প্রকাশ : ২৩ মে ২০২২, ০০:০০
নারী পৃথিবীর বিপুলা এক শক্তির নাম, নারী পৃথিবীর অতুলনীয় সৌন্দর্যের নাম। নারী পৃথিবীর মমতার আধার, আবার নারী সকল জটিলতারও উৎস। নারী পৃথিবীর কল্যাণী, নারী পৃথিবীর জননীও। মা থেকে শুরু করে বোন, কন্যা, বন্ধু, প্রেমিকা, ঘরণি, কর্ত্রী, শিক্ষিকা, সেবিকা ইত্যাদি বিভিন্ন ভূমিকায় নারীই পুরুষকে জন্ম দেয়, লালন-পালন করে, বিকশিত করে, প্রশমিত করে, পুলকিত করে। কাজেই পুরুষের জন্যে নারী অপরিহার্য এক আশীর্বাদ। বাংলা সাহিত্যের পরিমণ্ডলে ধূমকেতুরূপে আবির্ভূত হওয়া কাজী নজরুলের জীবনেও নারীর সাহচর্য একেক সময় এক এক রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে কবি-সমীপে। কবির মনে-মননে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমীহ ছিলো অতুলনীয়। তিনি নারী স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়ে লিখেছেন অসাধারণ কবিতা ‘নারী’। তিনিই বলেছেন,
‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
...
সেদিন সুদূর নয়
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়।’
নজরুলের লেখা এই ‘নারী’ কবিতাটি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত প্রিয় ছিলো বলেই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে দেখা করতে গিয়ে তার বন্ধুদের শুনিয়ে দেন। নজরুল বারাঙ্গনা নারীদের নিয়েও অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন। তিনি সেইসব সমাজ-অপাংক্তেয় মহীয়সীদের নিয়ে ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় লিখেছেন,
‘কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুথু ও-গায়ে?
হয়ত তোমায় স্তন্য দিয়াছে সীতাণ্ডসম সতী মায়ে’।
কবি নজরুলই আবার তুর্কী মহিলার সৌন্দর্য নিয়ে লিখেছেন প্রবন্ধ, ‘তুর্ক মহিলার ঘোমটা খোলা’। আদ্যাশক্তিরূপে কালী সাধনার কথাও জানা যায় কবিবন্ধু মুজফ্ফর আহমদের স্মৃতিকথা থেকে। দ্বিতীয় পুত্র বুলবুল তথা অরিন্দম খালেদের মৃত্যুতে ভীষণ মুষড়ে পড়েন কবি। তাকে স্বাভাবিক করে তুলতে তার আধ্যাত্মিক গুরু শ্রী বরদাচরণ মজুমদার কালী সাধনায় দীক্ষা দেন এবং পরলোকগত শিশুপুত্রের মৃত্যু-পরবর্তী অবস্থা অবলোকন করিয়ে কবিকে স্বাভাবিক করে তোলেন। এ কথার উল্লেখ কবির জীবনীতে এলেও বাস্তবে কী হয়েছিল তা বলা যায় না।
নারীর মান ও মর্যাদার প্রতি সংবেদনশীল এই সাম্য-দ্রোহ-প্রেমের কবিকে আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন বয়সের নারীর সান্নিধ্যে আসতে দেখি। নারী কখনো মা ও মাতৃসমা, পত্নী-সখী, প্রিয়া ও প্রেমিকা, বন্ধু, ছাত্রী ও কন্যাসমা হয়ে তাঁর কাছাকাছি থেকেছে। নজরুলের জীবন-ঘনিষ্ঠ নারী চরিত্রগুলো অধ্যয়ন করে আমরা বুঝতে পারি, তাঁর সৃজনে-মননে নারীর গুরুত্ব।
নজরুলের জীবনে মা ও মাতৃসমা নারীগণ
নজরুলের জীবনে ভাগ্য বিড়ম্বিত নারীটির নাম জাহেদা খাতুন। বড় অভাগী তিনি। নজরুলের গর্ভধারিণী মা। দেখতে সুন্দর এই মা ছিলেন দরিদ্র ফকির আহমদের দ্বিতীয় স্ত্রী। নজরুল ছিলেন এই মায়ের ষষ্ঠ সন্তান। বড়ভাই কাজী সাহেবজানের জন্মের পরে চারটি সন্তান মারা যায় অকালেই। নজরুল জন্মের সাথে সাথেই যমের যাতে অরুচি হয়, তাই নাম রাখা হলো চুরুলিয়ার আঞ্চলিক উচ্চারণে দুক্ষু মিয়া যা প্রমিত বাংলায় দুখু মিয়া বলেই পরিচিতি পায়। কিন্তু নজরুলের মাত্র আট বছর বয়সে স্বামীহারা হওয়া জাহেদা খাতুন ফকির আহমদের চাচাতো ভাই তথা নজরুলকে লেটো গানের উৎসাহ দাতা বজলে করিমের সাথে সন্তানদের ভরণ-পোষণের কারণে দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ হওয়ায় মায়ের সাথে নজরুলের অভিমান হয়। নজরুল সেই যে মাকে ছাড়লেন, মায়ের মৃত্যুতেও তাঁকে আর দেখতে যাননি। এমনকি হুগলী জেলে রাজবন্দি থাকাকালীন একটানা ঊনচল্লিশ দিন অনশনকারী পুত্রকে দেখতে ১৯২৩ সালের এপ্রিলে হুগলী জেলে এলেও নজরুল তাঁকে দেখা দেননি। অভিমানী পুত্রকে না দেখার কষ্ট নিয়েই মা জাহেদা খাতুন ১৯২৮ সালের ৩০ মে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি তাঁর পেটে ধরা নূরুকে একটিবার দেখতে চেয়েছিলেন। নজরুলের বিমাতা বা বড় মা সৈয়দা খাতুন কিংবা তাঁর বৈমাত্রেয় বোন সাজেদা খাতুনের সাথে নজরুলের খুব একটা সম্পর্ক ছিল না। এমনকি নজরুলের আপন ছোট বোন উম্মে কুলসুমের সাথেও নজরুলের উল্লেখযোগ্য কোনো স্মৃতি নেই।
নজরুল কিশোর বয়সে দারিদ্র্য জয় করতে গৃহত্যাগী হয়ে ওয়াহেদ বক্সের দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। রাতের বেলা দারোগা কাজী রফিজউল্লাহর বারান্দায় শোয়ার ব্যবস্থার কারণে তিনি দারোগা ও তার পত্নীর নজরে আসেন। নজরুলের প্রতি এসময় দারোগা রফিজউল্লাহর বাৎসল্য তৈরি হলেও দারোগা-পত্নী তাকে গৃহভৃত্য হিসেবেই নিয়োগ দেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নিজের কর্মক্ষেত্র বদলের আশঙ্কায় নজরুলকে তার বাড়ি তথা কাজীর শিমলায় পাঠিয়ে দেন। সেখানে নিজের বাড়িতে দারোগা-পত্নী তাকে জায়গা দিতে কার্পণ্য করায় নজরুল বিচুতিয়া ব্যাপারি বাড়িতে জায়গীর থেকে জায়গীরদারের মেয়েকে পড়াতেন। কিন্তু নজরুলের বখাটেপনা, দস্যুবৃত্তি দেখে জায়গীরদার তাকে পছন্দ করতেন না। পক্ষান্তরে দারোগা রফিজউল্লাহর বউ মাতৃসমা হয়েও নজরুলকে ঘরে জায়গা না দিয়ে উল্টো তাকে স্নেহের চোখে দেখতেন বলে পরবর্তীকালে প্রচার করেন। নজরুল বিখ্যাত হয়ে গেলে, ১৯৬১ সালের দিকে কাজী রফিজউল্লাহ দারোগার বৃদ্ধা পত্নীকে ময়মনসিংহের তৎকালীন জেলা প্রশাসক নজরুলের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। তিনি তখন বানিয়ে বানিয়ে নজরুলের প্রতি তার স্নেহের কথা তুলে ধরেন। ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসকের ভাষ্যে আমরা এই ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হতে পারি।
নজরুল দশম শ্রেণির টেস্ট পরীক্ষায় প্রথম হয়েও প্রবেশিকা পরীক্ষায় না বসে ১৯১৭ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৪৯ বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে করাচী চলে যান। যুদ্ধফেরত কবি ১৯২০ সালের মার্চে কলকাতায় ফিরে অগ্নিবীণার আগুন জ্বালিয়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। ১৯২১ সালের এপ্রিলে কুমিল্লায় এসে নজরুল বেশ কয়েকজন মা ও মাতৃসমাদের খুঁজে পান। নজরুলের মা সম্বোধনে যারা ধন্যা হয়েছিলেন তাদের মধ্যে কুমিল্লাস্থ দৌলতপুরের বিশিষ্ট পুস্তক ব্যবসায়ী জনাব আলী আকবর খানের মেজো বোন নার্গিসের খালাম্মা এখতারুন্নেসা খানম, বিপ্লবী হেমপ্রভা দেবী, হুগলীর মিসেস এম. রহমান, কুমিল্লার বিরজা সুন্দরী দেবী এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী বাসন্তী দেবী উল্লেখযোগ্য। আলী আকবর খান জানতেন, তার মেজো বোন বিধবা এখতারুন্নেসা ছিলেন পরিবারের ওপর অত্যন্ত প্রভাবশালী। তার ওপর তিনি নিঃসন্তান ছিলেন বিধায় নজরুলকে আদর করতেন সন্তান স্নেহে। নজরুল তার স্বল্পকালীন দৌলতপুর অবস্থানের সময় এখতারুন্নেসাকে মা সম্বোধনে স্নেহের উৎখনন ঘটান। নজরুল ও নার্গিসের বিয়ের ব্যাপারে আলী আকবর খান এই এখতারুন্নেসার মাধ্যমে সবার ওপরে প্রভাব বিস্তার করে সেই বিয়েকে সম্ভব করে তুলেছিলেন। ১৯২১ সালের ১৭ জুন নজরুলের সঙ্গে নার্গিস আসার খানম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, যদিও এ বিয়ে নিয়ে অনেক মতানৈক্য আছে।
এই সময় এখতারুন্নেসা খানম মায়ের মতোই নজরুলের সকল আব্দার পূরণ করতেন। এখতারুন্নেসা ছাড়া আর কাউকে কবি পাত্তাই দিতেন না। নজরুলকে তিনি এতোটা আপন করে নিয়েছিলেন যে, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্য তাঁর পৈত্রিক সম্পত্তিও নজরুলের নামে লিখে দেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন।
কবি তাঁর ‘মা’ নামের কবিতায় এখ্তারুন্নেসাকে নিয়ে লেখেন,
‘যেখানেতে দেখি যাহা
মা-এর মতন তাহা
একটি কথায় এত মধু মেশা নাই।
মায়ের মতো এত
আদর সোহাগ সে তো
আর কোনখানে কেহ পাইবে না ভাই’।
বাংলার বিপ্লবী আরেক অগ্নিকন্যা হেম প্রভাকেও নজরুল ‘মা’ সম্বোধন করেন। তিনি ছিলেন বিপ্লবী বসন্তকুমার মজুমদারের স্ত্রী এবং নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের ফরওয়ার্ড ব্লকের নেত্রী। তিনি নিজেও লেখিকা এবং সম্পাদিকা ছিলেন। এই অগ্নিকন্যা হেমপ্রভাকে নিয়ে কবি ১৯২৬ সালে রচনা করেন 'হৈমপ্রভা' কবিতাটি। ইতিহাসমতে ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ২৯ ফাল্গুন কবি মাদারিপুরে মৎস্যজীবী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। প্রগতিশীল শান্তি আন্দোলন ও নারী জাগরণের অগ্রসেনানী হেমপ্রভাও ঐ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। ১৮৮৮ সালে বৃটিশ ভারতের নোয়াখালীতে জন্ম নেয়া এই অগ্নিকন্যা ১৯৪৬ সালের ১ জানুয়ারি কলকাতায় মারা যান। ১৯২১ সালে মুল্লুক চলো আন্দোলনে ধর্মঘটী চা-শ্রমিকদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে তিনি ও তাঁর স্বামী চাঁদপুরে আসেন এবং ধর্মঘটকে জোরদার করেন। কবি মহীয়সী হেমপ্রভাকে নিবেদন করে লেখেন,
‘কোন অতীতের আঁধার ভেদিয়া
আসিলো আলোক জননী।
প্রভায় তোর উদিল প্রভাত
হেমণ্ডপ্রভ হল ধরণী ॥
এসো বাংলার চাঁদ সুলতানা
বীর মাতা বীর জায়া গো।
তোমাতে পড়েছে সকল কালের
বীর নারীদের ছায়াগো ॥
শিব সাথে সতী শিবানী সাজিয়া
ফিরছি শ্মশানে জীবন মাগিয়া,
তব আগমনে নব বাঙালীর
কাটুক আঁধার রজনী।’
কবিবন্ধু বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের মা, ব্যক্তিত্বময়ী বিরজা সুন্দরী দেবীকে কবি প্রমীলার সাথে বিয়ের আগে থেকেই মা বলে ডাকতেন। তাদের কুমিল্লা কান্দিরপাড়ের বাড়িতে তিনি বেশ কয়েকবার গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন প্রমীলার জেঠীমা। ১৯২১ সালে প্রথম পরিচয় হওয়ার পর এই বাড়িতে কবি বেশ কিছুদিন ছিলেন। নজরুলের মায়াকাড়া চোখ ও ভুরুতে তার প্রতি বিরজাসুন্দরীর সন্তানবাৎসল্য জেগে ওঠে। নজরুলের সাথে নার্গিসের বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর অজ্ঞাত কারণে কবি বাসর যাপন না করে কুমিল্লা ফিরে আসতে চাইলে বীরজা সুন্দরী দেবীকেই কবি প্রথম অবহিত করেন। তিনি তাঁদের আনা নৌকা দিয়ে নজরুল ও বীরেন্দ্রকে কুমিল্লা পাঠিয়ে দেন এবং নিজে সেই রাতে দৌলতপুরে থেকে যান যাতে সম্ভাব্য খারাপ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন বরের মা হিসেবে। 'আনন্দময়ীর আগমনে' কবিতা রচনার জন্যে তাঁকে ইংরেজ সরকার আটক করলে তিনিই নজরুলকে হুগলী জেলে নিজ হাতে লেবুর রস পান করিয়ে দীর্ঘ ঊনচল্লিশ দিনের অনশন ভঙ্গ করান। সেদিন নজরুলের অনশন ভাঙ্গিয়ে জেল থেকে বাইরে এসে অপেক্ষামান জনতার উদ্দেশে বিরজা সুন্দরী দেবী বলেছিলেন- 'খাইয়েছি পাগলকে, কথা কি শোনে! বলে, না, অন্যায় আমি সইব না' শেষ পর্যন্ত আমি হুকুম দিলাম, আমি ‘মা’। মার আদেশ সব ন্যায় অন্যায় বোধের ওপরে। লেবুর রস খাইয়ে এসেছি।' বিরজা সুন্দরী দেবী সপরিবারে কলকাতা চলে আসার পর কবি নিয়মিত তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ১৯৩৮ সালে কলকাতায় এই মহীয়সী নারী দেহত্যাগের সময় নজরুল তাঁর শয্যাপাশে উপস্থিত ছিলেন।
১৯২৬ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ 'সর্বহারা' কবি বিরজা সুন্দরী দেবীকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গ কবিতাটি ছিল এরকম :
‘মা (বিরজা সুন্দরী দেবী)র শ্রী চরণারবিন্দে
সর্বসহা সর্বহারা জননী আমার।
তুমি কোন দিন কারো করনি বিচার।
কারেও দাওনি দোষ, ব্যথা বারিধির
কুলে বসে কাঁদো মৌনা কন্যা ধরণীর।
হয়তো ভুলেছো মাগো, কোন একদিন,
এমনি চলিতে পথে মরু-বেদুইন
শিশু এক এসেছিল, শ্রান্ত কণ্ঠে তাঁর
বলেছিল গলা ধরে “মা” হবে আমার?’
নজরুল বহরমপুর জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর যে পরিবারের সঙ্গে কবির পরিচয় হয়, সেই নলিনাক্ষ স্যানালের পরিবারের কর্ত্রী সুনীতি বালাকেও কবি মায়ের আসনে রাখেন। এর পাশাপাশি আরেক জন মহীয়সী নারী কে তিনি প্রাণ ভরে ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন। তিনি হচ্ছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সহধর্মিণী বাসন্তী দেবী। তিনিও তাঁকে সন্তানতুল্য ¯েœহ করতেন। দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের বাড়িতে গেলে বাসন্তী দেবী নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করে কাছে বসে কবিকে খাওয়াতেন। ২৩ মার্চ ১৮৮০ সালে কলকাতায় জন্ম নেয়া এই বিপ্লবী কন্যা ভারতবর্ষের প্রথম নারী, যিনি জেলখাটা স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি ১৯৭৪ সালের ৭ মে মৃত্যুবরণ করেন। কবি তাঁর অবিস্মরণীয় 'চিত্তনামা' কাব্যগ্রন্থটি বাসন্তী দেবীকে উৎসর্গ করেন। চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুতে নজরুল তাৎক্ষণিক 'ইন্দ্রপতন' শিরোনামে যে কবিতাটি লিখেছিলেন তা 'চিত্তনামা' কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
কবির শাশুড়ি শ্রীমতী গিরিবালা দেবী নজরুলের মাতৃসমা হলেও তাঁকে মা নয়, তিনি মাসীমা ডাকতেন। গিরিবালা দেবী নিজে নজরুলের সংসারে রান্না-বান্না ও নাতিদের দেখভাল করতেন। হিজ মাস্টার্স ভয়েসে থাকাকালীন নজরুলের ফ্ল্যাটে ছাদের ওপরে তার ঠাকুরঘর ছিল। কিন্তু তার নিজের তাতে ধর্মকর্ম পালন হতো না বললেই চলে। ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের মেয়ে যুবাইদা মির্যার স্মৃতিচারণ হতে জানা যায়, গিরিবালা নিজে ধর্ম চর্চার কারণে মুরগির মাংস না খেলেও নাতিদের ও নজরুলের জন্যে রেঁধে দিতেন।
কবি নজরুলের জীবনে আরেকজন মহীয়সী নারী এসেছিলেন মা হয়ে। তিনি মিসেস এম রহমান তথা মাসুদা রহমান। হুগলির সরকারি উকিল খান বাহাদুর মজহারুল আনওয়ার চৌধুরীর কন্যা এই মিসেস এম. রহমান যাঁর স্বামী ছিলেন স্বনামধন্য বিখ্যাত সাংবাদিক ও সাহ্যিতিক মুজিবর রহমান। তিনি ধূমকেতু পত্রিকায় 'সন্ধ্যাপ্রদীপ' শিরোনামে নারীদের বিভাগে প্রতিবাদী নারীদের নিয়ে আগুন ঝরানো প্রবন্ধ লিখতেন। এ কারণে তিনি অনেকের হিংসার পাত্র হয়েই ছিলেন। হিন্দু মেয়ে-মুসলমান ছেলের মধ্যে বিয়ে সে যুগে অতি অস্বাভাবিক চিন্তা হলেও প্রমীলা ও নজরুলের বিয়েকে সম্ভব করে তুলেছিলেন এই মিসেস এম রহমান। তার বিশেষ উদ্যোগেই নজরুল-প্রমীলার মধ্যে আন্তঃধর্মীয় বিয়ে সম্পন্ন হয় ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল। বিয়ের পর নব দম্পতির বসবাসের জন্য তিনিই হুগলীতে নজরুলকে বাসা ভাড়া করে দেন। এই বিদুষী নারী ১৯২৬ সালের ২০ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত নজরুল রচনা করেন 'মিসেস্ এম. রহমান' নামের বিখ্যাত কবিতাটি। কবি তাকে স্মরণ করে বলেছেন,
‘বন্দিনীদের বেদনার মাঝে বাঁচিয়া আছ মা তুমি
চিরজীবী মেয়ে, তবু যাই ঐ কবরের ধূলি চুমি।’
নজরুলের জীবনে ভগ্নি-নারীরা
আজকের জননী সাহসিকা সুফিয়া কামাল ছিলেন নজরুলের কাছে ভগ্নিতুল্য। সুফিয়া কামালের 'সাঁঝের মায়া' কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো হাতে পেয়ে নজরুল লাফ দিয়ে ওঠেন বিস্ময়ে, আনন্দে। তিনি ভাবতেই পারেননি, তৎকালে কোন মুসলিম নারী এরকম কবিতা লিখতে পারে। তিনি নিজে কবি সুফিয়া কামালের 'সাঁঝের নায়া' কাব্যগ্রন্থের মুখবন্ধ লিখে দেন। সওগাতে সুফিয়া কামালের প্রথম লেখা ছাপা হয় ১৯২৬ সালে 'বাসন্তী' শিরোনামে। তা দেখে নজরুল অত্যন্ত আশাবাদী হয়েছিলেন। নজরুলের আর্থিক দুর্দশা দেখে সওগাত পত্রিকার সম্পাদক নাসিরউদ্দীনকে তিনি আবেগঘন চিঠি লেখেন যাতে নজরুলের জন্যে কিছু করা যায়। সেই চিঠি মোতাবেক নাসিরউদ্দীন মাসিক দেড়শো টাকা সম্মানী দিয়ে নজরুলকে সওগাতের জন্যে সংযুক্ত করে রাখেন। কোনো একদিন নজরুল কবি সুফিয়া কামালের বাড়িতে গিয়ে দেখেন, গানের আসর বসেছে। সেখানে একজন গোয়েন্দাও ছিলেন যাকে কবি চিনতে পেরেছিলেন। তাকে উদ্দেশ্য করে কবি নজরুল কবিতা আওড়ালেন, ‘তুমি টিকটিকি, জানি ঠিকঠিকিই।’ ব্যঙ্গ কবিতা শুনে গোয়েন্দাটি মানে মানে কেটে পড়তেই কিশোরী সুফিয়া কামাল অবাক হয়ে কবিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দাদু তুমি একে চিনলে কী করে?’ নজরুল উত্তর দিয়েছিলেন, ‘গায়ের গন্ধে। বড়কুটুম যে।’
লেখিকা হিসেবে সুফিয়া কামালের পর কবিবন্ধু হবীবুল্লাহ্ বাহারের ছোটবোন শামসুন্নাহার মাহমুদ কবির স্নেহ অর্জন করেন। তিনি কবিকে নূরুদা বলেই সম্বোধন করতেন। তার নানার বাসা চট্টগ্রামের তামাকুমন্ডি লেইনে বেশ কয়েকদিন ছিলেন নজরুল। তিনি এখানেই রচনা করেন 'বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি' কবিতাটি। কলাকাতা হতে প্রকাশিত ও শামসুন্নাহার মাহমুদ সম্পাদিত 'বুলবুল' পত্রিকায় তিনি লেখা পাঠাতেন এবং নাহারের আব্দারে লেখা সংগ্রহ করে দিতেন। 'নজরুলকে যেমন দেখেছি' তার বিখ্যাত গ্রন্থ। নজরুল তাঁর 'সিন্ধু হিন্দোল' কাব্যগ্রন্থ 'বাহার ও নাহার' দুই ভাইবোনকে উৎসর্গ করেছেন।
নজরুলের কন্যাসমা নারীরা
বিভিন্ন উৎস হতে জানা যায়, নজরুলের ঔরসে প্রমীলার গর্ভে একটা ছোট্ট ফুটফুটে কন্যাশিশুর আগমন ঘটেছিল যে জন্মের পরপরই মারা যায়। নজরুলের পিতৃহৃদয়ে সেই কন্যার মুখটি হয়তোবা জ্বলজ্বলে হয়ে থাকবে। এক সময় ১৯২৮ সালে কবিপত্নী প্রমীলার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া সুশীলা দেবীর ছয়-সাত বছর বয়সের মেয়ে শান্তিলতা তাঁর বাড়িতে বেড়াতে আসে। তখন কবিপুত্র বুলবুলের বয়স ছিল আড়াই বছর। বুভুক্ষু পিতৃস্নেহের কারণে নজরুল সুশীলা দেবীকে অনুরোধ করেন, যাতে মেয়েটাকে তাঁর বাড়িতে রেখে যায়। কবি শান্তিলতাকে নাম দিয়েছিলেন 'খুকি' বলে। কবি নজরুলের পালিতা কন্যা শান্তিলতা দেবী, যাঁর আতিথ্যে তাঁর অনেকটা সময় কেটেছে, সেই শান্তিলতার স্মৃতিতর্পণ থেকে জানা যায় যে, কবি ঝিঙে আর শুক্তোর একটা রান্না খুব পছন্দ করতেন। আর পোস্ত দিয়ে রান্না বড় কই মাছও ছিল তাঁর প্রিয়। বাড়িতে মুরগি এবং খাসির মাংস এলেও আগ্রহ করে খেতেন। কিন্তু গরুর মাংস তাঁর পছন্দের তালিকায় ছিল না।
একসময় সওগাত পত্রিকায় কাজের সুবাদে নাসিরউদ্দীনের ছোট্ট মেয়ে নূরজাহান বেগম তথা নূরী কবির সান্নিধ্যে আসে। নূরী সত্যিকার অর্থেই কবির মেয়ের মতো ছিলো। মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের পরবর্তী ধারাবাহিক কিস্তি লিখিয়ে নিতে নাসিরউদ্দীন মেয়ে নূরীকে নজরুলের পেছনে পাহারায় লাগিয়ে দিতেন। নূরীও একখিলি পান আর এককাপ চা ধরিয়ে দিয়ে নূরু কাকাকে দিয়ে ঠিকই উপন্যাসটির পরবর্তী কিস্তি লিখিয়ে নিতো।
বর্ধমান হাউজে কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরীর বাসায় থাকাকালীন নজরুল তার পাঁচ বছরের মেয়ে তথা জ্যেষ্ঠা কন্যা যুবাইদা মির্যার সাথে কাকাণ্ডভাতিজির সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি তাকে গান শেখাতেন। কাজী মোতাহার হোসেনের ভাষ্যে কবি খুকুকে 'এ আঁখিজল মোছো প্রিয়া ভোল আমারে, কে বিদেশি মন উদাসী বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে, কি হবে জানিয়া বল কেন জল নয়নে' ইত্যাদি গান শিখিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে
বাইরে থেকে এসেই তিনি খুকিকে কাঁধে নিয়ে নিতেন। রানু সোমের বাড়ি থেকে ফেরার পথে যেবার তিনি কতিপয় বখাটে যুবক দ্বারা আক্রান্ত হলেন, সেবার বর্ধমান হাউজে ফিরে তিনি ঘটনা বর্ণনা করলে মোতাহার সাহেবের বড় মেয়ে বলে উঠেছিল, 'আমাকে নেনি বলেই তো।' হাসির তোড়ে ভাসিয়ে দিয়ে নজরুল জবাবে বলেছিলেন, 'ভাগ্যিস্ নিইনি! নইলে বিপদ আরো বেড়ে যেতো।' খেতে বসলে ছোট্ট যোবাইদা যখন মাছের ত্বককে মাছের শাড়ি আর ত্বকের সাথে লেগে থাকা মাছকে হরিণের মাংস বলে উঠেছিল, তখন নজরুল হো হো করে হেসে উঠে বলেছিল, শিশুদের সাথে খেতে বসা উচিত। কারণ তারা খুব গুছিয়ে খায়।
নজরুলের ছাত্রী ও খুদে নারীভক্ত
ছাত্রী হিসেবে তিনি ফিরোজা বেগমকে গান শিখিয়েছেন যেমন, তেমনি তার কণ্ঠে গানও শুনেছেন। দশ বছর বয়সে ফিরোজা বেগম কাজী নজরুলের কাছে সঙ্গীতে তালিম নেন এবং বার বছর বয়সে তার এইচএমভি থেকে রেকর্ড বের হয়। নজরুল নির্বাক হওয়ার পর তিনি নজরুল সংগীতের শুদ্ধ স্বরলিপি সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
১৯৭২ সালের ২৪ মে নজরুলের জন্মদিনের আগে আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেই নির্বাক নজরুলকে ১৯৭২ সালে বাবার সাথে দেখতে গিয়েছিলেন আরেক ছোট্ট খুকু যার নাম দীপু মনি। তিনি নজরুলকে জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে যখন ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছিলেন, নির্বাক নজরুল তখন তাঁর বড় বড় চোখ মেলে খুকু দীপু মনির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন।
নজরুলের আবেগ-অনুরাগে সিক্ত নারীরা
ঢাকা বনগ্রাম রোডের অধিবাসী প্রতিভা সোম ওরফে রানু সোম এবং রমনা হাউজের অধিবাসী ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্র মৈত্রের কন্যা উমা মৈত্র ওরফে নোটন- এই দুজনের সাথেও কবির বিশেষ পরিচয় হয়। রানুর কণ্ঠস্বর মিষ্টি ও সুরেলা ছিল বিধায় কবি তাকে গান শুনিয়ে আনন্দ পেতেন। তিনি ' কল্যাণীয়া বীণাকণ্ঠী শ্রীমতী প্রতিভা সোম জয়যুক্তাসু' নামে তাঁর 'চোখের চাতক ' উৎসর্গ করেছিলেন। রানুকে গান শোনাবার আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল কবির, তা হলো দিলীপ রায়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা। দিলীপ রায়ের ছাত্রী ছিলেন টিকাটুলি লেনের রেনুকা সেন। নজরুল রেনুকা সেনের চেয়ে রানু সোমকে দিয়ে উৎকৃষ্ট ও উচ্চাঙ্গের রেকর্ড সঙ্গীত গাওয়াতে চেয়েছিলেন। প্রসঙ্গত বলা যায়, রানুর সঙ্গে কবির সম্পর্কের বিকৃত ব্যাখ্যা করে সজনীকান্তের 'শনিবারের চিঠি' লেখে, কে বিদেশি বনগাঁবাসী বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে। ' নজরুল রানু সোমকে ' যাও যাও তুমি ফিরে (এই) মুছিনু আঁখি, ছাড়িতে পরাণ নাহি চায়, তবু যেতে হবে হায়, আঁধার রাতে কে গো একেলা, নয়ন সলিলে ভাসালে ভেলা, আমি কি দুখে লো গৃহে রব, না মিটিতে সাধ নিশি পোহায়, নাইয়া কর পার, কূল নাহি নদী সাঁতার- ইত্যাদি বহু ঠুমরী ও খেয়াল-কীর্তন এবং বিভিন্ন জাতীয় গান শেখান।
প্রিন্সিপাল সুরেন মৈত্রের মেয়ে উমা মৈত্র ওরফে নোটন অপরূপ সুন্দরী ছিলেন। তারা ব্রাহ্মবাদী ছিলো। নজরুল এই পরিবারের একজন বিশিষ্ট বন্ধু ছিলেন। নজরুলের গাওয়া ' নিশি ভোর হ'ল জাগিয়া পরাণ পিয়া, আজি এ কুসুম হার সহি কেমনে, বসিয়া বিজনে কেন একা মনে' ইত্যাদি গানের সঙ্গে নোটন বা উমা মৈত্র সেতারে সঙ্গত করেছেন। নজরুলের 'চক্রবাক' গ্রন্থটি নোটনের বাবা সুরেন মৈত্রকে উৎসর্গ করেছেন কবি। উৎসর্গপত্রে উদ্ধৃত ছিল ' বিরাট প্রাণ, কবি, দরদী-প্রিন্সিপাল শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র শ্রীচরণারবিন্দেষু'। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতায় যে অভিমানের সুর ফুটে ওঠে, তাতে এ কথা পরিষ্কার, নোটনের পক্ষ থেকে কবি কোন প্রশ্রয় বা পক্ষপাত কিংবা সাড়া লাভ করেননি। কবির 'শিউলিমালা' গল্পের নায়িকার ওপর নোটনের চরিত্র অনেকটাই ছায়া ফেলেছে। শিল্পী কানন দেবীকেও নজরুল গান শিখিয়েছিলেন। সজনীকান্তের পত্রিকা 'শনিবারের চিঠি' এ নিয়ে নানা মুখরোচক কাহিনি ছাপতে থাকে। রটানো হয়েছিল যে কবিকে কোথাও না পাওয়া গেলেও কানন দেবীর বাড়িতেই পাওয়া যাবে। গান শেখাতে গিয়ে রাত হয়ে গেলে কানন দেবীর বাড়িতে কবির থেকে যাওয়ার ঘটনা নিয়েও গুজব ছড়ানো হয়।
মিস্ ফজিলাতুন্নেসা : নজরুলের রহস্যময়ী
রানু সোম, নোটন মৈত্রেয়দের গান শেখানোর যাত্রায় কবির সাথে পরিচয় হয় মিস্ ফজিলাতুন্নেসার। কবি হস্তরেখা ও ভাগ্য গণতে পারায় কিছুটা সক্ষম ছিলেন। কবিবন্ধু কাজী মোতাহার হেসেনের কাছ থেকে মিস ফজিলাতুন্নেসা এই কথা জানতে পেরে কবির কাছে হাত দেখানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। সেই ইচ্ছা কবির উৎসাহে বাস্তবে রূপ লাভ করে। এভাবেই কবির সাথে ফজিলাতুন্নেসা ও তার ছোটবোন সফীকুন্নেসার সাথে পরিচয়ের সূত্রপাত ঘটে। একদিন ভোরবেলা কাজী মোতাহার হোসেন দেখলেন, নজরুল ঢাকার ৯২ নং দেওয়ান বাজার এলাকায় রাস্তার ওপর অবস্থিত ফজিলতদের ঘরে চলে গেছেন। তিনি সেখানে কতক্ষণ ছিলেন, কী করেছিলেন তা জানা যায়নি। কিন্তু মোতাহার হোসেন পরদিন খেয়াল করলেন, ফজিলতের গলার লম্বা মটর মালার হারটা ছেঁড়া। পরে সেটা অবশ্য স্যাঁকরার দোকান থেকে জোড়া লাগানো হয়েছিল। এ ঘটনার পরেই নজরুল ঢাকা হতে কলকাতা চলে যান। নজরুল ফজিলতদের সে বাড়িতে মোট তিনদিন গিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে ফজিলতকে উদ্দেশ্য করে লেখা একটা চিঠি কবি মোতাহার হোসেনকে পাঠিয়েছিলেন, যাতে তা পত্রে উল্লেখিত 'রহস্যময়ী'র কাছে পৌঁছানো হয়। ১৯২৮ সালে কবি চেয়েছিলেন, তাঁর 'সঞ্চিতা' কাব্যগ্রন্থটি মিস্ ফজিলাতুন্নেসার নামে উৎসর্গ করতে। কিন্তু তিনি রাজি না হওয়ায় কবি তা পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করেন।
নজরুলের অপ্রকাশিত প্রণয়ীরা
নজরুলের প্রথম যৌবনের বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মতে, নজরুল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে যাননি, তিনি বরং প্রেমে ব্যর্থ হয়েই যুদ্ধে যোগ দেন। এ প্রসঙ্গে 'বাঁধনহারা' উপন্যাস কিছুটা সাক্ষ্য দেয়। নজরুলের আত্মজৈবনিক পত্রোপন্যাস 'বাঁধনহারা'তে নায়ক নূরুল হুদা সৈন্য বাহিনীতে যোগ দিয়ে করাচী চলে যায়। সে যার প্রেমে পড়েছিলো, লেখক তার নাম দেয় মাহবুবা। অনেকের মতে এই তরুণী মাহবুবার চরিত্রটি আসলে রাণীগঞ্জের এক হিন্দু পুলিশ কর্মকর্তার কন্যা। ১৯২৫ সালে কবি 'চৈতী হাওয়া' কবিতায় এই তরুণীকে স্মরণ করেন। বাস্তবজীবনে নজরুল যুদ্ধে যাবার সময় তাঁর প্রেমিকার একটি চুলের কাঁটা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। করাচিতে আড়াই বছর থাকার সময় তিনি এই কাঁটা যত্ন করে রেখেছিলেন। যুদ্ধফেরত হয়েও তিনি কাঁটাটি সঙ্গে রেখে দেন এবং দীর্ঘ পাঁচ বছর পরেও তিনি তাঁর সেই প্রেমিকাকে ভোলেননি। বরং তাকেই 'মানসী আমার' বলে 'ব্যথার দান' পত্রোপন্যাসটি উৎসর্গ করেন। তারও আগে কথিত আছে, নজরুল ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন খিদির আলীর শ্যালিকার সাথে তার বাল্যপ্রেম ঘটে। ত্রিশালে স্কুলশিক্ষক খিদির আলী তার শ্বশুর বাড়ি দরিরামপুর গ্রামে মাঝে মাঝে নজরুলকে নিয়ে বেড়াতে যেতেন। সেখানে প-িত সাহেবের শ্যালিকা নূরজাহানের রূপে মুগ্ধ হন কবি। প্রণয়ে পড়েন এ নূরজাহানের সাথেও। কিন্তু পি.এ. নাজির যিনি ১৯৬৪ সালে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক ছিলেন, তার গবেষণা মতে এ কাহিনীর সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কারণ ষষ্ঠ শ্রেণির এক দুরন্ত বালকের প্রেমের কথা দরিরামপুরে কেউ অবহিত ছিল না।
নজরুলের প্রিয়া ও পত্নীদ্বয়
কবির জীবনে যে দুজন নারীর কথা না বললেই নয়, তারা হলেন কবির দুই পত্নী নার্গিস ও প্রমীলা নজরুল। তারা দুজনেই কুমিল্লার মেয়ে। দুজনের সঙ্গেই কবির প্রণয় হয়। সেই প্রণয় উভয়ের ক্ষেত্রেই অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পরিণয়ে পরিণত হয়। এর মধ্যে প্রথমজনের কপালে সংসার জোটেনি আর পরেরজনের কপালে সংসার জুটলেও সুখ জোটেনি। দুজনের সাথে পরিচয়ের সূত্র আলী আকবর খান ও বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত। ১৯২১ সালের এপ্রিলে তথা চৈত্র মাসের শেষের দিকে নজরুল আলী আকবর খানের সাথে কুমিল্লা এসে বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে কয়েকদিন কাটিয়ে মুরাদনগরের দৌলতপুরে আসেন। এখানেই আলী আকবরের ভাগ্নি সৈয়দা খাতুনের সাথে কবির ঘনিষ্ঠতা হয়। এই ঘনিষ্ঠতাকে অনেকেই প্রেম নামে অভিহিত করেন। হয়তোবা তা প্রেম নয়, বয়সের ঘোরও হতে পারে। এসময় তিনি মানস-বধূ শিরোনামে একটি কবিতা রচনা করেন। এতে তিনি বলেন,
‘সে যেন কোন দূরের মেয়ে আমার কবি-মানস-বধূ
বুক-পোরা আর মুখণ্ডভরা তার পিছলে পড়ে ব্যথার মধু।’
ঘনিষ্ঠতায় প্রেম হোক বা না হোক, নজরুল তার নাম পাল্টে রেখেছিলেন নার্গিস আসার খানম। নার্গিসের মামা আলী আকবর যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি নজরুলকে বিয়ের আয়োজনে আটকে ফেলেন। অথচ কবিবন্ধু মুজফ্ফর আহমদ এই বিয়েতে সম্মত ছিলেন না। ফলে ১৯২১ সালের ১৭ জুন বিয়ে সম্পন্ন হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে নজরুল বিয়ের রাতেই পালিয়ে চলে আসেন কুমিল্লা। আর কোনোদিন তিনি নার্গিসের সামনে আসেননি। ১৯৩৭ সালে নার্গিস নজরুলকে একটি চিঠি দেন দূত মারফত। এতে নার্গিস নজরুলের কাছে বিয়ের অনুমতি আকাক্সক্ষা করেন। নজরুল প্রত্যুত্তর চিঠিতে ( একমাত্র) অনুমতি দিয়ে বহুদিনের আটকে থাকা সম্পর্ক হতে মুক্ত হন। নার্গিস তার মামার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মী আজিজুল হাকিমের সাথে ১৯৩৭ সালে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। নজরুল কুমিল্লা হতে ১৯২১ সালের ৮ জুলাই চাঁদপুর হয়ে কলকাতা প্রত্যাবর্তনের আগে একটি রচনায় কুমিল্লা ছাড়ার কষ্টে লেখেন,
‘আমি এ দেশ হ'তে বিদায় যেদিন নেবো প্রিয়তম
আর কাঁনে এ-বুক সঙ্গীহারা কপোতিনী সম।’
নজরুলের অন্যতম প্রেমিকা ও পত্নী আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে দোলন বা দুলি ছিলেন ত্রিপুরার নায়েব বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত ও গিরিবালা দেবীর একমাত্র কন্যা। ১৯০৮ সালের ১০ মে মানিকগঞ্জের তেওতায় মামাবাড়িতে তার জন্ম। বাবার আকস্মিক প্রয়াণে তারা মা-মেয়ে চলে আসেন কুমিল্লা কান্দিরপাড়ে কাকা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের কাছে। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের ছেলে বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের বন্ধু ছিলেন আলী আকবর খান। তারই সূত্র ধরে নজরুলের সাথে তার বন্ধুতা হয়ে যায় এবং নজরুল তাদের বাড়িতে ঘরের ছেলে হয়ে বেশকিছু দিন যাপন করেন। এ বাড়িতেই তিনি কিশোরি দুলি ও তার কাকাতো ছোট বোন জটুকে (অঞ্জলি সেন) নিয়ে পেয়ারা গাছের পেয়ারা পাড়ার তৎপরতা দেখে লেখেন বিখ্যাত শিশুতোষ কবিতা 'খুকী ও কাঠবেড়ালি'। নার্গিসের সাথে বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে পালিয়ে এসে নজরুল বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্তদের বাসায় ওঠেন। পরবর্তী সময়ে দুলির সাথে তার প্রণয় গড়ে ওঠে। এ প্রণয় প্রগাঢ় হয়ে ওঠে মানিকগঞ্জের তেওতায় গিয়ে। এখানেই তিনি দুলিকে কেন্দ্র করে লেখেন তাঁর সেই বিখ্যাত গান 'তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় / সে কী মোর অপরাধ?' দুলিকে উপহার দিয়ে তিনি রচনা করেন 'বিজয়িনী' কবিতাটি। এ কবিতার দুটো লাইন,
‘আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত রথের চূড়ে,
বিজয়িনী! নীলাম্বরী আঁচল তোমার উড়ে।’
পরবর্তীকালে কবি তাঁর 'দোলনচাঁপা' কাব্যগ্রন্থটি আশালতা সেনগুপ্তকে উৎসর্গ করেন। 'দোলনচাঁপা' কাব্যগ্রন্থের নায়িকা হিসবে কবি দোলন ওরফে দুলিকেই চিত্রিত করেছেন। প্রণয়পর্ব চলাকালীন কবি 'প্রিয়ার রূপ' (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থভুক্ত) এবং
‘অভিমানী’ (‘নির্ঝর’ কাব্যগ্রন্থভুক্ত) নামে দুটো কবিতা আশালতাকে কেন্দ্র করে রচনা করেন।
১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল নজরুল ও দুলি বা আশালতা সেনগুপ্তের 'আহ্লুল কিতাব' মোতাবেক বিয়ে হয় এবং নজরুল তার নাম দেন 'প্রমীলা।' আমৃত্যু তারা সংসারে আবদ্ধ ছিলেন। নজরুলকে অন্য অসংগত সম্পর্ক থেকে দূরে রেখে মেয়ের সংসার টিকিয়ে রাখতে গিরিবালা দেবী কড়া প্রহরায় রাখতেন নজরুলকে। মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যাওয়া নজরুলকে তিনি ধরে আনতেন। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েও প্রমীলা তাঁর নির্বাক হয়ে যাওয়া স্বামীকে সচল দুহাতে খাইয়ে দিতেন। পরবর্তী তিনি তার নাতিদের সামলে রাখতেন, যাতে পুত্রবধূ উমা সাংসারিক কাজ-কর্ম করতে পারে। ১৯৬২ সালের ৩০ জুন প্রমীলা মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল-প্রমীলার চার সন্তান জন্ম নিয়েছিলো, যাদের মধ্যে দুজন বেঁচেছিলেন। প্রমীলা নজরুল নিজেও কবিতা লিখেছেন বেশকিছু। দ্বিমাসিক সাম্যবাদী পত্রিকার বৈশাখ ১৩৩২ (এপ্রিল-মে ১৯২৫) সংখ্যায় প্রমীলা নজরুলের 'শঙ্কিতা' শিরোনামে একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল যা দ্বিতীয়বার প্রকাশিত হয়েছিল সওগাতের মহিলা সংখ্যায়। এরপর দ্বিমাসিক সাম্যবাদী পত্রিকার আষাঢ় ১৩৩২ (জুন-জুলাই ১৯২৫) সংখ্যায় আরও একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল 'করুণা' শিরোনামে।
কবি নজরুলের জীবন বড় দুঃখের জীবন। দুক্ষু মিয়া বা দুখু মিয়া নাম নিয়ে যাঁর জীবনের শুরু দুঃখ তাঁকে এতটুকু ছেড়ে যায়নি। তাঁর জীবনে নারীরা মৌমাছির মতো ঘিরে থাকলেও মায়ের সাথে নিরেট অভিমান, পুত্রশোক, প্রথম বিবাহের অপূর্ণতা, দ্বিতীয় পত্নীর পক্ষাঘাত, নিজের দারিদ্র্য এবং সবশেষে জীবন্মৃত নজরুল ; একজীবনে এত বেদনা কবির জীবনকে সর্বদা দুখণ্ডসঙ্কুল করে রেখেছিল। কবি নিজে যতটুকু প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন পৃথিবীতে তার অর্ধেকই বিলীন হয়ে গেছে কবির নির্বাক জীবনের সাথে। কবির নিজের ভাষ্যে তিনি প্রেম দিতে এসেছিলেন, প্রেম পেতে এসেছিলেন। সেই প্রেম না পাওয়ায় কবি চিরতরে নির্বাক হয়ে যেন বুঝিয়ে দিয়েছেন,
‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব
তবু আমারে দেবো না ভুলিতে।’
তথ্যপঞ্জি :
১। বাংলাদেশে নজরুল : সম্পাদনা-রশীদ হায়দার, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, আগস্ট ২০১৪
২. কেউ ভোলে না কেউ ভোলে : শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, নিউ এজ পাবলিশার্স, ১৯৬০
৩. নজরুল জীবনে নারী ও প্রেম : ডঃ আবুল আজাদ
৪. নজরুল জীবনের ট্র্যাজেডি : শেখ মুহম্মদ নূরুল ইসলাম
৫. নজরুল প্রতিভার নানা দিগন্ত : আফতাব চৌধুরী
৬. নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায় : সুফী জুলফিকার হায়দার
৭. নজরুল ও নাসির উদ্দীন (স্মারকগ্রন্থ) : সম্পাদনা-মাহফুজউল্লাহ
৮. সঞ্চিতাণ্ডকাজী নজরুল ইসলাম
৯. নজরুল জীবনী, বিদ্রোহী রণক্লান্ত-ড. গোলাম মুরশিদ, প্রথমা প্রকাশন, ২০০৪
১০. নজরুল রচনাবলী-বাংলা একাডেমি, ১৯৬৬
১১. রসিক কাজী সাহেবের খাওন টা-ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়, ইরাবতী, ১ জুন ২০২১