প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২২, ০০:০০
কেবল চাঁদপুরের নয়, ভারত উপমহাদেশের অন্যতম কীর্তিমান মানুষ শান্তিদেব ঘোষ। তিনি একাধারে প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশারদ, লেখক, কণ্ঠশিল্পী, নৃত্যশিল্পী ও অভিনেতা। আজীবন তিনি শিল্পচর্চার সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর অপরিসীম অবদানের কথা বিবেচনা করে ভারত সরকার তাঁকে ‘জাতীয় প-িত’-এর সম্মানে ভূষিত করে। তিনি পদ্মভূষণ সম্মাননাও লাভ করেন। অন্যদিকে রবীন্দ্র চর্চা কেন্দ্র শান্তিদেব ঘোষকে ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধি প্রদান করে।
শান্তিদেব ঘোষ ১৯১০ সালের ৭ মে চাঁদপুর জেলার বাজাপ্তি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় তাঁদের পরিবারের দীর্ঘ ঐতিহ্য ছিল। শান্তিদেবের ঠাকুরদার কবিগানের দল ছিল। অন্যদিকে তাঁর বাবা কালীমোহন ঘোষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দীর্ঘদিনের সহকর্মী। মা মনোরমা দেবী। শান্তিদেবের ছোটভাই সাগরময় ঘোষ বিখ্যাত দেশ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। শান্তিদেবের জন্মের মাস ছয়েক পরে সপরিবারে কালীমোহন ঘোষ শান্তিনিকেতনে আসেন। এখানে শান্তিদেব একবছর ছিলেন। তিনি দ্বিতীয়বার শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন ১৯১৩ সালে। এখানেই তাঁর শৈশবের পড়াশোনা শুরু হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ, গান, আবৃত্তি, অভিনয়ের চর্চা করতেন নিয়মিত। এভাবেই শান্তিনিকেতনের উদার পরিবেশে শিল্পচর্চার মধ্য বেড়ে ওঠলেন শান্তিদেব।
শান্তিদেব ঘোষ নামটির পেছনে একটি গল্প রয়েছে। শান্তিনিকেতনের সাথে মিল রেখে কালীমোহন সন্তানের নাম রেখেছিলেন শান্তিময়। তিরিশের দশকে নৃত্য-গীত-আবৃত্তির একটি অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাম রাখেন শান্তিদেব। সেই থেকে শান্তিময় হয়ে যান ‘শান্তিদেব’। শেষ পর্যন্ত তিনি এ নামেই পরিচিতি লাভ করেন।
শৈশব থেকেই গান ভালোবাসতেন শান্তিদেব। মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি শান্তিনিকেতনের গানের দলে জায়গা করে নেন। কৈশোরে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে গান শিখেছিলেন। সে কথা তিনি তাঁর বিভিন্ন স্মৃতিচারণেও বলেছেন। শান্তিদেব বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ নিজেও আমাকে শিখিয়েছেন। গান ভুল হলে তিনি তা শুধরে দিতেন। তিনিই আমাকে পথ দেখিয়েছেন। মনে পড়ে, ১৯৩০ সাল নাগাদ আমি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রথম একলা বসে গান শিখবার সুযোগ পেয়েছিলাম। ১৯৩৫ সাল থেকে, গুরুদেব অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হবার আগে পর্যন্ত একটানাভাবে তাঁর কাছে গান শিখেছি। এ তো আমার জীবনের পরমপ্রাপ্তি।’
শান্তিদেব পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি করার দায়িত্ব পান। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রস্থান ও রমা করের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ নতুন গানের কপি তুলে দিতেন শান্তিদেবের হাতে। তিনি গানগুলির স্বরলিপি করে দিতেন। শান্তিদেব ঘোষ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সঙ্গীতের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ১৯৩০ সালে বিশ^ভারতীর সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৩৯ সালে তিনি সঙ্গীতভবনের পরিচালক ও ১৯৪৫ সালে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪ সালে শান্তিদেব ঘোষ রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নৃত্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপকের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে অবসরগ্রহণের পূর্বে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে তিনি বিশ^ভারতীর সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁর অনেক শিক্ষার্থী পরবর্তীতে দেশবরেণ্য শিল্পী হয়েছেন। প্রখ্যাত শিল্পী সুচিত্রা মিত্র, প্রতিমা মল্লিক, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, পাপিয়া সারোয়ার, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, আবদুল আহাদ শান্তিদেবের কাছে গান শিখেছিলেন।
শান্তিদেব মাত্র ৯ বছর বয়সে প্রথম মঞ্চনাটকে অভিনয় করেন। ১৯১৯ সালে তিনি ‘শারদোৎসব’ নাটকে কাজ করেন। ১৯২৩ সালে ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যে তিনি রবীন্দ্রনাথের সাথে নাচে যোগ দেন। শান্তিদেব ঘোষ পরবর্তীতে অরূপরতন, ডাকঘর, তাসের দেশ, শাপমোচন, বাল্মিকী প্রতিভা, চিত্রাঙ্গদা, চ-ালিকা, শ্যামা নাটকে অভিনয় করেন। সঙ্গীত ও অভিনয়ের পাশাপাশি নৃত্যচর্চার প্রতি আগ্রহ ছিল শান্তিদেবের। তিনি মণিপুরী, শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডি, গুজরাটের গরবা, ডান্ডিয়া রাসনৃত্য, মায়ানমারের রামপোয়ে, জাভা ও বালি দ্বীপের নাচ জানতেন। রবীন্দ্রনাথের গানের সাথে তিনি অনেক নৃত্য রচনা করেন।
শান্তিদেব ঘোষ তাঁর অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, গবেষণা নিয়ে দু হাতে লিখে গেছেন। সেজন্যে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা কম নয়। তাঁর শিল্পচর্চার মতো সাহিত্যচর্চার প্রধান অনুষঙ্গ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর লেখা গ্রন্থের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত, ভারতীয় গ্রামীণ সংস্কৃতি, জাভা ও বালির নৃত্যগীত, রূপকার নন্দলাল, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শে সঙ্গীত ও নৃত্য, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য, রবীন্দ্রসঙ্গীত বিচিত্রা, স্মৃতি ও সঞ্চয়, নৃত্য ও অভিনয়ের স্থান, নৃত্যকলা ও রবীন্দ্রনাথ, জীবনের ধ্রুবতারা উল্লেখযোগ্য। ভারতের প্রবন্ধ সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্যে শান্তিদেব আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন।
বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় শান্তিদেব ১৯৯৯ সালে ভর্তি হন কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে। সেখানেই তিনি ১ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। শান্তিদেব ঘোষের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান তাঁর বেড়ে ওঠার স্থান শান্তিনিকেতনে করা হয়।
রবীন্দ্রনাথের চিঠি : শান্তিদেব ঘোষকে
কল্যাণীয়েষু শান্তি,
কেবল দুটি উপদেশ আমার আছে। এই আশ্রমেই তুই মানুষ। সিনেমা প্রভৃতির সংস্পর্শে কোনও গুরুতর লোভেও নিজেকে যদি অশুচি করিস তাহলে আমার প্রতি ও আশ্রমের প্রতি অসম্মানের কলঙ্ক দেওয়া হবে।
দ্বিতীয়, আমার গানের সঞ্চয় তোর কাছে আছে-বিশুদ্ধভাবে সে গানের প্রচার করা তোর কর্তব্য হবে। আমি তোর পিতার পিতৃতুল্য। আশা করি আমার উপদেশ মনে রাখবি। ইতি-
শুভার্থী
রবীন্দ্রনাথ
২১/১/৪১
চিঠি প্রসঙ্গে শান্তিদেব ঘোষ
গুরুদেবের মৃত্যুর মাস আষ্টেক পূর্বে, অর্থলোভে আমি শান্তিনিকেতন ত্যাগ করব, আমি সিনেমায় যোগ দেব, এইরূপ এক মিথ্যা অভিযোগ গুরুদেবের কাছে এমনভাবে পেশ করা হয়েছিল যে, গুরুদেব তা বিশ^াস করে এবারে আমাকে আর ডেকে পাঠালেন না। তখন তিনি খুবই অসুস্থ। কিন্তু কাউকে না জানিয়ে নিজের অসুস্থ হাতেই চিঠি লিখে, তাঁর দ্বিতীয় ভৃত্যকে দিয়ে আমার কাছে তা পাঠিয়ে দিলেন। আমি বাড়িতে দুপুরের ¯œান-আহার করে, সংবাদপত্র পড়ছিলাম। ভৃত্যটি চিঠিখানি আমার হাতে ধরিয়ে দেবার সময় বলেছিল, ‘বাবামশায় এটি পাঠিয়েছেন’। আমি চিঠি পড়ে স্তম্ভিত। তাঁর হাতের লেখা দেখে বুঝতে পারলাম, বেশ কষ্ট করেই চিঠিটি তাঁকে লিখতে হয়েছিল।
গুরুদেবের হস্তলিখিত চিঠিপত্রগুলি তখনকার দিনের একটি অফিসের খাতায় নিয়মিত নকল রেখে, তারপরে যথাস্থানে পাঠানো হত। আমাকে লেখা এই চিঠির ক্ষেত্রে তিনি তা করতে না দিয়ে, কাউকে না জানিয়ে সরাসরি আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কেন জানি না, তখন আমার মনে হয়েছিল, নিশ্চয়ই এই চিঠির কথা অন্য কেউ না জানুক, হয়তো তিনি তা চাননি। পরে বুঝেছিলাম, আমার অনুমান সত্য। এই চিঠির কথা তখন আর কেউ জানতেন না। আমি কাউকে জানাব না বলেই স্থির করেছিলাম।
সেদিন গুরুদেবের ওই চিঠি পাঠ করে আমি উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে চলে গিয়েছিলাম গুরুদেবের কাছে। তিনি তখন উদয়ন বাড়ির নীচের তলায় দক্ষিণ অংশের বারান্দায় একটি বড় আরাম কেদারায় একাকী বসেছিলেন। আমি চিঠিটি দেখিয়ে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলতে লাগলাম, আমাকে এভাবে কেন আপনি অবিশ^াস করলেন? স্বপ্নেও কখনও আপনাকে এবং শান্তিনিকেতন ত্যাগ করবার কথা আমার মনে জাগেনি। আপনার আশ্রয়েই আমি মানুষ। নিষ্ঠার সঙ্গে আপনার কাজ আমি করবার সুযোগ পেয়েছি বলে আমার মনে কোনও অসন্তোষ স্থান পায়নি। আমি খুবই আনন্দের সঙ্গে আমার কর্মজীবন কাটাচ্ছি। আমার তখনকার চোখের জল ও কণ্ঠস্বর শুনে গুরুদেব আমাকে শান্ত হতে বলে, নিকটেই একটি মোড়া ছিল, তাতে বসতে বললেন। চোখ মুখ মুছে আমি মুখোমুখি বসেছিলাম। তখন তিনি যে কথাগুলো আমাকে বলেছিলেন, তাকে আমি পরে মন্ত্রের মতো আমার জীবনে গ্রহণ করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, আমি যদি সৎপথে থেকে আমার কর্মজীবন চালিয়ে যাই, তাহলে কোনও অশুভ শক্তি আমার কোনও প্রকার ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু সেদিন তিনি কথাও বলেছিলেন, তাঁর অবর্তমানে বেশ কিছু ঝড়-ঝাপটার মুখে আমাকে পড়তে হবে। তখন ভয় না পেয়ে মাথা উঁচু করে আমি যেন চলি। ভয়ে ভেঙে পড়লেই আমাকে অন্যায়ের কাছে হার মানতে হবে। তাঁর এই উপদেশে সাহস পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার মন বলেছিল, আমার মতো সামান্য যুবকের পক্ষে এইভাবে একলা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো কি সম্ভব হবে! আমার মন বেশ খানিকটা শান্ত হবার পর আমি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর পায়ে হাত রেখে বলেছিলাম, বিশ^ভারতী আমাকে যদি জোর করে তাড়িয়ে না দেয়, তা হলে কোনও প্রলোভনে আমি শান্তিনিকেতন কখনওই ত্যাগ করব না। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে আমাকে সেদিন আশীর্বাদ করেছিলেন।
তথ্যসূত্র :
১. শান্তিদেব ঘোষ, জীবনের ধ্রুবতারা, কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স, ষষ্ঠ মুদ্রণ ২০১৬
২. স্বপনকুমার ঘোষ, শতবর্ষ পেরনো রবীন্দ্রব্রতী শান্তিদেব ঘোষ, ঢাকা : গণশক্তি, ৪ জুন ২০১১
৩. পাপিয়া মিত্র, শান্তিনিকেতনের শান্তিদেব, কলকাতা : আনন্দবাজার, প্রকাশ : ২১ মে ২০১৩