বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

(চতুর্থ খণ্ড)

কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র হিসেবে প্রবেশ করার পর ইংরেজি ছিলো আমাদের বন্ধুদের কাছে ফেভারিট ক্লাস। আমাদের ইংরেজি ক্লাস নিতেন রেহানা আলম খান ম্যাডাম, আব্দুর রশিদ স্যার, আবুল কালাম স্যার, অজিত দাশ স্যার এবং নাজিমুদ্দিন স্যার। রেহানা আলম খান ম্যাডাম অনেক সুন্দর দেখতে একজন মানুষ। তিনি পড়াতেন ‘অ্যা মাদার ইন ম্যানভিল’ গদ্য। আব্দুর রশিদ স্যার পড়াতেন 'গিফট অব দ্য ম্যাজাই।' অজিত দাশ স্যার পড়াতেন 'দ্য লাঞ্চিঅন'। নাজিমুদ্দিন স্যারের বিষয় ছিলো 'দ্য অ্যানসিয়েন্ট ম্যারিনার।' কালাম স্যার কী পড়াতেন তা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। রেহানা ম্যাডামের ক্লাসে বন্ধু জিয়াউদ্দিন মাহমুদ দিনার গ্যালারির ওপর থেকে মার্বেল ছেড়ে দিলো একদিন। এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে মার্বেলগুলো যেন কুচকাওয়াজ করতে করতে পড়ছিলো ওপর থেকে নিচে। পিন পতন নিরবতার মাঝে মার্বেল পতনের শব্দ যেন জলপ্রপাতের চেয়েও বাক্সময় হয়ে উঠলো। ম্যাডাম অত্যন্ত বিজ্ঞতায় এই অনভিপ্রেত বিড়ম্বনা সামাল দিলেন। যদিও তাঁর লেমন ইয়েলো গ-দেশে গোধূলির রঙরাগে এঁকে তুলেছিলো বেয়ারা মোকাবেলার মহাকাব্য।

আব্দুর রশীদ স্যারের পড়ানোর ধরণে নিজস্বতা ছিলো। তিনি একটু চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলতেন বিধায় দুষ্টুরা বলতো, স্যার মনে হয় কথাগুলো থেকে ভাইটামিন চুষে নিচ্ছেন। স্যারের পড়ানোর কারণে আমরা বাইবেলের কিছুটা জানতেও পেরেছিলাম। অজিত স্যারের পড়ানোর কৌশলের কারণে আজও মনে আছে, 'আয়্যাম টুওও ইয়াং টু সে নো টু অ্যা উওম্যান।' নাজিমউদ্দিন স্যার তখনও বিবাহিত ছিলেন না এবং তিনি পড়াতে আসলে ছেলেরা তাঁকে লক্ষ্য করে নিম্নস্বরে অনেক নামে ডাকতো। তুলনামূলক কালাম স্যার ছিলেন বয়সের কারণে ধীরস্থির। তাঁর পাঠদান তাই কোন বিড়ম্বনা ছাড়াই সমাপ্ত হতো। স্যারদের পড়ানোর লক্ষ্য ছিলো যেন একটা গদ্য দিয়েই ছয়মাস কাটিয়ে দেওয়া যায়। যে কারণে রেফারেন্স থেকে শুরু করে গল্পেসল্পে কেটে যেতো দিন। বলতেই হয়, যে পরিমাণ সময় তাঁরা পেয়েছিলেন, সেইভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাঁরা ইংরেজি প্রীতি তৈরি করতে পারেননি।

বাংলা পড়াতেন কবি আ ফ ম সিরাজউদ্দৌলা স্যার, আখতারুজ্জামান স্যার এবং অর্ধেন্দু বিকাশ রুদ্র স্যার। সিরাজউদ্দৌলা স্যার বানান জানা জিজ্ঞেস করতেন। একদিন তিনি আমাকে দাঁড় করিয়ে বিদূষী, মনীষীসহ আরো একটা বানান জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমার উত্তরের পর তিনি পুরো ক্লাসকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার উত্তর ঠিক হয়েছে কি না। তিনি মৌখিক ভোট নিলেন সবার। দেখা গেলো, খুব কম সংখ্যক বা হাতেগোণা শিক্ষার্থীই হাত তুললো আমার পক্ষে। অর্থাৎ তাদের মতে আমার করা বানান শুদ্ধ। আর অধিকাংশই হয় আমাকে একহাত নেওয়ার জন্যে নয়তো স্যারের ভোটাভুটির ধরণে বিভ্রান্ত হয়ে আমার বিপক্ষে রায় দিলো। পরে স্যারে ভোট গণনা করে বললেন, ভালো ও খাঁটি জিনিস খুব কম লোকেই চিনে। ও শুদ্ধ বানান করতে পারে বলেই বোর্ড স্ট্যান্ড করেছে। সুতরাং সেই দফায় স্যারের স্নেহার্দ্র বাক্যে আমার মান বাঁচলো।

আখতারুজ্জামান স্যার একদিন সৈয়দ আলী আহসানের বিখ্যাত কবিতা 'আমার পূর্ব বাংলা' পড়াচ্ছিলেন। তখন সৈয়দ আলী আহসান স্বৈরাচারের পক্ষ নিয়ে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে কবি বানানোর লীজ নিয়েছিলেন। তাই আমি একটু সাহসী হয়ে বলেছিলাম, স্যার, আমরা এই কবিতা এখন কেন পড়ছি? আমরাতো এখন বাংলাদেশ, এখনতো আর পূর্ব বাংলার নই। কাজেই এই কবিতা এখন পড়া ঠিক হবে না। স্যারে আমার সাথে একমত হয়েও বলেছিলেন, এবারের মতো পড়ি। কিন্তু এর পরিণাম টের পেলাম ক্লাসের পরে। শিবিরের নেতারা আমাকে ক্লাসের পরে নিরালায় ডেকে নিয়ে ভয় দেখালো, যাতে রাজাকার জাতীয় কোনো শব্দ ক্লাসে বা কলেজের ক্যাম্পাসে উচ্চারণ না করি। অর্ধেন্দু বিকাশ রুদ্র স্যার পড়াতেন ভাষা ও ছন্দ কবিতা। দার্শনিক গভীরতা নিয়ে তিনি তাঁর সহজ ব্যক্তিত্বে পড়াতেন কবিতাটি। তাঁর সাথে পড়তে পড়তে কতোবারই মনে হয়েছে, কবির কী মহৎ আশা, তাঁর ছন্দে-গানে মানবতার জয়গান গেয়ে তিনি মানুষকে দেবপ্রতিম করে তুলবেন।

গণিতের ক্লাসে হরিদাস হালদার স্যার যখনই ক্লাসে আসতেন, আমাকে বোর্ডে ডেকে নিয়ে অঙ্ক (গণিত) করতে দিতেন। স্থানাঙ্কের অঙ্ক। তিনি আমার নাম মনে রাখতে পারতেন না। বার বার আমাকে পঙ্কজ নামে ডাকতেন। বলতেন, একটা অঙ্ক পারলে পাঁচটা পার্সেন্টেজ ফ্রি। আমি তাঁর স্নেহের বদৌলতে বার বারই তা অর্জন করতাম। একদিন স্যার ক্লাস চলাকালীন আওয়াজের কারণে আমাকে বলেছিলেন, গ্যালারির দরোজা আটকে দিতে। তখন কিন্তু আমার পার্সেন্টেজ পাওয়া শেষ। আমি তাই দরোজা বন্ধ করতে এসে নিজেকে বাইরে রেখে কপাট আটকে দিলাম। বিষয়টি স্যারের নজরে না আসলেও বন্ধুরা স্যারের নজরে আনলো। সেই ক্লাসে তিনি আবার আমাকে ডাক পাঠিয়ে ক্লাসে ফেরালেন। আমাকে শুধু বানিয়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বলতে হয়েছিলো শাস্তি এড়াতে।

রসায়নবিদ্যার ক্লাসে মোত্তালিব স্যার পড়াতেন অজৈব রসায়নের ওজোন গ্যাস। ওজোন কীভাবে প্রকৃতিতে তৈরি হয় তা তিনি বুঝাতে গিয়ে বলতেন, শব্দহীন বিদ্রুত ক্ষরণের ফলে নীলাভ আলো দেখা যায় ও ওজোন গ্যাস তৈরি হয়। তিনি কখনো বিদ্যুৎ কথাটা বলতে পারতেন না। জাফর স্যারের কথা মনে আছে, যিনি পিরিয়ডিক টেবল পড়াতে গিয়ে লিখতে লিখতে ব্ল্যাক বোর্ড হাতে নিয়ে নিতেন। কেমিস্ট্রি ক্লাসে আমরা পেয়েছিলাম চৌধুরী মনজুরুল হক স্যারকে। তিনি বলতেন, বাংলাদেশে অনেক মনজুরুল হক চৌধুরী আছে কিন্তু চৌধুরী মনজুরুল হক আছে একজন। এজন্যে তাঁকে সংক্ষেপে ডাকা হতো সিএমএইচ।

বোটানি পড়াতেন তিনজন। তাঁরা হলেন নূরুল হুদা স্যার ( যিনি আবার উপাধ্যক্ষও বটে), জ্যোতিপ্রকাশ স্যার এবং এনামুল হক। নূরুল হুদা স্যার পড়াতেন কোষ ও কোষ বিভাজন। জ্যোতিপ্রকাশ স্যার পড়াতেন উদ্ভিদের দ্বিপদী নামকরণ আর এনামুল হক স্যার পড়াতেন উদ্ভিদের অঙ্গসংস্থান। নূরুল হুদা স্যারের পরনের প্যান্ট এবং তাঁর দৈহিক গঠনের জন্যে বন্ধুরা নাম দিয়েছিলো ভ্যাট সিক্সটি নাইন। অবশ্য তিনি তা জানতেন না। এনামুল হক স্যার বোর্ডে ঘাসের পর্ব ও পর্বমধ্য বুঝাতে গিয়ে চিত্রটা বড় হয়ে যায়। তিনি ব্ল্যাকবোর্ড হতে মাথা তুলে পিছনে ফিরে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী? বেঞ্চের পেছন সারি থেকে জবাব আসলো 'বাঁশ'। ব্যস্! স্যার গেলেন খেপে। এরপরে আর ক্লাস হলো না। হলো শুধু গালমন্দ।

কলেজে কলেজিয়েট স্কুল আর চট্টগ্রাম স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে একটা স্নায়ুযুদ্ধ চলতো। দুটো স্কুলের ছাত্ররাই নিজেদের ডন ভাবতো। আমরা ভয়ে ছিলাম, চট্টগ্রাম স্কুলের ছাত্ররা এই বুঝি এনামুল হক স্যারকে সেই নামটা বলে দ্যায়, কে বাঁশ শব্দটা উচ্চারণ করেছিলো। সৌভাগ্যবশত তারা কেউ সেদিন এ কথা ফাঁস করেনি।

পদার্থবিদ্যার ক্লাস হতো হোস্টেলের দিকে যেতে পদার্থবিদ্যা ভবনের নিচতলায়। তুষার কান্তি বিশ্বাস স্যার, সিরাজুল ইসলাম এবং নূরুল হক স্যার ক্লাস পেতেন। কলিমদাদ স্যার ডেমোনেস্ট্রেটর হলেও মাঝে মাঝে ক্লাসে আসতেন। একবার সিরাজ স্যার আলোর প্রতিসরণ পড়াতে গিয়ে ছবি আঁকতে হলো বোর্ডে। কিন্তু তাঁর আপতন কোণ এবং প্রতিসরণ কোণ বড় হয়ে যাওয়ার কারণে তিনি বোর্ডে প্রতিবিম্ব গঠন করে দেখাতে পারছিলেন না। তিনি বিব্রত হয়ে পড়েন। স্যারের ডায়াগ্রাম দেখে সবাই হেসে দিলো। এটা স্যারের ইগোতে লেগে যাওয়ায় তিনি টি-স্কেল দিয়েই পিছনের দুই সারিকে মেরামত করা শুরু করলেন। ফিজিক্সের তুষার কান্তি বিশ্বাস স্যারের একটা মুদ্রাদোষ ছিলো। তিনি কথায় কথায় 'আর কী' শব্দ ব্যবহার করতেন। পদার্থবিদ্যার ক্লাসে একদিন বাজি ধরলো এক বন্ধু, আমি মেয়েদের সিটে বসতে পারবো কি না। তখনো ক্লাসে স্যার না আসায় আমি অনায়াসে সেই বাজি জিতে পাঁচ টাকা পেয়েছিলাম।

প্রাণিবিদ্যার ভবনটা ছিল নিচু জায়গায়। তবে ক্লাস হতো দুইতলায়। কিন্তু ঐ ভবনের দুইতলা মানে রসায়নবিদ্যা ভবনের নিচতলার সমান। আবার রসায়নবিদ্যা ভবনের তিনতলা মানে ভূগোল বিভাগের নিচতলার সিঁড়ি। প্রাণিবিদ্যা পড়াতেন জয়নাব ম্যাডাম, শহীদুল্লাহ্ স্যার, হরিপদ দত্ত এবং ডেমোনেস্ট্রেটর ছিলেন বাসন্তী ম্যাডাম। জয়নাব ম্যাডাম পড়াতেন মানবশারীরবিদ্যা। একদিন তিনি ক্লাসে রেচনের সংজ্ঞা জিজ্ঞেস করলেন। আমাদের ভর্তির কারণে রোল এক যার, সে দাঁড়িয়ে উত্তর দিলো, যে প্রক্রিয়ায় বিপাকের ফলে উৎপন্ন দেহের নাইট্রোজেনজনিত বর্জ্য পদার্থ বের হয়ে যায় তাকে রেচন বলে। আমি জবাবের বিরোধিতা করে বলেছিলাম, ম্যাডাম, ও তে সম্পূর্ণ শুদ্ধ বলেনি। তার সংজ্ঞায় 'বিপাকের ফলে উৎপন্ন' এই কথাটা বলেছে। কিন্তু ডায়রিয়া রোগীর ক্ষেত্রে পাচিত ও অপাচিত সবই তো বের হয়ে যায়। ম্যাডাম বুঝেছিলেন, আমি দুষ্টুমিও করেছি আবার বুদ্ধিদীপ্ত বিরোধিতা করেছি। তাই তিনিসহ পুরো ক্লাস হেসে উঠলো। আমাদের শহীদুল্লাহ্ স্যার পড়াতেন সিলেন্টারেটা পর্ব। তাই একসময় তাঁর নাম হয়ে যায় হাইড্রা। তিনি অবশ্য নিডারিয়ার মতো চিকনও ছিলেন। হরিপদ স্যার ছিলেন বন্ধু পলাশের বাবা। দুষ্টুরা পলাশকে খেপানোর জন্যে হরিপদ স্যারের নামে 'প'-এর সাথে আ-কার আর 'দ' এর সাথে এ-কার যোগ করে ডাকতো।

একানব্বই সালের ঊনত্রিশে এপ্রিল ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয়। সেই প্রথম সুনামির কথা শোনা যায়। সুনামিকে বাংলায় কেউ কেউ জলকম্পও বলতো। সাগরের তলদেশে ভূমিকম্পের কারণে প্রায় তিরিশ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়। বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলি নদীর মোহনা হতে কিছু কিছু ছোট ছোট জাহাজ খালে ঢুকে ডাঙায় উঠে যায়। ক্যাম্পাসের গাছের পাতাগুলো অগ্নিবায়ুতে দগ্ধ হয়ে বাদামী হয়ে যায়। মনে হয় তারা ঝলসে গিয়েছে। বড় বড় গাছ শেকড়সহ উপড়ে রাস্তার ওপর পড়ে থাকে। বিদ্যুতের খুঁটি কয়েকটির অবস্থাও তথৈবচ। এইদিন রাতে আমার বাবা হাওয়ার প্রচণ্ড তাণ্ডবে আর তাঁর কর্মস্থল থেকে বের হতে পারেননি। সারারাত তিনি সেখানে কাটিয়ে দেন কোনোমতে। ভোর হলে পরে সকাল সাতটায় আমার মা আমাকে দুটো ছাতা দিয়ে বাবাকে আনতে পাঠান। আমি ও বাবা শেষমেষ যুদ্ধজয়ী পিতা-পুত্রের মতো বাসায় আসি। বিদ্যুতের সংযোগ বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে আলো আসতে দুই-তিনদিন লেগে যায়। সবাই হারিকেন-মোমবাতি দিয়ে কোনোমতে জীবনকে বহমান রাখে। ভাগ্যিস! সেদিন রাতে অর্থাৎ ঊনত্রিশে এপ্রিল রাতে আমার দিদিমা আমাদের বাসায় ছিলেন। কিন্তু সকাল হওয়ার পর থেকেই আমার দিদিমাকে আর আটকে রাখা গেলো না। তিনি তাঁর বাড়িতে যাবেনই। তাঁর ভাড়াটিয়ারা না জানি কী হালে আছে। মা বুঝিয়ে সুজিয়ে দুপুরের ভাত খাইয়ে আমাকেসহ পাঠালেন চাঁদগাঁওয়ে। যাওয়ার পথে বাস তখনও চালু হয়নি। আমরা ভেঙে ভেঙে পথ চলেছিলাম। কোন কোন জায়গায় পথ এতো দুর্গম হয়ে উঠেছিলো যে, দিদিমাকে আমি পাঁজাকোলা করে পার করেছি ঐ পথ। অবশেষে তাঁর ভিটায় আমরা পৌঁছালাম। গিয়ে দেখি, ভাড়াটিয়াদের বাসাগুলো অতো ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও আলো-জল নেই। ত্বরিত ব্যবস্থা নিয়ে দিদিমা জলের ব্যবস্থা করালেন। বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ না দেওয়া অবধি অপেক্ষায় থাকতে হলো। ঐদিন সন্ধ্যায় আমি ও দিদিমা আবার শহরে আমাদের বাসায় চলে আসি। এই ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি ছিলো। এখন অবশ্য ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ হলেও তখন এরকম নাম দেওয়া হয়নি। ফলে তারিখ দিয়েই ঘূর্ণিঝড়কে মনে রাখতে হতো। আজ যত সহজে হামুন, সিত্রাং কিংবা মহাসেনদের নাম বলা যাচ্ছে, তখন অতো সহজে তা করা যেতো না।

কলেজে প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন শুরু হলো। কারণ নব্বইয়ের শেষের দিকে এরশাদ ভ্যাকেশন এবং একানব্বইয়ের এপ্রিলে ঘূর্ণিঝড় আমাদের দাবিকে বৈধতা দিয়েছিলো। কোনো কারণে পরীক্ষা পেছানোর দরখাস্ত মুসাবিদা করার দায়িত্ব বর্তালো আমার ওপর। আমি যুক্তি দেখিয়ে পরীক্ষা পেছানোর আবেদন রচনা করলে শিবিরের ক্যাম্পাস সভাপতি আনোয়ার ভাই তা সংশোধন করার জন্যে হাতে নিলেন। আমি লিখলাম, বিনীত, সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য। তিনি বললেন, সর্বদলীয় কথাটা লেখা যাবে না। লিখতে হবে সংগ্রামী ছাত্র ঐক্য। আমরা সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য লেখার বিষয়ে অনড় রইলাম। আমার সমর্থনে রাহিমসহ আমার অন্য বন্ধুরা অনড় থাকলো। আমাদের দৃঢ়তার জয় হলো। অতএব, সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের পক্ষে আবেদনপত্র জমা হলো। পরীক্ষা মে মাসের পরিবর্তে জুনে নেওয়া হলো।

কলেজে ঢোকার প্রথম কয়েক মাস পরে শুরু হলো শিবিরের দাওয়াতী সপ্তাহ। এ সময় শিবিরের নেতা সরফরাজ ভাই আমার সাথে হাত মিলিয়ে আমার শার্টের টাই বোতাম আটকাতে আটকাতে বললেন, পীযূষ ভাই, আমরা ক্ষমতায় আসলে আপনারা মেহমানের মতো থাকবেন। আমি তার প্রতিবাদ করে বললাম, আমার দেশে আমি কেন মেহমান হবো? তিনি বলেছিলেন, না, সেরকম নয়, আসলে আপনাদেরকে সুযোগ-সুবিধা বেশি দেওয়া হবে। এরমধ্যে মুজিববাদী ছাত্রলীগের হারুণভাই, যিনি অনার্সের ছাত্র ছিলেন, তিনি চকবাজার সবুজ হোটেলে চুপে চুপে আমাদের ডেকে মিটিং করলেন। আমরা পরদিন আন্দরকিল্লা আইন কলেজের সামনে প্রেসের ওপর তলায় আ জ ম নাছির ভাইয়ের বাসায় গেলাম। সেখানে রায়হান হাসনি ভাই ছিলেন। তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের বড় ক্যাডার। তার বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, আমরা চাইলে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই চট্টগ্রাম কলেজকে শিবিরমুক্ত করতে পারি। কিন্তু এতে আপনাদের ক্ষতি হবে। কারণ আমরা এসে যাওয়ার পর ওরা আবার দখল করে নিবে এবং আপনাদের ওপর অত্যাচার বাড়বে। তাই যা করতে হবে তা বুদ্ধি দিয়ে, কৌশল দিয়ে। রায়হান ভাইয়ের বাস্তব অবস্থার বিশ্লেষণ আমাদের পছন্দ হলো। তাই আমরা পূর্বনির্ধারিত থাকলেও ক্যাম্পাসে আর মিছিল করিনি।

যে সময় আমরা কলেজে ভর্তি হই সে সময় কলেজের দেওয়ালে ছাত্র ইউনিয়নের চিকা মারা দেখতে পেতাম। তারা লিখতো, 'আগামীকাল বলে দিবে আজ আমরা কী পারিনি। শহীদ রাজুর রক্তাক্ত শার্ট আমাদের আদর্শের পতাকা।' ছাত্র ইউনিয়নের এই চিকা মারা দেখে আমার রাগ তাদের উপর গিয়ে পড়লো। আগে এই ছাত্র ইউনিয়নের হাতেই ছিলো চট্টগ্রাম কলেজের কর্তৃত্ব। কিন্তু তাদের ব্যর্থতার কারণেই এই ক্যাম্পাস চলে যায় ছাত্র শিবিরের একচ্ছত্র দখলে। আন্ডার গ্রাউন্ডের রাজনীতি এরাই শিবিরকে শিখিয়েছে। ঊনিশশো চুরাশি সালের আটাশে মে ছাত্র ইউনিয়নের শাহাদাতকে হোস্টেলে ঘুমন্ত অবস্থায় জবাই করে হত্যা করা হয় । শাহাদাত হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে দুজনের সাজা হয়। দুবছর পর উচ্চ আদালত এই মামলার প্রধান আসামি হারুন ও ইউসুফকে বেকসুর খালাস দেন। শাহাদাতকে জবাই করেই শিবির মূলত দখল করে নেয় চট্টগ্রাম কলেজ ক্যাম্পাস। ঊনিশশো বিরানব্বই সালে আমাদেরকে কলেজ ক্যাম্পাসে শিবির র‌্যাগডে পালন করতে দেয়নি। আমরা র‌্যাগডে পালন করি পাঁচলাইশ পার্কে। তারা কলেজের দেওয়ালে দেওয়ালে চিকা মারতো,'হে যুবক, মুক্তি চাও কি? এসো ইসলামী ছাত্র শিবিরের পতাকা তলে।' তারা আরও লিখতো, ' মানবরচিত সব ভ্রান্ত মতবাদ মানুষের মুক্তি দিতে পারে না।' তাদের দেওয়াল লিখন থেকেই বুঝা যায়, তারা ছাত্র ইউনিয়নকে টার্গেট করেই এই দেওয়াল লিখন লিখেছে। কারণ ছাত্র ইউনিয়ন তখন সেক্যুলারিজম ও কমিউনিজমের মানে পরিষ্কার করে বলতে পারেনি। সবার একটা ভাসা ভাসা ধারণা ছিলো, কমিউনিজম মানে নাস্তিক্যবাদ এবং সেক্যুলারিজম মানে ধর্মহীনতা। বঙ্গবন্ধু বার বার তাঁর বক্তব্যে এই বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন, অসাম্প্রদায়িকতা মানে ধর্মহীনতা নয়, বরং হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে, বৌদ্ধরা বৌদ্ধ ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা খ্রিস্ট ধর্ম পালন করবে এবং মুসলিমরা তাদের ধর্ম পালন করবে। রাষ্ট্র কাউকে বাধাও দেবে না, পৃষ্ঠপোষকতাও দিবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি চলবে না।

এইচএসসিতে পড়াকালীন বোটানি প্রাইভেট পড়তাম হামিদ স্যারের কাছে। তাঁর কারণেই আমার অনেক উদ্ভিদের দ্বিপদী নামকরণ শেখা হয়ে গেছে। তিনি প্রথমদিনই আমাদের অবাক করে দিয়েছিলেন, 'একটি লেবু গাছের কয়টি প্রাণ?' এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। পরে অবশ্য আমরাও উত্তর দিয়েছিলাম, যত কোষ তত প্রাণ। কারণ জীবের প্রতিটা কোষেই আছে প্রাণপঙ্ক। কলেজের ক্যান্টিনে আমার পছন্দের ছিলো তেহারি। তেহারি খেয়েই টিফিনে দৌড় মারতাম কমনরুমে টিটি বোর্ডে। মাঝে মাঝে ক্রিকেটের মাঠেও ছুটির দিনে আমাদের পদধূলি পড়তো। কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়তে পড়তেই আমাদের বন্ধু ক্রিকেটার সালাউদ্দিন ওরফে মিজান নাই হয়ে যায়। বর্ষাক্রান্ত দিনে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালাতে গিয়েই...। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়