সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২২, ০০:০০

শাপমোচন : ভিন্নধর্মী ভালোবাসার গল্প
অনলাইন ডেস্ক

বাংলা সাহিত্যে অবশ্যপাঠ্য উপন্যাসের তালিকা করলে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় রচিত ‘শাপমোচন’ উপন্যাসটির নাম অবশ্যই যুক্ত করতে হয়। শাপমোচন একটি রোমান্টিক উপন্যাস। রোমান্টিক বলে আখ্যায়িত হলেও ভালোবাসার ভিন্ন একটি রূপ এখানে চিত্রিত হয়েছে। সাধারণত একজন মানুষ তার প্রিয় মানুষকে নিজের করে পাওয়ার মধ্যেই ভালোবাসার স্বার্থকতা খুঁজে পান। কিন্তু নিজের করে না পেলেও যে ভালোবাসা স্বার্থক করা যায়, উপন্যাসে লেখক সেটিই দেখিয়েছেন। ভিন্নধর্মী এ ভালোবাসার গল্পই হয়তো শাপমোচনকে এতটা জনপ্রিয় করে তুলেছে। উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ সালে। পরে বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করা হয়।

শাপমোচনের কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম মহেন্দ্র মুখার্জি। তাকে মহীন বলে ডাকে কাছের মানুষরা। সেই মহেন্দ্রকে নিয়েই মূলত পুরো উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের ছেলে মহেন্দ্র। অল্প বয়সে বাবা-মাকে হারানোর পর বড়দাদা দেবেন্দ্রের তত্ত্বাবধানেই বড় হতে থাকে সে। স্কুলের পাঠ চুকিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার জন্য শহরের কলেজে গিয়ে ভর্তি হয় মহেন্দ্র। তার কিছুদিন পর হঠাৎ করেই তার দাদা দেবেন্দ্র অন্ধ হয়ে যান। চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে জমিজমা প্রায় সবই বিক্রি হয়ে যায়। তারপর এক পর্যায়ে পড়াশোনা ছেড়ে সংসারের ভার নিজের কাঁধে তুলে নেয়। অন্ধ দাদা, বৌদি আর ভাতিজাকে নিয়ে শুরু হয় তার নতুন জীবন সংগ্রাম।

দেবেন্দ্রের একমাত্র সন্তান খোকনকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসে মহেন্দ্র। খোকনের মুখে দু’বেলা ভালো খাবার তুলে দিতে, ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করাতে সে কী আপ্রাণ চেষ্টা তার! কিন্তু গ্রামে থেকে কিছুতেই যেন কুলিয়ে উঠতে পারছিল না সে। এক পর্যায়ে খোকনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভাগ্যের সন্ধ্যানে শহরে পাড়ি জমায়। শহরে উমেশবাবু নামে তার বাবার এক বাল্যবন্ধু থাকেন। সেই উমেশবাবুর বাড়িতেই প্রথম যায়। পরিচয় পাওয়ামাত্রই মহেন্দ্রকে চিনতে পারেন উমেশবাবু।

উমেশবাবু শহরের শীর্ষস্থানীয় ধনীদের একজন। বিশাল বাড়ি, গাড়ি, দাস-দাসি সবকিছু মিলিয়ে তার বাড়িটা যেন একটা রাজমহল। এ বাড়িতে মহীনের যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দেন তিনি। উমেশবাবুর ছেলেরা শুরুতে মহীনকে তেমন ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। অচেনা শহর, অচেনা পরিবেশ, আলিশান বাড়ি, অচেনা মানুষজনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল মহীনের। তার এই কষ্ট দূর করতে এগিয়ে আসে উমেশবাবুর মেয়ে মাধুরী। একে একে মহেন্দ্রকে সবকিছু বুঝিয়ে দেয় সে। শুরুর দিকে উমেশবাবুর অফিসে গিয়ে কিছুদিন কাজ শেখে মহেন্দ্র। তাকে হাতে ধরে টাইপিং শিখিয়ে দেয় মাধুরী। পাশাপাশি ছুটির দিনগুলোয় একসাথে শহরের বিখ্যাত জায়গাগুলো ঘুরে দেখে তারা। এ ছাড়াও শপিং, সুইমিং, বান্ধবীর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়াসহ প্রায় সব কাজেই মাধুরীর সঙ্গী হতে হয় মহীনকে।

একপর্যায়ে মহীনের অন্য জায়গায় চাকরি হয়ে যায়। চাকরির সুবিধার্থে উমেশবাবুর বাড়ি ছেড়ে দিয়ে অফিসের কাছে এক মেসে গিয়ে ওঠে সে। মহীনের চলে যাওয়াটা শুরুর দিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি মাধুরী। কেননা এ বাড়িতে থাকাকালীন মহীনের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল তার। পরে নিজেকে সামলে নেয় মাধুরী। হঠাৎ একদিন একরাশ জিনিসপত্র কিনে নিয়ে হাজির হয় মহীনের মেসে। সেখানে গিয়ে মহীনের ঘর নিজের হাতে সাজিয়ে দেয়। এরপর থেকে প্রায় প্রতি শনিবারই মহীনের মেসে যায়। একদিন নিজের পছন্দের সেতারটা মহীনকে দিয়ে আসে। মেসের অন্যরা মাধুরী আর মহীনের সম্পর্ক নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে। মহীনকে রীতিমতো ক্ষ্যাপাতে থাকে। তারপর একদিন মেসের সবাইকে নিজের বাড়িতে দাওয়াত করে খাওয়ায় মাধুরী। মাধুরীর ব্যবহারে মেসের সবাই মুগ্ধ হয়। মাধুরী কবে মেসে আসবে সে অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে।

প্রতি শনিবারই মেসে গিয়ে মহীনকে নিয়ে ঘুরতে বের হয় মাধুরী। একদিন মহীনকে নিয়ে স্টুডিওতে ছবি তুলতে যায়। সে সময় তাকে নিজের পছন্দের ফুল কিনে দেয় মহীন। এভাবে তাদের বন্ধুত্বটা প্রণয়ের দিকে মোড় নিতে শুরু করে। মহীনের প্রতি যখন মাধুরীর মনে ভালোবাসা উঁকি দিচ্ছিল, ঠিক তখনই মহেন্দ্রের শরীরে দানা বাঁধতে শুরু করে এক মরণব্যাধি। রোগ সম্পর্কে জানার পর থেকেই মাধুরীকে বিভিন্নভাবে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে মহীন। কাউকে কিছু না বলে সে শহর থেকে চলে যায়। মহীনকে খুঁজতে তার মেসে যায় মাধুরী। সেখানে গিয়ে জানতে পারে, মহীনের বিয়ের জন্য গ্রাম থেকে চিঠি এসেছে। সে চিঠি দেখে খুব কষ্ট পায় মাধুরী। সে বুঝতে পারে মহীন তাকে ভালোবাসেনি, পুরোটাই মহীনের ছলনা।

অপরদিকে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে মহীন। কোনোভাবেই শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না দেখে তাকে নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান তার দাদা-বৌদি। বিজয়া দশমীর দিন গ্রামের সব ডাক্তার-কবিরাজ খবর দিয়ে বাড়িতে আনেন দেবেন্দ্র। সেদিন সকালেই একটি চিঠি আসে মহীনের নামে। চিঠিটি লাল কালিতে লিখে নীল খামে করে মুড়িয়ে দিয়েছে মাধুরী। চিঠিটা পড়ার পর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে মহীনের। এ সময় ঘরে উপস্থিত হন তার বৌদি। তখন মহীন তাকে মাধুরীর ব্যাপারটা জানায় এবং তার অসুখের ব্যাপারে মাধুরীকে কিছু জানাতে নিষেধ করে।

সন্ধ্যায় স্টুডিও থেকে মহীনের ছবিগুলো আনতে যায় মাধুরী। সে সময় মহীনের প্রিয় ফুলের মালাও কিনে আনে। বাড়িতে এসে দরজা বন্ধ করে মহীনের ছবিতে নিজের রক্ত দিয়ে ফোটা দেয়। সন্ধ্যা থেকেই মহীনের অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। এক সময় মাধুরীর দেওয়া সেতার বাজানোর জন্য দাদা দেবেন্দ্রকে অনুরোধ করে মহীন। সেতারের শব্দ শুনতে শুনতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। মহীনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেই সেতারের একটি তার ছিঁড়ে যায়।

জীবন চলতে থাকে স্বাভাবিকভাবেই। মহীনের মৃত্যু সংবাদ অজানাই রয়ে যায় মাধুরীর কাছে। সে ধরে নেয় মহীন বিয়ে করে সংসার করছে। কিন্তু নিজে আর সংসার করার কথা ভাবে না। তার মনে পড়ে, একদিন মহীনকে নিয়ে সে একটি জায়গায় গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে দুঃখী অসহায় মানুষের জন্য নিজের স্বপ্নের কথা বলেছিল মহীন। সেই স্বপ্নকেই বাস্তবে রূপ দেয় মাধুরী। সেখানে গরিব মানুষদের জন্য একটি বিশাল কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়। অসহায় দরিদ্র ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলাসহ নানা কাজ করে যায় মাধুরীর সংগঠন। একে ঘিরেই যেন গড়ে ওঠে মাধুরীর সংসার।

মহীনের মৃত্যুর পর কয়েক বছর কেটে গেলেও প্রতিবছরই বিজয়া দশমীর দিন তার বাড়িতে চিঠি পাঠায় মাধুরী। অশ্রুসিক্ত চোখে চিঠিগুলো সযত্নে তুলে রাখেন মহীনের বৌদি। ততদিনে মহীনের ভাতিজা খোকন অনেক বড় হয়ে গেছে। শহরে থেকে পড়াশোনা করে। একবার পূজার ছুটিতে বাড়ি এসে মাধুরীর দেওয়া চিঠিগুলো পায় খোকন। তার কাকার মৃত্যুর এত বছর পরেও কে এই চিঠি পাঠায়। সেটি জানার জন্য চিঠিতে দেওয়া ঠিকানায় যাবে বলে ঠিক করে।

পরের বার পূজার সময় গ্রামে না এসে শহরে যায় খোকন। বিজয়া দশমীর দিন মাধুরীকে দেখে। মাধুরীর সেই নন্দনকাননে সেদিন হাজার হাজার মানুষের সমাগম। খোকন অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, মাধুরীর প্রতি এই অগণিত মানুষের ভক্তি। ভিড় ঠেলে মাধুরীর কাছে যাওয়া হয়ে ওঠে না তার। দিনশেষে মাধুরী বিশ্রাম নিতে যায়। সে সময় মহেন্দ্রের গাওয়া গান ক্যাসেটে শুনতে থাকে। একই গান গাইতে গাইতে মাধুরীর জানালার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে থাকে খোকন। মহেন্দ্রের গাওয়া এই গান শুনে থমকে যায় মাধুরী। খোকনকে নিজের কাছে ডেকে পাঠায়। খোকনের চেহারার সাথে মহীনের চেহারার মিল খুঁজে পায়। সহজেই চিনতে পারে। খোকনকে খুব আদর-যত্ন করে খাইয়ে দেয় মাধুরী। তারপর সমস্ত এলাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায়।

একপর্যায়ে মহীনের কথা জানতে চায় মাধুরী। মহীন কেমন আছে, মহীনের ছেলেমেয়ে আছে কি না ইত্যাদি প্রশ্ন করে। তখন খোকন জানায়, মহীন এখনো বিয়ে করেনি। এটি শুনে মাধুরীর চেহারা নববধূর মতো লজ্জায় লাল হয়ে যায়। তার মানে মহীন এখনো তারই আছে! তখন মাধুরীকে দেখে কান্না পেয়ে যায় খোকনের। সে খুব দ্রুত পুকুরের কাছে যায় এবং পুকুরের পানিতে নিজের চোখ ধুয়ে নেয়। এরপর কী করবে খোকন? সে কি মহীনের নির্মম সত্যটি মাধুরীকে বলে দেবে নাকি মাধুরী যে বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছে; সেই বিশ্বাস নিয়েই তাকে থাকতে দেবে? কী করবে খোকন?

লেখক : শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়