বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২৩ মে ২০২৩, ০০:০০

প্রাচীন ভারতীয় গণিত শাস্ত্র
অনলাইন ডেস্ক

অপরিমিত ধীশক্তিসম্পন্ন প্রাচীন আর্য পণ্ডিতগণের প্রণীত সংখ্যাতত্ত্ব ভারতবর্ষ থেকে বাগদাদ হয়ে পশ্চিমা বিশ্বে প্রবেশ করে। ভারতীয় শূন্যসহ দশটি গণনার প্রতীক বা অংক বিভিন্ন ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন প্রতীকে রূপান্তরিত হয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। পরবর্তীকালে রোমান প্রতীকগুলোও মূল প্রতীকের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত আছে। শূন্যসহ ভারতের দেয়া এই দশটি অংকের উদ্ভাবন চাতুর্য যে কোনো সংখ্যা পাওয়ার পথ সুগম করে দিয়েছে। অংকগুলো হলো ১, ২, ৩, ৪, ৫,৬, ৭, ৮, ৯ এবং ০ (শূন্য)। প্রত্যেকটি অংকের একটা বিশেষ স্থানীয় মান রয়েছে।

প্রাচীন গ্রীক গণিতবিদ এবং বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস আর অ্যাপোলোনিয়াস-এর মতে, ভারতের এই দশটি পাটিগণিতীয় অংকের আশ্চর্যজনক আবিষ্কার বিজ্ঞানের উন্নয়নের আদিযুগকে আলোয় উদ্ভাসিত করে দিয়েছে। বিশেষ করে গণিত শাস্ত্রের ক্রমোন্নতিতে শূন্যের প্রয়োজনীয়তা কোনো কালেই অতিকথন হবে না। কারণ পৃথিবীর যে কোনো সংখ্যাই এই দশটি অংকের দ্বারা সৃষ্টি হয়ে থাকে। অথচ খ্রিস্টপূর্ব দুইশত অব্দে ‘কিছুই নয়’ এমন ধারণার প্রতীক ছিলো শূন্য। কিন্তু প্রচলিত সংখ্যাতত্ত্বে এর ব্যবহার বৈজ্ঞানিক তথ্যকে প্রভূত সমৃদ্ধ করে দিয়েছে।

গণিত শাস্ত্রের অবিচ্ছেদ্য শাখাগুলো হলো : সংখ্যাতত্ত্ব-পাটিগণিত-এলজাবরা-জ্যামিতি-ক্যালকুলাস ইত্যাদি। প্রাচীন আর্য ঋষিগণ তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে এবং বিভিন্ন যাগ্-যজ্ঞাদির অনুষ্ঠানে বিভিন্ন আকৃতির চিত্র ব্যবহার করতো। সেই চিত্রগুলো ছিল ত্রিভূজাকৃতি-চতুর্ভূজাকৃতি-গোলাকৃতি ইত্যাদি। এগুলো থেকেই কিন্তু জ্যামিতি শাস্ত্রের ভ্রুণ উপ্ত হয়। পরবর্তী কালে গ্রীস এবং আলেকজেন্দ্রিয়াতে পীথাগোরাস-টলেমি-আর্কিমিডিস এবং ইউক্লিড প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত গণিতবিদদের প্রতিষ্ঠিত স্বতঃসিদ্ধ তত্ত্বগুলো জ্যামিতিক এলজাবরার বীজ বপন করে। যেটি পরবর্তীকালে আলেকজেন্দ্রিয়া হয়ে ভারতে প্রবেশ করে। সেখানকার মোহাম্মদ ইবনে মুসা আল খারেজমি আলজাবেরের নামানুসারে ভারতে এসে গণিত শাস্ত্রের একটি অতি মূল্যবান শাখা 'এলজাবরা' সৃষ্টি হয়।

শূন্যের প্রয়োগ বিধি এবং অংকগুলোর স্থানীয় মান নির্ণয় পদ্ধতির আবিষ্কার আর বর্ণমালার অজ্ঞাত মানের বর্ণ গুলোর এলজাবরায় ব্যবহারের সাথে সাথে ভারতে গণিত শাস্ত্রের অভূতপূর্ব উন্নয়নের দিকে মোড় ঘুরে যায়। সমসাময়িক কালেই অংকগুলোর পরস্পরের সাথে যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ চিহ্নসহ যথাক্রমে (+ -) প্রচলিত হয় যায়। যেমন : ী-ী=০/ী+০=ী/ী-০=ী/ী০=০ এবং ীস্ট০= অসীম। ভাগের মূলে বেরিয়ে আসে ভগ্নাশের ধারণা এবং অজ্ঞাত রাশির সহগ ও সূচকের কার্যক্রম। এবং কোন রাশির ভগ্নাংশ জাতীয় সূচক তথা বর্গমূল এবং ঘনমূলের চিহ্ন আর কার্যক্রম। অর্থাৎ অজ্ঞাত বা জ্ঞাত রাশির সূচক যথাক্রমে এবং ইত্যাদির স্পষ্ট ধারণা ভারত থেকেই সূচিত হয়েছিল।

৪৯৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতের আর্যভট্ট এলজাবরার ওপর একখানা যুগান্তকারী বই প্রকাশ করেন বলে তাঁর অনুসারী এবং পূর্বসূরিরা তাকে এলজাবরার জনক হিসেবে জানতো। কিন্ত পরে এ ধারণা পাল্টে যায়। এতদ্ব্যতীত পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত যে সমস্ত স্বনামধন্য গণিতবিদ জ্যামিতিক গণিতের অগ্রগতির ওপর আলোকপাত করেছেন তাঁরা হলেন অ্যাপাস্টামবা এবং কাত্যায়নী। ৫২২ খ্রিস্টাব্দে ভাষ্কর (১) নামে একজন গণিতবিদ জ্যামিতি এবং এলজাবরার বিভিন্ন দিক নিয়ে একখানা অতিজনপ্রিয় বই লেখেন, তারপর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মগুপ্ত নামে অপর একজন গণিতবিদ এলজাবরা এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রের ওপর যুগান্তকারী পথ নির্দেশনা মূলত বই লিখে প্রভূত যশস্বী হয়েছিলেন। তিনি শূন্য নামক অংকটিরও আবিষ্কারক ছিলেন। আবার ১১১৪ খ্রিস্টাব্দে ভাস্কর (২) নামক একজন পণ্ডিত ব্যক্তি এলজাবরা এবং পাটিগণিতের ওপর আলোড়ন সৃষ্টিকারী একখানা বইরচনা করেছিলেন। বই খানার নামকরণ করেছিলেন তাঁরই একমাত্র কন্যা লীলাবতীর নামে। যেটি শুধু সংস্কৃত স্কুলের জন্যেই প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু এর অপরিহার্যতা গণিত শাস্ত্রের জন্য স্বকপোলকল্পিত ছিল না।

অষ্টম শতাব্দীতে বাগদাদের খলিফা আল-মনসুরের শাসনামলে (৭৫৩-৭৭৪) কতেক ভারতীয় পণ্ডিত ব্যক্তি গণিতশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে ভারতীয়দের লেখা কিছু উল্লেখযোগ্য বইয়ের আরবী ভাষায় অনুবাদ করা কপি নিয়ে সদাশয় খলিফা সকাশে উপস্থিত হয়ে বইয়ের মর্মার্থ যথাযথ ব্যক্ত করার পর তিনি বিমোহিত হয়ে যান। সেই যুগে মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল মধ্য এশিয়া থেকে সুদূর স্পেন পর্যন্ত এবং বাগদাদ ছিল জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র। ইসলামী জগতের সদাশয় খলিফা আল-মনসুরের সক্রিয় সহযোগিতায় গণিত শাস্ত্রের বিভিন্ন শাখা পশ্চিমা দেশগুলোতে আন্তরিকভাবে সমাদৃত হয়।

গণিত সম্পর্কে ভারতীয় বাস্তব চিন্তার প্রতিফলন ঘটে, যা পরবর্তী সময়ে ইউরোপিয়ান গণিতের মূল ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। বিশেষ করে ভারতীয় গাণিতিক মতবাদে যে দশটি অংকই সকল সংখ্যার মৌলিক ভিত্তি, এখানে ব্রিটেনের কিছুটা সংশয় ছিল। যা পরে ১৪৯০ সালে ব্রিটেনে নির্দ্বিধায় স্বীকৃতি পেয়ে যায়। অতঃপর স্পেনের মুরিশ ইউনিভার্সিটি মারফতে ভারতীয় গাণিতিক দর্শনাগুলো একছত্র মৌলিকত্ব পেয়ে যায়। যেটি আধুনিক যুগের গণিতের জন্য অনতিক্রম্য।

সূত্র : জওহর লাল নেহেরুর লেখা The Discovery of India.

প্রাচীন ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত বঙ্গদেশ বর্তমানের স্বাধীন পতাকা সমন্বিত বাংলাদেশ। প্রাচীন বাংলাদেশে পরিমাপের ৩টি একক ছিল : দৈর্ঘ্যের পরিমাপ এবং ওজন পরিমাপ আর ছিল সময়ের পরিমাপ। দৈর্ঘ্য পরিমাপের একক ছিলো : ইঞ্চি-ফুট-গজ-মাইল-ক্রোশ। এগুলোর পারস্পারিক সম্পর্ক হলো : ১২ইঞ্চি=১ ফুট/ ৩ ফুট= ১ গজ/ ১৭৬০ গজ= ১ মাইল/২.২৭ মাইল=১ ক্রোশ/ মেট্রিক পদ্ধতিতে ১ ইঞ্চি= ২.৫৪ সেন্টিমিটার। চলমান দৈর্ঘ্য পরিমাপের একক হলো : মিলিমিটার-সেন্টিমিটার-ডেসিমিটার-মিটার-কিলোমিটার। এখানে ছোটটির পরেরটি দশগুণ বেশি। সংক্ষেপে (সস-পস-ফস-স-শস)। ওজন পরিমাপের আদি একক ছিল : তোলা- ছটাক-সের-মণ (৫ তোলা=১ ছটাক/ ১৬ ছটাক=১ সের/ ৪০ সের=১ মণ)। চলমান আধুনিক একক হলো : সমণ্ডমস-শমণ্ডমেট্রিক টন ইত্যাদি। ভূমি পরিমাপের একক হলো : ৪৮৪০ বর্গগজ= ১ একর=১০০ শতাংশ। ৪৩৫.৬ বর্গফুট = ১ শতাংশ। আদি পরিমাপ ছিল : কড়া-গন্ডা-কানী। সম্পর্ক ছিল ৪ কড়া= ১ গন্ডা=৬শতাংশ/২০ গন্ডা=১ কানী=১২০ শতাংশ। প্রাচীন ভূমি পরিমাপ ছিল : ১৬ ছটাক= ১ কাঠা/ ২০ কাঠা=১ বিঘা = ৩৩ শতাংশ সময়ের পরিমাপ ছিল এবং আছে : ৬০ সেকেন্ড=১ মিনিট/ ৬০ মিনিট= ১ ঘন্টা/ ২৪ ঘন্টা=১ দিন/ ৩০ দিন= ১মাস/ ১২ মাস= ১ বছর/ ১২ বছর= ১ যুগ। এখানে স্পষ্টত যে, প্রাচীন যুগের গণিত এবং পরিমাপের সাথে ডিজিটাল যুগের একটি সুনির্মল অভিপ্রেত মিল তথা সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু অমিল হলো : প্রাচীন কালে মানুষ ছিল তৃপ্তজীব এবং জ্ঞান পিপাসু আর ডিজিটাল যুগের মানুষ অতৃপ্ত জীব এবং জ্ঞানার্জনে নিস্পৃহ।

বিমল কান্তি দাশ : কবি ও প্রবন্ধকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, বলাখাল, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়