সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০

চলচ্চিত্রের গানের কবিতার দোষ-গুণ

তপন বাগচী

চলচ্চিত্রের গানের কবিতার দোষ-গুণ
অনলাইন ডেস্ক

আধুনিক গানের বিকাশে চলচ্চিত্রের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে রচিত হয়েছে অনেক নতুন গান। চলচ্চিত্রের পরিচালক অনেক কবিকে নিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন গান, যা হয়তো তাঁরা নিজেদের তাগিদে না-ও লিখতে পারতেন। গানের জন্য আমাদের কান প্রস্তুত থাকে বলে সুরকার কিংবা গীতিকারের নামের অপেক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই করা হয় না। কণ্ঠশিল্পীর নামেই আমরা চিনে রাখি পছন্দের গানকে। কিন্তু গানের প্রথম রূপ তো লিখিত। অর্থাৎ কবিতাকেই সুর বসিয়ে কণ্ঠে তুলে গান সৃষ্টি করা হয়। অনেক ভাল গীতিকবিতা ভাল সুরের অভাবে কিংবা ভাল কণ্ঠের অভাবে অবিকশিত থেকে যায়। আবার কেবল সুর ও কণ্ঠের গুণে অনেক দুর্বল এবং ভুল বাণীবিন্যাসের গানও উৎরে গিয়ে ইতিহাস হয়ে আছে। গানের ক্ষেত্রে যদি শিল্পরীতিকে পুরোপুরি মান্য করা হয়, একমাত্র এদিক-সেদিকে যদি অনুমোদন না দেয়া হয়, তবে গানের বাণী কিংবা কবিতার শিল্পরূপকেও গুরুত্ব দেয়া দরকার। আমরা চলচ্চিত্রের কিছু স্মৃতি জাগানিয়া গান নিয়ে আমাদের আলোচনা অগ্রসর করতে পারি।

চলচ্চিত্রের স্মৃতি জাগানিয়া গান নিয়ে বিশদ গবেষণা করেছেন আসলাম আহসান। তিনি আমাদের চলচ্চিত্রের সুরস্রষ্টা, গীতিকার, কণ্ঠশিল্পীদের পরিচয় উদ্ধারের পাশাপশি ৮০টি গানের কবিতা তুলে ধরেছেন শেষ অধ্যায়ে। কাজটি কেবল প্রশংসনীয়ই নয়, আমাদের চলচ্চিত্রের সেরা গানের কবিতার লেখ্যরূপ দেখে যেমন তৃপ্ত হওয়া যাবে, তেমনি এর কাঠামো নিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি হলো। তিনি ‘রুচিশীল প্রতিনিধিত্বশীল গানের তালিকায় এই গানগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া কঠিন হবে’ বলে ধারণা করেছেন। আমাদের চলচ্চিত্রের ষাট বছরের উল্লেখ করার মতো এই গান। আমরা তাঁর নির্বাচিত কিছু গান নিয়েই আলোচনা করতে পারি।

‘মুখ ও মুখোশ’ (১৯৫৬) চলচ্চিত্রে সমর দাসের সুরারোপিত ও আবদুল গফুর সারথী রচিত ‘মনের বনে দোলা লাগে’ গানটি সঙ্গত কারণেই তালিকার শুরুতে রয়েছে। কাঠামোতে কোনো ত্রুটি নেই। আস্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগ-- বাংলা কবিতার এই কাঠামো মেনে চলেছেন। স্বরবৃত্ত ছন্দে চার মাত্রার পূর্ণপর্বের পরে অপূর্ণপর্বের অপূঅন্ত্যমিলের শুদ্ধতা রক্ষা করেছেন-- হাওয়া, পাওয়া, গাওয়া, নাওয়া। সঞ্চারীতেও (প)বনে/(আন)মনে মিল দেয়েছেন। এরকম শুদ্ধ ছন্দ, পর্ববিন্যাস এবং অন্ত্যমিলের কবিতা লিখেছেন শামসুর রাহমান, আবু হেনা মোস্তাফা কামাল, সৈয়দ শামসুল হক, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মাসুদ করিম, খান আতাউর রহমান, ওবায়েদউল হক, কাজী আজিজ আহমেদ, মোস্তাফিজুর রহমান গামা, আজাদ রহমান, ফজল-এ-খোদা, মুকুল চৌধুরী, মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, আলাউদ্দীন আলী, মনিরুজ্জামান মনির, নজরুল ইসলাম বাবু, শহীদুল হক খান। এঁদের অনেকেরই একাধিক কবিতা এই গ্রন্থে তালিকাভুক্ত হয়েছে। যাঁর অন্তত একটি গান এখানে শুদ্ধ পেয়েছি, তাঁর নামই আমি এতক্ষণে উচ্চারণ করেছি। এঁদের অনেকেরই অন্য গানে হয়তো পূর্ণভাবে শুদ্ধ মনে করা যায় না। আর যাঁদের একটি গানও শুদ্ধ মনে হয়নি আমার কাছে তাঁদের নাম এখানে উচ্চারণ করিনি।

ধরা যাক দ্বিতীয় গানটির কথা। এহতেশাম পরিচালিত ‘রাজধানীর বুকে’ (১৯৬০) চলচ্চিত্রের রবীন ঘোষ ও ফেরদৌসী রহমানের সুরে তালাত মাহমুদের কণ্ঠে গীত গানের কবিতাটি লিখেছেন কে জি মুস্তাফা। ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভাল চাঁদ বুঝি তা জানে’ কবিতাটির জন্য কে.জি. মুস্তাফা আজ বিখ্যাত হয়ে আছেন। মাত্রাবৃত্তে ৬+৫+৭ মাত্রার আস্থায়ী এবং সেতুবন্ধ চরণ অসাধারণ। দুটি অন্তরাতেই ৬+৬/৬+৬/৬+৬/৫+৬ মাত্রা রয়েছে। এটিও লক্ষ্যযোগ্য বৈশিষ্ট্য। কিন্তু অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রে ‘জানে/টানে/কানে/কানে’ আমাদের প্রত্যাশাকে পূর্ণ করতে পারে না। কে.জি. মুস্তাফা যে শেষের ‘কানে’ পরিবর্তে ‘খানে’, ‘গানে’ বানাতে পারতেন না, আমি তা বিশ্বাস করি না।

‘আকুল ভোমরা বলে সে কথা বকুলের কানে কানে’

‘আকুল পাপিয়া ছড়ায় সে কথা বাতাসের কানে কানে’

ভোমরা আর পাপিয়ার বিশেষণ হিসেবে ‘আকুল’ শব্দটি দুইবার ব্যবহার না করলেই ভাল লাগত। একবার ‘বকুলের কানে কানে’, আরেকবার ‘বাতাসের কানে কানে’ শ্রোতার কান এড়িয়ে গেলেও পাঠকের বোধে তা খটকা সৃষ্টি করে। এইটুকু সামান্য বিকল্প খোঁজা কোনোমতেই বাড়তি দাবি নয়। সুর এবং কণ্ঠের কারণে এই কবিতা কালজয়ী গান হয়ে উঠলেও কথার এই দুর্বলতাটুকু অস্বীকার করা যাবে কি? কে.জি. মোস্তফার আরেকটি বিখ্যাত গানের কবিতা হলো ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবো বলে’। চোখে/লোকে শুদ্ধ মিলের পরে যদি ‘ঢেকে’ বসানো হয়, তবে কানে লেগে যায়। শেষ চরণেও একই অন্ত্যমিল। এটা এক ধরনের দুর্বলতা। এহতেশাম পরিচালিত ‘নতুনসুর’ (১৯৬২) চলচ্চিত্রেও গান লিখেছেন কেজি মোস্তফা। রবীন ঘোষের সুরে আঞ্জুমান আরা বেগমের কণ্ঠে ‘কে স্মরণের প্রান্তরে চুপিচুপি ছোঁয়া দিয়ে যায়’ কবিতায় সঞ্চারীতে ‘বাতায়ন খুলে’/ শুধু আঁখিজলে’র মিলকে তো অলঙ্কারশাস্ত্র অনুমোদন দেয় না।

‘রাজধানীর বুকে’ চলচ্চিত্রে তালাত মাহমুদের গাওয়া সাঈদ সিদ্দিকীর লেখা ‘আমার সে গান হারিয়ে গেছে’ কবিতায় প্রথম অন্তরায় প্রাণে/(বিজনে) মিল শুদ্ধ নয়। আবার আস্থায়ীর অন্ত্যমিল বনে/(আলা)পনে-র সঙ্গে প্রথম অন্তরার ‘(আবা)হনে’ চমৎকার লাগলেও শেষ অন্তরার ‘ঝরবে না কি নয়ন তব গোপন বেদনাতে’র ‘নাতে’ কোনোক্রমেই শুদ্ধ হতে পারে না। একই চলচ্চিত্রে ফরিদা ইয়াসমিনের কণ্ঠে আজিজুর রহমানের কথায় প্রথম অন্তরার

‘ফুলের হাওয়া লাগে বনে ওই

দোলা দিল মনে মনে

রঙিন পলাশ রঙ ছড়ালো হায়

আমার আঁখির কোণে॥’

এই কথায় অন্তরা আছে, সঞ্চারী আছে, আভোগ আছে কিন্তু মনে/কোণের সঙ্গে মিলসম্ভাবী কোনো শব্দ নেই। সুরে ঝংকৃত হয়েছে বলে একে গান বলে মেনে নিলেও কবিতার এই দুর্বলতা তো ঢাকা যাবে না। ‘হারানো দিন’ (১৯৬১) চলচ্চিত্রে আজিজুর রহমানের আরেক কবিতা ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের যাদু এনেছি’র সঙ্গে অন্ত্যমিল হিসেবে রয়েছে ‘এসেছি/বেঁধেছি/চলেছি’। রবীন ঘোষের সুরে ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠে গান হিসেবে অসাধারণ হলেও তিনমাত্রার মিল দিতে পারলে কবিতা হিসেবেও এর উচ্চমূল্য তৈরি হতো। সৈয়দ আউয়ালের ‘অন্তরঙ্গ’ (১৯৭০) চলচ্চিত্রে ওবায়েদউল হক লিখেছেন ‘ভুল যদি হয় মধুর এমন হোক না ভুল’ ত্রুটিহীন চমৎকার কবিতা। খন্দকার নুরুল আলমের সুরে সেটি গেয়েছিলেন বশীর আহমদ।

আমরা এই তালিকায় গত শতকের পঞ্চাশের দশকের পাঁচজন গুরুত্বপূর্ণ কবিকে পাই গীতিকার হিসেবে। আবু হেনা মোস্তাফা কামাল, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান ও ফজল শাহাবুদ্দীন। এঁদের মতো কবি এগিয়ে এসেছিলেন বলে আমরা ভাল কিছু গানের কবিতা পেয়েছি। তবুও কারো কারো ক্ষেত্রে কথা থেকে যায় কিছু।

মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘তোমার আমার’ (১৯৬১) চলচ্চিত্রে কাদের জামেরীর সুরে আসাফউদ্দৌলা যে গানটি গেয়েছিলেন তা লিখেছেন কবি আবু হেনা মোস্তাফা কামাল। স্বরবৃত্ত ছন্দে সঞ্চারীযুক্ত কী সুন্দর কবিতা ‘মুখের হাসি নয় গো শুধু মনের দিশা মেলে/ আয়না আমার পেলে/ আয়না আছে, এই আয়না আছে॥’ রহিম নওরোজের ‘যোগ বিয়োগ’ (১৯৭০) চলচ্চিত্রে আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘এই পৃথিবীর পান্থশালায়’ কবিতাটি রয়েছে। সুবল দাসের সুরে এটি গেয়েছেন সৈয়দ আবদুল হাদী। ছন্দ, পর্ববিন্যাস, অন্ত্যমিল কোথাও কোনো ঘাটতি নেই। নজরুল ইসলামের ‘দর্পচূর্ণ’ (১৯৭০) চলচ্চিত্রে তিনি লিখেছেন ‘তুমি যে আমার কবিতা, আমার বাঁশির রাগিণী’। সাবিনা ইয়াসমিন ও মাহমুদুন্নবীর কণ্ঠের এই গানে সুর দিয়েছেন সুবল দাস। অলঙ্কারঋদ্ধ এই কবিতার একটু দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে ‘চিরদিন তোমারে চিনি’ পর্বটি ৩ বার ব্যবহার করায়। এটি তিনি এড়াতে পারতেন।

সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘সুতরাং’ (১৯৬৪) চলচ্চিত্রে গান লিখলেন কবি সৈয়দ শামসুল হক। সত্য সাহার সুর আর আঞ্জুমার আরা বেগম ও কাজী আনোয়ার হোসেনের দ্বৈতকণ্ঠে গীত ‘তুমি আসবে বলে, কাছে ডাকবে বলে’ অসাধারণ কবিতা। কিন্তু ‘শুধু মোরে/মনে পড়ে/দূরে দূরে/এই বাসরে’ এই অন্ত্যমিল চারটি তো কবিতার অন্ত্যমিল হিসেবে ঘাটতি থেকে যায়। সুরে ও গায়কীতে উতরে গেলেও কবিতার এই দুর্বলতাতো চোখে থেকে যায়। একই বছরে মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘শীত বিকেল’ চলচ্চিত্রেও গান লেখেন সৈয়দ শামসুল হক। সুর করেন শেখ মোহিতুল হক আর কণ্ঠ দেন সোহরাব হোসেন। একবার মাত্রাপতন ছাড়া কবিতাটি অনেক সুন্দর! একটি মাত্র যুক্তাক্ষর প্রয়োগে চার মাত্রার মাত্রাবৃত্তে তিনি কবিতাটি লিখেছেন। তবে ‘নিভে গেছে দীপখানি বাতাসের আঘাতে/সবি হলো ভুল বুঝি বাসর সাজাতে’--সঞ্চারীর শেষ পর্বে একটি মাত্রা যুক্ত হতে পারত। তাহলে গান হিসেবে উতরে যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে কবিতা হিসেবেও ত্রুটিমুক্ত হতে পারত। সুভাষ দত্তের ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ (১৯৬৭) চলচ্চিত্রে 'যার ছায়া পড়েছে মনের আয়নাতে/ সে কি তুমি নও? ওগো তুমি নও?’ কবিতায় সুর দিয়েছেন সত্য সাহা আর গেয়েছেন ফেরদৌসী রহমান। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই গান। কিন্তু ‘তুমি নও’র সঙ্গে আরেকবার ‘তুমি নও’ আছে। তারপর ‘কথা কও’ আর ‘ছবি নও’ মিল রয়েছে। মোদ্দাকথা ‘নও/কও’ মাত্র দুটি মিল। অন্য দুটি অন্তরার জন্য দরকারি দুটি অন্ত্যমিলের ঘাটতি রয়েই গেল! কামাল আহমেদের ‘অবাঞ্ছিত’ চলচ্চিত্রে তাঁর লেখা ‘প্রিয়তম তুমি এলে’ কবিতায় সুর দিয়েছেন আলী হোসেন এবং কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন ও বশীর আহমদ। এই কবিতায় লগনে/কূজনে/বিজনে ৩ মাত্রার শব্দ হলেও ২ মাত্রার অন্ত্যমিল রয়েছে। এই সামান্য দুর্বলতা অগ্রাহ্য করতে পারলে কবিতা হিসেবে উৎকৃষ্ট এটি। কামাল আহমেদের ‘অধিকার’ (১৯৭০) চলচ্চিত্রে ‘কে যেন আমায় ডাকে প্রিয় নাম ধরে’ গানটিতে ত্রুটি নেই কোনো। কবি হিসেবে সৈয়দ শামসুল হকের অসাধারণত্বকে মান্য করি বলেই গানের কবিতার এই শিথিলতা মনের মধ্যে দাগ কেটে থাকে।

কবিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গান লিখেছেন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘ডাকবাবু’ (১৯৬৬) চলচ্চিত্রে সৈয়দ আবদুল হাদীর কণ্ঠে তুলে আলী হোসেন তুলে দিলেন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কবিতা ‘চাতুরী জানে না মোর বঁধুয়া’। জানে না/টানে না/আনে না/ মানে না--কী চমৎকার মিল! মাত্রাবৃত্তে পাঁচ মাত্রার কবিতা। তবে শেষ অন্তরার ‘ভ্রমরের বীণ চরণে বাজে ঠমকে ঠমকে যায়’ চরণে মাত্রাসাম্য বজায় থাকে নি। নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘এতটুকু আশা’ (১৯৬৮) চলচ্চিত্রে সত্য সাহার সুরে গেয়েছেন মোহাম্মদ আবদুল জব্বার। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ‘তুমি কি দেখছ কভু জীবনের পরাজয়’। মাত্রাবৃত্তে প্রথম চরণে ৬+২+৬+২ মাত্রা, আর অবশিষ্ট ৬+৬+৬+২ মাত্রায় এগিয়ে গেছে। পর্ববিন্যাস এবং অন্ত্যমিলের শুদ্ধতার ক্ষেত্রে এটি আদর্শ কবিতা হতে পারে। নারায়ণ ঘোষ মিতার আরেকটি চলচ্চিত্র ‘নীল আকাশের নীচে’ (১৯৬৯)-তে সত্য সাহার সুরে গেয়েছেন ‘মাহমুদুন্নবী। কবিতাটি হলো ‘প্রেমের নাম বেদনা সে কথা বুঝিনি আগে’। আগে/লাগে/মাগে/জাগে অন্ত্যমিল চমৎকার। তবে ছন্দের চালটা একটু জটিল। কবিতার বিচারে সহজে ধরা যায় না। একই পারিচালকের ‘দীপ নেভে নাই’ (১৯৭০) চলচ্চিত্রে ‘আমার এ গান তুমি শুনবেই, জানি শুনবেই’ কবিতায় অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রে আপস রয়েছে। কোনদিন/সেদিন/চিরদিন/রঙিন--এরকম ‘দিন’বাচক তিনটি শব্দ এড়াতে পারলে এটাও অসাধারণ কবিতা। আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’ (১৯৭১) চলচ্চিত্রে সমর দাসের সুরে এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘ওরে আয় ঘরে আয়, সাগর ভেঙে বন্যার বেগে আয়’ গানটি অসাধারণ কবিতা। পুরোপুরি অনুকরণযোগ্য।

আলমগীর কবিরের ‘সূর্যকন্যা’ (১৯৭৬) চলচ্চিত্রে পঞ্চাশের কবি ফজল শাহাবুদ্দিনের লেখা গানের কবিতায় সুর দিয়েছেন সত্য সাহা আর কণ্ঠ দিয়েছেন শ্যামল মিত্র। সুর আর কণ্ঠের কারণে এই গান তো জনপ্রিয় না হয়ে যায় না। ‘চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা/ ভালবাসো যদি কাছে এসো না’। চমৎকার বক্তব্য। কিন্তু (অ)চেনা/(এ)সোনা মিল তো গ্রাহ্য নয়। আস্থায়ীর এই দুই মিলের পরে অন্তরায় এসেছে (বে)দনা/(জো)ছনা। এরকম দুর্বল ও গোঁজামিলের গানও যতই জনপ্রিয় হোক, তাঁর কাব্যগুণের ঊণতাকে বর্জন করতেই হবে।

সালাইদ্দিন পরিচালিত ‘সূর্যস্নান’ (১৯৬২) চলচ্চিত্রে খান আতাউর রহমানের কবিতা ও সুরে কলিম শরাফী গেয়েছিলেন ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে/ সে দুঃখে চক্ষের পানি/ ও আমাপর চক্ষু নাই, পার নাই কিনার নাই রে॥’ এই সুর কালজয়ী হয়েছে। গায়কীও অপূর্ব। কিন্তু অন্ত্যমিলের সমস্যা তো রয়ে গেছে। শেষ চরণে আছে ‘তবু জনমদুঃখী আমি তোমায় আপন জানি’। বোঝা যাচ্ছে যে পানি/জানি-র অন্ত্যমিল হবে প্রতিটি সেতুবন্ধ চরণে। সেখানে অন্তরায় ‘তবু দিলাম ভাঙা নায়ে অকুল সায়র পাড়ি’-কে আমরা মেনে নিতে পারি না গানের কবিতার শিল্পরূপ বিচার করতে গেলে। পানি/জানি-র সঙ্গে পাড়ি-র মিল একেবারেই গোঁজামিল। রহিম নওয়াজের ‘মনের মতো বউ’ (১৯৬৯) চলচ্চিত্রে খান আতার ‘সুরের বাঁধনে তুমি যতই কণ্ঠ সাধো, তাকে আমি বলব না গান’ চমৎকার কবিতা। তাঁর সুরে বশীর আহমদ গেয়েছেনও ভাল। কিন্তু চার মাত্রার মাত্রাবৃত্তের প্রয়োগনৈপুণ্যও প্রশংসনীয়। আমাদের আপত্তির জায়গা অন্ত্যমিলের স্থানে। আস্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগ থাকলে তো অন্তত চারটি মিলবাচক শব্দ দরকার হবে। কিন্তু খান আতা এখানে গান আর দান দিয়েই শেষ করেছেন। মিলের এই পুনরাবৃত্তি গানের কবিতাকে দুর্বল করে ফেলেছে। একই চলচ্চিত্রে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘এ কি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে’র ক্ষেত্রে অন্ত্যমিলের এই দুর্বলতা নেই। তবে ৬ মাত্রার মাত্রাবৃত্তের চাল রাখতে গিয়ে ‘রিক্ত আমার ক্ষুদ্র প্রাণে তোমার আঁখিটি রেখো’ চরণে ‘প্রাণে’ উচ্চারণ করতে গেলে ৩ মাত্রা পায় না। এইটুকু সমস্যা মেটাতে পারতেন। তবু বাকিটুকু অসাধারণ নির্মাণ। স্বপরিচালিত ‘জোয়ার ভাঁটা’ চলচ্চিত্রে নিজের লেখা ও সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে গীত ‘মন যদি ভেঙে যায় যাক, যাক কিছু বলব না’ কবিতায় ‘বলব না’/ ‘তুলব না’-র সঙ্গে দুইবার ‘সান্ত¡না’ দিয়ে মিল দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, যা অলঙ্কারিক বিচারে বড় দুর্বলতা বটে! স্বপরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’ (১৯৭৩) চলচ্চিত্রে নিজের রচনায় ও সুরে ‘তুমি চেয়েছিলে ওগো জানতে’ কবিতায় কণ্ঠ দিয়েছেন আবিদা সুলতানা। এই কবিতায় অন্ত্যমিলের শুদ্ধতা রক্ষা করা হয়নি।

নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’ (১৯৭৪) চলচ্চিত্রে মোস্তাফিজুর রহমান গামার রচনা ‘এই পৃথিবীর পরে/ কত ফুল ফোটে আর ঝরে’ অসাধারণ। সত্য সাহার সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে এটি বেশ জনপ্রিয় হয়।

আবদুল জব্বার খান পরিচালিত ‘জোয়ার এলো’ (১৯৬২) চলচ্চিত্রে মোহাম্মদ মহসিনের কবিতায় সুর দিয়েছেন ধীর আলী মিয়া আর কণ্ঠ দিয়েছেন ফেরদৌসী রহমান। ‘নিশিজাগা চাঁদ হাসে, কাঁদে আমার মন’ কবিতার প্রথম চরণে এক মাত্রা কম পড়লেও অন্ত্যমিল ঠিক রয়েছে। কাঠামো হিসেবেও যথাযথ।

সালাহউদ্দিনের ‘ধারাপাত’ (১৯৬৩) চলচ্চিত্রে সালাহউদ্দিনের সুরে ইসমত আরার কণ্ঠে আমজাদ হোসেনের কবিতা ‘এতো কাছে চাঁদ বুঝি কখনো আসেনি’র একটি মিলও শুদ্ধ পাওয়া গেল না। আসেনি/দেখিনি/সজনী মিল কি শ্রোতার কান অনুমোদন করে। অন্তরায় দূরে/(সা)গরে, আঁধারে/পাঁজরে মিল কি মেনে নেব? প্রথম অন্তরার শেষের চরণ আর সর্বশেষ চরণ একই। এটাও এক ধরনের দুর্বলতা বটে!

রাশেদ আজগর চৌধুরী পরিচালিত ‘অভিশাপ’ চলচ্চিত্রে মো. ইউসুফের কবিতায় সুর দিয়েছেন আশরাফ এবং কণ্ঠ দিয়েছেন জীনাত রেহানা ও মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী। ছন্দে এলোমেলো, অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রেও দেখি ‘বনে’-র সঙ্গে ‘জানে’-র মিল দিয়ে বসে আছেন।

সুভাষ দত্তের ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ (১৯৬৭) চলচ্চিত্রে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কবিতায় ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’ অসাধারণ গেয়েছেন বশীর আহমদ ও আঞ্জুমান আরা বেগম। সত্য সাহার সুর অসাধারণ। চারমাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে চমৎকার বিন্যাস। অলঙ্কারবহুল কবিতাটি এখনো জনপ্রিয়। আস্থায়ীর তৃতীয় চরণে ‘রাত্রির গায়ে জ্বলে জোনাকী’-তে তিনমাত্রা বাড়লে প্রথম চরণের সমান হতো। আভোগের ‘জানি না কীসে এত দ্বন্দ্ব ((৪+৩+৩)। শেষের দ্বন্দ্ব অপূর্ণ পর্ব। এই কবিতায় প্রতিটি অপূর্ণ পর্বই ৩ মাত্রার। এখানে ‘কীসে’ শব্দের বদলে ‘কীসের’ হলেও চলত। ‘বলি বলি করে তবু বলা হলো না’ চরণেও একমাত্রার ঘাটতি রয়ে গেছে। এই ঘাটতি পূরণ হয়ে গেছে সুরের আতিশয্যে। কিন্তু কবিতার বিচারে তা পূরণ হবে কীসে! মোস্তফা মেহমুদের 'মোমের আলো’ (১৯৬৮) চলচ্চিত্রে গাজী মাজহারুল আনোয়ার চার মাত্রার মাত্রাবৃত্তে লিখেছেন ত্রুটিহীন কবিতা ‘ফেলে আসা দিনগুলি স্মৃতি হয়ে রয়’। সত্য সাহার সুরে হাসিনা মমতাজের কণ্ঠে এই গান বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। কাজী জহিরের ‘ময়নামতি’ (১৯৬৯) চলচ্চিত্রে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়’ ৪ মাত্রার স্বরবৃত্তে চমৎকার কবিতা। বশীর আহমদ গেয়েছেন এটি নিজের সুরেই। এই কবিতাও ত্রুটিহীন। সুভাষ দত্তের ‘আলিঙ্গন’ চলচ্চিত্রে তাঁর সত্য সাহার সুরে ও কণ্ঠে গীত ‘দিগন্তে দাঁড়িয়ে দুবাহু বাড়িয়ে’ কবিতাটিও ত্রুটিমুক্ত। বাবুল চৌধুরীর ‘আঁকাবাঁকা’ (১৯৭০) চলচ্চিত্রে আলতাফ মাহমুদের সুরে শাহনাজ রহমতউল্লাহর গাওয়া ‘আনুরাগের গানে গানে আরও কাছে এলে যদি’ কবিতায় গাজী মাজহারুল আনোয়ার ‘নদী’র সঙ্গে ‘ক্ষতি’ আর ‘মুদি’ শব্দের মিল দিয়েছেন, যা অত্যন্ত দুর্বলতার প্রকাশ। ইবনে মিজানের ‘কত যে মিনতি’ (১৯৭০) চলচ্চিত্রে ‘তুমি সাত সাগরের ওপার থেকে আমায় ডেকেছ' কবিতায় দেখেছি/থেকেছি/মেখেছির সঙ্গে ‘লিখেছি’ মিলে একটু সমস্যা হয়ে থাকে। সুভাষ দত্তের ‘বিনিময়’ (১৯৭০) চলচ্চিত্রে ‘জানতাম যদি শুভঙ্করের ফাঁকি’ কবিতায় শূন্য/জন্য মিলটা একটু দুর্বল। মাত্রাও দু-একস্থানে কম বেশ হয়েছে। নজরুল ইসলামের ‘স্বরলিপি’ (১৯৭১) চলচ্চিত্রের ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে কী হবে’ এবং এইচ. আকবরের ‘জলছবি’ (১৯৭১) চলচ্চিত্রে ‘এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে দুটি মন কাছে আসলো’ গান দুটোতে এই ধরনের কোনো ত্রুটি নেই। এসএম শফির ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’ (১৯৭২) চলচ্চিত্রে ‘গীতিময় সেই দিন চিরদিন’ কবিতাটিও ত্রুটিহীন। হাসমত পরিচালিত ‘স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা’ চলচ্চিত্রে ‘দুটি পাখির একটি ছোট্ট নীড়ে’ গানটিও কাব্যবিচারে উত্তীর্ণ। আবার দীলিপ সোমের ‘আলো তুমি আলোয়া’ (১৯৭৫) চলচ্চিত্রে ‘আমি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে’ কবিতায় ‘পড়ে আছি’র সঙ্গে ‘গড়েছি’র মিল পুরোপুরি শুদ্ধ নয়। আজিম পরিচালিত ‘প্রতিনিধি’ (১৯৭৬) চলচ্চিত্রে ‘তুমি বড় ভাগ্যবতী’র সঙ্গে বাতি/রাতি-ও মিল তো অপুষ্টতার লক্ষণ। কিন্তু সত্য সাহা সুর দিলে আর রুনা-সাবিনা গাইলে সেই গান তো হিট হবেই। শ্রোতা তো আর কবিতার এই দুর্বলতার দিকে দৃষ্টি দেয়ার সুযোগ পায় না।

সৈয়দ মোহাম্মদ আউয়ালের ‘অপরিচিতা’ (১৯৬৮) চলচ্চিত্রে মাসুদ করিম লিখেছেন ত্রুটিহীন কবিতা। বাবুল চৌধুরী পরিচালিত ‘আগন্তুক’ চলচ্চিত্রে আবু হায়দার সাজেদুর রহমানের কবিতায় মরে/কেড়ে অন্ত্যমিলের দুর্বলতা লক্ষণীয়।

আমির হোসন পরিচালিত ‘যে আগুনে পুড়ি’ (১৯৭০) চলচ্চিত্রে কাজী আজিজ আহমেদ লিখেছেন ‘চোখ যে মনের কথা বলে’ কবিতাটি। খোন্দকার নূরুল আলম নিজের সুরে এটি গেয়েছেন নিজেই। এই গানটি কেউ কেউ গাজী মাজহারুল আনোয়ারের নামে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু গবেষক আসলাম আহানকে লেখা পরিচালকের পত্রে এটা পরিষ্কার হয়েছে যে, এর রচয়িতা কাজী আজিজ আহমেদই। এই কবিতায় ছন্দ ও অন্ত্যমিলে সমস্যা রয়েছে। কাজী আজিজ আহমদের আরেকটি কবিতা গান হয়েছে এইচ. আকবরের ‘জীবনতৃষ্ণা’ (১৯৭৩) চলচ্চিত্রে। গানটিতে তেমন ত্রুটি নেই। ‘মনের আয়নায় যে একবার ধরা দেয়’ গানটি গেয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন খোন্দকার নূরুল আলমের সুরে।

এহতেশামের ‘পীচঢালা পথ’ (১৯৭০) চলচ্চিত্রে আহমদ জামান চৌধুরীর ‘পীচঢালা এই পথটারে ভালবেসেছি’ কবিতায় ‘এমনি করে’/ ‘ঘুরে ঘুরে’র দুর্বল মিলটুকু বাদে অসাধারণ হয়েছে। রবীন ঘোষের সুরে এটি গেয়েছেন মোহাম্মদ আবদুল জব্বার।

নিজাম উল হকের ‘কোথায় যেন দেখেছি’ (১৯৭০) চলচ্চিত্রে খন্দকার ফারুক আহমেদের গাওয়া ফিরোজা হকের লেখা ‘কোথায় তোমায় যেন দেখেছি’ কবিতায় ছন্দে ও অন্ত্যমিলে সমস্যা রয়েছে।

আবদুল জব্বার খানের ‘কাচ কাটা হীরে’ (১৯৭০) চলচ্চিত্রের মুকুল চৌধুরীর ‘জলতরঙ্গ মন আমার’ কবিতায় ‘বাজে’র সঙ্গে মিলযুক্ত কোনো শব্দই দেখা যাচ্ছে না। গানের কবিতা হওয়ার ক্ষেত্রে এটি তো অন্তরায়। আলম খানের সুরে আর রূপা খানের কণ্ঠে ভাল লাগলেও কবিতার দুর্বলতা তো ঝেড়ে ফেলা যাবে না। আবুল বাশারের ‘লাভ ইন সিমলা’ (১৯৭৫) চলচ্চিত্রে আলম খানের সুরে রুনা লায়লা গেয়েছেন ‘হেরে গেছি আজ আমি নিজের কাছে/ হেরে গেছি জীবনেরই খেলাতে’ কবিতাতে অন্ত্যমিলের কোনো চেষ্টাই করা হয়নি। এরকম দুর্বল কাঠামোতে আলম খানের মতো সুরকার কে যে সুর বসিয়েছেন, তা ভাবলে অবাক হই।

মাসুদ পারভেজের ‘মাসুদ রানা’ (১৯৭৪) চলচ্চিত্রে আজাদ রহমানের ‘মনের রঙে রাঙাবো/ বনের ঘুম ভাঙাবো’ কবিতাটি ছন্দমিলের বিচারে ঠিক আছে। মাসুদ পারভেজ পরিচালিত ‘এপার ওপার’ (১৯৭৫) চলচ্চিত্রে ফজল-এ-খোদা রচিত ‘ভালোবাসার মূল্য কত আমি কিছু জানি না’ কবিতাটি আজাদ রহমানের সুরে ও কণ্ঠে দারুণ জনপ্রিয় হয়। আস্থায়ীতে ‘জানি না/ বুঝি না’ মিল যথাযথ নয়। অন্তরায় ‘মন হবে কি/ ফুল হবে কি’, ‘কী হবে না/ কী পাব না’ মিলগুলোও একেবারেই উচ্চমানের নয়। ‘আমি না জেনে না বুঝে নিলাম তোমার মন/ পরে বেশি দাম চেও না’ এই দুই চরণই বারবার এসেছে প্রতি অন্তরার শেষে। গান হিসেবে উতরে গেলেও কবিতার এই দুর্বলতা থেকেই যাচ্ছে।

আমরা জানি গানের কবিতা নিয়ে এই ধরনের আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু কবিতা নিয়ে আলোচনা হলেও গানের কবিতা নিয়ে আলোচনার অভাব দেখা যায়। এর একমাত্র কারণ হলো গানকে আমরা সাহিত্য হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত নই। গানের সুরমণ্ডিত অংশটুকুই আমরা স্মৃতিতে গেঁথে নিই। কিন্তু এটি প্রথমত সাহিত্য বলেই কাব্যতত্ত্ব বিচারে এর আলোচনার সুযোগ রয়েছে। আমাদের স্মৃতিজাগানিয়া গানগুলোর সাহিত্যসৌন্দর্য আবিষ্কারের পাশাপাশি ত্রুটি-দুর্বলতার দিকটিও উন্মোচন করা যেতে পারে। এইসব দোষ-গুণ নিয়েই আমাদের চলচ্চিত্রের গান সমৃদ্ধ হয়ে আছে।

তপন বাগচী : কবি-গীতিকার-প্রাবন্ধিক। উপ-পরিচালক, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়