শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

জসীমউদদীন বাংলা সাহিত্য বলতে কী বুঝতেন!

ড. কুদরত-ই-হুদা
জসীমউদদীন বাংলা সাহিত্য বলতে কী বুঝতেন!

জসীমউদদীন বাংলা সাহিত্যকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করতেন--দেশি এবং বিদেশি। বিদেশি সাহিত্য বলতে তিনি বিদেশিদের রচিত সাহিত্যকেই শুধু বোঝাতেন না। নিজের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে বাদ দিয়ে বিদেশি ভাবধারা নিয়ে রচিত সাহিত্যকে তিনি বিদেশি সাহিত্য হিসেবে গণ্য করতেন। এই হিসেবে তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীনচন্দ্র সেনের রচনাও দেশি ভাষায় রচিত বিদেশি সাহিত্য হিসেবে দেখতেন।

খাঁটি বাংলা সাহিত্য খুঁজে বের করতে জসীমউদদীন দুটি মোক্ষম জায়গায় হাত দিয়েছিলেন। এক, ভাবগতভাবে বাংলা সাহিত্যে ইউরোপীয় চেতনার প্রবেশ এবং দুই, ভাষাগতভাবে সংস্কৃত শব্দের ব্যাপক আমদানি। জসীমউদদীনের বাংলা সাহিত্য বিষয়ক চিন্তা ও তাঁর নিজের সাহিত্যকর্ম এই দুইয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিশিষ্টতা লাভ করেছে।

একটা জাতি যখন অন্য একটি জাতি দ্বারা অধিকৃত হয়, তখন বাইরে থেকে বিষয়টি কেবল ভূখণ্ডগত আর শাসন-শোষণগত মনে হয়। এটি মূলত উপনিবেশের বাইরের চেহারা। কিন্তু ভেতরের চেহারা অন্যরকম। ঔপনিবেশিক শক্তি যখন আসে, তখন সাথে নিয়ে আসে তার নিজস্ব সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান আর সভ্যতার ধারণা।

উপনিবেশিতের সভ্যতার ধারণার সঙ্গে ঔপনিবেশিক সভ্যতার ধারণার তখন শুরু হয় দ্বিপাক্ষিক সংঘর্ষ। এই ঠেলাঠেলিতে সংগত কারণেই ক্রমে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে ঔপনিবেশিক শক্তির সভ্যতাণ্ডসংস্কৃতি। কারণ, এর পেছনে থাকে রাজ-পৃষ্ঠপোষকতা আর অর্থনৈতিক ক্ষমতার আধিপত্য।

জসীমউদদীন বিষয়টি বুঝতেন। তিনি এও বুঝতেন যে, উপনিবেশিত অঞ্চলে ঔপনিবেশিক চিন্তা ও সংস্কৃতি-সভ্যতা টিকে থাকে নতুন ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত নব্য শ্রেণির মগজে ও কলমের ডগায়। বাংলায় তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।

ইউরোপীয় চিন্তা আর সংস্কৃতি বাংলা অঞ্চলে দাপুটে হয়ে উঠেছে ঊনিশ শতকে ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মগজ ও কলমের মাধ্যমে। জসীমউদদীন বলেছেন, ‘কলিকাতায় তাঁরা (ইংরেজ) নতুন নগর পত্তন করলেন, হিন্দু-ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বৈদ্যের দল এখানে এসে আস্তানা তুললো। ইংরেজের নতুন সভ্যতা এঁরা চোখ বুঁজে গ্রহণ করলেন। ... নতুন যে মধ্যবিত্ত-হিন্দু-দলটি শহরে এসে আস্তানা তুললো, তাতে শহরে তাদের নিজস্ব কোনো tradition -এর বনিয়াদ ছিল না। তাই ইংরেজের নগরে এসে তারা ইউরোপীয় ভাবধারার পানপাত্রটি পরিপূর্ণ মনে শুধু গ্রহণই করলো না, নিজের দেশের গ্রাম্য-জীবনের সেই প্রাচীন ভাবধারার বনিয়াদকে লাথি মেরে দূরে ছুড়ে ফেলে দিল।’

প্রকৃতপক্ষে, ঊনিশ শতকের নতুন এই সাহিত্যিক শ্রেণি ছিলেন দেশের বিপুল সংখ্যক গণমানুষ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ফলে, যা দাঁড়াল তা হচ্ছে, ইউরোপীয় জীবন চেতনার আলো যে মুষ্টিমেয় কলকাতা নগরকেন্দ্রিক শিক্ষিত শ্রেণির ওপর পড়লো তাদের অনুভূতির বয়ান তাদেরই নতুন বাংলা ভাষায় রূপায়িত হতে থাকলো।

বাংলা সাহিত্য হয়ে উঠলো নতুন ভাব ও ভাষার আকর। এই নতুন ভাবের নাম হলো ‘মহৎ-ভাব’, ‘উন্নত-ভাব’। আর নতুন ভাষার নাম হলো ‘মহৎ-ভাষা’, ‘উন্নত-ভাষা’। আপামর জনসাধারণের মনের মধ্যে খেলে যাওয়া ভাব আর তাদের ব্যবহৃত ভাষা বাংলা সাহিত্য থেকে দূর হয়ে গেলো।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যিনি মূলত নতুন সাহিত্যিক শ্রেণির প্রথম দিককার প্রধান সেনাপতি নিজেই রায় দিলেন যে, জনমানুষের মুখের কাছাকাছি ভাষায় গ্রন্থ রচিত হওয়া উচিত নয়। কেননা তা ‘উন্নত’ নয়; ‘উন্নত ভাব’ প্রকাশের ক্ষমতা তার নেই।

বাংলা সাহিত্য ঔপনিবেশিক পর্বে ঢোকার ফলে এর কয়েকটি গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। প্রথমত, এটি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে মুষ্টিমেয় অভিজাত লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়েছে। দ্বিতীয়ত, পাশ্চাত্য জীবন চেতনা দ্বারা স্নাত হয়েছে।

তৃতীয়ত, পূর্বতন সাহিত্য ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। চতুর্থত, আঙ্গিকের নানামাত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ঋদ্ধ হয়েছে। পঞ্চমত, সাহিত্য শ্রুতির বিষয় থেকে শুধু পাঠ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

ষষ্ঠত, বহুমানুষের সম্মিলিত উপভোগ থেকে সাহিত্য ব্যক্তির প্রাইভেট উপভোগের দরজা খুলে দিয়েছে। জসীমউদদীনের নিজের সাহিত্যকর্ম এবং সাহিত্যতত্ত্ব এইসব পরিবর্তনের উজানে চলেছে সবসময়। জসীমউদদীন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের যমুনার উজান স্রোতের নাম।

জসীমউদদীনের কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ বাল্যকালেই। তাঁর কবি হয়ে ওঠার যে-বর্ণনা তিনি জীবনকথা গ্রন্থে দিয়েছেন তা যেমন চমকপ্রদ, তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ।

তখন জসীমউদদীনের বয়স সাত-আট বৎসর। চাচার বিয়ের বরযাত্রী হয়ে গেলেন শ্যামসুন্দরপুর গ্রাম। পাশের গ্রামে পরদিন ঢোলের বাদ্য শুনে সেই শব্দ ধরে হাজির হন। ‘সেখানে দুইদল কবি-গায়কের মধ্যে পালা হইতেছিল। ... কবিয়ালেরা যখন তাল-ছন্দ ঠিক রাখিয়া একটি পদের সঙ্গে অপর পদের মিল দিয়া উপস্থিত বোল তৈরি করিতেছিল, সেই মিলের আনন্দে আমার সর্ব দেহ-মন আলোড়িত হইতেছিল। ... গানের একটি ধুয়া বারবার আবৃত্তি করিতে করিতে আমি বিবাহ বাড়িতে ফিরিয়া আসিলাম।’

এভাবেই তার কবি হয়ে ওঠা। কবিয়ালের গর্ভ থেকে জসীমউদদীন কবি হয়ে উঠেছেন। তার পরবর্তী কবি জীবনে এবং সৃষ্টিশীল সত্তায় এই কবিগান এবং অসংখ্য কবিয়ালের প্রভাব ছিল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জসীমউদদীনের কবিতার সাবলীলতা এবং ছন্দের সহজ গতির প্রশংসা করলে তিনি বলেছিলেন ‘ইহা যদি আমার গুণ হইয়া থাকে তবে এই শিক্ষা আমি পাইয়াছি আমার দেশের অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত কবিয়ালদের কাছ থেকে। তাহারাই আমার কাব্য জীবনের প্রথম গুরু। সেই যাদব, পরীক্ষিত, ইসমাইল, হরি পাটনী, হরি আচার্য এঁদের কথা আমি যখন ভাবি আমার অন্তর কৃতজ্ঞতায় অশ্রুসিক্ত হইয়া উঠে।’

এমনকি যে ‘কবর’ কবিতা জসীমউদদীনকে অল্প বয়সে অতুলনীয় কবি-স্বীকৃতি এনে দিয়েছিল, সেই কবিতার সাদৃশ্য তিনি খুঁজে পেয়েছেন এক অখ্যাত কবিয়াল হরি আচার্যের রচনায়। একথা তিনি হরি আচার্যের কাছে স্বীকারও করেছেন।

হরি আচার্যকে তিনি তার ‘পরিণত বয়সে’ বলেছিলেন, “আপনার রচিত নিমাই সন্ন্যাস গানটি যদি আমি আগে শুনিতাম তবে হয়তো আমার ‘কবর’ কবিতা রচনা করিতাম না। আপনার নিমাই সন্ন্যাস যে-আসরে গীত হয়, শ্রোতারা কাঁদিয়া বুক ভাসায়।”

সুতরাং জসীমউদদীনের কবি-প্রতিভার গঠনে দেশীয় গণমানুষের কাব্যরস-পিপাসা-মেটানো-সাহিত্যধারা এবং এর রচয়িতাদের রয়েছে এক ব্যাপক প্রভাব। তিনি বাংলা সাহিত্য বলতে বুঝতেন ওই বহুমানুষের ভোগ-উপভোগের সাথে সম্পৃক্ত সাহিত্যকে।

উপনিবেশ আমলের কাব্যধারা বাদ দিলে এর পূর্বের সব কাব্যই রচিত হতো গণমানুষের উপভোগের জন্যে। চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র সবার রচনাই বহুমানুষের কাব্যরস পিপাসা নিবৃত্ত করেছে। গণমানুষের উপভোগের জন্যে রচিত হতো বলে জসীমউদদীন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যকে বলতে চান ‘গণ-সাহিত্য’ ও খাঁটি বাংলা সাহিত্য।

জসীমউদদীন আজীবন নিজেকে বাংলা সাহিত্যের মূলধারার সাহিত্যিক মনে করতেন। বলতেন, তিনিই বাংলাদেশের নব্বই ভাগ মানুষের রুচি-চিন্তা ও নন্দনের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনিই খাঁটি বাংলা ভাষার কবি। কিন্তু বাংলা সাহিত্য জসীমউদদীনের সেই ধারায় এগিয়ে যাননি। ইউরোপীয় ধারারই এখানে জয়জয়কার।

তবে একথা সত্য যে, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের দুইশ বছরের সাধনার মধ্যে ঔপনিবেশিক সাহিত্যধারা থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা কম-বেশি কারো কারো মধ্যে লক্ষ করা গিয়েছে।

বাংলা সাহিত্য কোথাও কোথাও স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করেছে এবং করছেও। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এইসব প্রচেষ্টা আসলে তাত্ত্বিকভাবে জসীমউদদীনের সাধনারই সমীপবর্তী। সম্ভবত সাহিত্যে আর চিন্তায় যখনই আমরা উপনিবেশ বিরোধিতার কথা বলি তখনই জসীমউদদীনের ‘দেশি বাংলা সাহিত্যের’ ধারণা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে। ফলে জসীমউদদীন পুরাতন নন, মৃত নন। তিনি উত্তর ঔপনিবেশিক সাহিত্য-সংগ্রামের এই যুগের প্রধানতম কবি।

ড. কুদরত-ই-হুদা : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও শিক্ষক

[email protected]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়