সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২২, ০০:০০

নব্বই দশকের কবি : কাব্যশিল্পের মগ্ন তাপসেরা
পীযূষ কান্তি বড়–য়া

কবিতা স্বয়ং এক সীমানাহীন বিহগ। শিল্পের যেমন কোনো জাত-পাত-বর্ণ-গোত্র ভেদ নেই, তেমনি কবিতাও সীমা-সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠা সংস্কারমুক্ত এক বিহগপ্রতিম সত্তা। কিন্তু কবিরা সীমানামুক্ত নয়। কবিতার মতো শিল্পের সূক্ষ্মতা কবির নেই। কবি তাই সীমানায় আবদ্ধ শিল্প¯্রষ্টা, যার সৃষ্টিগুলো সীমানাজয়ী নান্দনিক জীবন-ন্যাস্ত অপ্রতিম সত্তার মতো। কবিতা পরিযায়ী কিন্তু কবির একটা সুনির্দিষ্ট পরিচিতি ও শেকড় আছে। এ শেকড় হতে পারে সময়, হতে পারে ভূমি, হতে পারে কোনো আদর্শিক চেতনা। যদি বৃটিশ শাসনের অগ্নিকু-ে জন্ম না নিতেন কবি নজরুল, তবে তাঁর সৃজন-¯্রােতস্বিনীর গতিধারা আজ ভিন্নমুখে প্রবাহিত হতো, তাতে ‘বিদ্রোহী’র রুদ্রধারার সমুদ্র-মন্থন হতো না। যদি মাইকেল মধুসূদন দত্ত পাশ্চাত্যের কোনো দেশের কবি হতেন, তবে তাঁর কবিতায় স্বদেশপ্রেমের অমৃত-সন্ধান হতো না বলেই প্রতীয়মান হয়। তেমনি কবি জীবনানন্দ দাশ যদি মধ্যযুগে জন্ম নিতেন, তবে তাঁর কবিতায় মঙ্গলকাব্যের আঙ্গিক ও আভাসের আধিক্য থাকতো, সে বিষয়ে নিশ্চিত বলা যায়। নিজস্ব কাব্যভাষার বিনির্মাণ হয়তো হয়ে উঠতো না। অর্থাৎ কবির চারিত্র নির্মাতারূপে সময় বা যুগ, ভূমি বা রাষ্ট্র, জাতি বা সংস্কৃতিকেই মুখ্যরূপে চিন্তা করতে হয়, স্থান দিতে হয়। কবি সেই অবস্থান থেকেই তাঁর রচিত শিল্পের নান্দনিকতার শক্তিতে সার্বজনীনতা ও কালজয়িতা অর্জন করেন।

তার মানে দাঁড়ালো এই, কবিকে দশক দিয়ে বিভাজন করা বা কবির পরিচিতি নির্মাণ করার বিষয়ে যে দ্বিমত বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব প্রচলিত আছে তা যতোটুকু না বিজ্ঞানপ্রসূত, তার চেয়ে অধিক আবেগ মথিত। কেননা, সমকালীনতা একটা বড় বিষয় যা কবিকে ঋদ্ধ করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আবার আমরা দেখেছি, কবির কালজয়ী শিল্পগুলো জীবনঘনিষ্ঠ কিংবা মানুষলগ্ন হয়েই গ্রহণযোগ্যতা পায়। আর এ কারণেই ‘হুলিয়া’ কবিতাটি নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় আবদ্ধ হয়ে রইলো না, বরং তা হয়ে উঠলো আমাদের উত্তাল ষাটের দশকের এক অজর-অব্যয় দলিল। ‘হুলিয়া’ই একশব্দে কবি নির্মলেন্দু গুণের পরিচিতি নির্মাণ করিয়ে দেয়, যা দ্বারা চোখ বন্ধ করলেই ষাটের দশককে স্পর্শ করা যায়। দশকের বিভাজন কবিকে সংকীর্ণ করার কোনো প্রয়াস নয়, বরং কবিকে অধ্যয়নের এক সুশৃঙ্খল প্রচেষ্টা মাত্র। বিজ্ঞানে যেমন স্তন্যপায়ী প্রাণী বললেই মাতৃগর্ভে জন্ম ও বৃদ্ধি, স্তন্যসুধায় পালিত হওয়া এবং মেরুদ-ধারীকে আমরা বুঝে নিই, তেমনি কে কোন্ দশকের কবি তা বললেই আমরা ঐ কবিবরের মৌলিক কিছু বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে পারি। যেরকম 'তিরিশের পঞ্চপা-ব'-এই উপাধি উচ্চারণমাত্রই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে কবিতায় প্রাত্যহিক ভাষার বিপ্লব আনয়নকারী পাঁচ কীর্তিমান কবির মুখ। এঁরা মানেই শাশ্বত তিন ছন্দের পাশাপাশি আধুনিক গদ্যছন্দের চর্চামগ্ন পাঁচ কাব্যতাপস। সুতরাং দশক বিভাজন কবি ও কবিতার অধ্যয়নকে জটিল কিংবা সংকীর্ণ করে না, বরং তা সহজ করে তোলে আগ্রহী অধ্যবসায়ীকে।

দশক বিভাজনে পাওয়া এক গুরুত্বপূর্ণ শিল্প¯্রষ্টা হচ্ছে নব্বই দশকের কবি। এই দশক বাংলা কবিতায়, বাংলাদেশের কবিতায় এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। রাজনীতিতে এ পর্বটা ছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গমাখা উত্তাল সময়ের উত্তর-পর্ব। এ সময়ের শিল্পে পূর্বসূরিদের ‘অদ্ভুত উটের পিঠে চলছে স্বদেশ’ যেমন প্রতিপাদ্য ছিলো, তেমনি অগ্রজ কবি রফিক আজাদের ‘সব শালাই কবি হতে চায়’-এর মতো ধ্রুববাণীকেও স্বকালের গর্ভে ধারণ করেছে নব্বইয়ের কবিরা। নব্বইয়ের দশক তাই দ্রোহে ভরা, স্বৈরাচারবিরোধী কবিতার চর্চায় পরিপূর্ণ। এ দশকের কবিদের সংযোগসূত্র বলেও চিহ্নিত করা যায়। তারা একদিকে ধ্রুপদী তিন ছন্দকে ধারণ করেছেন, আবার অন্যদিকে ফ্রি-ভার্সকেও মাথায় তুলে নিয়েছেন। মুক্তক গদ্য ছন্দকে এ দশকের কবিরাই নিজেদের কাব্যচর্চার প্রধান বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সময়টা ছিল নির্জনতার কবি জীবনানন্দকে নতুন করে উৎখননের সময়। কবির জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন যতো ঘনিয়ে আসছিলো, ততো জীবনানন্দ আলোকিত হয়ে উঠছিলেন। এরই মাধ্যমে তিনি নব্বই দশকের কবিদের প্রভাবিত করতে শুরু করলেন। নব্বই দশকের কবিদের প্রায় সবারই জীবনানন্দীয় কাব্যভাষার অনুকরণে এক বা একাধিক কবিতার পিতৃত্ব অর্জিত হয়েছে। জীবনানন্দীয় ক্রিয়াপদ ও সর্বনামে আক্রান্ত হননি, এমন নব্বই দশকীয় কবি পাওয়া বিরল। যেমনটি রবিবলয়ের কবিদের কথা আমরা জানি, তেমনটি জীবনানন্দীয় বলয়ের কবিদেরও এক মুখ্য পরিচিতি আমরা পাই নব্বই দশকের কবিরূপে। ধীরে ধীরে এই কবিরা নিজেদের আপন পথ ও নিজস্ব কাব্যভাষা খুঁজে পেয়েছেন। এরা কেউ ইশারা ভাষাকে নিজের কবিতার বাহনরূপে আত্মস্থ করেছেন, কেউ কবিতায় অধুনাবাদকে প্রসারিত করেছেন, কারও কারও কবিতায় মিথ ও পুরাণের আশ্রয়ে ইতিহাস-ঐতিহ্য জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ কবিতায় যৌনতাকে শিল্পের রূপ দিতে চেয়েছেন, কেউ কেউ কবিতাকে পরাবাস্তবতার নামে দুর্বোধ্য করে তুলতে দীক্ষিত হয়েছেন। কবিতায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা এরা কম করেননি। নব্বইয়ের দশকই ক্রান্তিকালের কবি উপহার দিয়েছে অধিক। এরা একদিকে যেমন আদর্শিক চেতনায় নিজেদের মুক্ত রেখেছেন, তেমনি প্রতিবাদেও মুখর হয়েছেন আপন শিল্পের খর-খড়গ ভাষ্যে।

নব্বইয়ের দশক প্রসূতি হিসেবে বাংলাদেশের কবিতায় অসংখ্য কবির জন্মদাত্রী। রাজধানীকেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চা যারা করেন তারাই হয়তো অধিক আলোকিত হয়েছেন আর মফস্বলের কবিরা রয়ে গেছেন প্রচ্ছন্নতায়। তাৎক্ষণিকভাবে সন্ধান করলেও নব্বই দশকের কবিদের তালিকাটি অনেক দীর্ঘ হবে। এই দীর্ঘ তালিকায় আপাতভাবে যে নামগুলো উঠে আসে তাদের মধ্যে কবি অদিতি ফাল্গুনী, অদ্বিত্ব শাপলা, অনন্ত সুজন, অনিকেত শামীম, অলকা নন্দিতা, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, আলফ্রেড খোকন, আল হাফিজ, আহমেদ বাদল, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, আয়শা ঝর্ণা, ইশারফ হোসেন, ওবায়েদ আকাশ, ওমর বিশ্বাস, কবির হুমায়ুন, কামরুজ্জামান, কামরুজ্জামান কামু, কামরুল ইসলাম, কামাল আহসান, কাজল কানন, কুমার বিপ্লব, কুমার চক্রবর্তী, চঞ্চল আশরাফ, জফির সেতু, জাকির আবু জাফর, জানে আলম, জাফর আহমেদ রাশেদ, জামসেদ ওয়াজেদ, জামাল উদ্দিন বারী, জেনিস মাহমুদ, জুনান নাশিত, জ্যোতি পোদ্দার, টোকন ঠাকুর, নয়ন আহমেদ, নেহাল আহমেদ, তপন বাগচী, তুষার গায়েন, তৌফিক জহুর, দাউদ আল হাফিজ, পরিমল রায়, পাবলো শাহি, পীযূষ কান্তি বড়ুয়া, প্রত্যয় জসীম, পরিতোষ হালদার, ফরিদুজ্জামান, ফাতিমা তামান্না, ফাহিম ফিরোজ, বায়তুল্লাহ কাদেরী, বায়েজীদ মাহবুব, বিপ্লব ফারুক, ব্রাত্য রাইসু, বীরেন মুখার্জি, ভাগ্যধন বড়ুয়া, মজনু শাহ, মতিন রায়হান, মনসুর আজিজ, মহিবুর রহিম, মাতিয়ার রাফায়েল, মারজুক রাসেল, মাহবুব কবির, মিহির মুসাকী, মুজিব ইরম, মুর্শিদ-উল-আলম, মুহাম্মদ আবদুল বাতেন, মোস্তাক আহমাদ দীন, মিলু শামস্, রওশন ঝুনু, রথো রাপি, রফিক রইচ, রহমান হেনরী, রাজু আলীম, রাসেল আসেকী, রায়হান রাইন, রোকসানা আফরীন, রাতুল হরিৎ, রাহমান মুজিব, লীসা অতন্দ্রিলা, শাকিল রিয়াজ, শান্তা মারিয়া, শামীম রেজা, শাহনাজ পারভীন, শাহনাজ মুন্নী, শাহিন হাসনাত, শাহীন রিজভী, শিমুল মাহমুদ, শোয়াইব জিবরান, সরকার আমিন, স্বর্ণা নাজনীন, সাজজাদ বিপ্লব, সায়ীদ আবু বকর, সেলিনা শিরিন শিকদার, সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব, সৌমিত্র দেব, হামিদ রায়হান, হাসান আল আবদুল্লাহ এবং কবি হেনরী স্বপনের নাম উল্লেখ করা যায়। এতো স্বল্প পরিসরে এবং এতো স্বল্পকালের মধ্যে নব্বই দশকের কবিদের সম্পূর্ণ অধ্যয়ন-অভিজ্ঞান প্রকাশ করা হার্কিউলিসের কাজ বৈকি। নব্বইয়ের কবিরা কাব্য রচনায় যেমন তপস্যার পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি আত্মপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও পাড়ি দিয়েছেন দুর্গম পথ, অতিক্রম করেছেন নানা চড়াই-উৎরাইয়ের গন্তব্য। তাদের প্রতিষ্ঠা সহজ ছিল না কোনোমতেই। তখন এতো সংবাদপত্র কিংবা লিটলম্যাগের বিপ্লব ঘটেনি। আজকের মতো সপ্তাহের মধ্যেই মন চাইলে একটা সংকলন নামানো যায়নি। সাময়িকীর সম্পাদকরাও ছিলেন জাঁদরেল। নিজস্ব তরুণ কবিগোষ্ঠী লালন-পালন করে নিজের অবস্থান শক্ত করার মতো অসৎ প্রয়াসও তখনকার সম্পাদকদের ছিল না। কাজেই রাতারাতি খ্যাতিমান হওয়ার সুযোগ ছিল না নব্বইয়ের কবিদের। তারা চর্চার ও আত্মনির্মাণের পরশ-পাথরে সম্পন্নতা অর্জন করেছেন। তাদের কাব্যগ্রন্থের নামগুলোর কথা বিবেচনায় নিলেই বোঝা যায়, আত্মবিশোধন ও আত্মবিকাশের পথে তারা কতটুকু অধ্যবসায়ী। এ জার্নি বাই লাইফ, ইস্ত্রি করা জীবন আমার ভাল্লাগে না (সরকার আমিন), পৃষ্ঠাজুড়ে সুলতানপুর, তথ্যসূত্র পেরুলেই সরোবর (ওবায়েদ আকাশ), নৈঃশব্দ্যের ঘ্রাণ, জলের কারুকাজ (বীরেন মুখার্জি), বাওফোটা, নির্ণয় ন জানি (মুজিব ইরম), কাচের জামা, আপেল গড়ানো রাত (পরিতোষ হালদার), বুদবুদ পর্যায়ের কবিতা, শিহরণসমগ্র (টোকন ঠাকুর), অসমাপ্ত শিরদাঁড়া, খুব গান হলো, চলো(চঞ্চল আশরাফ), কমলাক্ষের অকাল বোধন, নৈরাজ্যের নেই রাজ্য (অদিতি ফাল্গুনী), আত্মধ্যানের আসন (মনসুর আজিজ) ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থসমূহের শিরোনামের বৈচিত্র্য আমাদের নব্বই দশকের কবিদের কাব্যমগ্নতার বিষয়ে সবিশদ ওয়াকিবহাল করে তোলে। কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম যেমন 'এ জার্নি বাই লাইফ' তেমনি নব্বইয়ের কবিরাও জীবনের যাত্রায় কবিতাকে সর্বতোভাবে সঙ্গী করে তুলেছেন। নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে তারা যে নিরন্তর সাধনাবাদী, তা কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম 'অসমাপ্ত শিরদাঁড়া'তেই প্রতীয়মান। একজন শিল্পতাপসের সার্থকতা অর্জনের এটাই সত্যিকারের পথ। অতৃপ্তি না থাকলে নিজেকে নিজে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা থাকে না। প্রতিনিয়ত আত্মশুদ্ধি অর্জনের চেষ্টাতেই নব্বইয়ের কবিরা তপস্যা করে গেছেন। নিজেদের সৃষ্টিকে তারা সঙ্কোচ নিয়ে পাঠকের কাছে পরিবেশন করেছেন, আদৌ তাদের সৃষ্টি শিল্পসম্মত হয়েছে কি না তা যাচাইয়ে। 'বুদবুদ পর্যায়ের কবিতা'-কাব্যগ্রন্থের এই শিরোনামই বলে দেয় নব্বইয়ের কবিদের বিনয়ের কথা। তারা কবিতার মধ্যেই 'আত্মধ্যানের আসন' গেঁড়েছেন যাতে শিল্পসৃষ্টির সাধনা বিফলে না যায়, যাতে শিল্পের করতালিতে সৃজন-মানস বিকশিত হয়ে ওঠে। নব্বইয়ের কবিরা তাই যতটা না চাষী, তার চেয়েও অধিক সাধক, যতটা না শিল্পী, তার চেয়েও অধিক স্রষ্টা। নব্বইয়ের কবিরা যুগপৎভাবে নির্মাণ করেছেন শিল্পসাধনার সম্মিলিত ঐকতান।

নব্বই দশকের কবিরা ¯œায়ুযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করে বড় হয়েছেন। যুদ্ধের ধ্বংসলীলা তাদের কোমল মানবিক মনকে বিধ্বস্ত করে তুলেছে। তাই সঙ্গত কারণেই তাদের কবিতায় যুদ্ধবিরোধী মনোভাব ফুটে উঠেছে। তারা মানবিক পৃথিবী গড়ার লক্ষে বন্দুকের নলের মুখে রাখির বন্ধন পরাতে চেয়ে লেখেন,

‘ভিজে গেলে বারুদ, যে কোনো জেনারেল মনে মনে কাঁদে।

আমি কাঁদি তুমি নিরুদ্দেশ হলে, পাখি;

যুদ্ধের মাঠে আমি সন্ন্যাসী এক; বন্দুকে বেঁধে রাখি সন্ধির রাখি।’ (বারুদ ভিজে গেলে, সরকার আমিন)

যুদ্ধ নয় শান্তির সন্ধি চেয়ে যে কবিরা বাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দিতে চান আগামী প্রজন্মকে, তারাই জীবনের আপাত কন্টকাকীর্ণতাকে অবলোকন করে লেখেন প্রতিবাস্তব কবিতা। তারা বলেন,

‘ভোরবেলা আর তোমার কাছে কিছু চাইবো না

সারারাত্রি চেয়ে চেয়ে জ্যোৎস্না দিয়ে সূর্য ঢেকেছি

কম্বল দিয়ে গ্রীষ্ম ঢেকেছি আর অমন

মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হিমালয়ের মৃত্যু দেখেছি। (আর চাইবো না, ওবায়েদ আকাশ)

জীবনের প্রতিবাস্তবতা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সূক্ষ্ম হতে এমনভাবে সূক্ষ্মতর করে তোলে যে, তাদের আণুবীক্ষণিক চোখে ফুটে ওঠে দারিদ্র্যের দেহতত্ত্ব। একজন রশিতনের প্রাত্যহিক দারিদ্র্যের মাঝেও জীবনের প্রয়োজনে রচিত হয় দেহতাত্ত্বিক আখ্যান। কবিকে বলতে শুনি,

‘দিনডা মুখ লুকাইলো আন্দারের আঁচলে

শইলের পশমে আরেকরকম মান্দার কাঁটা জাইগা উঠলো

শীতের পোয়াইল্যা বাতাসে ডালে ডালে ঘষা লাইগা তুফান উঠলো মাঝরাইতে!’ (পোয়াইল্যা রাইতের তুফান, মনসুর আজিজ)

দেহতাত্ত্বিকতা একসময় দারিদ্র্য ছাপিয়ে কবির কবিতায় ছড়িয়ে পড়ে পদ্মবিলের প্রকৃতিতে। কবিও তখন রচনা করেন মনের উপাখ্যান,

‘পদ্মবিলে রোদের তাপে পুড়ছে আমার শরীর

আর তুমি কিনা বুকের ভেতর থেকে

বের করে আনলে পোড়া মন?

কোন জলে এবার নিভাবো আমি

কাঠপোড়া কয়লার মতো পোড়া মন?

চিতাকাঠ চিতাভষ্ম জলে ভাসতে ভাসতে

কোনো জলের সোঁতায় খুঁজে পায় নিজস্ব ঠিকানা।’ (পোড়ামন, জ্যোতি পোদ্দার)

দেহতাত্ত্বিক ভাবনাগুলোকে কবিতায় শিল্পিত করে তুললেও নব্বইয়ের কবিরা ইতিহাস-ঐতিহ্য অন্বেষার দিকেও নজর দিয়েছেন প্রগাঢ়ভাবে। তাদের কবিতায় ফুটে ওঠে লোকায়ত বাংলা। আমরা কবি তৌফিক জহুরের কবিতায় চলে যাই ‘পোড়াদহের মেলা’য়,

‘সাইকেলের টায়ার চালিয়ে স্বপ্ন কুড়াতাম কৈশোরে

প্রতিদিন ভেবেছি ঘূর্ণনের ভিতর সূর্য উদিত হয়

পিথাগোরাসের সূত্র মানিনি কখনো

আইলপথ আমার প্রিয় সাইকেলের রানওয়ে

আমি দৌড়াতাম একটা ভোরকে পাশে নিয়ে

গাবতলী পার হয়ে যেতাম পোড়াদহ মেলায়।’

নব্বইয়ের কবিতায় লোকায়ত বাংলাকে খুঁজতে গিয়ে আমরা পেয়ে যাই কৃষ্ণনগরের পুতুলকে, যা আমাদের সংস্কৃতিকে যেমন তুলে ধরে তেমনি ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে বিপুল জগতে ছড়িয়ে দেয় গ্রাম বাংলার মৃত্তিকা শিল্পকে। এরই ফলস্বরূপ কবি ফরিদুজ্জামানের হাতে পেয়ে যাই ব্র্যান্ডিংধর্মী কবিতা ‘কৃষ্ণনগরের পুতুল’, যাতে জানতে পারি,

‘একদিন দৌলতদিয়া ঘাটে নদীর পাড়ে ইতিউতি

তাকাতেই এক ষোড়শী টিপ্পনী কেটে বলেছিল-

কৃষ্ণনগরের পুতুল গলির ভেতর ঢোক, সব তৃষ্ণা

জল হয়ে যাবে।’

নব্বইয়ের কবিরা যে নস্টালজিক ছিলেন এ কথা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। জ্যোতি পোদ্দারের 'অক্টোবর' কবিতাটি যে কাউকেই স্মৃতিভারাতুর করে তোলে নিঃসন্দেহে। জ্যোতি পোদ্দার যখন নস্টালজিক হয়ে বলেন,

‘অক্টোবরের এই সময় অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে আলাদা।

অতসী ফুলের গন্ধ মাখা একেকটি অক্টোবর

আমি আমার ওয়ার্ডরোবে তুলে রাখি।

ঊষের ঝাপটায় যেটি ভেজা ভেজা সেটি একটু গরমে সেঁকে

পাটে পাটে ভাজ করে সাজিয়ে রাখি টালি করে।

অক্টোবরের সাথে তোমার বৈরিতা আমার অজানা নয়।

যে কোন কর্তনে রক্তক্ষরণ বেশি

মুখরতা বেশি নিরবতা বেশি শত্রুতা বেশি

দেরাজে ঝুলিয়ে থাকা চাবির গোছার মতো

মনে ঝুলে থাকে একগোছা খচখচ’,

তখন আমরাও মনে মনে সহমর্মী হয়ে উঠি কবির সংবেদনকে প্রত্যক্ষ করে।

আত্মানুসন্ধান কবির জন্যে এক আবশ্যকীয় অন্বেষা। কবি এর মধ্য দিয়েই ‘আত্মানং বিদ্ধি’কে সম্পূর্ণ করে তোলেন। নিজের শেকড় খুঁজতে গিয়ে কবি মুজিব ইরম সুদূর পরবাসে থেকেও নিজের সাং-কে সতত মনে লালন করেন। কোন এক উদাসী দুপুরে তিনি আমাদের জানান,

‘নিজ নামে ডাক দিলে কেঁপে ওঠে অতলান্ত পথের গরিমা। যা কিছু জন্মে পাওয়া যা কিছু নালিহুরী যা কিছু নিজনামৃনিজদেশৃনিজস্ব নিয়মৃজেগে ওঠে নিজ কোলাহল।

মানুষ কেবলি হাঁটে সীমাবদ্ধ জলে। যদিও বা কেউ কেউ হেঁটে আসে গ্রিস। আরো দূর ছুঁয়ে আসে মাথুউজেলা গাছের বয়স। আমাজান হ্রদের শরীর। অতঃপর স্ট্রবেরি ক্ষেতের পাশে একটু জিরিয়ে নিয়ে যদি বা কেউ নিদ্রামগ্ন হয়, ঠিক তখনি তার নিজ নামে ডেকে ওঠে কেউ।

মানুষ কেবলি ভুলে নিজ সাং, নিজস্ব আয়াত। তারপর ঘুরেফিরে পঞ্চনদী— নিজের নিকটে এসে ধরা পড়ে যথার্থ নিয়মে। আজ এ-ভোরবেলায় এ বড়ো সত্য বাণী ভাবিলো ইরমে।’ (সাং নালিহুরী) প্রবাসী কবি যেমন নিজের সাং খ্ুঁজে বেড়ান, তেমনি স্বদেশে গর্বিত কবিও নদীর নিজস্ব ঘ্রাণে খুঁজে নেন নিজের শেকড়। আমাদেরকে তিনি তার শেকড় খুঁজে পাওয়ার গল্প বলে চলেন আপন ভাষ্যে,

‘মাতামুহুরীর কথাই বলছি; যার একান্নবর্তী সংসার ভরে আছে জল, জাল, মাতাল তরঙ্গ আর প্রবহমান করতালি। রাত যখন ক্রমশ আঁধার হয়ে আসে তখন অস্পষ্ট স্বর নিরবতায় মাদক ঢালে আর ঢুলুঢুলু চোখে চারদিকের আয়োজন দেখে; ভয় নাকি পরাজয়! বেদনা না প্রণোদনা!

কারা সঙ্গ দিতে আসে রাতে নদীর বুকে?’ (নদীর নিজস্ব ঘ্রাণ, ভাগ্যধন বড়ুয়া)।

কবিতায় নিজের শেকড় খুঁজতে গিয়ে নব্বইয়ের কবিরা মা-কে ভুলতে পারেন না। মাকে তারা কবিতার বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে শাশ্বত সত্যের জয়গান গেয়ে চলেন। কবি রওশন ঝুনু পৃথিবীর সকল মাকে উৎসর্গ করে নিজের মায়ের কথা আমাদের জানান,

‘বড় অসময়ে শীত অনুভব হলো মাঝরাতে!

মাতৃ হস্তে সযতœ সেলাই, মিহিন মমতা

কাশফুল গাঁথা পাতলা কাঁথাটা ঘুমঘোরে

উঠে এলো ঘুমগায়ে’ (শরতে শীত ও বর্ষা)।

কবি রওশন ঝুনুর মতো সংবেদনশীলতা নিয়ে তারই সমকালীন কবি আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ পড়ে থাকা রৌদ্রের রঙে খুঁজে পান মায়ের মুখের আদল। তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে মাকে স্মরণ করে ‘মায়ের মুখ’ কবিতায় বলেন,

‘কোথাও একটা রৌদ্র পড়ে আছে

মায়ের মুখের মতো।

ব্রিজ ভেঙ্গে পাখি তো উড়ল,

হাত থেকে সরে গেল গলিপথের বাবলা।

হাতি চলে, হাতি চলে

সমস্ত পাড়া গাঁ সিরাজ হয়ে যাওয়ার গান।

দেখি কোলাকুলি করছে কলকাতার ঝাউগুলো।

নিচে নেমে যায় হালকা চালের গীতিময় সন্ধ্যা।

বাড়িতে এলেই- বাবা তুই ভাত খাবি?’

কবিতায় মায়ের কথা আসলে মাতৃভাষার কথাও এসে যায়। মায়ের ভাষা যে মাতৃস্তন্যসুধার মতই। নব্বইয়ের কবি ওমর বিশ্বাস মাতৃভাষার প্রতি আবেগাপ্লুত হয়ে আমাদের বলেছেন,

‘...আমার প্রথম চিৎকার ছিল আমার ভাষার স্বরলিপি

গভীর মমতা-উচ্চারণের আবেগ প্রাণের স্পন্দন

আমার সে শব্দ ভাষা নিয়ে চলার প্রথম স্নেহ

মা ও আমার প্রথম মুখোমুখি আত্মার বন্ধন।’

(আমার সে শব্দ ভাষা ছিল)

নব্বইয়ের কবিদের দীক্ষা মূলত জীবনানন্দের কবিতার কাছেই সম্পন্ন হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। ফলে সেই দীক্ষার প্রভাবে তাদের কবিতাতেও পুরাণ ও মিথের প্রগাঢ় প্রভাব লক্ষ্যণীয়। পুরাণ ও মিথের ব্যবহারে নৈপুণ্যবান বলেই নব্বইয়ের কবিতাগুলো হয়ে উঠেছে পরিযায়ী। তেমনই এক পরিযায়ী কবিতা কবি পরিতোষ হালদারের ‘অস্মিতি’, যেখানে আমরা পাই,

‘আর্শিজগৎ থেকে হেঁটে আসা আমি, আমারও নির্মাণ আছে,

দুই পায়ে তা-ব প্রণালি। দূরে যাব, তবুও অশোকস্তম্ভের তলে

রেখে যাব দীর্ঘ-নিঃশ্বাস।’

মিথ ও পুরাণকে নিজেদের কবিতায় আত্মস্থ করতে গিয়ে পৌরাণিক দর্শনও তারা প্রয়োগ করেছেন পংক্তির অন্তরজুড়ে। তার ফলে জন্ম হয়েছে অসংখ্য দর্শনবাদী কবিতার। নয়ন আহমেদের এরকম পৌরাণিক দর্শনবাদী একটি কবিতা হতে আমরা জানতে পারি,

‘একদা মৈনাক পাহাড়ে রেখে এসেছি উচ্চতা।

মাপকাঠি, পরিমাপ

দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের পরিচয়;

সমাহিত করে এসেছি এখানে-

চুল্লির নৈকট্যে;

গাহর্স্থ্য উত্তাপে।

ভেবেছিলাম, উচ্চতাকে কখনো ভালোবাসবো না।

উচ্চ হতে হতে একা হতে হয়।

বিচ্ছিন্ন হতে হতে নিঃস্ব হতে হয়।’ (উচ্চতা)

মিথ ও পুরাণের পাশাপাশি অবধারিতভাবেই নব্বইয়ের কবিদের কবিতাকে দখল করে নিয়েছে পরাবাস্তবতা। পরাবাস্তবতাহীন নব্বইয়ের কবিতা অকল্পনীয়। তারই একটি নমুনা আমরা তুলে ধরতে পারি কবি লীসা অতন্দ্রিলার কাব্যভা-ার হতে। কবি আমাদের মৃতদের ধূমপান বিষয়ে অবহিত করে জানাচ্ছেন,

‘যখন গাছের মতন হাওয়া বয় এবং পৃথিবীর রূপ হয় অনেকটা সমতল ঠিক তখনই ডানায় ভর দিয়ে আসা গাঙে মৃতেরা ধূমপান করে।’ ...(দূরত্ব, লীসা অতন্দ্রিলা)

মৃতদের ধূমপান হতে মৃতদের নিয়ে আধ্যাত্মিকতার অবতারণা করেছেন কবি কুমার চক্রবর্তী। তার লেখা কবিতা আমাদের জানায়,

‘সব কিছুই কাছাকাছি, মাটি আর মানুষের মতো―শুধু আলাদা হয়ে গেছে তাদের ভাষা

চাঁদ খুব নিচু দিয়ে হাঁটছিল রাংতা পায়ে

হাওয়া একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকে,

মাটির নৈকট্যে চলে আসি আমরা

বুঝতে চেষ্টা করি স্থিরতার কথাবার্তা

তারা কথা বলছে বিলম্বিত লয়ে

আরও যেন বলতে চাইছে, ‘বরফের শকটে চড়ে আমাদের বর্ণমালাহীন দেশে চলে আসো।’ (মৃতরা)

পরাবাস্তবতার পাশাপাশি নব্বইয়ের কবিদের কাব্যশিল্প চিত্রকল্পে সিদ্ধহস্ত। জীবনানন্দীয় দীক্ষার কারণেই চিত্রকল্পের সিদ্ধি একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবেই অবরোহন করেছে নব্বইয়ের কবিতায়। কবি শাকিল রিয়াজ এর নি¤েœর কবিতার উদাহরণ দিয়েই আমরা তা বুঝে নিতে পারি সহজে। ঘন তুষারপাতে ছন্দহীন পদরেখাকে কবিতার চিত্রকল্পরূপে ফুটিয়ে তুলে তিনি জিজ্ঞেস করেন,

‘অন্ধকারে বসে আছি

তুষারপাত থেকে কিছু আলো ছিনিয়ে নিয়ে

কে ছুঁড়ে মারল জানালায়?

কেউ নেই। কিছু পদচিহ্ন পড়ে আছে পথে।

আঁকাবাঁকা ছন্দহীন পদরেখা, টলোমলো অক্ষর যেন।

এই ঘন তুষারপাতে কে এমন কবিতা লিখে গেল পথে?’ (একটি শাদা প্রেম)

বাঙালি সমাজ মানসের মধ্যে নেতিবাচক প্রচারণার প্রবণতা অধিক। প্রতিবেশীর ইতিবাচকতাকে উপেক্ষা করে নেতিবাচক বিষয়কে উপজীব্য করে দিনযাপন বাঙালির শোণিত প্রবাহে মিশে গেছে একাত্ম হয়ে। বাঙালির এই নেতিবাচকতাপ্রীতি এড়িয়ে যায়নি নব্বইয়ের কবিদের সংবেদনকে। তাই সেই সংবেদনে সাড়া দিয়ে টোকন ঠাকুর ‘প্রচারক’ কবিতায় এরকম এক চরিত্রকে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন। তার আক্ষেপের আর্তনাদ আমরা শুনতে পাই, যখন তিনি বলেন,

‘বহুদিন প্রচার করেছি আর্তনাদ।

অসুখী ছিলাম;

কারখানা বানিয়েছিলাম।

একটা কমলালেবুর পাশে শুশ্রূষার কানাকানি স্থাপন করিনি।

বড় মূর্খ ছিলাম!

বহুদিন প্রচার করেছি হাহাকার।

অসুস্থ ছিলাম।

সন্দেহের দোকান খুলেছিলাম।

একটা সূর্যের পাশে ঘরবাড়ির নিত্য সম্পর্ক বিস্তৃত করিনি।

বড় অদক্ষ ছিলাম!’

বাঙালির নেতিবাচক চর্চার মধ্যে আরেকটি বড় উপাদান ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার চর্চা। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা বিনষ্ট করে আমাদের শেকড়ের আবহমানতাকে। সহজাত প্রতিবাদের প্রবৃত্তিতে নব্বইয়ের কবিরাও এগিয়ে এসেছেন সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী কবিতা নিয়ে। কবি মাহবুব কবিরের ‘ভারতবর্ষ’ কবিতাটিতে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হয়ে কবির স্বরে আমরাও স্বর মিলিয়ে বলি,

‘আর কত কাল ঘুরব এই মুসলমানের দেশে,

এই হিন্দুর দেশে।

নদীর সঙ্গে এসেছিলাম-

মায়ের সঙ্গে এসেছিলাম এখানে।

কোত্থেকে এসেছিলাম মনে নেই কিছু।

শুধু জানি, নদীতীরে মায়ের সঙ্গে থাকতাম।

শুধু জানি, কারা যেন একদিন নদীতে বাঁধ দিল–

আর ধীরে ধীরে মরে গেল নদী,

আমার মা মরে গেল।

আর কত কাল ঘুরব এই মুসলমানের দেশে,

এই হিন্দুর দেশে।

আমার কাঁধে মায়ের লাশ; নদীর লাশ।’

কবিতার মূলসুর যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঙালির আদর্শের সাথে সমাপতিত হয়।

সংবেদনশীল কবির মনে ও মননে ব্রাত্যজীবনের বেদনার আখ্যান সর্বদাই দাগ কেটে যায়। নব্বইয়ের মানবিক কবিদের মনেও এই সংবেদনশীলতা বাক্সময় হয়ে ওঠে। আর এ কারণেই আমরা পাই রূপোপজীবী নারীর ব্রাত্য জীবনের করুণ উপাখ্যান,

‘সে ফিরেছে চুক্তি-করা প্রেমিকের কাছ থেকে...

ও-মুদ্রা রহস্যে মেশে, কিছু দূর, মর্মাপ্লুত আইসক্রিম, আপেল

আর হাই হিলে

‘এই নাও’- রাত্রিজাগা স্বর ব্যর্থ ঢেউ তোলে নিদ্রিত দেহের

দশ দিকে, দরজায় উঠে যাচ্ছে জল, আপেলের সব লাল

অন্ধকারে ঝরে যেতে থাকে, গড়ায় শুশ্রূষাকামী তলপেটে

গলছে আইসক্রিম;

‘এসছিস?’- নিদ্রাজড় চোখে কাঁপে জননীর শূন্য জলাশয়;

এখুনি কান্নার মধ্যে ডুবে যাবে সমস্ত দরজা

তার আগে একবার মেয়েটিকে যেতে হবে টয়লেটে...’।(নিমজ্জন চিত্র, চঞ্চল আশরাফ)

বাঙালির সামাজিক শক্তির সার্থক গর্ভধারিণী হলো মধ্যবিত্ত সমাজ। সকল মূল্যবোধ, আন্দোলন-আলোড়ন ও প্রতিবাদে মধ্যবিত্ত সমাজই অগ্রণী ভূমিকা রাখে। নান্দনিকতার সূতিকাগার এই মধ্যবিত্ত সমাজের সৃষ্টিশীল টানাপোড়েন নব্বইয়ের কবিদেরও আলোড়িত করেছে। এই আলোড়নকে চমৎকারভাবে প্রকাশ করেছেন নব্বই দশকের কবি ভাগ্যধন বড়ুয়া তার ‘আঁচলের গিঁট’ কবিতায়। তার বদৌলতেই আমরা জেনে যাই বাঙালি মধ্যবিত্তের হাঁড়ির খবর,

‘চাল নেই বাজার নেই; মায়ের গলায় এই রেওয়াজ শুনতে শুনতে বড় হয়েছি অভাবের গৃহছায়ায়; মনে হতো আমার মা পৃথিবীর সেরা অভাবী আর আমার বাবা স্বীয় স্বভাবে এইসব কথা এক কান দিয়ে ঢুকায় আর অন্য কান দিয়ে বের করে। টানাটানির সংসারে কোন কিছুই বেশি ছিল না বলে যা খাবার পেতাম কম কম করে মিলেমিশে সবাই মজা করে খেতাম ধীরে ধীরে শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত; শুনেছি অভাবের টানে মমতা বাড়ে। কিন্ত এখন তা বিশ্বাস করি’।

মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ যেমন আছে তেমনি আছে নিজস্ব জীবনদর্শন। আর্থিক সামর্থ্যের চেয়ে মধ্যবিত্তের জীবনদর্শনের শক্তি অধিক। বিত্ত নয় চিত্তই তাদের অনন্ত শক্তির উৎস। নব্বইয়ের কবির সৃষ্টিতে চিত্তবান মধ্যবিত্তের জীবনদর্শনকে তুলে আনতে আমরা দেখি নি¤েœর কবিতায়,

‘সমন্বয়ের পিঁপড়েগুলো ঘাড় গুঁজে

অহোরাত্র এভাবে দাঁড়ায়

খাদে পড়া সিংহের মতন জলের তা-ব

হুইলচেয়ারে কবি, স্ত্রী এখন মৃত

ঝড়ে পড়া বটের শাখায়

বানর কুড়ায় ফল সেখান থেকে

বাজতে থাকে সানাই অবিরল

বাজলে বাজুক মৃতের গুহায়

তবুও সাতশ’ চিল

হুইলচেয়ারে কবি, স্ত্রী এখন মৃত’। (দ্বিতীয় কবিতা, হাসান আল আব্দুল্লাহ্)

নব্বই দশকের কবিদের অন্যতম এক শনাক্তযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো কবিতায় বিজ্ঞানমনষ্কতা। যে সময়ে নব্বইয়ের কবিরা প্রপঞ্চ মাতিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, সে সময়ে চলৎশক্তিহীন জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস তাঁর 'অ্যা ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম' লিখে তোলপাড় ফেলে দিয়েছেন সৃষ্টিশীল জগতে। সেই তোলপাড়ের ঢেউ নব্বইয়ের কবিদের শিল্পতটেও এসে দোলা দিয়ে গেছে। ফলে কবিরাও বিজ্ঞান চেতনাকে ধারণ করে কবিতায় লিখেছেন,

‘সে আমার প্রভু, সে আমার ক্রীতদাস

আধখানা ঘৃণা, আধখানা অধিবাস-

তবুও প্রণয়, তবুও গ্রহের বঞ্চনা-

সিন্দারেলার পালক জুতো,

সে-ও হয়েছিল ভারি-

উড়ো না ও মেয়ে,

উড়ো নাকো তুমি বলশয় ব্যালেরিনা-

মাটির মানবী মাটিতেই থাকো দৃঢ়-

আকাশ গঙ্গার সন্ধান না করে!’ (অভিকর্ষের মেদ, অদিতি ফাল্গুনী)

শিল্পী মাত্রেই অগ্রজের প্রতি, গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাবনত। শিল্পের শিক্ষাই হলো গুরুমুখী। যদিও কবিতা কেউ কাউকে লিখতে শেখাতে পারেন না, কবিতা হলো ঈশ্বরদত্ত অনন্য বর, তবুও অগ্রজ কেউ না কেউ অনুজের মনে রেখাপাত করে। সেই প্রভাবই অনুজকে অগ্রজের প্রতি শ্রদ্ধাবনত করে তোলে। নব্বই দশকের কবি ওমর বিশ্বাসও শিল্প দিয়েই অঞ্জলি নিবেদন করেন প্রভাবশালী অগ্রজ কবির প্রতি,

‘সব কিছু পিছু ফেলে যে ভূমে দাঁড়ানো যায়, তুমি

ছুঁয়ে গেছো তার চেয়ে বেশি আকাশের আবিরতা

তুমি ছুঁয়ে গেছো আরো শিকড়ের গভীর গাঢ়তা

অনুভবে উচ্চকিত করেছ আপন দেশভূমি।’

(কবিতা-কাজী নজরুল ইসলাম)

সমকালীনতার প্রতি সংবেদনশীলতা ব্যতিরেকে কবি নাম নিরর্থক। কবি মাত্রেই সমকালীন বিষয়ে সংবেদনশীল। নব্বইয়ের শিল্পস্রষ্টারাও এর ব্যতিক্রম নন। নব্বইয়ের কবিরাও সমকালীনতায় সহমর্মী হয়ে কলম ধরেছেন, শিল্প সৃষ্টি করেছেন। সন্ধ্যা নদীতে যখন 'অভিযান' নামক লঞ্চের অগ্নিদহনে মানুষের অমূল্যপ্রাণ জীবন্ত কয়লা হয়ে যায়, তখন কবিরা আর স্থির থাকতে পারেন না। তারাও কলম হাতে নিয়ে একাত্মতা ঘোষণা করে বলেন,

‘অতল নদীর বুক চিরে চলছে অগ্নিযান

শিশুর চিৎকার, মায়ের আর্তনাদ, বাবার বুকের হাহাকার

মিশে গেছে আগুনের পট পট শব্দে

মানুষের পোড়া গন্ধ ছড়িয়েছে বাতাসে

ছুটে গেছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে

সুগন্ধা নদীতে মানুষের চিৎকারে চারিদিকে বেজে ওঠে নিনাদের সুর’। (আগুনের চলন্ত দ্বীপ, মনসুর আজিজ)

নব্বই দশকের কবিদের মধ্যে যেমন শেকড় সন্ধানী প্রয়াস ছিল, তেমনি আছে আত্ম-জিজ্ঞাসার স্বাতন্ত্র্যবোধ। আত্ম-জিজ্ঞাসা যেমন আত্ম-বিনির্মাণের এক বিনিন্দিত পথ, তেমনি আত্মশুদ্ধিরও এক নান্দনিক প্রক্রিয়া। নব্বইয়ের কবি টোকন ঠাকুর আত্ম-জিজ্ঞাসা নিয়ে পাঠকের দরবারে হাজির হয়ে বলতে শুরু করেন,

‘নিষ্প্রয়োজনে আমি ছোট নাম লেখাতে গেছি কবির খাতায়

নিজ প্রয়োজনে আমি নক্ষত্রের দেনা নিয়েছি মাথায়

বিষ-প্রয়োজনে আমি সাপ ও বেদেনি চেয়েছি দুটোই দুহাতে দুধের ছানা, বেপরোয়া মুঠোয় মুঠোয় সম্পূর্ণ ফুটেও নারী ক্ল্যাসিক্যালি অস্ফুট- সুতরাং, আজ আমাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো-

আমি কি কবি ছিলাম? সাপুড়ে ছিলাম?’ (আত্মচরিত)।

নব্বইয়ের দশক বাংলা কবিতার সা¤্রাজ্যে আপন বিভায় বিভান্বিত। এ দশকের কবিরা জীবনানন্দীয় ধ্রুপদের বলয়ভুক্ত হয়েও নির্মাণ করে নিয়েছেন স্বতন্ত্র কাব্যভাষা, নিজস্ব চিন্তার অনন্য গতিপথ। তারা শিল্পের গুণে যেমন নিজ জন্মজনপদকে খ্যাতিমান করে তুলেছেন (পৃষ্ঠাজুড়ে সুলতানপুর দ্রষ্টব্য), তেমনি 'নদীর নিজস্ব ঘ্রাণ' অনুসন্ধান করে শেকড়াশ্রয়ী হয়েছেন। এ দশকের কবিরা ধ্রুপদী ছন্দকে যেমন আত্মস্থ করেছেন, তেমনি উত্তরাধুনিক মুক্তক গদ্যছন্দকেও বিজয়ী করে তুলেছেন। ভাষাকে তারা যেমন কবিতার কাছে রেখেছেন, তেমনি কবিতাকেও নিয়ে গেছেন ভাষার সরোবরে। তারা পরাবাস্তবতাকে যেমন জায়গা দিয়েছেন, সোঁদা মাটির সারল্যকেও আলিঙ্গন করেছেন। সবকিছু মিলিয়ে, বাংলা কবিতার উত্তরাধুনিক পথ-পরিক্রমায় নব্বই দশকের কবিদের কদম-কুসুম সুরভিত হয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছে কালান্তরের পাঠকের অন্তরে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়