাডার আমাকে দেখার সাথে সাথে আর কোনো গ-গোল করেনি। এ রকম আরেকটা বিপদ এসেছিলো নাসিরাবাদ শাখায়। ওই শাখার ম্যানেজার কবির তার অবসর সময়ে নাসিরাবাদ টিএন্ডটি কলোনীর মাস্তান আলমের সাথে সখ্য গড়ে তোলে। কোনো একটা কারণে কবির ভাই ক্লাস চালানোর কোনো বিষয়ে আমার সাথে দ্বিমত হয়ে মানতে পারলেন না। তিনি আলম মাস্তানকে জানালেন আমাদের নাসিরাবাদ শাখায় চাঁদাবাজি করতে। কিন্তু তারা আমার দৃঢ়তায় সেই কাজে সফল হয়নি। ফলে আমাকে ধরে নিয়ে ধোলাই দিতে আসলো একদিন। আমি সেদিন ইংরেজি ক্লাস নিচ্ছিলাম সি-ইউনিটের ব্যাচের। একদল মাস্তান এসে আমাকে টানাটানি শুরু করলো, যাতে পাশের কলোনীতে তাদের আড্ডায় নিয়ে যেতে পারে ধোলাই করার জন্যে। কিন্তু আমাকে টেনে নামাতে পারেনি তারা। আমার ছাত্র-ছাত্রী তাদের ঘিরে ধরেছিলো বিধায় সফল হতে পারেনি।
কোচিং ক্লাস নেওয়ার সময় কয়েকজন মজার মানুষের সাথে পরিচয় হয়। এদের একজন হলেন সালাউদ্দিন ভাই। তিনি বুয়েটে চান্স পেয়েছিলেন ইলেক্ট্রিক্যালে। তার কথার অ্যাকসেন্টেই আমরা মজা পেতাম। তিনি বুয়েট থেকে ছুটিতে এসে ক্লাস নিতে গেলে আমাদের আড্ডায় প্রভূত বিনোদন দিতেন। তাদের হোস্টেলের সব অ্যাডাল্ট জোকস্ তিনি রসিয়ে রসিয়ে বলতেন। আমরাও মুখিয়ে থাকতাম তার মুখামৃতের জন্যে। ক্ল্যাসিক কোচিংয়ে আর একজন মজার মানুষ ছিলেন জাকির ভাই। তাকে আমাদের ছোটন ভাই ডাকতেন ‘মাডেল জাকির’ বলে। জাকির ভাই কেন চট্টগ্রাম গিয়ে কয়েক বছর ছিলেন তার প্রকৃত কারণ আমরা জানতে পারিনি। তিনি কাতালগঞ্জে এরফানদের সাথে মেসে থাকতেন। একই মেসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কক্সবাজারের মোস্তাক ভাইও থাকতেন। এরফান দেখতে ঠিক ঠিক নকল আমির খানের মতো ছিলো। সে ইউএসটিসিতে ফার্মেসি বিভাগে পড়তো। জাকির ভাই আমাদের কোচিংয়ে ভার্সিটি ভর্তি শাখায় সাধারণ জ্ঞান ক্লাস নিতেন। তিনি বৃটিশ কাউন্সিলে ভর্তি হয়ে তাদের অ্যাকসেন্টে কথা বলার চেষ্টা করতেন। তিনি আইইএলটিএস ক্লাসে শিখেছেন, ওটা কোকাকলা নয়, ওটা কাকাকালা। ব্যস্! এটা শুনেই তার ইয়ারমেট বন্ধু হেলাল আহমেদ ছোটন ভাই তাকে নাম দিয়েছিলেন, ‘মাডেল জাকির।’ তাঁর নাম নিয়ে আমাদের ঠাট্টার অন্ত ছিলো না। তখন থেকেই বন্ধুর বদৌলতে জাকির ভাইয়ের নাম হয়ে গেলো মাডেল জাকির। অথচ তার সত্যিকারের নাম হোসাইন জ্যাকি। মাডেল জাকির ভাইকে নিয়ে আরও একটা মজার ঘটনা আছে। বন্ধু রাজুর সাথে বাজি ধরে তিনি হোটেলে বসে মিষ্টি আর পরোটা খেতে শুরু করলেন। টানা সতেরোটা পরোটা খেয়ে অতঃপর আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘পীযূষ, আজ থাক, আর নয়। না হলে বাসায় গিয়ে ভাত খেতে পারবো না।’ হাসতে হাসতে অবাক হয়ে তাঁর এ কথায় সেদিন সাড়া দিয়েছিলাম। ক্ল্যাসিক কোচিংয়ে মিলন নামে সি-গ্রুপে বাণিজ্য বিভাগে ভার্সিটি কোচিংয়ের ছাত্র ছিলো একজন। বিদেশ থেকে তার একটা জরুরি টেলিফোন কল আসার কথা। সে নাম্বার দিয়ে রেখেছে আমাদের অফিসেরটা। কিন্তু কাউকে জানায়নি। এদিকে বিকেল পাঁচটার পরে ম্যানেজার অলি ভাই সেদিন শুক্রবারে প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে হাল্কা ঘুরতে বের হন। এই অবসরে মিলনের ফোন চলে আসায় সে তালা ভেঙে সেই টিএন্ডটি ফোন কল অ্যাটেন্ড করে। এটা যে অনৈতিক ছিলো তা বুঝতে কারও কোনো বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু তা হলে কী হবে, মিলন নিজে এ কথার গুরুত্ব বুঝতে পারেনি আজও। কোচিংয়ে রাজুর বন্ধু ছিল আশিক। যত ষড়যন্ত্র পাকাতে সে অভ্যস্ত ছিলো। একবার মুদ্রণ প্রমাদের কারণে ক্ল্যাসিকের প্রসপেক্টাসে তার নামের নিচে পরিচয় লেখা ছিলো-- পিতা : বসুরহাট, নোয়াখালী। এটা নিয়ে বেশ কয়েকদিন হাসাহাসি ছিলো আমাদের মধ্যে। আশিকের ষড়যন্ত্রে ক্ল্যাসিকের প্রশিক্ষকদের মধ্যে একতায় ফাটল ধরে যায়।
কোচিং ক্লাসের দিনগুলোতে কিছু কিছু অবাক করা ঘটনা ঘটে। আমি কখনো ধূমপায়ী ছিলাম না। কিন্তু আমার এক শিক্ষার্থী একদিন হঠাৎ করে আমাকে একটা দামি লাইটার উপহার দেয়। আরেকজন শিক্ষার্থী এসে জানায়, পীযূষ ভাই, আপনার প্রয়োজন হলে আমাকে বলবেন, আপনাকে আমি রক্ত দেবো। কোচিংয়ে ক্লাস নেওয়ার ফলে শিক্ষার কিছু কিছু বিষয় আমার আয়ত্তে এসে যায়। এর মধ্যে ইংরেজি গ্রামার, রসায়নবিদ্যার খুঁটিনাটি উল্লেখযোগ্য।
আমাদের প্রফেসররা বলেন, মেডিকেলে ঢুকতে কষ্ট, ঢুকিয়া কষ্ট। বাহির হতে কষ্ট, বের হয়ে কষ্ট। বাস্তবিকই তা-ই। একচুলও এদিক-সেদিক নয়। তিনমাস ট্রিপল মার্ডার ভ্যাকেশানের পর আমরা আবারো কলেজের ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী হয়ে গেলাম। দ্বিতীয় বর্ষ শেষে মেডিকেলে প্রথম প্রফেশনাল এমবিবিএস পরীক্ষার সময় কলেজে বেলমাথা হওয়ার হিড়িক পড়ে। আমাকেও সেই টানে পড়তে হয়েছিলো। সম্ভবত এই বেলমাথা হওয়ার সূচনা করেন আমাদের চৌত্রিশ ব্যাচের লাবিব ভাই। এরপর তাকে দেখেই অন্যরা উৎসাহ বোধ করে। মেডিকেল পড়াশুনায় আমাদের কলেজের সামনে অবস্থিত তৃণা ফটোস্ট্যাট আমাদের যথেষ্ট সেবা দিয়েছে। তৃণার নোট না হলে আজ অনেকেই এখনও পার হতে পারতো বলে মনে হয় না।
ছিয়ানব্বই সালে থার্ড ইয়ারে উঠার পরে চট্টগ্রাম রোটারর্যাক্ট ক্লাবের আয়োজনে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আমাদের দল বানানো হবে। তার জন্যে উপস্থিত বক্তৃতার আয়োজন করা হলো। এ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আমি দ্বিতীয় বক্তা হিসেবে নির্বাচিত হই। আমাদের প্রথম ও তৃতীয় বক্তা ছিলেন চৌত্রিশতম ব্যাচের যুবরাজ ভাই ও হুমায়ূন ভাই। যুবরাজ ভাই ছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্র আর হুমায়ূন ভাই ছিলেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের। আমরা সেই বিতর্ক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হই। আমাদের ক্লাসের অনেকেই আমাদের বিতর্ক উপভোগ করার জন্যে নাসিরাবাদ উইমেন্স কলেজে গিয়েছিল। একজন বিতার্কিক হিসেবে আমার মধ্যে আক্রমণ করার প্রবণতা বেশি ছিলো। আমার দলনেতা হুমায়ূন ভাই আমাকে এই আক্রমণ প্রবণতা হতে নিবৃত্ত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন। বক্তব্যের সূচনার জন্যে আমার তৈরি গল্পগুলো তিনি পছন্দ করতেন বেশি। আমাদের প্রথম বক্তা যুবরাজ ভাই চমৎকারভাবে প্রস্তাবনার ব্যবচ্ছেদ করতেন। তার ব্যবচ্ছেদের কারণে আমাদের বিতর্কে অবস্থান দৃঢ় ছিলো। আমরা যে সময় কলেজে ঢুকি, তার কিছুদিন আগে থেকেই আমাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজকে সবাই 'চট্টগ্রাম মেডিকেল সাহিত্য সাংস্কৃতিক কলেজ' নামে অভিহিত করেছিলো। আমাদের ক্যাম্পাসে আতিক ভাই সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে তিনবার দায়িত্ব পালন করেছেন।
আমাদের একজন বায়োকেমিস্ট্রির ম্যাডাম এবং স্যার ছিলেন যারা মাঝে মাঝেই নিউমার্কেট এলাকায় একই রিকশায় হুড তুলে দিয়ে বেড়ানোর সময় আমার চোখে পড়ে যেতেন। স্যার অনেক সময় টিউটোরিয়াল ক্লাসে এসে ইনডিরেক্টলি বলতেন, সবকিছু মেটাবলিজম করতে হবে। আমি শুনতাম আর মনে মনে হাসতাম। কলেজের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় আমি কবির লড়াই, নির্ধারিত বক্তৃতা ও বিতর্কে বিজয়ী হই। অন্তক্রীড়ায় আমার খুবই ভালো দক্ষতা ছিলো। আমি দাবায় চ্যাম্পিয়ন ও টেবিল টেনিস দ্বৈততে রানারআপ হই। টেবিল টেনিসে আমার পার্টনার ছিলো সনেট। তার খারাপ খেলার কারণেই আমাকে রানারআপ হয়েই মেনে নিতে হয়। মেডিকেলের ফাইনাল প্রফের ক্ষেত্রে আমার বিতার্কিক পরিচয় বেশ কাজে লেগেছে। গাইনিকোলজি ভাইবাতে মুখ খোলে না দেখে শামসুন্নাহার ম্যাডাম বলেছিলেন, তুমি না বিতার্কিক! এরপর থেকে সব প্রশ্নের উত্তর পানির মতো সহজ হয়ে যায়। বিরিয়ানি অন্তপ্রাণ সার্জারির শহিদ স্যারের ক্লাসও আমার নির্ধারিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার কারণে সহজ হয়ে যায়। কেননা তিনিই ঐ প্রতিযোগিতায় মুখ্য বিচারক ছিলেন।
পঞ্চম বর্ষ সমাপনীতে আমরা একটা মজার নাটক নামালাম। 'রঙিন টাইটানিক' নাম দিয়ে। আমি রচয়িতা। সাথে কিছু ডায়লগ লিখেছিলো সহপাঠী রিটন। নির্দেশনা যেমন দিয়েছি, তেমনি অভিনয়ও করেছি একটা চরিত্রে। কলেজের রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জয়ন্তী উদযাপনের স্ক্রিপ্টও আমি গ্রন্থনা করেছিলাম। আমাদের পঞ্চম বর্ষ সমাপনীতে আমরা ট্রাকে চড়ে আনোয়ারা পারকি সী-বিচে যাই। আমার বন্ধু নোবেল ছিলো আমাদের চমেকসুতে ভিপি। মোহনা নামের ম্যাগাজিন প্রকাশনায় আমি একার হাতে সবক'টা বাণী লিখেছিলাম। মনে হয় ঊনচল্লিশটা। পঞ্চমবর্ষে ক্যাম্পাসে প্রথম আলো-এসকেএফ-এর আয়োজনে আন্তঃ মেডিকেল বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এতে আমাদের দুটো দল অংশগ্রহণ করে। একটা দল হলো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ আগুন দল, যার দলনেতা ছিলাম আমি। আর অন্যটা হলো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ফাগুন দল, যার দলনেতা ছিলো অনুজ জুয়েল, যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত। এ দুটো দলের নাম দিয়েছিলেন তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর ডাঃ শুভাগত চৌধুরী। আমার বন্ধু ফসি ছিলো অলস কিন্তু বুদ্ধিমান। সে চারটা লাক্স সাবানের খালি খাপ জমিয়েছিলো। কারণ পাঁচটা খালি খাপ দিতে পারলে একটা ফ্রি। তো, চারটা খালি খাপ নিয়ে সে হোস্টেলবর্তী দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলো, লাক্স আছে? হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকিয়ে দোকানদার একটা লাক্স সাবান দিলো। ফসি ঐ সাবানের খাপ খুলে নিয়ে আগের চারটাসহ মোট পাঁচটা খালি খাপ দিলো। এবার দোকানদার নিয়মমাফিক তাকে খাপছাড়া সাবানটি দিতে বাধ্য ছিলো।
ছাত্রজীবনের কয়েকটা মাস আমি হোস্টেলে ছিলাম। ফলে হোস্টেল জীবনের ভালোমন্দকেও বুক পেতে নিয়েছি। হোস্টেলের সবচেয়ে ভালো দিক ছিলো বন্ধুদের সমারোহ। পড়াশুনার নোট বা তথ্য কারও না কারও কাছে থাকতো এবং চাইলেই পাওয়া যেতো। খারাপ দিক হলো, দুপুর বারোটাতেই ডাইনিং শেষ এবং রাতের আটটাতেই ডিনার। ফলে ছাত্রদের বাধ্য হয়েই চানাচুর-মুড়ি দিয়ে রাত কাটাতে হতো। বন্ধু নূরুল আলম বাবু, আমি, খসরু ও অনন্তের বিপক্ষে সারারাত অকশন ব্রিজ বাজি খেলেছিলাম এবং পরদিন সকালে ঝালবিতানের তেহারি খেয়ে রাতজাগা ঘুম ঘুমাতে গিয়েছিলাম। আটানব্বই সালে বেশ ভালো বৃষ্টি হয় এবং দেশজুড়ে বন্যা দেখা দেয়। এই অবস্থাতেই আমরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ বিতর্ক দল বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিতর্ক লড়তে যাই। আমাদের বিপক্ষ দল ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হল। তাদের দলনেতা ছিলো শামীম রেজা। ট্রেনে করে যাওয়ার সময় আমরা খবর পেলাম, অমর্ত্য সেন অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর তত্ত্ব দিয়েই তারা আমাদের ঘায়েল করে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রযোজক প্রশান্ত ভূষণ বড়ুয়া আমার স্ক্রিপ্ট দেখে ভূয়সী প্রশংসা করেন।
দুহাজার সালের মাঝামাঝি আমাদের ইন্টার্ন ডক্টরস্ এসোসিয়েশন গঠিত হয়। বন্ধু শওকত এর আহ্বায়ক হয়। ফিফথ্ ইয়ারের পরীক্ষা শেষে করে মাসখানেক ছুটিতে আড়ং আমদুধ হাতে নিয়ে শুধু ক্যারম খেলেছি। ফলে স্বাস্থ্য ভারী হয়ে গেলো হুট করে। (চলবে)