প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন
(ষষ্ঠ খণ্ড)
আঠারো বছর ধরে জীবন আমাকে হাঁটাতে হাঁটাতে নিয়ে এলো গলি থেকে রাজপথে। প্রথম ক্রন্দনে যে জীবন মাতৃগর্ভ ছেড়ে লুটালো ধূলিতে সে জীবন আঠারোর মাঝামাঝি এসে নিউমার্কেটের জিরো পয়েন্টের মতো বিশাল এক মোড়ে এসে দাঁড়ালো। এই মোড় থেকেই শুরু হবে জীবনের মূল যাত্রা। জীবনের হাত ধরে হেঁটে হেঁটে দুটো পাবলিক পরীক্ষার সনদই হয়ে উঠলো মহার্ঘ্য সম্বল। মধ্যবিত্ত ঘরের শিক্ষার্থীরা নিজেরা নিজেদের স্বপ্ন বানাতে পারে না। তাদের স্বপ্ন বানিয়ে দেয় বাবা-মা এবং পরিবার। এই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার ভার অর্পিত হয় সেই শিক্ষার্থীর কাঁধে। আমার ছোট ভাই গণিত নিয়ে ভয় পেলেও জোর করে মা তাকে গণিত নেওয়ালেন উচ্চ মাধ্যমিকে। ফলে ছোটভাই তার পরিশ্রম ও মেধায় যতটুকু যেতে পারতো, মায়ের বেঁধে দেওয়া ছকে সে ততটুকু যেতে পারেনি। মাঝখানে ঢের কষ্ট হলো তার নিজেকে জীবনের গতিতে টিকিয়ে রাখতে। পরিবারে একজনকে ডাক্তার বানাতেই হবে এ আশায় স্বপ্ন দেখা বাবা-মায়ের নির্ধারণ করে দেওয়া গন্তব্যে ছোটার দায়িত্ব নিয়ে জীবনের জিরো পয়েন্ট হতে নিউমার্কেটের মতো বিশাল মোড় হতে শুরু হলো নতুন যাত্রা। বাড়ি বসে শুধু গাইড বই পড়লেই সে গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে না। তাই যেতে হলো কোচিং সেন্টারে। কোচিং সেন্টার নিয়ে অনেকেরই ভুল ধারণা আছে। অনেকেই একে কেবল বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক টপকে আসা সদ্য তরুণ শিক্ষার্থীর কাছে একটা মডেল না থাকলে তার পক্ষে প্রস্তুতি নেওয়া কঠিন। ফি-এর বিনিময়ে এইসব ভর্তি কোচিং সেন্টারকে বলা যায় অভিভাবকদের জন্যে আশার আলোর মতো। কেননা, এইসব ভর্তি কোচিং না থাকলে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে শিক্ষার্থীরা তৃতীয় স্তরের ভর্তি পরীক্ষার যুদ্ধে অথৈ সাগরে পড়ে যেতো। কিছুটা বড় হওয়ার কারণে যে স্বাধীনতা আসে তাতে আর পড়ার টেবিলের সাথে সংযোগ থাকে না বললেই চলে। কিন্তু কোচিং সেন্টারগুলো কেবল শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলেই ধরে রাখে না বরং তাদের জ্ঞান ভাণ্ডারকেও সমৃদ্ধ করে। উল্টো অনেক ক্ষেত্রেই বলা যায়, এইসব কোচিং সেন্টার অতিরিক্ত পড়াশুনার বোঝাও চাপিয়ে দেয়। অবশ্য পরবর্তী জীবনে এই জ্ঞান বেশ কাজে লাগে।
শহরে অনেক 'ভর্তি কোচিং সেন্টার' আছে। কোনোটা ঢাকা থেকে নিয়ন্ত্রিত হয় আর কোনোটা স্থানীয়ভাবে। এইচএসসি পরীক্ষার শেষদিকে একটা কোচিং সেন্টারের পক্ষ থেকে মতবিনিময়ের চিঠি পেয়েছিলাম। মতবিনিময় সভায় না গেলেও সেই কোচিং সেন্টারেই পরে গিয়ে ভর্তি হলাম। স্থানীয় কোচিং সেন্টারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভর ভরান্ত যেটা সেটা চলে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক আদর্শে। এরাই বাংলাদেশের স্বাধীন অভ্যুদয়ের পক্ষে ছিল না সে সময়। এখনো স্বাধীনতা মনেপ্রাণে মেনে নিতে পেরেছে তা বলা যাবে না। আমি যে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হলাম তার নাম ক্ল্যাসিক কোচিং সেন্টার। সাইদ আহমেদ বাবু ভাই ছিলেন এর মালিক ও পরিচালক। চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ-কাতালগঞ্জে এটার অফিস। আমার স্কুল জীবনের বন্ধু হুমায়ূনের মায়ের স্কুলে আমাদের ক্লাস হতো। অফিস ছিলো দোতলার বারান্দায়, রাস্তা সংলগ্ন। হুমায়ূনের বাবার নাম ছিলো হাশেম সাহেব। হুমায়ূন আমার সাথে সেন্ট প্ল্যাসিডস্ স্কুলে পড়েছিলো ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। এরপর সে ক্যাডেট কলেজে চলে যায়। এসএসসির পর সে আর ক্যাডেট কলেজে পড়েনি। বের হয়ে এসে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়। তার মা সেই সুবাদে আমাকে চিনতেন। তার বোনও ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজে পড়তো এবং কেমনে কেমনে জানি আমাদের সাথেই কোচিংয়ে ভর্তি হয়। হুমায়ূন অবশ্য সায়েন্সে পড়েনি। সে এইচএসসিতে কমার্সে চলে গিয়েছিলো।
আমাদের ক্ল্যাসিক কোচিং সেন্টারের মালিক সাইদ আহমেদ বাবু হলেও চট্টগ্রামে কোচিং চালানোর জন্যে আরিফ ভাই, মেজবাহ ভাই এবং জাভেদ ভাইকে দায়িত্ব দিলেন। তার আগে অবশ্য ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী ভাইও কিছুদিন যুক্ত ছিলেন। আরিফ ভাই ও মেজবাহ ভাই ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের একত্রিশতম ব্যাচের ছাত্র। জাভেদ ভাই ছিলেন তেত্রিশতম ব্যাচের। তখন ক্ল্যাসিক কোচিংয়ের ম্যানেজার ছিলেন অলি ভাই। অলিউল্লাহ্। তার বাড়ি ছিলো ঢাকায়, উত্তরখানে। খাটো, স্বাস্থ্যবান। নাকের নিচে পুরু ও মোটা গোঁফ ও মাথায় চকচকে টাকে দারুণ সমন্বয়। তখনও কাতালগঞ্জেই এর একমাত্র শাখা ছিলো। আমি মেডিক্যাল ভর্তি কোচিংয়ে ভর্তি হলাম। মেডিক্যাল কোচিংয়ে তখন একটা ব্যাচ হয়েছিলো। চল্লিশ কি পঞ্চাশজন শিক্ষার্থী। ক্লাস হতো সপ্তাহে তিনদিন বিকেল তিনটা থেকে পাঁচটা, দুই ঘন্টা। প্রথমে আধঘন্টা পূর্ববর্তী লেকচারের উপর পরীক্ষা। তারপর দেড়ঘন্টা ক্লাস। আধঘন্টার পরীক্ষায় তিরিশ নম্বরের এমসিকিউর উত্তর দিতে হতো। ওএমআর শীটের আদলে উত্তরপত্র তৈরি। এই উত্তরপত্র নিরীক্ষা করার জন্যে অলি ভাই একটা দারুণ উপায় বের করলেন। এই উত্তরপত্রের একটা ডামি হার্ডবোর্ডে তিনি তৈরি করতেন। তারপর দাগিয়ে অ্যান্টি কাটার দিয়ে কেটে ছক তৈরি করতেন। সেই ছক হুবহু বসিয়ে তিনি লাল বল পয়েন্ট কলম টেনে আঁক দিতেন। লাল আঁকে যতগুলো বৃত্ত পড়তো ততটা উত্তর শুদ্ধ হতো। এভাবে খুব সহজেই অলি ভাই অল্প সময়ে শ'য়ে শ'য়ে উত্তরপত্র নিরীক্ষণ করতেন। আমার সাথে কোচিংয়ে ভর্তি হলো আল মাহমুদ হাসান। সে এসএসসিতে ষষ্ঠ হয়েছিলো। পরে এইচএসসিতে প্রথম। আমাদের ক্লাস নিতেন প্রিন্স ভাই, জয় ভাই, আতিক ভাই, সালাউদ্দিন ভাই, নূপুরদা, ধ্রুব ভাই, ছোটন ভাই এঁরা। একবার ক্লাসে জয় ভাইকে কম্পন নিয়ে প্রশ্ন করে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিলাম। আতিক ভাই চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের দুই বারের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। তিনি ফাঁকি দিয়ে পড়ালেও তা মনে হতো না। ক্লাস শেষে একটা ভালো লাগার রেশ থাকতো। মাঝে মাঝে ঢাকা থেকে বাবু ভাই টিচার পাঠাতেন, যারা একশ নম্বরের পরীক্ষার উত্তরপত্র পর্যালোচনা করতেন। টিটু ভাই, সামি ভাই এরা আসতেন। চল্লিশটা লেকচারে আমাদের মেডিক্যাল ভর্তি কোচিং কোর্স শেষ হলো। এরপর আট-দশটা সাবজেক্ট ফাইনাল এবং ছয়টা মডেল টেস্ট। কোচিং শেষে কখনো টিটবিটে বসে বার্গার খাওয়া আর কখনো মেডিক্যাল বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে গিয়ে শুটিং প্র্যাকটিস করতাম।
আমাদের পাড়ায় আরিফ ভাই নামের একজন কবি ছিলেন। তিনি কমার্স ব্যাক গ্রাউন্ডের মানুষ। জীবনানন্দ তার প্রিয় কবি ছিলেন। আমি যখন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির জন্যে কোচিং করছি তখন তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন পাথরঘাটায় তার খালার বাড়ি। তাদের ওখানে আমাকে ক্লাস নাইনের স্টুডেন্ট পড়াতে হবে। তিনি তার খালাকে কথা দিয়েছেন, তাই আমাকে যেতে হবে। মনে হয় বারোশ টাকা পেতাম তখন। অনেক টাকা। পড়াতে গিয়ে আমার কিছুটা সুবিধা হলো। ভর্তি পরীক্ষার জন্যে অনেক কিছু ক্লাস নাইন-টেন হতে আমার চর্চায় যোগ হতে লাগলো। ফলে রসায়ন, পদার্থ ও জীববিদ্যার মৌলিক বিষয়গুলো আমার নিত্য চর্চিত হয়ে উঠতে লাগলো।
আবার অন্যদিকে, মেডিক্যাল কোচিংয়ের সিস্টেমের কারণে কোনো চ্যাপ্টার না পড়া থাকেনি। লাল পেন্সিল দিয়ে অজানা প্রশ্নের উত্তর দাগাতাম। নীল পেন্সিল দিয়ে মাঝারি জানা প্রশ্নের উত্তর চিহ্নিত করতাম। সবশেষে সবুজ পেন্সিলে সবচেয়ে ভালো জানা প্রশ্নগুলোর উত্তর দাগিয়ে রাখতাম। এর ফলে পরীক্ষার দুদিন আগে আমাদের পড়ার মতো বিষয় কমে আসলো। দেখা গেলো হাতে গোণা পঞ্চাশটা প্রশ্ন রিভিশন করার মতো ছিলো। মেডিক্যাল ভর্তি প্রশ্নের জটিলতা ছিলো, কোন উত্তর থাকতো না, চারটা উত্তরও থাকতে পারতো এবং উপরের সব ঠিক, কোন্টি সত্য নয়, দুই ও তিন নং ঠিক এই জাতীয় উত্তরের ব্যবস্থা ছিলো। ফলে ঘোরানো-প্যাঁচানোর কারণে উত্তরে জটিলতা তৈরি হতো। তবে একটা সাধারণ সূত্র ছিলো আমাদের। প্রথম যে উত্তর মনে আসে সেটাই সত্য, এই বেদবাক্য ধরে নিয়েই আমরা আগাতাম। মেডিক্যাল ভর্তির গাইডের কলেবর ছিলো গামা কুস্তিগীরের মতো মোটা। তাকে এক হাতে আলগানো কঠিন ছিলো। আমাদের কোচিংয়ে অনেকেই মডেল টেস্ট দিতে এলেও আমরা কোথাও আর মডেল টেস্ট দেইনি। কারণ বিষয় একই। শুধু চ্যাপ্টারগুলো রিডিং পড়ে গেলেই হয়।
মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার এমসিকিউ-এর রেজাল্ট প্রকাশিত হওয়ার পর আমাদের ভাইবার জন্যে ডাক পড়লো। প্রতিদিন বেশ কয়েকটা বোর্ডে পরীক্ষা হতো। প্রতি বোর্ডে বিশ জন করে পরীক্ষার্থী ছিলো। আমি পড়েছিলাম অধ্যাপক মান্নান সিকদার স্যারের বোর্ডে। মোট কুড়ি নম্বরের ভাইবা ছিলো। তাতে ঊনিশ নম্বর পেতে মোটামুটি অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে। সেদিন যারা আমার সাথে পরীক্ষা দিয়েছিলো তাদের কয়েকজনের প্রশ্ন, আমার এক নম্বর কাটলো কীসে। আর্কিমিডিসের সূত্র দিয়ে শুরু এবং ইংরেজি ট্রান্সলেশনে এসে তা শেষ। এর মধ্যে আমাকে ডাবের ভেতরে ঢুকতে হলো, টরিসেলির সূত্র বলতে হলো, আরও কতো কী! এই ভাইবা পরীক্ষার জন্যে ক্ল্যাসিক কোচিং সেন্টারে বেশ কয়েকটা ডামি ভাইবা নেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমবিবিএস-এর ইলাবোরেশন জিজ্ঞেস করেছিলো। এটা যে মেডিসিনিয়া ব্যাকেলরিয়া ব্যাকেলরিয়া সিরগিজ, একথা অনেকেই জানেন না। সবাই ব্যাচেলর অব মেডিসিন ব্যাচেলর অব সার্জারি বলেই খালাস। যদিও ল্যাটিন শব্দ হতেই এমবিবিএস-এর উৎপত্তি, তবুও তা ইংরেজি ফর্মেই প্রচলিত অধিক।
যেদিন পূর্ণাঙ্গ রেজাল্ট দিলো, সেদিন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ আমার ঠিকানা হওয়ায় বাবা এই বলে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন যে, যাক ঘর থেকে গরম ভাত খেয়েই ক্লাস করতে পারবি। আসলে এমববিবিএস কোর্স দীর্ঘ মেয়াদী বলে যে কোন বাবা-মায়ের কাছে তা ভাববার বিষয়। দূরের কোনো কলেজে যেতে হলে ছয় বছরের খরচের বিষয়টা মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। ভর্তির দিন মার্কশীটসহ অন্যান্য কাগজপত্র চেক করার দায়িত্ব পড়লো অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী স্যারের কাছে। তারপর চোখের দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষণ। তখনো আমার চশমার দরকার পড়েনি। হার্নিয়া আছে কি না তাও পরীক্ষা করা হলো। তারপর ভর্তি নিশ্চিত হলো। চারশ সতের কি সাতাশ টাকা ভর্তি ফি লাগলো। ব্যস্! ওইটুকুই। এভাবেই হয়ে গেলাম চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের একজন শিক্ষার্থী।
আমার মেজদা যখন মেডিক্যালে ভর্তি হতে পারলো না তখন আমাদের গ্রামের এক কাকিমা আমার মাকে বলেছিলেন, আশীষের মা, দিদি আপনি তো পারলেন না ছেলেকে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করাতে, দেখি আমি পারি কি না। কিন্তু তাঁর ছেলেও মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য হলেন না। পরে আমার মাধ্যমে মায়ের সেই ইচ্ছা পূরণ হওয়ায় তাদের মধ্যকার হা-হুতাশ দূর হলো। আসলে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়া একটা সাধনা। এটা এমন না যে, কেবল এক বছর ভালো করলেই হবে না, দুটো পাবলিক পরীক্ষায় অসাধারণ ভালো করার পর মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। এখন অবশ্য ভর্তিপূর্ব ভাইবা পরীক্ষা নেই। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির পর বাবা হাঁফ ছেড়ে মন্তব্য করলেন, আমার সেজ ছেলের পড়াশুনায় আমার তেমন কোনো ব্যয় নেই। কারণ সে সব ক্লাসে বৃত্তি পেয়েই পড়ে এসেছে। (চলবে)